‘তৃতীয় পক্ষের’ মাধ্যমে পরিদর্শন হলেও প্রতিবারই পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। এবারও ৩০ শতাংশ বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এবার বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি পাঠ্যবই। অভিযোগ রয়েছে, ঘুরেফিরে একই ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দুই স্তরে পাঠ্যবইয়ের মান তদারকির কাজ পাচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘আঁতাতের’ মাধ্যমে পছন্দের প্রতিষ্ঠানের ‘নিম্নমানের’ কাগজে পাঠ্যবই ছাপায় ‘সায়’ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সব জেলা থেকে বইয়ের নমুনা সংগ্রহ
মান খারাপ হলে দায়ী ‘এজেন্ট ও প্রেস’ এনসিটিবি চেয়ারম্যান
এজন্য দায়ী হওয়া উচিত এনসিটিবির মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতা
গত শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় তিন কোটি পাঠ্যবই নিম্নমানের কাগজে ছাপার তথ্য পায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ নেয়া অন্তত ১২টি প্রেসের (ছাপাখানা) বিরুদ্ধে নিম্নমানের বই ছাপার অভিযোগ ওঠে। ওইসব বই ছাপতে সরকারের প্রায় ১৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
এজন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘শাস্তি’ দেয়নি এনসিটিবি। সংস্থার কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তারা ‘তৃতীয় পক্ষ’ হিসেবে ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ করে বই মুদ্রণের কাজ তদারকি করেন। এক্ষেত্রে ভুলত্রুটি হলেও সেটির দায় এজেন্টের।
নিম্নমানের পাঠ্যবই বিতরণের জন্য ‘মনিটরিং এজেন্ট ও ছাপাখানা’ এই দুই পক্ষকেই দায়ী করছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী সংবাদকে জানান, সারাদেশ থেকে তারা পাঠ্যবইয়ের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এখন সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কী ধরনের শাস্তি হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এজেন্ট ও ছাপাখানা দুইপক্ষই দায়ী। তাদের উভয়পক্ষের ২০ শতাংশ বিল আমরা আটকে রেখেছি; সেখান থেকে জরিমানা করা হবে।’
এ ব্যাপারে ছাপাখানা মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের যুক্তি- এনসিটিবির কর্মকর্তা ও তাদের নিয়োজিত মনিটরিং এজেন্টের ‘ছাড়পত্র’ পাওয়ার পরই পাঠ্যবই বিতরণ বা সরবরাহ করেন ছাপাখানা মালিকরা। সেক্ষেত্রে কিছু বইয়ের
‘কোয়ালিটি খারাপ’ হলে তার জন্য এনসিটিবিই দায়ী।
এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান সংবাদকে বলেন, ‘এ বছর অন্তত ৭০ শতাংশ বইয়ের ছাপা ও কাগজ খুবই ভালো হয়েছে, যা আগে হয়নি। আর ৩০ শতাংশের মান খারাপ হতে পারে। সেটির জন্য দায়ী এনসিটিবিরই দায়ী হওয়া উচিত। কারণ তাদের কর্মকর্তা ও এজেন্টের ছাড়পত্রের পরই বই গেছে। বই খারাপ হলে তারা ছাড়পত্র দেবে কেন?’
তিনি বলেন, গত দুই বছরের পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কমিটি করার কথা ছিল। কিন্তু একটি বিশেষ মহলের চাপে সেই প্রক্রিয়া থেমে গেছে।
গত বছর পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণ কাজ তদারকির জন্য এনসিটিবির নিয়োগ করা তৃতীয় পক্ষ প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) এজেন্ট ‘অনুমোদনহীন নিম্নমানের কাগজে’ ১২-১৩টি প্রেসের বই ছাপার বিষয়ে বারবার অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এনসিটিবিকে অনুরোধ জানায়।
কাগজ ও এর ব্রাইটনেস এই দুই উপাদানের ওপরই পাঠ্যবইয়ের গুণগত মান নির্ভর করে। বিগত সময়ে পাঠ্যবই ছাপায় ৮৫ ব্রাইটনেস ও ৭০ জিএসএমের কাগজ ব্যবহার করা হতো। গত বছরের বইয়ে ব্রাইটনেস কমিয়ে ৮০ শতাংশ করা হয়।
এতে এনসিটিবির শর্ত ছিল ৭০ জিএসএম কাগজে ৮০ শতাংশ ব্রাইটনেসে চার রঙে পাঠ্যবই ছাপতে হবে। কিন্তু ১২-১৩টি প্রেস এই শর্ত ভঙ্গ করে পাঠ্যবই মুদ্রণ করেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা পেয়েছে ‘নিম্নমানের’ বই।
এনসিটিবি বই মুদ্রণ ও বিতরণ কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে পিডিআই এজেন্ট ও পিএলআই এজেন্ট নিয়োগ দেয়। এই এজেন্টরা এনসিটিবির পক্ষে বই মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ তত্ত্বাবধান করেন।
পাশাপাশি এনসিটিবির নিজস্ব কর্মকর্তারা মনিটরিং টিমের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ের কাজ তদারকি করা হয়। তার পরও নিম্নমানের বই গ্রহণ ও বিতরণের অভিযোগ ওঠে।
সব জেলা থেকে ‘নমুনা’ পাঠ্যবই সংগ্রহ:
এ বছর সারাদেশে বিতরণ করা পাঠ্যবই ‘টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন’ অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য এপ্রিলের শেষের দিকে ৬৪ জেলা থেকে ‘নমুনা সংগ্রহ’ করেছে এনসিটিবি। এতে বেশিরভাগ জেলায় ‘নিম্নমানের’ বই বিতরণের আলামত পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
কোন কোন প্রেস (ছাপাখানা) নিম্নমানের বই বিতরণ করেছে, কোন প্রতিষ্ঠান কতটি নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছে সেই বিষয়ে ‘সমন্বিত’ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর আগে এভাবে ‘ব্যাপক পরিসরে’ সারাদেশ থেকে পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের পর বইয়ের গুণগত মান যাচাইয়ের কাজ করে এনসিটিবির নিয়োগ করা ‘পোস্ট-ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন’ (পিএলআই) এজেন্ট। কিন্তু প্রায় প্রতি বছর নিম্নমানের বই নিয়ে নানা সমালোচনা হতো। এজন্য এবার মাধ্যমিক স্তরে পিএলআইয়ের পাশাপাশি নিজস্ব কর্মকর্তাদের দিয়ে মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি।
চলতি শিক্ষাবর্ষের ‘নিম্নমানের’ পাঠ্যবই শনাক্তের জন্য ৬৪ জেলার জন্য ৩২টি কমিটি করা হয়েছে। এনসিটিবির দুইজন কর্মকর্তা একটি করে জেলা ঘুরে নিম্নমানের বই সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিচ্ছেন।
সংগ্রহ করা বইয়ের নমুনা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ন্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনসহ (বিএসটিআই) সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষা করে বইয়ের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি।
গত ১৭ এপ্রিল এনসিটিবি এক অফিস আদেশে ‘মনিটরিং কমিটির কর্মকর্তাদের’ বলা হয়, বইয়ের মান বোর্ডের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হয়েছে কিনা এবং শিক্ষার্থী সংখ্যার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা যাচাই করে পরিদর্শন প্রতিবেদন বোর্ড সদস্যের (পাঠ্যপুস্তক) কাছে জমা দিতে হবে।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ বছর সারাদেশে প্রায় ৪০ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে। এবার বেশিরভাগ উপজেলায় ‘খুব ভালো’ মানের বই বিতরণ হয়েছে। কিন্তু কাগজ সংকট ও হঠাৎ কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়া এবং দেরিতে দরপত্র আহ্বানের কারণে উপজেলা পর্যায়ে নিম্নমানের বই দেয়ায় খবর পাচ্ছে এনসিটিবি।
বইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে দরপত্রের মাধ্যমে এনসিটিবি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দুইটি ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে পিডিআই ও পিএলআই ইন্সপেকশনের কাজ একই প্রতিষ্ঠান করে। তবে মাধ্যমিক স্তরে ইন্সপেকশনের কাজ দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়।
দরপত্রের শর্তানুযায়ী, বইয়ের উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত সব কাজ তদারকি করে প্রি-ডিস্ট্রিবিউশন এজেন্ট (পিডিআই)। আর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বই সরবরাহের পর বইয়ের মান যাচাইয়ের তদারকি করে পিএলআই এজেন্ট।
বইয়ের মান সম্পর্কে পিএলআই এজেন্টের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে ছাপাখানাগুলোর মোট কাজের ২০ শতাংশ বকেয়া টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা নেয় এনসিটিবি। শর্তানুযায়ী বই সরবরাহ করতে না পারলে অভিযুক্ত প্রেসের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত এবং কিছু বই ছাপার দরপত্র পুনরায় আহ্বান করা হয়। এতে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাজ কিছুটা পিছিয়ে পড়ে।
আবার বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছরের পাঠ্যবই ছাপার কাজে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে এনসিটিবির। এরপরও বইয়ের মান নিম্ন নিয়ে ‘বিতর্ক’ উঠেছে।
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
‘তৃতীয় পক্ষের’ মাধ্যমে পরিদর্শন হলেও প্রতিবারই পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। এবারও ৩০ শতাংশ বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এবার বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি পাঠ্যবই। অভিযোগ রয়েছে, ঘুরেফিরে একই ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দুই স্তরে পাঠ্যবইয়ের মান তদারকির কাজ পাচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘আঁতাতের’ মাধ্যমে পছন্দের প্রতিষ্ঠানের ‘নিম্নমানের’ কাগজে পাঠ্যবই ছাপায় ‘সায়’ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সব জেলা থেকে বইয়ের নমুনা সংগ্রহ
মান খারাপ হলে দায়ী ‘এজেন্ট ও প্রেস’ এনসিটিবি চেয়ারম্যান
এজন্য দায়ী হওয়া উচিত এনসিটিবির মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতা
গত শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় তিন কোটি পাঠ্যবই নিম্নমানের কাগজে ছাপার তথ্য পায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ নেয়া অন্তত ১২টি প্রেসের (ছাপাখানা) বিরুদ্ধে নিম্নমানের বই ছাপার অভিযোগ ওঠে। ওইসব বই ছাপতে সরকারের প্রায় ১৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
এজন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘শাস্তি’ দেয়নি এনসিটিবি। সংস্থার কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তারা ‘তৃতীয় পক্ষ’ হিসেবে ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ করে বই মুদ্রণের কাজ তদারকি করেন। এক্ষেত্রে ভুলত্রুটি হলেও সেটির দায় এজেন্টের।
নিম্নমানের পাঠ্যবই বিতরণের জন্য ‘মনিটরিং এজেন্ট ও ছাপাখানা’ এই দুই পক্ষকেই দায়ী করছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী সংবাদকে জানান, সারাদেশ থেকে তারা পাঠ্যবইয়ের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এখন সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কী ধরনের শাস্তি হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এজেন্ট ও ছাপাখানা দুইপক্ষই দায়ী। তাদের উভয়পক্ষের ২০ শতাংশ বিল আমরা আটকে রেখেছি; সেখান থেকে জরিমানা করা হবে।’
এ ব্যাপারে ছাপাখানা মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের যুক্তি- এনসিটিবির কর্মকর্তা ও তাদের নিয়োজিত মনিটরিং এজেন্টের ‘ছাড়পত্র’ পাওয়ার পরই পাঠ্যবই বিতরণ বা সরবরাহ করেন ছাপাখানা মালিকরা। সেক্ষেত্রে কিছু বইয়ের
‘কোয়ালিটি খারাপ’ হলে তার জন্য এনসিটিবিই দায়ী।
এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান সংবাদকে বলেন, ‘এ বছর অন্তত ৭০ শতাংশ বইয়ের ছাপা ও কাগজ খুবই ভালো হয়েছে, যা আগে হয়নি। আর ৩০ শতাংশের মান খারাপ হতে পারে। সেটির জন্য দায়ী এনসিটিবিরই দায়ী হওয়া উচিত। কারণ তাদের কর্মকর্তা ও এজেন্টের ছাড়পত্রের পরই বই গেছে। বই খারাপ হলে তারা ছাড়পত্র দেবে কেন?’
তিনি বলেন, গত দুই বছরের পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কমিটি করার কথা ছিল। কিন্তু একটি বিশেষ মহলের চাপে সেই প্রক্রিয়া থেমে গেছে।
গত বছর পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণ কাজ তদারকির জন্য এনসিটিবির নিয়োগ করা তৃতীয় পক্ষ প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) এজেন্ট ‘অনুমোদনহীন নিম্নমানের কাগজে’ ১২-১৩টি প্রেসের বই ছাপার বিষয়ে বারবার অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এনসিটিবিকে অনুরোধ জানায়।
কাগজ ও এর ব্রাইটনেস এই দুই উপাদানের ওপরই পাঠ্যবইয়ের গুণগত মান নির্ভর করে। বিগত সময়ে পাঠ্যবই ছাপায় ৮৫ ব্রাইটনেস ও ৭০ জিএসএমের কাগজ ব্যবহার করা হতো। গত বছরের বইয়ে ব্রাইটনেস কমিয়ে ৮০ শতাংশ করা হয়।
এতে এনসিটিবির শর্ত ছিল ৭০ জিএসএম কাগজে ৮০ শতাংশ ব্রাইটনেসে চার রঙে পাঠ্যবই ছাপতে হবে। কিন্তু ১২-১৩টি প্রেস এই শর্ত ভঙ্গ করে পাঠ্যবই মুদ্রণ করেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা পেয়েছে ‘নিম্নমানের’ বই।
এনসিটিবি বই মুদ্রণ ও বিতরণ কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে পিডিআই এজেন্ট ও পিএলআই এজেন্ট নিয়োগ দেয়। এই এজেন্টরা এনসিটিবির পক্ষে বই মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ তত্ত্বাবধান করেন।
পাশাপাশি এনসিটিবির নিজস্ব কর্মকর্তারা মনিটরিং টিমের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ের কাজ তদারকি করা হয়। তার পরও নিম্নমানের বই গ্রহণ ও বিতরণের অভিযোগ ওঠে।
সব জেলা থেকে ‘নমুনা’ পাঠ্যবই সংগ্রহ:
এ বছর সারাদেশে বিতরণ করা পাঠ্যবই ‘টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন’ অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য এপ্রিলের শেষের দিকে ৬৪ জেলা থেকে ‘নমুনা সংগ্রহ’ করেছে এনসিটিবি। এতে বেশিরভাগ জেলায় ‘নিম্নমানের’ বই বিতরণের আলামত পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
কোন কোন প্রেস (ছাপাখানা) নিম্নমানের বই বিতরণ করেছে, কোন প্রতিষ্ঠান কতটি নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছে সেই বিষয়ে ‘সমন্বিত’ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর আগে এভাবে ‘ব্যাপক পরিসরে’ সারাদেশ থেকে পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের পর বইয়ের গুণগত মান যাচাইয়ের কাজ করে এনসিটিবির নিয়োগ করা ‘পোস্ট-ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন’ (পিএলআই) এজেন্ট। কিন্তু প্রায় প্রতি বছর নিম্নমানের বই নিয়ে নানা সমালোচনা হতো। এজন্য এবার মাধ্যমিক স্তরে পিএলআইয়ের পাশাপাশি নিজস্ব কর্মকর্তাদের দিয়ে মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি।
চলতি শিক্ষাবর্ষের ‘নিম্নমানের’ পাঠ্যবই শনাক্তের জন্য ৬৪ জেলার জন্য ৩২টি কমিটি করা হয়েছে। এনসিটিবির দুইজন কর্মকর্তা একটি করে জেলা ঘুরে নিম্নমানের বই সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিচ্ছেন।
সংগ্রহ করা বইয়ের নমুনা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ন্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনসহ (বিএসটিআই) সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষা করে বইয়ের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি।
গত ১৭ এপ্রিল এনসিটিবি এক অফিস আদেশে ‘মনিটরিং কমিটির কর্মকর্তাদের’ বলা হয়, বইয়ের মান বোর্ডের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হয়েছে কিনা এবং শিক্ষার্থী সংখ্যার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা যাচাই করে পরিদর্শন প্রতিবেদন বোর্ড সদস্যের (পাঠ্যপুস্তক) কাছে জমা দিতে হবে।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ বছর সারাদেশে প্রায় ৪০ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে। এবার বেশিরভাগ উপজেলায় ‘খুব ভালো’ মানের বই বিতরণ হয়েছে। কিন্তু কাগজ সংকট ও হঠাৎ কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়া এবং দেরিতে দরপত্র আহ্বানের কারণে উপজেলা পর্যায়ে নিম্নমানের বই দেয়ায় খবর পাচ্ছে এনসিটিবি।
বইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে দরপত্রের মাধ্যমে এনসিটিবি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দুইটি ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে পিডিআই ও পিএলআই ইন্সপেকশনের কাজ একই প্রতিষ্ঠান করে। তবে মাধ্যমিক স্তরে ইন্সপেকশনের কাজ দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়।
দরপত্রের শর্তানুযায়ী, বইয়ের উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত সব কাজ তদারকি করে প্রি-ডিস্ট্রিবিউশন এজেন্ট (পিডিআই)। আর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বই সরবরাহের পর বইয়ের মান যাচাইয়ের তদারকি করে পিএলআই এজেন্ট।
বইয়ের মান সম্পর্কে পিএলআই এজেন্টের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে ছাপাখানাগুলোর মোট কাজের ২০ শতাংশ বকেয়া টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা নেয় এনসিটিবি। শর্তানুযায়ী বই সরবরাহ করতে না পারলে অভিযুক্ত প্রেসের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত এবং কিছু বই ছাপার দরপত্র পুনরায় আহ্বান করা হয়। এতে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাজ কিছুটা পিছিয়ে পড়ে।
আবার বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছরের পাঠ্যবই ছাপার কাজে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে এনসিটিবির। এরপরও বইয়ের মান নিম্ন নিয়ে ‘বিতর্ক’ উঠেছে।