মাগুরায় ৮ বছরের শিশুর ধর্ষণ ও হত্যার আলোচিত মামলার মূল আসামি হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। মামলার বাকি তিন আসামি শিশুটির বোনের জামাতা সজীব শেখ, সজীবের ভাই রাতুল শেখ ও তাদের মা জাহেদা বেগম পেয়েছেন খালাস। শনিবার,(১৭ মে ২০২৫) সকাল সাড়ে ৯টায় মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এই রায় ঘোষণা করেন বলে জানিয়েছেন মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনিরুল ইসলাম মুকুল।
অভিযোগপত্রের বর্ণনায় হিটু শেখের ‘বীভৎসতা’
‘ওরা ছাড়া পায় কীভাবে’, খালাস নিয়ে ক্ষুব্ধ মা
মাত্র ১৪ কর্ম দিবসে হত্যার বিচার সম্পন্ন পিপি
ঘটনার মাত্র দুই মাস ১১ দিনের মাথায় এই মামলার রায় হলো। গত ৬ মার্চ মাগুরার শ্রীপুর উপজেলায় শিশুটি তার বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়। সাত দিন পর ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যায় শিশুটি।
এরপর ১৩ এপ্রিল মাগুরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন। মামলার মূল আসামি হিটু শেখ ১৬৪ ধারায় আদালতে ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন। তবে তিনি মামলার সাক্ষ্যে একাধিক দিন সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, তিনি এর সঙ্গে ‘জড়িত নন’।
অভিযোগপত্রে অপরাধীদের সংশ্লিষ্টতা
অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি হিটু শেখের যে ‘বীভৎসতার’ বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তাতে তার ‘বিকৃত ও পৈশাচিক মানসিকতাই’ প্রকাশ পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন। ৮ বছরের শিশুটিকে যৌন নিপীড়ন করতে গিয়ে প্রধান আসামি ধারালো ব্লেড ব্যবহার করেছেন- অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। বাড়িতে একা পেয়ে শিশুটিকে তিনি ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পরেও তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। খাওয়া-দাওয়া করেছেন এবং মাঠে গিয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন। মামলায় হিটু শেখের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইনের ৯ এর ২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে (ধর্ষণের শিকার) নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডের বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত (অনধিক বিশ লাখ টাকা) অর্থদণ্ডে ও দণ্ডনীয় হইবেন।’
শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে এটা বুঝতে পেরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে ও স্বামীকে বাঁচাতে ‘জিনে আছর করেছে বলে সুকৌশলে’ প্রথমেই হাসপাতালে না নিয়ে ঝাঁড়ফুঁক করানোর জন্য এক হুজুরের কাছে নিয়ে যান প্রধান আসামি হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম। কিন্তু সদর উপজেলার নিজনান্দুয়ালি মদিনাতুল উলুম পৌর গোরস্তান মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের হুজুর শিশুটির গলার কালচে দাগ ও বুকে আঁচড়ের চিহ্ন দেখে বলেন, ‘এটি ঝাঁড়ফুঁকের কাজ না। আপনারা দ্রুত বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।’
তারপরই শিশুটিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও শিশুটির বড় বোনের শাশুড়ি জাহেদা বেগম (৩৮) চিকিৎসক ও নার্সদের বিভ্রান্ত করেন। হাসপাতালে ভর্তি না করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে চান। অভিযোগপত্রে জাহেদা বেগমের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। যারা অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, সত্য গোপন করে এবং আলামত নষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া হিটু শেখ ও জাহেদা বেগমের দুই ছেলে সজীব শেখ ও রাতুল শেখের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ৫০৪ অনুযায়ী অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলায় যা বলা হয়েছে
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে ঘটনার আগে ১ মার্চ ৮ বছরের শিশুটি তার বড় বোনের সঙ্গে শ্রীপুর উপজেলার গ্রামের বাড়ি থেকে মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে হিটু শেখের বাড়িতে আসে। ভগ্নিপতি সজীব শেখ ওরফে ইসমাইল তাদের নিয়ে আসে। পরের পাঁচটি দিন ভালোই যায়। ৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় সবার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সেরে শিশুটি তার বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমায়। পরদিন ৬ মার্চ খুব সকালে বাড়ির লোকজন ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সকাল ৬টায় হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম (৩৮) বাড়ির পাশের ওলিয়ারের খেতে মসুরির ডাল তোলার কাজে চলে যান।
হিটু শেখের মা রোকেয়া বেগম রান্নাবান্নার কাজে চলে যান। সকাল ৮টা থেকে সোয়া ৮টার মধ্যে খাওয়া-
দাওয়া করে শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব শেখও রাজমিস্ত্রির কাজে বাড়ির বাইরে চলে যান। এরপর রান্নাঘর থেকে ভাত ও তরকারি এনে বড় বোন শিশুটিকে খাওয়ায়। হাতমুখ ধুয়ে শিশুটি আবার বোনের ঘরেই বিছানায় শুয়ে থাকে। রোকেয়া বেগম এর কিছু সময় পর বিদ্যুৎ বিল দেয়ার জন্য বাড়ির বাইরে চলে যান।
ফলে ওই সময় হিটু শেখ, শিশুটি, তার বড় বোন এবং হিটু শেখের বড় ছেলে রাতুল শেখ বাড়িতে ছিল। হিটু শেখ, রাতুল শেখ তাদের নিজেদের ঘরে এবং শিশুটি তার বড় বোনের ঘরের বিছানায় শুয়ে ছিল। বড় বোন বাড়ির রান্নাঘরের আশপাশে কাজ করার পাশাপাশি মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিল। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে হিটু শেখ ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার পুত্রবধূ অর্থাৎ সজীবের স্ত্রী রান্নাঘরের পাশে বরই গাছের নিচে মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। হিটু শেখ তখন সজীবের ঘরের বারান্দায় যায় এবং দেখতে পায়, সেই ঘরের দরজা খোলা। শিশুটি তার বোনের বিছানায় শুয়ে আছে।
হিটু শেখ তখন সজীবের ঘরে ঢুকে শিশুটির মুখ চেপে ধরে এবং বিছানা থেকে তাকে নামিয়ে ঘরের মেঝেতে রাখে। শিশুটি চিৎকার করলে হিটু শেখ পাশে থাকা একটি ওড়না দিয়ে শিশুটির গলায় চেপে ধরে। এরপরই শিশুটি অচেতন হয়ে যায়। এই অবস্থাতেই হিটু শেখ শিশুটির বুকের উপর চেপে বসে। একপর্যায়ে বিছানা থেকে বালিশ টেনে এনে শিশুটির মুখ চেপে ধরে এবং শিশুটির উপর যৌন নিপীড়ন চালায়। অভিযোগপত্রের বর্ণনায় বলা হয়েছে, যৌন নিপীড়নের একপর্যায়ে সময় হিটু শেখ তার নিজের ঘরে গিয়ে বিছানার তোশকের নিচ থেকে একটি পুরনো ব্যবহার করা ব্লেড নিয়ে আসে এবং শিশুটির যৌনাঙ্গ ও বুকে ব্লেড ব্যবহার করা হয়। যৌন নিপীড়ন শেষে হিটু শেখ সেই ব্লেডটি আবার নিজের ঘরের বিছানার তোশকের নিচে নিয়ে রেখে দেয়।
‘ওরা ছাড়া পায় কীভাবে’ : ক্ষুব্ধ মা
প্রধান আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও বাকি তিন আসামির খালাসে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়া মাগুরার শিশুটির মা। শনিবার সকালে রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হিটু শেখের সঙ্গে আরও তিনটা আসামি ছিল, তারা আমার মেয়েকে মারতে সহযোগিতা করছে। তারা কীভাবে খালাস পেয়ে গেল? ‘আমি চাই, ওরাও তো দোষী, ওদেরও শাস্তি হোক।’ এ সময় নিজের মেয়ের জামাই সজীব শেখের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তার তো শালী, তার তো একটা দায়িত্ব ছিল। ও তো নিজেই ছেড়ে দিছে। ‘তাইলে আমরা এই রায়ে খুশি হলাম কীভাবে? আমি হাইকোর্টে যাব, যাতে ওই তিনজনেরও শাস্তি হয়।’
১৪ কর্ম দিবসে হত্যার বিচার
শিশু হত্যার আলোচিত মামলার বিচার ১৪ কর্ম দিবসে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মনিরুল ইসলাম মুকুল। মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, প্রধান আসামি হিটুর প্রাণদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত। বাকি তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা খালাস পেয়েছে। ‘আমরা রাষ্ট্রপক্ষ, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরে আলোচনা করে খালাসকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করব, পরবর্তীতে আমরা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।’
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মামলার বিশেষ কৌঁসুলি এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘এই মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আসামিদের যখন পরীক্ষা করা হয়, বিজ্ঞ বিচারিক আদালত পরিষ্কারভাবে তাদের বলেছেন, ‘পরীক্ষাকালে যে আপনাদের জবানবন্দী এবং যে সাক্ষ্য আপনারা শুনেছেন, আপনাদের কোনো বক্তব্য আছে কিনা?’।
‘আসামিরা বলেছে, ‘আমাদের কোনো বক্তব্য নাই’। (বিচারক জানতে চেয়েছেন) ‘কোনো লিখিত বক্তব্য দেবেন?’, উনারা বলেছেন, ‘না, ‘কোনো সাফাই সাক্ষী দেবেন?’-উনারা বলেছেন, ‘না’।
এক নজরে শিশু ধর্ষণ-হত্যা
১ মার্চ : রোজার ছুটিতে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ৮ বছরের শিশুটি তার বোনের বাড়ি বেড়াতে আসে। ৬ মার্চ : সকালে শিশুটি তার বোনের বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়। ওইদিনই শিশুটিকে মাগুরা সদর হাসপাতাল থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতেই তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
৭ মার্চ : শিশুটির চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। ৮ মার্চ : পরে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। এদিন শিশুটির মা চারজনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মাগুরা সদর থানায় একটি মামলা করেন। আসামিরা হলেন শিশুটির বড় বোনের শ্বশুর হিটু শেখ, বোন জামাই সজীব শেখ, তার ভাই রাতুল শেখ ও তাদের মা জাহেদা বেগম। শুরু থেকেই তারা পুলিশ হেফাজতে ছিলেন।
৯ মার্চ : শিশুটির ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ছাত্র-জনতার অব্যাহত বিক্ষোভ। ১০ মার্চ : নিরাপত্তার কারণে রাতে শুনানি করে চার আসামিকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ১২ মার্চ : তিন পুরুষ আসামির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ। ১৩ মার্চ : শিশুটি চিকিৎসাধীন অবস্থায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যায়। আসামিদের গ্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ওইদিনই বিমানবাহিনীর একটি উড়োজাহাজে শিশুটির মরদেহ মাগুরায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফা জানাজা শেষে তাকে রাতে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
১৪ মার্চ, পুলিশ জানায়, শিশুটি মারা যাওয়ায় আগের ধর্ষণ মামলার পাশাপাশি হত্যা মামলাও হয়েছে। ১৫ মার্চ, ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হিটু আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। ৮ এপ্রিল, মাগুরার পুলিশ সুপার জানান, হিটু শেখের ডিএনএ প্রতিবেদনে শিশুটিকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৩ এপ্রিল, মাগুরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন। ২০ এপ্রিল, শুনানি শেষে আদালত অভিযোগ গঠনের জন্য ২৩ এপ্রিল দিন রাখেন। ২৩ এপ্রিল, অভিযোগ গঠনে শেষে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। ২৭ এপ্রিল, শিশুটির মা ও মামলার বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
৮ মে, মামলার মোট ২৯ জনের সাক্ষ্যপ্রদান শেষ হয়। ১৩ মে, দুই দিনের যুক্তিতর্ক শেষে মাগুরা জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান আলোচিত এই মামলার রায়ের জন্য ১৭ মে দিন রাখেন। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন মনিরুল ইসলাম মুকুল। মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রালয় থেকে বিশেষ কৌঁসুলি হিসেবে (অ্যাটর্নি জেনারেল সমমর্যাদার) আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীকে নিয়োগ দেয়া হয়।
শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
মাগুরায় ৮ বছরের শিশুর ধর্ষণ ও হত্যার আলোচিত মামলার মূল আসামি হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। মামলার বাকি তিন আসামি শিশুটির বোনের জামাতা সজীব শেখ, সজীবের ভাই রাতুল শেখ ও তাদের মা জাহেদা বেগম পেয়েছেন খালাস। শনিবার,(১৭ মে ২০২৫) সকাল সাড়ে ৯টায় মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এই রায় ঘোষণা করেন বলে জানিয়েছেন মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনিরুল ইসলাম মুকুল।
অভিযোগপত্রের বর্ণনায় হিটু শেখের ‘বীভৎসতা’
‘ওরা ছাড়া পায় কীভাবে’, খালাস নিয়ে ক্ষুব্ধ মা
মাত্র ১৪ কর্ম দিবসে হত্যার বিচার সম্পন্ন পিপি
ঘটনার মাত্র দুই মাস ১১ দিনের মাথায় এই মামলার রায় হলো। গত ৬ মার্চ মাগুরার শ্রীপুর উপজেলায় শিশুটি তার বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়। সাত দিন পর ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যায় শিশুটি।
এরপর ১৩ এপ্রিল মাগুরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন। মামলার মূল আসামি হিটু শেখ ১৬৪ ধারায় আদালতে ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন। তবে তিনি মামলার সাক্ষ্যে একাধিক দিন সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, তিনি এর সঙ্গে ‘জড়িত নন’।
অভিযোগপত্রে অপরাধীদের সংশ্লিষ্টতা
অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি হিটু শেখের যে ‘বীভৎসতার’ বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তাতে তার ‘বিকৃত ও পৈশাচিক মানসিকতাই’ প্রকাশ পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন। ৮ বছরের শিশুটিকে যৌন নিপীড়ন করতে গিয়ে প্রধান আসামি ধারালো ব্লেড ব্যবহার করেছেন- অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। বাড়িতে একা পেয়ে শিশুটিকে তিনি ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পরেও তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। খাওয়া-দাওয়া করেছেন এবং মাঠে গিয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন। মামলায় হিটু শেখের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইনের ৯ এর ২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে (ধর্ষণের শিকার) নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডের বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত (অনধিক বিশ লাখ টাকা) অর্থদণ্ডে ও দণ্ডনীয় হইবেন।’
শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে এটা বুঝতে পেরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে ও স্বামীকে বাঁচাতে ‘জিনে আছর করেছে বলে সুকৌশলে’ প্রথমেই হাসপাতালে না নিয়ে ঝাঁড়ফুঁক করানোর জন্য এক হুজুরের কাছে নিয়ে যান প্রধান আসামি হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম। কিন্তু সদর উপজেলার নিজনান্দুয়ালি মদিনাতুল উলুম পৌর গোরস্তান মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের হুজুর শিশুটির গলার কালচে দাগ ও বুকে আঁচড়ের চিহ্ন দেখে বলেন, ‘এটি ঝাঁড়ফুঁকের কাজ না। আপনারা দ্রুত বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।’
তারপরই শিশুটিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও শিশুটির বড় বোনের শাশুড়ি জাহেদা বেগম (৩৮) চিকিৎসক ও নার্সদের বিভ্রান্ত করেন। হাসপাতালে ভর্তি না করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে চান। অভিযোগপত্রে জাহেদা বেগমের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। যারা অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, সত্য গোপন করে এবং আলামত নষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া হিটু শেখ ও জাহেদা বেগমের দুই ছেলে সজীব শেখ ও রাতুল শেখের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ৫০৪ অনুযায়ী অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলায় যা বলা হয়েছে
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে ঘটনার আগে ১ মার্চ ৮ বছরের শিশুটি তার বড় বোনের সঙ্গে শ্রীপুর উপজেলার গ্রামের বাড়ি থেকে মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে হিটু শেখের বাড়িতে আসে। ভগ্নিপতি সজীব শেখ ওরফে ইসমাইল তাদের নিয়ে আসে। পরের পাঁচটি দিন ভালোই যায়। ৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় সবার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সেরে শিশুটি তার বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমায়। পরদিন ৬ মার্চ খুব সকালে বাড়ির লোকজন ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সকাল ৬টায় হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম (৩৮) বাড়ির পাশের ওলিয়ারের খেতে মসুরির ডাল তোলার কাজে চলে যান।
হিটু শেখের মা রোকেয়া বেগম রান্নাবান্নার কাজে চলে যান। সকাল ৮টা থেকে সোয়া ৮টার মধ্যে খাওয়া-
দাওয়া করে শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব শেখও রাজমিস্ত্রির কাজে বাড়ির বাইরে চলে যান। এরপর রান্নাঘর থেকে ভাত ও তরকারি এনে বড় বোন শিশুটিকে খাওয়ায়। হাতমুখ ধুয়ে শিশুটি আবার বোনের ঘরেই বিছানায় শুয়ে থাকে। রোকেয়া বেগম এর কিছু সময় পর বিদ্যুৎ বিল দেয়ার জন্য বাড়ির বাইরে চলে যান।
ফলে ওই সময় হিটু শেখ, শিশুটি, তার বড় বোন এবং হিটু শেখের বড় ছেলে রাতুল শেখ বাড়িতে ছিল। হিটু শেখ, রাতুল শেখ তাদের নিজেদের ঘরে এবং শিশুটি তার বড় বোনের ঘরের বিছানায় শুয়ে ছিল। বড় বোন বাড়ির রান্নাঘরের আশপাশে কাজ করার পাশাপাশি মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিল। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে হিটু শেখ ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার পুত্রবধূ অর্থাৎ সজীবের স্ত্রী রান্নাঘরের পাশে বরই গাছের নিচে মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। হিটু শেখ তখন সজীবের ঘরের বারান্দায় যায় এবং দেখতে পায়, সেই ঘরের দরজা খোলা। শিশুটি তার বোনের বিছানায় শুয়ে আছে।
হিটু শেখ তখন সজীবের ঘরে ঢুকে শিশুটির মুখ চেপে ধরে এবং বিছানা থেকে তাকে নামিয়ে ঘরের মেঝেতে রাখে। শিশুটি চিৎকার করলে হিটু শেখ পাশে থাকা একটি ওড়না দিয়ে শিশুটির গলায় চেপে ধরে। এরপরই শিশুটি অচেতন হয়ে যায়। এই অবস্থাতেই হিটু শেখ শিশুটির বুকের উপর চেপে বসে। একপর্যায়ে বিছানা থেকে বালিশ টেনে এনে শিশুটির মুখ চেপে ধরে এবং শিশুটির উপর যৌন নিপীড়ন চালায়। অভিযোগপত্রের বর্ণনায় বলা হয়েছে, যৌন নিপীড়নের একপর্যায়ে সময় হিটু শেখ তার নিজের ঘরে গিয়ে বিছানার তোশকের নিচ থেকে একটি পুরনো ব্যবহার করা ব্লেড নিয়ে আসে এবং শিশুটির যৌনাঙ্গ ও বুকে ব্লেড ব্যবহার করা হয়। যৌন নিপীড়ন শেষে হিটু শেখ সেই ব্লেডটি আবার নিজের ঘরের বিছানার তোশকের নিচে নিয়ে রেখে দেয়।
‘ওরা ছাড়া পায় কীভাবে’ : ক্ষুব্ধ মা
প্রধান আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও বাকি তিন আসামির খালাসে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়া মাগুরার শিশুটির মা। শনিবার সকালে রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হিটু শেখের সঙ্গে আরও তিনটা আসামি ছিল, তারা আমার মেয়েকে মারতে সহযোগিতা করছে। তারা কীভাবে খালাস পেয়ে গেল? ‘আমি চাই, ওরাও তো দোষী, ওদেরও শাস্তি হোক।’ এ সময় নিজের মেয়ের জামাই সজীব শেখের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তার তো শালী, তার তো একটা দায়িত্ব ছিল। ও তো নিজেই ছেড়ে দিছে। ‘তাইলে আমরা এই রায়ে খুশি হলাম কীভাবে? আমি হাইকোর্টে যাব, যাতে ওই তিনজনেরও শাস্তি হয়।’
১৪ কর্ম দিবসে হত্যার বিচার
শিশু হত্যার আলোচিত মামলার বিচার ১৪ কর্ম দিবসে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মনিরুল ইসলাম মুকুল। মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, প্রধান আসামি হিটুর প্রাণদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত। বাকি তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা খালাস পেয়েছে। ‘আমরা রাষ্ট্রপক্ষ, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরে আলোচনা করে খালাসকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করব, পরবর্তীতে আমরা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।’
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মামলার বিশেষ কৌঁসুলি এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘এই মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আসামিদের যখন পরীক্ষা করা হয়, বিজ্ঞ বিচারিক আদালত পরিষ্কারভাবে তাদের বলেছেন, ‘পরীক্ষাকালে যে আপনাদের জবানবন্দী এবং যে সাক্ষ্য আপনারা শুনেছেন, আপনাদের কোনো বক্তব্য আছে কিনা?’।
‘আসামিরা বলেছে, ‘আমাদের কোনো বক্তব্য নাই’। (বিচারক জানতে চেয়েছেন) ‘কোনো লিখিত বক্তব্য দেবেন?’, উনারা বলেছেন, ‘না, ‘কোনো সাফাই সাক্ষী দেবেন?’-উনারা বলেছেন, ‘না’।
এক নজরে শিশু ধর্ষণ-হত্যা
১ মার্চ : রোজার ছুটিতে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ৮ বছরের শিশুটি তার বোনের বাড়ি বেড়াতে আসে। ৬ মার্চ : সকালে শিশুটি তার বোনের বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়। ওইদিনই শিশুটিকে মাগুরা সদর হাসপাতাল থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতেই তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
৭ মার্চ : শিশুটির চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। ৮ মার্চ : পরে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। এদিন শিশুটির মা চারজনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মাগুরা সদর থানায় একটি মামলা করেন। আসামিরা হলেন শিশুটির বড় বোনের শ্বশুর হিটু শেখ, বোন জামাই সজীব শেখ, তার ভাই রাতুল শেখ ও তাদের মা জাহেদা বেগম। শুরু থেকেই তারা পুলিশ হেফাজতে ছিলেন।
৯ মার্চ : শিশুটির ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ছাত্র-জনতার অব্যাহত বিক্ষোভ। ১০ মার্চ : নিরাপত্তার কারণে রাতে শুনানি করে চার আসামিকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ১২ মার্চ : তিন পুরুষ আসামির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ। ১৩ মার্চ : শিশুটি চিকিৎসাধীন অবস্থায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যায়। আসামিদের গ্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ওইদিনই বিমানবাহিনীর একটি উড়োজাহাজে শিশুটির মরদেহ মাগুরায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফা জানাজা শেষে তাকে রাতে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
১৪ মার্চ, পুলিশ জানায়, শিশুটি মারা যাওয়ায় আগের ধর্ষণ মামলার পাশাপাশি হত্যা মামলাও হয়েছে। ১৫ মার্চ, ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হিটু আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। ৮ এপ্রিল, মাগুরার পুলিশ সুপার জানান, হিটু শেখের ডিএনএ প্রতিবেদনে শিশুটিকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৩ এপ্রিল, মাগুরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন। ২০ এপ্রিল, শুনানি শেষে আদালত অভিযোগ গঠনের জন্য ২৩ এপ্রিল দিন রাখেন। ২৩ এপ্রিল, অভিযোগ গঠনে শেষে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। ২৭ এপ্রিল, শিশুটির মা ও মামলার বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
৮ মে, মামলার মোট ২৯ জনের সাক্ষ্যপ্রদান শেষ হয়। ১৩ মে, দুই দিনের যুক্তিতর্ক শেষে মাগুরা জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান আলোচিত এই মামলার রায়ের জন্য ১৭ মে দিন রাখেন। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন মনিরুল ইসলাম মুকুল। মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রালয় থেকে বিশেষ কৌঁসুলি হিসেবে (অ্যাটর্নি জেনারেল সমমর্যাদার) আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীকে নিয়োগ দেয়া হয়।