alt

জাতীয়

২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো দিন নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫

বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দাবি ও আন্দোলনের চাপে পড়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন তার নির্ধারিত আগামী বছরের জুন থেকে দুই মাস এগিয়ে্ে এপ্রিলে অনুষ্ঠানের ঘোষনা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস।

ঈদুল আজহা উপলক্ষে আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তিনি বলেছেন, “বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।”

ক্ষমতা গ্রহনের কিছুদিন পর থেকে ইউনূস বলে আসছিলেন, নির্বাচন কবে হবে তা নির্ভর করবে সংস্কার কতটা করা হবে তার ওপর। গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার সেরে ডিসেম্বরেই নির্বাচন সম্ভব। আর আরো কিছু সংস্কার করলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে ভোট করা যাবে। তবে নির্বাচন জুনের পরে যাবে না, সেটাও তিনি বলেছেন।

তবে তার এমন পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি হুমকি দেয়, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে এরপর সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। সেনাপ্রধানও একই সময়ে নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন–এমন খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছিল।

তবে জামায়াতে ইসলামী আগামী বছরের এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা সম্ভাব্য যে নতুন সময়সূচি দিলেন, তা জামায়াত আমিরের প্রত্যাশার সঙ্গেই মিলে গেল।

অন্যদিকে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গড়া দল এনসিপি বলে আসছিল আওয়ামী লীগের বিচার এবং সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন তারা চায় না।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইউনূস বলেন, “আমরা যারা এই নির্বাচনে ভোটার হব তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এবং সৌভাগ্যবতী। আমরা একটা অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের সুযোগ ও দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা জাতির নতুন যাত্রাপথ তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টির মহান সুযোগটা পাচ্ছি। আমাদের সুচিন্তিত ভোটের মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশ নির্মিত হবে। শহীদদের রক্তদান সার্থক হবে।

“আশা করি, বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেই সবাই ভোটকেন্দ্রে যাব এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে ভোট দেব। এখন থেকে ভাবনা চিন্তা শুরু করুন। আলোচনা শুরু করুন। এখন থেকে আপনাদের ভোটের গুরুত্বটা বুঝে নিন। আপনার এবারের ভোটের গুরুত্ব ঐতিহাসিক মানদণ্ডে দেখা হবে।”

ছাত্র-জনতার অভ্যুস্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত অগাস্টে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর শুরু হয় ‘সংস্কারের’ কাজ।

গত কয়েক মাসে সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তার ভিত্তিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশনেরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।

কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে অনৈক্য বেড়েছে। দ্রুত নির্বাচনের দাবিও তত বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে।

এর মধ্যেই মিয়ানমারের রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ তৈরির গুঞ্জন আর চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে।

এমনকি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও সেনাসদরের এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন, বন্দর ও করিডোরের বিষয়গুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর আসে।

সব মিলিয়ে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা তৈরি হয় মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে। তার মধ্যে ইউনূসের ‘পদত্যাগের অভিপ্রায়’ ঘিরে উদ্ভব হয় রাজনৈতিক সঙ্কটের।

সেই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে দুই ডজন দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ম্যারাথন বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে দলগুলো ইউনূস সরকারকে সমর্থনের কথা জানালেও যার যার দাবিতে অটল থাকে। তবে ওই আলোচনার পর উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়।

শুক্রবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে বন্দর, করিডোর, নির্বাচনসহ বিতর্কের প্রায় প্রতিটা বিষয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন ইউনূস।

বন্দর নিয়ে জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই আপনারা নিজেদেরকে ভিত্তিহীন বিরোধিতা এবং অপপ্রচারের শিকার হতে দেবেন না।

তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন্দর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগে আপনাদের দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখুন। যারা বিরোধিতা করছে তাদের প্রতিহত করুন।”

আর করিডোর নিয়ে তার ভাষ্য, “আমরা লক্ষ্য করেছি, রাখাইনের জন্য বাংলাদেশ করিডোর দিয়ে দিয়েছে বলে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি, এটি সর্বৈব মিথ্যা। এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প।”

বিচার

ইউনূস তার ভাষণে বলেন, “আমি শুরু থেকেই বলেছি, পতিত স্বৈরাচার বাংলাদেশকে যেভাবে ধ্বংসস্তূপ বানিয়েছে সেখান থেকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হলে ন‍্যূনতম তিনটি আবশ্যিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

“প্রথমত, বিচার ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দৃশ্যমান করে তোলা। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুর্নগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার সাধনে প্রয়োজনীয় ঐক্যমত ও পথনকশা তৈরি করা। তৃতীয়ত, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এ লক্ষ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে সংস্কার করা।”

তিনি বলেন, “এই তিনটি ম‍্যান্ডেট হচ্ছে দেশবাসীর সাথে আমাদের চুক্তি। চব্বিশের শহীদের রক্তেভেজা এই চুক্তি আপনাদের সার্বিক সমর্থন, আস্থা ও সহযোগিতা নিয়ে এবং পতিত শক্তি ও তার দোসরদের সৃষ্ট সকল বাধা-বিপত্তিকে পরাভূত করে আমরা সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”

গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞসহ বিগত ১৬ বছরের গুম-খুন নির্যাতনের ‘সত্য উদঘাটন’ এবং আর্থিক খাতের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া যে সরকার শুরু করেছে, সে কথা ইউনূস তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রসিকিউশন টিম গঠন ও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের পাশাপাশি বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা প্রক্রিয়াধীন ছিল। যত দ্রুত সম্ভব বিচারকাজ শুরুর ব্যাপারে আমরা আশাবাদী ছিলাম। আপনারা জানেন, জুলাইয়ে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিচার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।”

বিচারকাজ যেন দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগিতা দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোনো বিচার পর্ব আদালতের অনুমতিক্রমে সরাসরি কিংবা রেকর্ডকৃত পদ্ধতিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, এতে করে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। বিচার নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ হবে।

“প্রসিকিউশন বলছে, বিগত সরকার পতনের পর তাদের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। থানা, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দলিলপত্র পুড়িয়ে বা লুকিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক স্থাপনার আকার আকৃতি, দেয়াল ইত্যাদি ভেঙে এবং বিকৃত করে প্রমাণ লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন ডিজিটাল এভিডেন্স, যেমন ভিডিও, অডিও, ইন্টারনেট ডেটা যেগুলো ডিলিট বা ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলো রিকভার এবং রেস্টোর করার কাজ করছেন। এ কাজে আমরা দেশবাসীর কাছেও সহযোগিতা কামনা করছি।”

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে ‘রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের জন্য’ বিপুল সংখ্যক মানুষকে গুমের ঘটনা তদন্ত এবং এই ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের জন্য গঠিত কমিশনের কাজের অগ্রগতির তথ্যও ভাষণে তুলে ধরেন ইউনূস।

তিনি বলেন, কমিশন এখন পর্যন্ত দুটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তারা এখনো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিযোগ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে গুমের তদন্ত কার্যক্রমের জন্য ঢাকা শহরের তিনটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় তিনটি গুমের কেন্দ্র পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্তকাজে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা পর্যায়ে গণশুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। মোট আট শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ গণ-শুনানিতে অংশ নিয়েছেন।

“গুম সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে জমা হয়েছে। এছাড়াও এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি।”

জুলাই সনদ

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের সংগঠনগুলো ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। গত ১০ মে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে। তবে ইউনূস তার ভাষণে বলেছেন জুলাইয়ের কথা।

তিনি বলেন, “আগামী জুলাই মাসেই সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে আমরা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারবো বলে আশা করছি।”

তার ভাষায়, “এই জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যেকয়টিতে একমত হয়েছে তার তালিকা থাকবে এই সনদে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে তারা জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।

“জুলাই সনদ অনুযায়ী আশুকরণীয় সংস্কার কাজগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাকি অংশের বেশকিছু কাজও আমরা শুরু করে যেতে চাই। আশা করি, অবশিষ্ট অংশ পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন অব‍্যাহত থাকবে।”

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “এর কোনো বিকল্প নেই। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের কাছে দেশের নতুন ঐক্যবদ্ধ ভাবমূর্তি তুলে ধরা যাবে। বিশ্বব্যাপী সবার কাছে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে।”

ইউনূসের ভাষায়, সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে আনতে ঐকমত্য কমিশন গঠন করা ছিল ‘একটি দুঃসাহসিক উদ্যোগ’।

“অন্য কোনো দেশে এমন কোনো নজির নেই। এর মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে রাজনৈতিক গভীরতার সন্ধান পেয়েছি। রাজনৈতিক ঐক্যে পৌঁছার জন্য ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সকল দলের দলগত প্রস্তুতি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কমিশনের সঙ্গে ঐকান্তিক আলোচনা, জাতীয় লাইভ টেলিভিশনের সামনে সকল দলের ঐকমত্যে পৌঁছার একান্ত প্রয়াস আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

“এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সকল রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের সীমাহীন ধৈর্য এবং কমিশনের প্রতি তাদের সহযোগিতা এবং সৌজন্য প্রকাশের জন্য জাতির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি, আমাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করে জাতির জন্য একটা নতুন পথনির্দেশনা রেখে যেতে পারব।”

এই কমিশনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশে ‘নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখার কথা বলছেন কমিশনের প্রধান ইউনূস।

তিনি বলেন, “আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সেটা বিকাশমানভাবে স্থায়ী রূপ দিতে পারি তাহলে আমরা ভবিষ্যতের সকল রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।

“সকল প্রস্তুতি সমাপ্ত করে দেশের সকল মানুষের- কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক-জেলে, গৃহিনী, দিনমজুর, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিল্পী- সবাই মিলে চেষ্টা করে একটি সুন্দর, নিখুঁত নির্বাচন আয়োজন করে নতুন বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি রচনা করব।”

বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে

বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে

নির্বাচন

ইউনূস বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন কখন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানার জন্য রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে, সে কথা তিনি জাননে।

“আমি বারবার বলেছি এই নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তাই করছে।”

সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে যতবার বাংলাদেশ গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে তার সবগুলোরই প্রধান কারণ ছিল ‘ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন’।

“ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বারবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এই ধরনের নির্বাচন যারা আয়োজন করে তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এমন নির্বাচনের মধ‍্য দিয়ে যে দল ক্ষমতায় আসে তারাও জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকে।”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ সরকারের একটি বড় দায়িত্ব হলো একটি পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ, বিপুলভাবে অংশগ্রহণের পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা যাতে করে দেশ ভবিষ্যতে নতুন সংকটে না পড়ে।

“এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। যেই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সেগুলোতে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ছাত্র-জনতার সকল আত্মত্যাগ বিফলে যাবে।”

সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ জায়গায় পৌঁছনো যাবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

তিনি বলেন, “বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার- যা কি না জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়- সে বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারব। এতে আমাদের ওপর আপনাদের অর্পিত ম্যান্ডেট ন্যূনতম হলেও বাস্তবায়ন করে যেতে পারব।”

ইতিহাসে ‘সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।”

‘অঙ্গীকার আদায় করে নিন’

ইউনূস বলেন, তার সরকার এমন নির্বাচন করতে চায়, যা দেখে অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা ‘শান্তি’ পাবে।

“আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ও দল অংশ নিক। এটা সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতির কাছে স্মরণীয় থাকুক।

“দেড়যুগ পরে দেশে সত্যিকারের একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠিত হবে। বিপুল তরুণ গোষ্ঠী এবার জীবনে প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। এসব লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ।”

দেশবাসীর উদ্দেশে ইউনূস বলেন, “আপনারা সকল রাজনৈতিক দল এবং আপনাদের এলাকার প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন, যেন আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে তা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই যেন তারা অনুমোদন করেন।‌

“আপনারা ওয়াদা আদায় করে নেবেন যে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে কখনো কোনো প্রকার আপস করবেন না এবং দেশের বাইরের কোনো শক্তির কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবেন না।

“আপনারা তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেবেন এই মর্মে যে তারা কখনোই, কোনো অবস্থাতেই আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করবেন না।

“আপনারা তাদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যে তারা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতার সাথে দেশ পরিচালনা করবেন এবং সকল প্রকার দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি গণবিরোধী কাজ থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখবেন।”

ইউনূস বলেন, “আমি আপনাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এবারের নির্বাচন শুধু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয় নয়। এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার নির্বাচন। এই নির্বাচনে পরিচিত দলগুলিই থাকবে। তাদের পরিচিত মার্কাগুলিই থাকবে।

“কিন্তু ভোটারকে বের করে আনতে হবে যে এই মার্কার পেছনে আপনার কাছে ভোটপ্রার্থীরা কে কতটুকু ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার জন্য প্রস্তুত। কে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

‘পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা’ নতুন বাংলাদেশ গড়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অভিযোগ করে ইউনূস বলেন, “আমি আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি, আমরা একটা যুদ্ধাবস্থায় আছি। এখন আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে যেকোনো মূল্যে।

“পরাজিত শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা ওঁৎ পেতে বসে আছে আমাদের ছোবল মারার জন্য, আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়ার জন্য। আমরা তাদের কিছুতেই এই সুযোগ দেব না।”

ইউনূস বলেন, “আসুন, আমরা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার বিরুদ্ধে যে কোনো আঘাত প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে প্রতিরোধের ঐক্যবদ্ধ সুদৃঢ় প্রাচীর গড়ে তুলি।”

প্রধান উপদেষ্টা তার ৩৯ মিনিটের ভাষণ শুরু করেন জাতিকে ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা এবং ঈদ মোবারক জানিয়ে।

তিনি বলেন, “আমরা যদি কোরবানির মাহাত্ম্যকে ধারণ করে লোভ, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে নিজেদের নিয়োজিত করতে না পারি, তাহলে কোরবানির ঈদ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

সবশেষে সবাইকে আবার ঈদের শুভেচ্ছা ও সালাম জানিয়ে তিনি ভাষণ শেষ করেন।

ছবি

দেশের মঙ্গলে সবার দোয়া চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

জাতীয় ঈদগাহে ঈদুল আজহার প্রধান জামাত, দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা

আজ ঈদুল আজহা

সব অংশীদারকে এই প্রক্রিয়ায় গঠনমূলকভাবে জড়িত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইইউ

ছবি

সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

দেশজুড়ে ঈদুল আজহার নামাজ কখন কোথায়

ছবি

দীর্ঘ বিরতির পর কোভিডে মৃত্যুর খবর, নতুন শনাক্ত ৩

ছবি

বিচারকদের অপসারণে সংসদের ক্ষমতা নয়, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলই যথার্থ: পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

ছবি

শেখ হাসিনা, মোজাম্মেলসহ ৪০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা

গুমের দ্বিতীয় প্রতিবেদন জমা দিলো কমিশন, ওয়েবসাইট ও বই আকারে প্রকাশের কথা বললেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

একটি বদলির জন্য কোটি টাকা ঘুষের অফার এসেছিল : শিক্ষা উপদেষ্টা

তারাও মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাস পরিবর্তন করা যায় না: উপদেষ্টা

ছবি

কোরবানির পশুর পর্যাপ্ত সরবরাহ, বিক্রি কম

ছবি

কোরবানির পশুর পর্যাপ্ত সরবরাহ, বিক্রি কম

ছবি

আওয়ামী লীগ না থাকলেও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে নির্বাচন: জাতিসংঘ প্রতিনিধি

ছবি

বিআরটিসি “ঈদ স্পেশাল বাস সার্ভিস” এর উদ্ভোধন

ছবি

গুম নিয়ে ওয়েবসাইট ও বই প্রকাশের পরামর্শ, তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা

ছবি

বিদ্যুৎখাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ২০১০ সালের বিশেষ আইন বাতিল: আসিফ মাহমুদ

ছবি

গণভবনে ‘হরর মিউজিয়াম’ করার পরিকল্পনা, গুমের ঘটনায় ১,৮৫০ অভিযোগ

ছবি

মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিলের খবর ‘ভিত্তিহীন’: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়

ছবি

ঈদুল আজহার দিন বন্ধ থাকবে মেট্রোরেল

ছবি

মানবিক করিডোর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সরকার: গোয়েন লুইস

ছবি

শেখ মুজিব ও জাতীয় চার নেতা ‘মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়’ আছেন: মুক্তিযুদ্ধ উপদেষ্টা

ছবি

ভারত থেকে পুশ ইন ফিজিক্যালি ঠেকানো সম্ভব নয়: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

সংজ্ঞায় পরিবর্তন: ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নয়, ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হবেন এমএনএ-এমপিএরা

গুম: হাসিনাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সালাহউদ্দিনের অভিযোগ

টানা ১০ দিন বন্ধ বেনাপোল বন্দরের কার্যক্রম, পাসপোর্টধারীদের যাতায়াত চলবে

ঈদে বাসে ডাকাতি ঠেকাতে যাত্রীদের ছবি তোলা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ: ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’

হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার শুনানি ও আদেশ ১৯ জুন

চাকরি আইন বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে বিক্ষোভ

বাজেট ‘বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের’ অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: সিপিডি

ছবি

সংবিধান সংস্কারে ঐকমত্য গঠনের আলোচনায় আস্থা ভোট নিয়ে মতপার্থক্য

ছবি

আবেদন শুরুর ১২ ঘণ্টার মাথায় ননক্যাডার প্রক্রিয়া স্থগিত করল পিএসসি

ছবি

৪৪ থেকে ৪৮তম বিসিএস পর্যন্ত রোডম্যাপ ঘোষণা করল কমিশন

ছবি

*সরকারি বেতন নিশ্চিতে এনআইডি বাধ্যতামূলক করতে চায় ইসি

tab

জাতীয়

২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো দিন নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫

বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দাবি ও আন্দোলনের চাপে পড়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন তার নির্ধারিত আগামী বছরের জুন থেকে দুই মাস এগিয়ে্ে এপ্রিলে অনুষ্ঠানের ঘোষনা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস।

ঈদুল আজহা উপলক্ষে আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তিনি বলেছেন, “বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।”

ক্ষমতা গ্রহনের কিছুদিন পর থেকে ইউনূস বলে আসছিলেন, নির্বাচন কবে হবে তা নির্ভর করবে সংস্কার কতটা করা হবে তার ওপর। গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার সেরে ডিসেম্বরেই নির্বাচন সম্ভব। আর আরো কিছু সংস্কার করলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে ভোট করা যাবে। তবে নির্বাচন জুনের পরে যাবে না, সেটাও তিনি বলেছেন।

তবে তার এমন পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি হুমকি দেয়, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে এরপর সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। সেনাপ্রধানও একই সময়ে নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন–এমন খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছিল।

তবে জামায়াতে ইসলামী আগামী বছরের এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা সম্ভাব্য যে নতুন সময়সূচি দিলেন, তা জামায়াত আমিরের প্রত্যাশার সঙ্গেই মিলে গেল।

অন্যদিকে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গড়া দল এনসিপি বলে আসছিল আওয়ামী লীগের বিচার এবং সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন তারা চায় না।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইউনূস বলেন, “আমরা যারা এই নির্বাচনে ভোটার হব তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এবং সৌভাগ্যবতী। আমরা একটা অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের সুযোগ ও দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা জাতির নতুন যাত্রাপথ তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টির মহান সুযোগটা পাচ্ছি। আমাদের সুচিন্তিত ভোটের মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশ নির্মিত হবে। শহীদদের রক্তদান সার্থক হবে।

“আশা করি, বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেই সবাই ভোটকেন্দ্রে যাব এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে ভোট দেব। এখন থেকে ভাবনা চিন্তা শুরু করুন। আলোচনা শুরু করুন। এখন থেকে আপনাদের ভোটের গুরুত্বটা বুঝে নিন। আপনার এবারের ভোটের গুরুত্ব ঐতিহাসিক মানদণ্ডে দেখা হবে।”

ছাত্র-জনতার অভ্যুস্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত অগাস্টে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর শুরু হয় ‘সংস্কারের’ কাজ।

গত কয়েক মাসে সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তার ভিত্তিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশনেরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।

কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে অনৈক্য বেড়েছে। দ্রুত নির্বাচনের দাবিও তত বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে।

এর মধ্যেই মিয়ানমারের রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ তৈরির গুঞ্জন আর চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে।

এমনকি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও সেনাসদরের এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন, বন্দর ও করিডোরের বিষয়গুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর আসে।

সব মিলিয়ে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা তৈরি হয় মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে। তার মধ্যে ইউনূসের ‘পদত্যাগের অভিপ্রায়’ ঘিরে উদ্ভব হয় রাজনৈতিক সঙ্কটের।

সেই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে দুই ডজন দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ম্যারাথন বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে দলগুলো ইউনূস সরকারকে সমর্থনের কথা জানালেও যার যার দাবিতে অটল থাকে। তবে ওই আলোচনার পর উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়।

শুক্রবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে বন্দর, করিডোর, নির্বাচনসহ বিতর্কের প্রায় প্রতিটা বিষয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন ইউনূস।

বন্দর নিয়ে জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই আপনারা নিজেদেরকে ভিত্তিহীন বিরোধিতা এবং অপপ্রচারের শিকার হতে দেবেন না।

তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন্দর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগে আপনাদের দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখুন। যারা বিরোধিতা করছে তাদের প্রতিহত করুন।”

আর করিডোর নিয়ে তার ভাষ্য, “আমরা লক্ষ্য করেছি, রাখাইনের জন্য বাংলাদেশ করিডোর দিয়ে দিয়েছে বলে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি, এটি সর্বৈব মিথ্যা। এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প।”

বিচার

ইউনূস তার ভাষণে বলেন, “আমি শুরু থেকেই বলেছি, পতিত স্বৈরাচার বাংলাদেশকে যেভাবে ধ্বংসস্তূপ বানিয়েছে সেখান থেকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হলে ন‍্যূনতম তিনটি আবশ্যিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

“প্রথমত, বিচার ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দৃশ্যমান করে তোলা। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুর্নগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার সাধনে প্রয়োজনীয় ঐক্যমত ও পথনকশা তৈরি করা। তৃতীয়ত, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এ লক্ষ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে সংস্কার করা।”

তিনি বলেন, “এই তিনটি ম‍্যান্ডেট হচ্ছে দেশবাসীর সাথে আমাদের চুক্তি। চব্বিশের শহীদের রক্তেভেজা এই চুক্তি আপনাদের সার্বিক সমর্থন, আস্থা ও সহযোগিতা নিয়ে এবং পতিত শক্তি ও তার দোসরদের সৃষ্ট সকল বাধা-বিপত্তিকে পরাভূত করে আমরা সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”

গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞসহ বিগত ১৬ বছরের গুম-খুন নির্যাতনের ‘সত্য উদঘাটন’ এবং আর্থিক খাতের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া যে সরকার শুরু করেছে, সে কথা ইউনূস তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রসিকিউশন টিম গঠন ও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের পাশাপাশি বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা প্রক্রিয়াধীন ছিল। যত দ্রুত সম্ভব বিচারকাজ শুরুর ব্যাপারে আমরা আশাবাদী ছিলাম। আপনারা জানেন, জুলাইয়ে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিচার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।”

বিচারকাজ যেন দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগিতা দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোনো বিচার পর্ব আদালতের অনুমতিক্রমে সরাসরি কিংবা রেকর্ডকৃত পদ্ধতিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, এতে করে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। বিচার নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ হবে।

“প্রসিকিউশন বলছে, বিগত সরকার পতনের পর তাদের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। থানা, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দলিলপত্র পুড়িয়ে বা লুকিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক স্থাপনার আকার আকৃতি, দেয়াল ইত্যাদি ভেঙে এবং বিকৃত করে প্রমাণ লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন ডিজিটাল এভিডেন্স, যেমন ভিডিও, অডিও, ইন্টারনেট ডেটা যেগুলো ডিলিট বা ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলো রিকভার এবং রেস্টোর করার কাজ করছেন। এ কাজে আমরা দেশবাসীর কাছেও সহযোগিতা কামনা করছি।”

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে ‘রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের জন্য’ বিপুল সংখ্যক মানুষকে গুমের ঘটনা তদন্ত এবং এই ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের জন্য গঠিত কমিশনের কাজের অগ্রগতির তথ্যও ভাষণে তুলে ধরেন ইউনূস।

তিনি বলেন, কমিশন এখন পর্যন্ত দুটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তারা এখনো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিযোগ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে গুমের তদন্ত কার্যক্রমের জন্য ঢাকা শহরের তিনটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় তিনটি গুমের কেন্দ্র পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্তকাজে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা পর্যায়ে গণশুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। মোট আট শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ গণ-শুনানিতে অংশ নিয়েছেন।

“গুম সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে জমা হয়েছে। এছাড়াও এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি।”

জুলাই সনদ

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের সংগঠনগুলো ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। গত ১০ মে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে। তবে ইউনূস তার ভাষণে বলেছেন জুলাইয়ের কথা।

তিনি বলেন, “আগামী জুলাই মাসেই সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে আমরা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারবো বলে আশা করছি।”

তার ভাষায়, “এই জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যেকয়টিতে একমত হয়েছে তার তালিকা থাকবে এই সনদে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে তারা জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।

“জুলাই সনদ অনুযায়ী আশুকরণীয় সংস্কার কাজগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাকি অংশের বেশকিছু কাজও আমরা শুরু করে যেতে চাই। আশা করি, অবশিষ্ট অংশ পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন অব‍্যাহত থাকবে।”

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “এর কোনো বিকল্প নেই। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের কাছে দেশের নতুন ঐক্যবদ্ধ ভাবমূর্তি তুলে ধরা যাবে। বিশ্বব্যাপী সবার কাছে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে।”

ইউনূসের ভাষায়, সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে আনতে ঐকমত্য কমিশন গঠন করা ছিল ‘একটি দুঃসাহসিক উদ্যোগ’।

“অন্য কোনো দেশে এমন কোনো নজির নেই। এর মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে রাজনৈতিক গভীরতার সন্ধান পেয়েছি। রাজনৈতিক ঐক্যে পৌঁছার জন্য ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সকল দলের দলগত প্রস্তুতি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কমিশনের সঙ্গে ঐকান্তিক আলোচনা, জাতীয় লাইভ টেলিভিশনের সামনে সকল দলের ঐকমত্যে পৌঁছার একান্ত প্রয়াস আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

“এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সকল রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের সীমাহীন ধৈর্য এবং কমিশনের প্রতি তাদের সহযোগিতা এবং সৌজন্য প্রকাশের জন্য জাতির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি, আমাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করে জাতির জন্য একটা নতুন পথনির্দেশনা রেখে যেতে পারব।”

এই কমিশনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশে ‘নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখার কথা বলছেন কমিশনের প্রধান ইউনূস।

তিনি বলেন, “আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সেটা বিকাশমানভাবে স্থায়ী রূপ দিতে পারি তাহলে আমরা ভবিষ্যতের সকল রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।

“সকল প্রস্তুতি সমাপ্ত করে দেশের সকল মানুষের- কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক-জেলে, গৃহিনী, দিনমজুর, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিল্পী- সবাই মিলে চেষ্টা করে একটি সুন্দর, নিখুঁত নির্বাচন আয়োজন করে নতুন বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি রচনা করব।”

বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে

বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে

নির্বাচন

ইউনূস বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন কখন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানার জন্য রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে, সে কথা তিনি জাননে।

“আমি বারবার বলেছি এই নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তাই করছে।”

সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে যতবার বাংলাদেশ গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে তার সবগুলোরই প্রধান কারণ ছিল ‘ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন’।

“ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বারবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এই ধরনের নির্বাচন যারা আয়োজন করে তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এমন নির্বাচনের মধ‍্য দিয়ে যে দল ক্ষমতায় আসে তারাও জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকে।”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ সরকারের একটি বড় দায়িত্ব হলো একটি পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ, বিপুলভাবে অংশগ্রহণের পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা যাতে করে দেশ ভবিষ্যতে নতুন সংকটে না পড়ে।

“এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। যেই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সেগুলোতে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ছাত্র-জনতার সকল আত্মত্যাগ বিফলে যাবে।”

সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ জায়গায় পৌঁছনো যাবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

তিনি বলেন, “বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার- যা কি না জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়- সে বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারব। এতে আমাদের ওপর আপনাদের অর্পিত ম্যান্ডেট ন্যূনতম হলেও বাস্তবায়ন করে যেতে পারব।”

ইতিহাসে ‘সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।”

‘অঙ্গীকার আদায় করে নিন’

ইউনূস বলেন, তার সরকার এমন নির্বাচন করতে চায়, যা দেখে অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা ‘শান্তি’ পাবে।

“আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ও দল অংশ নিক। এটা সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতির কাছে স্মরণীয় থাকুক।

“দেড়যুগ পরে দেশে সত্যিকারের একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠিত হবে। বিপুল তরুণ গোষ্ঠী এবার জীবনে প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। এসব লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ।”

দেশবাসীর উদ্দেশে ইউনূস বলেন, “আপনারা সকল রাজনৈতিক দল এবং আপনাদের এলাকার প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন, যেন আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে তা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই যেন তারা অনুমোদন করেন।‌

“আপনারা ওয়াদা আদায় করে নেবেন যে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে কখনো কোনো প্রকার আপস করবেন না এবং দেশের বাইরের কোনো শক্তির কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবেন না।

“আপনারা তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেবেন এই মর্মে যে তারা কখনোই, কোনো অবস্থাতেই আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করবেন না।

“আপনারা তাদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যে তারা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতার সাথে দেশ পরিচালনা করবেন এবং সকল প্রকার দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি গণবিরোধী কাজ থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখবেন।”

ইউনূস বলেন, “আমি আপনাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এবারের নির্বাচন শুধু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয় নয়। এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার নির্বাচন। এই নির্বাচনে পরিচিত দলগুলিই থাকবে। তাদের পরিচিত মার্কাগুলিই থাকবে।

“কিন্তু ভোটারকে বের করে আনতে হবে যে এই মার্কার পেছনে আপনার কাছে ভোটপ্রার্থীরা কে কতটুকু ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার জন্য প্রস্তুত। কে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

‘পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা’ নতুন বাংলাদেশ গড়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অভিযোগ করে ইউনূস বলেন, “আমি আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি, আমরা একটা যুদ্ধাবস্থায় আছি। এখন আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে যেকোনো মূল্যে।

“পরাজিত শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা ওঁৎ পেতে বসে আছে আমাদের ছোবল মারার জন্য, আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়ার জন্য। আমরা তাদের কিছুতেই এই সুযোগ দেব না।”

ইউনূস বলেন, “আসুন, আমরা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার বিরুদ্ধে যে কোনো আঘাত প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে প্রতিরোধের ঐক্যবদ্ধ সুদৃঢ় প্রাচীর গড়ে তুলি।”

প্রধান উপদেষ্টা তার ৩৯ মিনিটের ভাষণ শুরু করেন জাতিকে ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা এবং ঈদ মোবারক জানিয়ে।

তিনি বলেন, “আমরা যদি কোরবানির মাহাত্ম্যকে ধারণ করে লোভ, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে নিজেদের নিয়োজিত করতে না পারি, তাহলে কোরবানির ঈদ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

সবশেষে সবাইকে আবার ঈদের শুভেচ্ছা ও সালাম জানিয়ে তিনি ভাষণ শেষ করেন।

back to top