দেড় মাস ধরে চলা আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধুবাদ জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, যিনি নীতি প্রণয়ন করেন, তিনিই যদি তা বাস্তবায়ন করেন, এটা হলে কর্মকর্তাদের অসৎ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ইতোমধ্যেই অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এসেছে। তাই রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরটি পৃথকীকরণে সৎ ও দক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থার প্রত্যাশা করছেন তারা।
এনবিআর পৃথকীকরণের অধ্যাদেশ বাতিল ও চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে দেড় মাস ধরে আন্দোলন করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। গত শনি ও রোববার দুই দিন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে সারাদেশের রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অচল হয়ে যায়। এতে নড়েচড়ে বসে সরকার।
গত রোববার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আর কোনো বৈঠক হবে না। এবার সরকার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে একটি সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, এনবিআরের চাকরি অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং কাজে যোগ না দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারের কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
সরকারি বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘জাতীয় স্বার্থে আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্য চলমান রাখার স্বার্থে কাস্টম হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনের সব শ্রেণীর চাকরি অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’
এরপর আন্দোলনকারীরা পিছু হটে। গত শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশ চেম্বার
অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ এবং দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদলের নেতারা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘এতদিন নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থের কারণে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। কারণ যে ব্যক্তি কর নির্ধারণ করবেন তিনিই যদি কর আদায় করেন তাহলে এখানে আপোসের সুযোগ তৈরি হয়। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবসায়ী এই বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। তাই এনবিআরকে পৃথক করার সরকারের উদ্যোগ সময়োপযোগী ছিল। এটা করা ছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভবই হতো না।’
সরকারের পক্ষ থেকেও একই যুক্তি তুলে ধরা হয়। এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় টাকা ভাগাভাগি হয় এবং রাষ্ট্র বঞ্চিত হয় জানিয়ে সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নীতি যিনি করেন, বাস্তবায়নও তিনিই করবেন, এটা আসলে হয় না। আজই এক ব্যবসায়ী আমাকে জানালেন, এনবিআরের এক কর্মকর্তা এমন একটি কর ধার্য করলেন, দেখে তিনি ‘হা’ হয়ে গেছেন। কর্মকর্তা নাকি এ-ও বলেছেন, এ টাকা দিতেই হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয়, এনবিআরের কর্মকর্তা করের টাকা কমিয়ে দিতে পারেন। তাহলে কী দাঁড়াল বিষয়টা? যিনি কর ধার্য করলেন, তিনিই আবার তা কমিয়ে দিলেন। অনেক ক্ষেত্রে একধরনের ভাগাভাগি হয়। এতে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার। তবে সবাই যে এমন, তা নয়। এসব কারণেই দুই বিভাগ আলাদা হওয়া জরুরি।’
তবে এনবিআর পৃথকীকরণের অধ্যাদেশের চেয়ে তা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে সেটার ওপর গুরুত্বারোপ করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘যতই ভালো নীতি করা হোক না কেন, সেটা যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে তা কোনো কাজে আসে না। তাই সরকার এনবিআর সংস্কারে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেটা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। যত দেরি হবে তত দেশ পিছিয়ে পড়বে।’
এর মধ্যে আন্দোলনের পর এনবিআরে শুরু হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, বদলি ও তদন্ত-আতঙ্ক। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। কার্যালয়ে গেলেও কাজকর্মে মন নেই অনেকের। তবে গত রোববার রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর অর্থ উপদেষ্টা এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ডরহীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
গত পাঁচ দিনে সব মিলিয়ে এনবিআরের ২ জন সদস্যসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তাদের অধিকাংশই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এ পর্যন্ত তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কাজ বন্ধ রাখার দায়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এদিকে বাংলাদেশের কর-জিডিপি রেশিও অনেক কম। এই রেশিও বৃদ্ধি করতে হলে এনবিআরে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। ইকোনোমিক্সে ১৫ শতাংশ কর-জিডিপি রেশিওকে স্ট্যান্ডার্ড মনে করা হয়। সেখানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি রেশিও মাত্র ৮ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও কর-জিডিপি রেশিও অনেক বেশি। নেপালের কর-জিডিপি রেশিও ২০ শতাংশের ওপরে। ভারতের অবস্থাও তাই। পাকিস্তানের কর-জিডিপি রেশিও প্রায় ১৭ শতাংশের মতো। অর্থাৎ রাজস্ব আহরণে দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বল অর্থনীতিগুলোর চেয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
দেড় মাস ধরে চলা আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধুবাদ জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, যিনি নীতি প্রণয়ন করেন, তিনিই যদি তা বাস্তবায়ন করেন, এটা হলে কর্মকর্তাদের অসৎ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ইতোমধ্যেই অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এসেছে। তাই রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরটি পৃথকীকরণে সৎ ও দক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থার প্রত্যাশা করছেন তারা।
এনবিআর পৃথকীকরণের অধ্যাদেশ বাতিল ও চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে দেড় মাস ধরে আন্দোলন করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। গত শনি ও রোববার দুই দিন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে সারাদেশের রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অচল হয়ে যায়। এতে নড়েচড়ে বসে সরকার।
গত রোববার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আর কোনো বৈঠক হবে না। এবার সরকার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে একটি সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, এনবিআরের চাকরি অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং কাজে যোগ না দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারের কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
সরকারি বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘জাতীয় স্বার্থে আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্য চলমান রাখার স্বার্থে কাস্টম হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনের সব শ্রেণীর চাকরি অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’
এরপর আন্দোলনকারীরা পিছু হটে। গত শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশ চেম্বার
অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ এবং দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদলের নেতারা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘এতদিন নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থের কারণে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। কারণ যে ব্যক্তি কর নির্ধারণ করবেন তিনিই যদি কর আদায় করেন তাহলে এখানে আপোসের সুযোগ তৈরি হয়। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবসায়ী এই বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। তাই এনবিআরকে পৃথক করার সরকারের উদ্যোগ সময়োপযোগী ছিল। এটা করা ছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভবই হতো না।’
সরকারের পক্ষ থেকেও একই যুক্তি তুলে ধরা হয়। এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় টাকা ভাগাভাগি হয় এবং রাষ্ট্র বঞ্চিত হয় জানিয়ে সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নীতি যিনি করেন, বাস্তবায়নও তিনিই করবেন, এটা আসলে হয় না। আজই এক ব্যবসায়ী আমাকে জানালেন, এনবিআরের এক কর্মকর্তা এমন একটি কর ধার্য করলেন, দেখে তিনি ‘হা’ হয়ে গেছেন। কর্মকর্তা নাকি এ-ও বলেছেন, এ টাকা দিতেই হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয়, এনবিআরের কর্মকর্তা করের টাকা কমিয়ে দিতে পারেন। তাহলে কী দাঁড়াল বিষয়টা? যিনি কর ধার্য করলেন, তিনিই আবার তা কমিয়ে দিলেন। অনেক ক্ষেত্রে একধরনের ভাগাভাগি হয়। এতে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার। তবে সবাই যে এমন, তা নয়। এসব কারণেই দুই বিভাগ আলাদা হওয়া জরুরি।’
তবে এনবিআর পৃথকীকরণের অধ্যাদেশের চেয়ে তা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে সেটার ওপর গুরুত্বারোপ করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘যতই ভালো নীতি করা হোক না কেন, সেটা যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে তা কোনো কাজে আসে না। তাই সরকার এনবিআর সংস্কারে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেটা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। যত দেরি হবে তত দেশ পিছিয়ে পড়বে।’
এর মধ্যে আন্দোলনের পর এনবিআরে শুরু হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, বদলি ও তদন্ত-আতঙ্ক। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। কার্যালয়ে গেলেও কাজকর্মে মন নেই অনেকের। তবে গত রোববার রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর অর্থ উপদেষ্টা এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ডরহীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
গত পাঁচ দিনে সব মিলিয়ে এনবিআরের ২ জন সদস্যসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তাদের অধিকাংশই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এ পর্যন্ত তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কাজ বন্ধ রাখার দায়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এদিকে বাংলাদেশের কর-জিডিপি রেশিও অনেক কম। এই রেশিও বৃদ্ধি করতে হলে এনবিআরে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। ইকোনোমিক্সে ১৫ শতাংশ কর-জিডিপি রেশিওকে স্ট্যান্ডার্ড মনে করা হয়। সেখানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি রেশিও মাত্র ৮ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও কর-জিডিপি রেশিও অনেক বেশি। নেপালের কর-জিডিপি রেশিও ২০ শতাংশের ওপরে। ভারতের অবস্থাও তাই। পাকিস্তানের কর-জিডিপি রেশিও প্রায় ১৭ শতাংশের মতো। অর্থাৎ রাজস্ব আহরণে দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বল অর্থনীতিগুলোর চেয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।