সাতক্ষীরার দেবহাটার চাঁদপুর গ্রামের আমচাষি কামাল হোসেন -সংবাদ
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার চাদপুর গ্রামের আ. গফফারের ছেলে কামাল হোসেন। চলতি মৌসুমে সাড়ে সাত বিঘা আম বাগানের জমি লিজ নিয়ে উত্তম কৃষি চর্চার (গ্যাপ) অনুসরণ করে বাগান করেছেন। তিন বছরের জন্য ওই বাগান লিজ নিয়ে প্রথম বছর আমের বাগানে পরিচর্চা করছেন।
৫ বছরে দেশে তিন লাখ হেক্টর জমিতে সবজি ও ফল উৎপাদনের আশা
কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে
গ্যাপ গুরুত্বপূর্ণ:
ড. মনজুরুল ইসলাম
শুক্রবার গ্যাপ অনুসরণ করে নিরাপদ আম বাজারজাতকরণের উদ্বোধন
তিনি সংবাদকে বলেন, ‘সাড়ে সাত বিঘা জমি লিজ নিয়ে প্রথমবার গ্যাপ নিয়ম মানি (অনুসরণ করে) আমের আবাদ করিচি (করছি)। প্রথমরাই আমের ফলন ভালো হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ফলন ও আমের আকার ভালো হওয়ায় এলাকার লোকজন আমাকে দেখে আগ্রহ (আগ্রহী) হচ্ছে। কিভাবে চাষ করলি হয় সেটা আমার কাছে শুনতিচে। আশপাশে আরো বাগান আছে তোরা আমাক দেখে আগ্রহ হচ্ছে, তারা বলিচে আগামীবার আমার মতো বাগান করিবে।’
‘কৃষি অফিস থেকে আমাকে সার, বিষ (কীটনাশক) দিচিলো, আর বাগান পরিচর্চার জন্য অনেক সহযোগিতা করিচে (করেছে)’, বলেন কামাল হোসেন।
আশাশুনি, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বেউলা ইউনিয়নের পদ্মবেউলা গ্রামের মো. হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. মতিন সরদার। তিনিও তার বাগানের চার বিঘা জমি গ্যাপ পদ্ধতি অনুসরণ করে আম উৎপাদন করেছেন। কৃষি অফিস থেকে সহযোগিতায় আমের উৎপাদন করেছে। তিনি বলেন, ‘গত বচরের চেয়ে এবার তো আমের আকার আর কালার ভালো হইচে। দেখতে অনেক সুন্দর। দেখেই খাতি ইচ্ছে করে।’
শুধু কামাল হোসেন বা মতিন সরদারই নয়, সাতক্ষীরা সদরের ওমরাপাড়া এলাকার মো. ওসমান মোড়লের ছেলে মো. সোলাইমান মোড়ল, সাতক্ষীরা সদরের বালিথা এলাকার আরশাদ আলীর মো. হেলাল উদ্দীন, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগরের বানিয়াপাড়ার ছোবহান শেখের ছেলে সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকশ আম বাগানি গ্যাপ পদ্ধতি অনুসরণ করে আম উৎপাদন করে ভালো ফলন পেয়েছেন। তাদের আম দেখতে যেমন তেমনি বাজারের অন্য আমের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় দামও বেশি।
তাদের উৎপাদিত আম নিয়ে আগামী শুক্রবার নিরাপদ আম বাজারজাতকরণের উদ্বোধন হবে। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া উদ্বোধন করবেন।
উত্তম কৃষি চর্চা
দেশের আবহাওয়া শাকসবজি ও মৌসুমি ফল চাষের জন্য উপযোগী। দেশে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূলের ফলন বেড়েই চলেছে। তাই সময় এসেছে এখন নিরাপদ সবজি উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি বাড়ানোর। আর এ ন্য গুড এগ্রিকালচারাল প্রাকটিসেস (গ্যাপ) বা উন্নত কৃষি চর্চা অনুসরণে ফসল উৎপাদন প্রয়োজন। এতে উৎপাদন খরচ কমে এবং কৃষি কার্যক্রম টেকসই হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। প্রোগ্রাম
অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনরশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স (পার্টনার) প্রকল্পের ডিপিডি ড. মাহবুবা মুনমুন সংবাদকে বলেন, ‘উত্তম কৃষি চর্চায় এমন পদ্ধতিসমূহের চর্চা করা হয় যা খামারে প্রয়োগ করার ফলে উৎপাদন, সংগ্রহ এবং সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। এটি একগুচ্ছ নীতি-বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয়; যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের মান উন্নয়ন ও কাজের পরিবেশ উন্নত করে।’
‘এছাড়াও এই পদ্ধতির চাষাবাদে স্বাস্থ্যসম্মত উৎপাদন সার, সেচ, বালাইনাশক প্রয়োগ ও ব্যবহার বিধি, রোপণ সামগ্রীর (চারা, বীজ) ব্যবহার, রাসায়নিকের পরিমিত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা অবলম্বনে উৎপাদন নিশ্চিত করা। যার ফলে পরিবেশ সুরক্ষা, মাটি, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকে। সেই সঙ্গে ফসলের নিরাপদ ও খাদ্যমান রক্ষা: ফসল সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থাপনাও সঠিকভাবে করা হয়।’
পার্টনার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবুল কালাম আজাদ সংবাদকে বলেন, ‘পার্টনার প্রকল্পের ১০টা বড় ধরনের উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য হলো গ্যাপ প্রোটোকল তৈরি করা। অর্থাৎ একটা ফসল যে গ্যাপ সার্টিফাই হবে সেজন্য কিছু পদ্ধতি ফলো করতে হবে। সেই পদ্ধতিগুলো ফলো করলে সার্টিফিকেট দেয় যে এটা গ্যাপ সার্টিফাই প্রোডাক্ট।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই পদ্ধতিগুলো তৈরি করার কাজ করতেছে গ্যাপ। কোন পদ্ধতি ফলো করতে হবে, কোন প্রাকটিস ফলো করতে হবে সেটা পার্টনার করে দিচ্ছে। আগামী ৫ বছরে আমরা তিন লাখ হেক্টর জমিতে সবজি ও ফল উৎপাদন করবো। তাই গ্যাপ প্রোটোকল অনুযায়ী সবজি ও ফল উৎপাদন ও সর্বোপরি এটা মার্কেটে পৌঁছে দেয়া সব প্রক্রিয়াই পার্টনারের।’
# কেন গ্যাপ সার্টিফাই কৃষিপণ্য প্রয়োজন:
কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে গ্লোবাল এগ্রিকালচার প্রাকটিস (গ্যাপ) গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ড. মনজুরুল ইসলাম। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি ফল ও সবজি উৎপন্ন হয়। সেগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের মেম্বাররা রপ্তানি করে থাকে। তার মধ্যে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অন্যতম। যেসব দেশে আমাদের দেশের ফল ও সবজি যায় তারা কিছু রুলস বা এসপিএস মেজারমেন্ট দিয়ে থাকে। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে এসপিএস মেজারমেন্ট বা গ্যাপ মান নিয়ন্ত্রিত পণ্য রপ্তানি করতে হয়। সেজন্য বাংলাদেশে গ্যাপ মান নিয়ন্ত্রিত ফসলের উৎপাদন বাড়ানো জরুরি।’
‘কৃষি মন্ত্রণালয় গ্যাপের মাধ্যমে যেসব ফল উৎপাদন করছে সেটার মান অত্যন্ত ভালো। এই প্রডাক্টটি গ্লোবাল গ্যাপ সার্টিফিকেট পাওয়ার যোগ্য’, বলে তার মত।
ড. মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাপ সার্টিফাইড পণ্য ভোক্তারা ব্যবহার করবে, কারণ আমাদের দেশে কৃষকরা উৎপাদন করতে যে পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োগ করে তা সঠিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। তাই সুন্থ থাকতে হলে ভোক্তা গ্যাপ সার্টিফাই কৃষিপণ্য খাবারের জন্য উৎসাহী হবে।’
# গ্যাপ সার্টিফাইড কৃষিপণ্য দেশে ও বিদেশে বাজার:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বেশ অগ্রগামী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ড কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে অনেক এগিয়ে। দেশটির মোট জিডিপির শতকরা ২৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। প্রতি বছর কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করে থাইল্যান্ড ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। সেখানে বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের মাত্র ১ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত হয়। অথচ ভিয়েতনামের ৫ শতাংশ, চীনের ৩৮, ফিলিপাইনের ৩১, আমেরিকায় ৭০, থাইল্যান্ডে ৮১ ও মালয়েশিয়ায় ৮৪ শতাংশ কৃষি প্রক্রিয়াজাতের সঙ্গে জড়িত।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এর (সিপিডি) এক জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক জানান, আমাদের দেশের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এমনকি এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোর মানুষের কাছে বিক্রি হচ্ছে না। তার অন্যতম কারণ হলো বিদেশিরা হাইজেনিক এবং নিরাপদ খাদ্য ছাড়া গ্রহণ করে না। তারা জানতে চায় এসব পণ্য উৎপাদনের সময় জমিতে গ্যাপ অনুসরণ করা হয়েছে কিনা?
তবে বিশুদ্ধ খাদ্যদ্রব্য সুলভে সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালে স্বপ্ন বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। সারা দেশে স্বপ্নের বিপণনকেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে ভোক্তা নিয়মিত পণ্য ক্রয় করেন। স্বপ্নের ডেপুটি ডিরেক্টর মাহাদী ফয়সাল সংবাদকে বলেন, ‘স্বপ্ন ২০১৭ সালে প্রথম গ্লোবাল গ্যাপের সঙ্গে কাজ শুরু করে। সার্বিক পরীক্ষণ ও নিশ্চিতকরণ সম্পন্ন করে অডিট কমিটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর স্বপ্ন অর্জন করে গ্লোবাল গ্যাপ সার্টিফিকেট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রিটেইল ক্যাটাগরিতে ‘স্বপ্ন’ প্রথম গ্লোবাল গ্যাপের মেম্বার।’
# কৃষি মন্ত্রণালয় কী করছে:
গ্যাপ সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে ফল ও সবজির আওতাধীন এলাকায় ১০ লাখ কৃষককে আমরা গ্যাপ ট্রেনিং দিয়ে উত্তম কৃষি চর্চা শেখানোর কাজ এগিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে কৃষকদের দক্ষতা ও উৎপাদনের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পার্টনার প্রকল্পের আওতায় কৃষক উত্তম কৃষি চর্চা সার্টিফিকেশন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পার্টনার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এজন্য আমরা কৃষককে ট্রেনিং দিয়ে গ্যাপ সার্টিফাইড কৃষিপণ্য তৈরির উপযোগী করে গড়ে তুলছি। সারাদেশের ৫ লাখ কৃষককে আমরা একদিনের ট্রেনিং দিচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে একদিন এভাবে ১০টি সেশনের মাধ্যমে ট্রেনিং দিয়ে গ্যাপ শেখাবো। মোটামুটি ১০ লাখ কৃষককে আমরা গ্যাপ ট্রেনিং দিয়ে উত্তম কৃষি চর্চা শেখাবো।’
মাহাদী ফয়সাল বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগকে অবশ্যই আমরা সাধুবাদ জানাই । উত্তম কৃষি চর্চা (গ্যাপ) খুবই জরুরি ও প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ফসল উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।’
সাতক্ষীরার দেবহাটার চাঁদপুর গ্রামের আমচাষি কামাল হোসেন -সংবাদ
মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার চাদপুর গ্রামের আ. গফফারের ছেলে কামাল হোসেন। চলতি মৌসুমে সাড়ে সাত বিঘা আম বাগানের জমি লিজ নিয়ে উত্তম কৃষি চর্চার (গ্যাপ) অনুসরণ করে বাগান করেছেন। তিন বছরের জন্য ওই বাগান লিজ নিয়ে প্রথম বছর আমের বাগানে পরিচর্চা করছেন।
৫ বছরে দেশে তিন লাখ হেক্টর জমিতে সবজি ও ফল উৎপাদনের আশা
কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে
গ্যাপ গুরুত্বপূর্ণ:
ড. মনজুরুল ইসলাম
শুক্রবার গ্যাপ অনুসরণ করে নিরাপদ আম বাজারজাতকরণের উদ্বোধন
তিনি সংবাদকে বলেন, ‘সাড়ে সাত বিঘা জমি লিজ নিয়ে প্রথমবার গ্যাপ নিয়ম মানি (অনুসরণ করে) আমের আবাদ করিচি (করছি)। প্রথমরাই আমের ফলন ভালো হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ফলন ও আমের আকার ভালো হওয়ায় এলাকার লোকজন আমাকে দেখে আগ্রহ (আগ্রহী) হচ্ছে। কিভাবে চাষ করলি হয় সেটা আমার কাছে শুনতিচে। আশপাশে আরো বাগান আছে তোরা আমাক দেখে আগ্রহ হচ্ছে, তারা বলিচে আগামীবার আমার মতো বাগান করিবে।’
‘কৃষি অফিস থেকে আমাকে সার, বিষ (কীটনাশক) দিচিলো, আর বাগান পরিচর্চার জন্য অনেক সহযোগিতা করিচে (করেছে)’, বলেন কামাল হোসেন।
আশাশুনি, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বেউলা ইউনিয়নের পদ্মবেউলা গ্রামের মো. হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. মতিন সরদার। তিনিও তার বাগানের চার বিঘা জমি গ্যাপ পদ্ধতি অনুসরণ করে আম উৎপাদন করেছেন। কৃষি অফিস থেকে সহযোগিতায় আমের উৎপাদন করেছে। তিনি বলেন, ‘গত বচরের চেয়ে এবার তো আমের আকার আর কালার ভালো হইচে। দেখতে অনেক সুন্দর। দেখেই খাতি ইচ্ছে করে।’
শুধু কামাল হোসেন বা মতিন সরদারই নয়, সাতক্ষীরা সদরের ওমরাপাড়া এলাকার মো. ওসমান মোড়লের ছেলে মো. সোলাইমান মোড়ল, সাতক্ষীরা সদরের বালিথা এলাকার আরশাদ আলীর মো. হেলাল উদ্দীন, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগরের বানিয়াপাড়ার ছোবহান শেখের ছেলে সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকশ আম বাগানি গ্যাপ পদ্ধতি অনুসরণ করে আম উৎপাদন করে ভালো ফলন পেয়েছেন। তাদের আম দেখতে যেমন তেমনি বাজারের অন্য আমের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় দামও বেশি।
তাদের উৎপাদিত আম নিয়ে আগামী শুক্রবার নিরাপদ আম বাজারজাতকরণের উদ্বোধন হবে। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া উদ্বোধন করবেন।
উত্তম কৃষি চর্চা
দেশের আবহাওয়া শাকসবজি ও মৌসুমি ফল চাষের জন্য উপযোগী। দেশে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূলের ফলন বেড়েই চলেছে। তাই সময় এসেছে এখন নিরাপদ সবজি উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি বাড়ানোর। আর এ ন্য গুড এগ্রিকালচারাল প্রাকটিসেস (গ্যাপ) বা উন্নত কৃষি চর্চা অনুসরণে ফসল উৎপাদন প্রয়োজন। এতে উৎপাদন খরচ কমে এবং কৃষি কার্যক্রম টেকসই হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। প্রোগ্রাম
অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনরশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স (পার্টনার) প্রকল্পের ডিপিডি ড. মাহবুবা মুনমুন সংবাদকে বলেন, ‘উত্তম কৃষি চর্চায় এমন পদ্ধতিসমূহের চর্চা করা হয় যা খামারে প্রয়োগ করার ফলে উৎপাদন, সংগ্রহ এবং সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। এটি একগুচ্ছ নীতি-বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয়; যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের মান উন্নয়ন ও কাজের পরিবেশ উন্নত করে।’
‘এছাড়াও এই পদ্ধতির চাষাবাদে স্বাস্থ্যসম্মত উৎপাদন সার, সেচ, বালাইনাশক প্রয়োগ ও ব্যবহার বিধি, রোপণ সামগ্রীর (চারা, বীজ) ব্যবহার, রাসায়নিকের পরিমিত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা অবলম্বনে উৎপাদন নিশ্চিত করা। যার ফলে পরিবেশ সুরক্ষা, মাটি, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকে। সেই সঙ্গে ফসলের নিরাপদ ও খাদ্যমান রক্ষা: ফসল সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থাপনাও সঠিকভাবে করা হয়।’
পার্টনার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবুল কালাম আজাদ সংবাদকে বলেন, ‘পার্টনার প্রকল্পের ১০টা বড় ধরনের উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য হলো গ্যাপ প্রোটোকল তৈরি করা। অর্থাৎ একটা ফসল যে গ্যাপ সার্টিফাই হবে সেজন্য কিছু পদ্ধতি ফলো করতে হবে। সেই পদ্ধতিগুলো ফলো করলে সার্টিফিকেট দেয় যে এটা গ্যাপ সার্টিফাই প্রোডাক্ট।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই পদ্ধতিগুলো তৈরি করার কাজ করতেছে গ্যাপ। কোন পদ্ধতি ফলো করতে হবে, কোন প্রাকটিস ফলো করতে হবে সেটা পার্টনার করে দিচ্ছে। আগামী ৫ বছরে আমরা তিন লাখ হেক্টর জমিতে সবজি ও ফল উৎপাদন করবো। তাই গ্যাপ প্রোটোকল অনুযায়ী সবজি ও ফল উৎপাদন ও সর্বোপরি এটা মার্কেটে পৌঁছে দেয়া সব প্রক্রিয়াই পার্টনারের।’
# কেন গ্যাপ সার্টিফাই কৃষিপণ্য প্রয়োজন:
কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে গ্লোবাল এগ্রিকালচার প্রাকটিস (গ্যাপ) গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ড. মনজুরুল ইসলাম। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি ফল ও সবজি উৎপন্ন হয়। সেগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের মেম্বাররা রপ্তানি করে থাকে। তার মধ্যে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অন্যতম। যেসব দেশে আমাদের দেশের ফল ও সবজি যায় তারা কিছু রুলস বা এসপিএস মেজারমেন্ট দিয়ে থাকে। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে এসপিএস মেজারমেন্ট বা গ্যাপ মান নিয়ন্ত্রিত পণ্য রপ্তানি করতে হয়। সেজন্য বাংলাদেশে গ্যাপ মান নিয়ন্ত্রিত ফসলের উৎপাদন বাড়ানো জরুরি।’
‘কৃষি মন্ত্রণালয় গ্যাপের মাধ্যমে যেসব ফল উৎপাদন করছে সেটার মান অত্যন্ত ভালো। এই প্রডাক্টটি গ্লোবাল গ্যাপ সার্টিফিকেট পাওয়ার যোগ্য’, বলে তার মত।
ড. মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাপ সার্টিফাইড পণ্য ভোক্তারা ব্যবহার করবে, কারণ আমাদের দেশে কৃষকরা উৎপাদন করতে যে পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োগ করে তা সঠিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। তাই সুন্থ থাকতে হলে ভোক্তা গ্যাপ সার্টিফাই কৃষিপণ্য খাবারের জন্য উৎসাহী হবে।’
# গ্যাপ সার্টিফাইড কৃষিপণ্য দেশে ও বিদেশে বাজার:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বেশ অগ্রগামী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ড কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে অনেক এগিয়ে। দেশটির মোট জিডিপির শতকরা ২৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। প্রতি বছর কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করে থাইল্যান্ড ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। সেখানে বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের মাত্র ১ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত হয়। অথচ ভিয়েতনামের ৫ শতাংশ, চীনের ৩৮, ফিলিপাইনের ৩১, আমেরিকায় ৭০, থাইল্যান্ডে ৮১ ও মালয়েশিয়ায় ৮৪ শতাংশ কৃষি প্রক্রিয়াজাতের সঙ্গে জড়িত।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এর (সিপিডি) এক জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক জানান, আমাদের দেশের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এমনকি এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোর মানুষের কাছে বিক্রি হচ্ছে না। তার অন্যতম কারণ হলো বিদেশিরা হাইজেনিক এবং নিরাপদ খাদ্য ছাড়া গ্রহণ করে না। তারা জানতে চায় এসব পণ্য উৎপাদনের সময় জমিতে গ্যাপ অনুসরণ করা হয়েছে কিনা?
তবে বিশুদ্ধ খাদ্যদ্রব্য সুলভে সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালে স্বপ্ন বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। সারা দেশে স্বপ্নের বিপণনকেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে ভোক্তা নিয়মিত পণ্য ক্রয় করেন। স্বপ্নের ডেপুটি ডিরেক্টর মাহাদী ফয়সাল সংবাদকে বলেন, ‘স্বপ্ন ২০১৭ সালে প্রথম গ্লোবাল গ্যাপের সঙ্গে কাজ শুরু করে। সার্বিক পরীক্ষণ ও নিশ্চিতকরণ সম্পন্ন করে অডিট কমিটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর স্বপ্ন অর্জন করে গ্লোবাল গ্যাপ সার্টিফিকেট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রিটেইল ক্যাটাগরিতে ‘স্বপ্ন’ প্রথম গ্লোবাল গ্যাপের মেম্বার।’
# কৃষি মন্ত্রণালয় কী করছে:
গ্যাপ সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে ফল ও সবজির আওতাধীন এলাকায় ১০ লাখ কৃষককে আমরা গ্যাপ ট্রেনিং দিয়ে উত্তম কৃষি চর্চা শেখানোর কাজ এগিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে কৃষকদের দক্ষতা ও উৎপাদনের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পার্টনার প্রকল্পের আওতায় কৃষক উত্তম কৃষি চর্চা সার্টিফিকেশন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পার্টনার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এজন্য আমরা কৃষককে ট্রেনিং দিয়ে গ্যাপ সার্টিফাইড কৃষিপণ্য তৈরির উপযোগী করে গড়ে তুলছি। সারাদেশের ৫ লাখ কৃষককে আমরা একদিনের ট্রেনিং দিচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে একদিন এভাবে ১০টি সেশনের মাধ্যমে ট্রেনিং দিয়ে গ্যাপ শেখাবো। মোটামুটি ১০ লাখ কৃষককে আমরা গ্যাপ ট্রেনিং দিয়ে উত্তম কৃষি চর্চা শেখাবো।’
মাহাদী ফয়সাল বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগকে অবশ্যই আমরা সাধুবাদ জানাই । উত্তম কৃষি চর্চা (গ্যাপ) খুবই জরুরি ও প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ফসল উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।’