মঙ্গলবার এনবিআর ভেঙে দেয়ার প্রতিবাদে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে -সংবাদ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে দুইভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। গতকাল সোমবার গভীর রাতে এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। সংস্থাটি ভেঙে ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে এনবিআরের কর্মকর্তারা এর একমত ছিল না। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা সরকারের ‘সাহসী পদক্ষেপ’। এটা দেশের জন্য ‘ভালো হবে’।
তবে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে সংস্থাটির কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘এনবিআর ঐক্য পরিষদ’। আজ থেকে তিন দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে তারা। মঙ্গলবার, (১৩ মে ২০২৫) অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি এনবিআরকে দুইভাগ করা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলন করে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের মতামত উপেক্ষা করেই বহুল আলোচিত ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সোমবার রাতে জারি করা অধ্যাদেশে শুধু রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। রাজস্ব সংগ্রহের মূল কাজ করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধি কতটুকু?
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ নামে নতুন যে বিভাগ গঠিত হবে, সেটির কাজ হবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব জোগানে সম্প্রসারণমূলক কর ভিত্তি, যৌক্তিক করহার, সীমিত কর অব্যাহতি নীতি অনুসরণ করে উত্তম কর ব্যবস্থা তৈরি করা। এ ছাড়া স্ট্যাম্প আইনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন নতুনভাবে প্রণয়ন বা সংশোধন করা, স্ট্যাম্প ডিউটি, আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, সারচার্জ ও অন্যান্য শুল্ক-কর, ফি আরোপ, হ্রাস-বৃদ্ধি ও অব্যাহতি প্রদান-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে এই বিভাগ। পাশাপাশি কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতির মূল্যায়ন, কাস্টমস-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন ও মতামত প্রদান, আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি-সংক্রান্ত কার্যক্রম, রাজস্ব-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ ও গবেষণার মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের যথাযথ প্রক্ষেপণ ও প্রাক্কলন করা, রাজস্ব নীতি-সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান, প্রজ্ঞাপন, এসআরও প্রণয়ন, সংশোধন ও ব্যাখ্যা প্রদান করবে এই বিভাগ।
এই বিভাগের জনবল সম্পর্কে বলা হয়েছে, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস, অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞদের দিয়ে বিভাগটির বিভিন্ন পদ পূরণ করা হবে। আর সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে বলে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে।
এ বিভাগকে নিয়মিত পরামর্শ দেয়ার জন্য অর্থনীতিবিদ, রাজস্ববিশেষজ্ঞ, আইনবিশেষজ্ঞ, হিসাব ও নিরীক্ষাবিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী সংগঠন, পেশাজীবী প্রতিনিধি, ট্যারিফ কমিশনমসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিত্বে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে অধ্যাদেশে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতা কতটুকু, কী কাজ করবে?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুন এ বিভাগ গঠিত হবে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এ বিভাগের কাজের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ, কাস্টমস-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহারসংক্রান্ত চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন, কর ভিত্তি সম্প্রসারণে করসেবা, উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি জোরদার করা এবং সবাইকে করজালের মধ্যে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত পদ্ধতি প্রণয়ন, রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রাজস্ব নীতি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন, দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলা এবং নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর এনবিআরের বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে। তবে এসব জনবল হতে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগেও পদায়ন করা যাবে।
সাধুবাদ জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা
এনবিআর দুইভাগে বিভক্ত হওয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। মঙ্গলবার কথা হয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘এটা দেশের জন্য ইতিবাচক। আমি যখন বিশ্বব্যাংকে জয়েন করি ২৫ বছর আগে তখন থেকে এটা নিয়ে আলোচনা চলছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটা করা হচ্ছিল না। দেরিতে হলেও সরকার সেটা করতে পেরেছে এটার জন্য সাধুবাদ জানাই।’
গবেষণা সংস্থা সানেনের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানও একে সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দুটি নতুন বিভাগÑ রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এই সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবেÑ এমন সম্ভাবনা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম আলাদা করার সিদ্ধান্ত ভালো পদক্ষেপ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত উত্তম রীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। একটি বিভাগ নীতি প্রণয়ন ও আইন তৈরির কাজে যুক্ত থাকবে, অন্যটি আদায় ও বাস্তবায়নের কাজ করবে- এভাবে দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতিশীলতা বাড়ানো সম্ভব।’
তবে তা বাস্তবায়ন যেন সঠিকভাবে হয় সেটার ওপর গুরুত্বারোপ করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘দুইটা ভাগ হলো। এখন কোন বিভাগে কোন ক্রাইটেরিয়ায় জনবল নিয়োগ হবে সেটা দেখার বিষয়। বাংলাদেশে যেটা হয়, নিজের মামা-খালু, ভাগিনা-ভাতিজা এসব জনবল দিয়ে জায়গাগুলো ভরে ফেলে। সেটা যদি হয় তাহলে দুইভাগ করে কোনো লাভ হবে না। যারা যে বিভাগের জন্য যোগ্য তাদের যেন সে বিভাগে বসানো হয়। তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে।’
এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করলো সরকার
মঙ্গলবার এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বিবৃতি দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। এর মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, ‘এনবিআর বিলুপ্ত হয়ে দুটি বিভাগ গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। সব দেশেই এমন আলাদা বিভাগ থাকে। এনবিআরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেই করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে এর প্রভাব পড়বে না। কেউ চাকরিও হারাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় গতবারের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি হয়েছে। খুব হতাশাব্যাঞ্জক নয়, আমরা আরও প্রত্যাশা করছি। অন্তত গতবারের তুলনায় কম হবে না। বিশ্বের সব দেশেই রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাদের পেশাদার হতে হবে অর্থাৎ দেশের জিডিপি, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান এসব বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তারা আবার রাজস্ব সংগ্রহও করবেন, তা হতে পারে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এনবিআর বিলুপ্ত করার লক্ষ্য সম্পর্কে এ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। বিশ্বে কর-জিডিপির গড় অনুপাত ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি মালয়েশিয়ায় এই অনুপাত ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অন্তত ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত অর্জন করতেই হবে।
দীর্ঘদিনের কিছু প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলেছে, একই প্রতিষ্ঠানের হাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকায় করনীতিতে পক্ষপাতিত্ব ও অনিয়ম হয়েছে। কর আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা কার্যকর জবাবদিহি ছাড়াই কর ফাঁকিদাতাদের সঙ্গে গোপনে সমঝোতা করার সুযোগ পান। এটা জনস্বার্থের পরিপন্থী। অনেক সময় কর আদায়কারীরা ব্যক্তিস্বার্থে ফাঁকিদাতাদের সাহায্য করেন।
মঙ্গলবার এনবিআর ভেঙে দেয়ার প্রতিবাদে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে -সংবাদ
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে দুইভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। গতকাল সোমবার গভীর রাতে এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। সংস্থাটি ভেঙে ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে এনবিআরের কর্মকর্তারা এর একমত ছিল না। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা সরকারের ‘সাহসী পদক্ষেপ’। এটা দেশের জন্য ‘ভালো হবে’।
তবে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে সংস্থাটির কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘এনবিআর ঐক্য পরিষদ’। আজ থেকে তিন দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে তারা। মঙ্গলবার, (১৩ মে ২০২৫) অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি এনবিআরকে দুইভাগ করা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলন করে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের মতামত উপেক্ষা করেই বহুল আলোচিত ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সোমবার রাতে জারি করা অধ্যাদেশে শুধু রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। রাজস্ব সংগ্রহের মূল কাজ করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধি কতটুকু?
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ নামে নতুন যে বিভাগ গঠিত হবে, সেটির কাজ হবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব জোগানে সম্প্রসারণমূলক কর ভিত্তি, যৌক্তিক করহার, সীমিত কর অব্যাহতি নীতি অনুসরণ করে উত্তম কর ব্যবস্থা তৈরি করা। এ ছাড়া স্ট্যাম্প আইনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন নতুনভাবে প্রণয়ন বা সংশোধন করা, স্ট্যাম্প ডিউটি, আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, সারচার্জ ও অন্যান্য শুল্ক-কর, ফি আরোপ, হ্রাস-বৃদ্ধি ও অব্যাহতি প্রদান-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে এই বিভাগ। পাশাপাশি কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতির মূল্যায়ন, কাস্টমস-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন ও মতামত প্রদান, আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি-সংক্রান্ত কার্যক্রম, রাজস্ব-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ ও গবেষণার মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের যথাযথ প্রক্ষেপণ ও প্রাক্কলন করা, রাজস্ব নীতি-সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান, প্রজ্ঞাপন, এসআরও প্রণয়ন, সংশোধন ও ব্যাখ্যা প্রদান করবে এই বিভাগ।
এই বিভাগের জনবল সম্পর্কে বলা হয়েছে, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস, অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞদের দিয়ে বিভাগটির বিভিন্ন পদ পূরণ করা হবে। আর সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে বলে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে।
এ বিভাগকে নিয়মিত পরামর্শ দেয়ার জন্য অর্থনীতিবিদ, রাজস্ববিশেষজ্ঞ, আইনবিশেষজ্ঞ, হিসাব ও নিরীক্ষাবিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী সংগঠন, পেশাজীবী প্রতিনিধি, ট্যারিফ কমিশনমসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিত্বে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে অধ্যাদেশে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতা কতটুকু, কী কাজ করবে?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুন এ বিভাগ গঠিত হবে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এ বিভাগের কাজের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ, কাস্টমস-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহারসংক্রান্ত চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন, কর ভিত্তি সম্প্রসারণে করসেবা, উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি জোরদার করা এবং সবাইকে করজালের মধ্যে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত পদ্ধতি প্রণয়ন, রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রাজস্ব নীতি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন, দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলা এবং নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর এনবিআরের বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে। তবে এসব জনবল হতে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগেও পদায়ন করা যাবে।
সাধুবাদ জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা
এনবিআর দুইভাগে বিভক্ত হওয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। মঙ্গলবার কথা হয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘এটা দেশের জন্য ইতিবাচক। আমি যখন বিশ্বব্যাংকে জয়েন করি ২৫ বছর আগে তখন থেকে এটা নিয়ে আলোচনা চলছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটা করা হচ্ছিল না। দেরিতে হলেও সরকার সেটা করতে পেরেছে এটার জন্য সাধুবাদ জানাই।’
গবেষণা সংস্থা সানেনের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানও একে সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দুটি নতুন বিভাগÑ রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এই সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবেÑ এমন সম্ভাবনা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম আলাদা করার সিদ্ধান্ত ভালো পদক্ষেপ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত উত্তম রীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। একটি বিভাগ নীতি প্রণয়ন ও আইন তৈরির কাজে যুক্ত থাকবে, অন্যটি আদায় ও বাস্তবায়নের কাজ করবে- এভাবে দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতিশীলতা বাড়ানো সম্ভব।’
তবে তা বাস্তবায়ন যেন সঠিকভাবে হয় সেটার ওপর গুরুত্বারোপ করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘দুইটা ভাগ হলো। এখন কোন বিভাগে কোন ক্রাইটেরিয়ায় জনবল নিয়োগ হবে সেটা দেখার বিষয়। বাংলাদেশে যেটা হয়, নিজের মামা-খালু, ভাগিনা-ভাতিজা এসব জনবল দিয়ে জায়গাগুলো ভরে ফেলে। সেটা যদি হয় তাহলে দুইভাগ করে কোনো লাভ হবে না। যারা যে বিভাগের জন্য যোগ্য তাদের যেন সে বিভাগে বসানো হয়। তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে।’
এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করলো সরকার
মঙ্গলবার এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বিবৃতি দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। এর মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, ‘এনবিআর বিলুপ্ত হয়ে দুটি বিভাগ গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। সব দেশেই এমন আলাদা বিভাগ থাকে। এনবিআরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেই করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে এর প্রভাব পড়বে না। কেউ চাকরিও হারাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় গতবারের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি হয়েছে। খুব হতাশাব্যাঞ্জক নয়, আমরা আরও প্রত্যাশা করছি। অন্তত গতবারের তুলনায় কম হবে না। বিশ্বের সব দেশেই রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাদের পেশাদার হতে হবে অর্থাৎ দেশের জিডিপি, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান এসব বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তারা আবার রাজস্ব সংগ্রহও করবেন, তা হতে পারে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এনবিআর বিলুপ্ত করার লক্ষ্য সম্পর্কে এ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। বিশ্বে কর-জিডিপির গড় অনুপাত ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি মালয়েশিয়ায় এই অনুপাত ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অন্তত ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত অর্জন করতেই হবে।
দীর্ঘদিনের কিছু প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলেছে, একই প্রতিষ্ঠানের হাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকায় করনীতিতে পক্ষপাতিত্ব ও অনিয়ম হয়েছে। কর আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা কার্যকর জবাবদিহি ছাড়াই কর ফাঁকিদাতাদের সঙ্গে গোপনে সমঝোতা করার সুযোগ পান। এটা জনস্বার্থের পরিপন্থী। অনেক সময় কর আদায়কারীরা ব্যক্তিস্বার্থে ফাঁকিদাতাদের সাহায্য করেন।