একমুখী চুলায় মাসে ২০০০ টাকা, দ্বিমুখী চুলায় ২১০০ টাকা
গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম ‘এক লাফে’ দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রাষ্ট্রীয় গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। তাদের প্রস্তাবে আবাসিক খাতে (বাসা-বাড়িতে) রান্নার জন্য ব্যবহৃত একমুখী চুলায় (সিঙ্গেল বার্নার) মাসিক বিল দুই হাজার টাকা এবং দ্বিমুখী চুলায় (ডাবল বার্নার) দুই হাজার ১০০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে; বর্তমানে মাসিক বিল যথাক্রমে ৯২৫ ও ৯৭৫ টাকা। বিদ্যুৎ, সার, শিল্প, সিএনজি, চা বাগানসহ সব খাতেই দাম দ্বিগুণ
গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবে বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, বিশ্ব বাজারে এলএনজির দাম অনেক বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে দেশি-বিদেশি গ্যাস কেনা ও সরবরাহ, পরিচালন ব্যয়, ভ্যাট-ট্যাক্স এবং নানা চার্জ বিগত অর্থবছরের চেয়ে অনেক বেশি বলে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে।
আবাসিকে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি করতে সরকারি কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে অবাক সচেতন নাগরিকরা; ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ গ্রাহক। কেউ কেউ বলছেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? এক লাফে ডাবল!’
জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির কারণেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আসছে। তারা বলছেন, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদনে যথাযথ নজর না দিয়ে আমদানি নির্ভরতায় গুরুত্ব দেয়ার কারণেই জ্বালানি খাতে বিপর্যয় নেমে আসছে। তা না হলে, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নিয়ামক এবং জনগণের নিত্য ব্যবহার্য কোন পণ্যের মূল্য এক ধাপে দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে আসে কী করে!
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম সোমাবর (১৮ জানুয়ারি) রাতে সংবাদকে বলেন, কোম্পানির সর্বোচ্চ স্তরে আমলারা বসে আছেন। তারাই আমদানি নির্ভরতা বাড়াচ্ছেন। ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির কারণে বছর বছর গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব নেই। কয়লা মাটির নিচে পড়ে আছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ক্ষমতা কমিশনকে না দিয়ে অবৈধভাবে নিজেদের হাতে রেখেছে মন্ত্রণালয়। দেশীয় প্রাকৃতিক সম্পদের সাশ্রয়ী ব্যবহার; বঙ্গবন্ধুর যে ভিশন, তার থেকে দেশকে দূরে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সংবাদের এক প্রশ্নের জবাবে এম শামসুল আলম বলেন, এলপি গ্যাসের বাজার প্রমোট করার একটা বিষয়ও এখানে কাজ করছে। আবাসিক খাতে গ্যাসের দাম অনেকটা বাড়ানো গেলে এলপি গ্যাস ব্যবসায়ীদের সুবিধা। এ কারণেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
গ্যাসের দাম বাড়াতে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব সম্পর্কে ভোক্তা পর্যায়ের অনেকের সঙ্গে কথা হয় সংবাদের। মাতুয়াইলের বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, ‘এটা কী মগের মুল্লুক নাকি? যা চাইবে তাই হবে! কোন পণ্যের দাম এক লাফে ডাবল হয় কি করে?
মগবাজারের মনির হোসেন বলেন, কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের খবর নিয়ে দেখেন। বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সার কোন অভাব নাই। তারা আছে গরিব মারার তালে। আরে ভাই ঢাকায় নিম্ন আয়ের এমন অনেক পরিববার আছে, যারা তিন হাজার টাকার রুমে ভাড়া থাকে। ৯৭৫ টাকা গ্যাস বিল দিতেই তাদের কষ্ট হয়। এখন দুই হাজার করা হলে তাদের কী হবে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে সংবাদের কথা হয়। আবাসিক খাতে দ্বিগুণের বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করেন অনেকে।
দলটির সাবেক এক সহসম্পাদক বলেন, ‘রান্নার গ্যাসের দাম এত বাড়ানো, কার স্বার্থে? কিছু ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে, জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ সরকারের সুনাম নষ্টের পাঁয়তারা এটা।’
নির্ভরযোগ সূত্রে জানা গেছে, ‘ভর্তুকির চাপ’ সামলাতে ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরামর্শ দেয় ‘আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পাঠাতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেয়।
পরে পেট্রোবাংলা থেকে আমদানি করা এলএনজি ও দেশীয় গ্যাসের দাম, ভ্যাট-ট্যাক্স, বিভিন্ন তহবিলের চার্জ ধরে একটা খসড়া হিসাব বিতরণ কোম্পানিগুলোতে ৫ জানুয়ারি পাঠানো হয়। এরপর বিতরণ কোম্পানিগুলো নিজেদের আয়-ব্যয় হিসাব উল্লেখ করে প্রায় একই ধরনের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠায়। একই সঙ্গে কোম্পানিগুলো নিজেদের পরিচালন ব্যয় (মার্জিন) বৃদ্ধিরও প্রস্তাব দেয়।
ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে এ পর্যন্ত তিতাস, বাখরাবাদ, পশ্চিমাঞ্চলসহ চারটি গ্যাস কোম্পানি বিইআরসিতে পৃথক প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এ সপ্তাহে অন্য কোম্পানিগুলো তাদের প্রস্তাব জমা দেবে বলে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে।
চারটি বিতরণ কোম্পনির গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দিয়েছে জানিয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল সোমবার সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, ‘প্রথমে পেট্রোবাংলা কমিশনে আবেদন করেছিল। আমরা বলেছি, লাইসেন্সিদের (বিতরণ কোম্পানি) আবেদন করতে হবে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলো আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাদের প্রস্তাব অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ হয়নি। আইনগত কিছু ভুল ছিল। কিছু তথ্য কম ছিল। আমরা যেদিন প্রস্তাব হাতে পেয়েছি, সেদিনই যাচাই করে ভুলগুলো ঠিক করে তথ্য সংযোজন করে পাঠাতে বলেছি।’
প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়বে কিনা, বাড়লে কতদিনের মধ্যে বাড়বে? এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল জলিল বলেন, ‘সবার প্রস্তাব আসলে সেগুলো টেকনিক্যাল কমিটি যাচাই-বাছাই করবে। এরপর আইন অনুযায়ী গণশুনানির আয়োজন করা হবে। সবকিছু আইন অনুযায়ী হবে।
বিইআরসির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘আসলে কোম্পানিগুলো চাইলেই তো আর গ্যাসের দাম ডাবল হবে না। প্রস্তাবের ভিত্তি কী সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করা হবে। এর আগেও তারা বেশি পরিমাণ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে কমিশন পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে শুনানি করে সীমিতই দাম বাড়িয়েছিল।
কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ ও সারে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার চার টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা (১২৫%) করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। শিল্পে ব্যবহৃত ক্যাপটিভে দাম ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা (১১৬) এবং শিল্পে ও চা বাগানে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা (১১৬%) করার প্রস্তাব এসেছে।
হোটেল-রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে ৫০ টাকা (১১৭%), ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭ টাকা চার পয়সা থেকে ৩৭ টাকা দুই পয়সা (১১৭%), সিএনজিতে ৩৫ টাকা থেকে ৭৫-৭৬ টাকা (১১৪%) এবং আবাসিক মিটারে ১২ টাকা ৬০২ পয়সা থেকে ২৭ টাকা ৩৭ পয়সা (১১৫%) করার প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। একই সঙ্গে তিতাস তার পরিচালন মার্জিন ২৫ পয়সা থেকে বড়িয়ে ৩৮ পয়সা, জালালাবাদ ৫৫.১৮ পয়সা এবং বাখরাবাদ ২৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৬.৮৪ পয়সা করার আবেদন করেছে।
২০১৯ সালের ১ জুলাই সর্বশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। তখন আবাসিক খাতে দুই চুলার খরচ ৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা করা হয়। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, ক্যাপটিভ পাওয়ার, শিল্প ও চা বাগানে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম গড়ে ৩২.০৮ শতাংশ বাড়ানো হয়।
দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে কোম্পানিগুলোর যুক্তি
এবার বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের প্রস্তাবে মূল্য নির্ধারণের ব্যাখ্যায় বলেছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে দেশি-বিদেশি গ্যাস কেনা ও সরবরাহ, পরিচালন ব্যয়, ভ্যাট-ট্যাক্স এবং নানা চার্জ মিলিয়ে ৬৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
এর মধ্যে বছরে ৮৭৮ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানিতে ৪৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটার এলএনজিতে ব্যয় ৫০ টাকা ৩৮ পয়সা, যার মধ্যে ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা ৬৯ পয়সা, আমদানি পর্যায়ে মূসক পাঁচ টাকা ৫০ পয়সা, অগ্রিম আয়কর ৭৪ পয়সা, ফাইন্যান্সিং ব্যয় এক টাকা ৪৪ পয়সা, ব্যাংক চার্জ ও কমিশন ৫৯ পয়সা, রিগ্যাসিফিকেশন ব্যয় এক টাকা ৮৬ পয়সা, অপারেশনাল ব্যয় পাঁচ পয়সা এবং ভোক্তা পর্যায়ে উৎসে কর তিন টাকা ৫২ পয়সা (৭ শতাংশ)।
দেশে যেসব বিদেশি গ্যাস কোম্পানি (আইওসি) গ্যাস উত্তোলন করছে, তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনতে ব্যয় হবে প্রতি ঘনমিটারে দুই টাকা ৯১ পয়সা। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফএল) এবং বাপেক্সের পরিচলন ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৮৭.৯৮ পয়সা, ৩৩.৮৩ পয়সা এবং চার টাকা ৫৫ পয়সা।
এছাড়া প্রতি ঘনমিটারে পরিচলন মার্জিন সঞ্চালন কোম্পানির (জিটিসিএল) ৮৬.৪৮ পয়সা, বিতরণ কোম্পানির ২৭.৪৯ পয়সা ধরা হয়েছে। প্রতি ঘনমিটারে পেট্রোবাংলার পরিচলন ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় পয়সা, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে ৪৬.১৪ পয়সা এবং জ্বালানি উন্নয়ন তহবিলে ৮৮.৭০ পয়সা চার্জ ধরা হয়েছে। সরকারের হিস্যা হিসাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়েছে।
দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখন পাওয়া যাচ্ছে ২৩৩ কোটি ঘনফুট। বঙ্গোপসাগরে থাকা দুটি ভাসমান এলএনজি প্রক্রিয়াকরণ টার্মিনালের মাধ্যমে পাওয়া যায় ৬০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। পেট্রোবাংলার বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২০) অনুযায়ী, উৎপাদিত ও আমদানিকৃত গ্যাসের মধ্যে বিদ্যুতে ব্যবহৃত হয় ৪৫.৯ শতাংশ, সারে ৫.৫ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.২ শতাংশ, শিল্পে ১৫.৭ শতাংশ, বাণিজ্যিকে ০.৭ শতাংশ সিএনজিতে ৩.৬ শতাংশ. বাসাবাড়িতে ১৩.৩ শতাংশ এবং চা বাগানে ০.১ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
পেট্রোবাংলার অধীনে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৯টি। সবাইকে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে পারলে অনেক গ্যাস সাশ্রয় হয় জানিয়ে বিইআরসির দ্রুত সবাইকে পিপ্রেইড মিটার দিতে কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয়। তবে এখনো ৯১ শতাংশের বেশি গ্রাহকে প্রি-পেইড মিটার পাননি। এদিকে রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে কয়েক লাখ অবৈধ সংযোগ রয়ে গেছে, যা পুরোপুরি উচ্ছেদ করা যায়নি।
একমুখী চুলায় মাসে ২০০০ টাকা, দ্বিমুখী চুলায় ২১০০ টাকা
মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২২
গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম ‘এক লাফে’ দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রাষ্ট্রীয় গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। তাদের প্রস্তাবে আবাসিক খাতে (বাসা-বাড়িতে) রান্নার জন্য ব্যবহৃত একমুখী চুলায় (সিঙ্গেল বার্নার) মাসিক বিল দুই হাজার টাকা এবং দ্বিমুখী চুলায় (ডাবল বার্নার) দুই হাজার ১০০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে; বর্তমানে মাসিক বিল যথাক্রমে ৯২৫ ও ৯৭৫ টাকা। বিদ্যুৎ, সার, শিল্প, সিএনজি, চা বাগানসহ সব খাতেই দাম দ্বিগুণ
গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবে বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, বিশ্ব বাজারে এলএনজির দাম অনেক বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে দেশি-বিদেশি গ্যাস কেনা ও সরবরাহ, পরিচালন ব্যয়, ভ্যাট-ট্যাক্স এবং নানা চার্জ বিগত অর্থবছরের চেয়ে অনেক বেশি বলে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে।
আবাসিকে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি করতে সরকারি কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে অবাক সচেতন নাগরিকরা; ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ গ্রাহক। কেউ কেউ বলছেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? এক লাফে ডাবল!’
জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির কারণেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আসছে। তারা বলছেন, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদনে যথাযথ নজর না দিয়ে আমদানি নির্ভরতায় গুরুত্ব দেয়ার কারণেই জ্বালানি খাতে বিপর্যয় নেমে আসছে। তা না হলে, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নিয়ামক এবং জনগণের নিত্য ব্যবহার্য কোন পণ্যের মূল্য এক ধাপে দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে আসে কী করে!
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম সোমাবর (১৮ জানুয়ারি) রাতে সংবাদকে বলেন, কোম্পানির সর্বোচ্চ স্তরে আমলারা বসে আছেন। তারাই আমদানি নির্ভরতা বাড়াচ্ছেন। ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির কারণে বছর বছর গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব নেই। কয়লা মাটির নিচে পড়ে আছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ক্ষমতা কমিশনকে না দিয়ে অবৈধভাবে নিজেদের হাতে রেখেছে মন্ত্রণালয়। দেশীয় প্রাকৃতিক সম্পদের সাশ্রয়ী ব্যবহার; বঙ্গবন্ধুর যে ভিশন, তার থেকে দেশকে দূরে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সংবাদের এক প্রশ্নের জবাবে এম শামসুল আলম বলেন, এলপি গ্যাসের বাজার প্রমোট করার একটা বিষয়ও এখানে কাজ করছে। আবাসিক খাতে গ্যাসের দাম অনেকটা বাড়ানো গেলে এলপি গ্যাস ব্যবসায়ীদের সুবিধা। এ কারণেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
গ্যাসের দাম বাড়াতে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব সম্পর্কে ভোক্তা পর্যায়ের অনেকের সঙ্গে কথা হয় সংবাদের। মাতুয়াইলের বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, ‘এটা কী মগের মুল্লুক নাকি? যা চাইবে তাই হবে! কোন পণ্যের দাম এক লাফে ডাবল হয় কি করে?
মগবাজারের মনির হোসেন বলেন, কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের খবর নিয়ে দেখেন। বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সার কোন অভাব নাই। তারা আছে গরিব মারার তালে। আরে ভাই ঢাকায় নিম্ন আয়ের এমন অনেক পরিববার আছে, যারা তিন হাজার টাকার রুমে ভাড়া থাকে। ৯৭৫ টাকা গ্যাস বিল দিতেই তাদের কষ্ট হয়। এখন দুই হাজার করা হলে তাদের কী হবে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে সংবাদের কথা হয়। আবাসিক খাতে দ্বিগুণের বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করেন অনেকে।
দলটির সাবেক এক সহসম্পাদক বলেন, ‘রান্নার গ্যাসের দাম এত বাড়ানো, কার স্বার্থে? কিছু ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে, জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ সরকারের সুনাম নষ্টের পাঁয়তারা এটা।’
নির্ভরযোগ সূত্রে জানা গেছে, ‘ভর্তুকির চাপ’ সামলাতে ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরামর্শ দেয় ‘আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পাঠাতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেয়।
পরে পেট্রোবাংলা থেকে আমদানি করা এলএনজি ও দেশীয় গ্যাসের দাম, ভ্যাট-ট্যাক্স, বিভিন্ন তহবিলের চার্জ ধরে একটা খসড়া হিসাব বিতরণ কোম্পানিগুলোতে ৫ জানুয়ারি পাঠানো হয়। এরপর বিতরণ কোম্পানিগুলো নিজেদের আয়-ব্যয় হিসাব উল্লেখ করে প্রায় একই ধরনের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠায়। একই সঙ্গে কোম্পানিগুলো নিজেদের পরিচালন ব্যয় (মার্জিন) বৃদ্ধিরও প্রস্তাব দেয়।
ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে এ পর্যন্ত তিতাস, বাখরাবাদ, পশ্চিমাঞ্চলসহ চারটি গ্যাস কোম্পানি বিইআরসিতে পৃথক প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এ সপ্তাহে অন্য কোম্পানিগুলো তাদের প্রস্তাব জমা দেবে বলে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে।
চারটি বিতরণ কোম্পনির গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দিয়েছে জানিয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল সোমবার সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, ‘প্রথমে পেট্রোবাংলা কমিশনে আবেদন করেছিল। আমরা বলেছি, লাইসেন্সিদের (বিতরণ কোম্পানি) আবেদন করতে হবে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলো আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাদের প্রস্তাব অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ হয়নি। আইনগত কিছু ভুল ছিল। কিছু তথ্য কম ছিল। আমরা যেদিন প্রস্তাব হাতে পেয়েছি, সেদিনই যাচাই করে ভুলগুলো ঠিক করে তথ্য সংযোজন করে পাঠাতে বলেছি।’
প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়বে কিনা, বাড়লে কতদিনের মধ্যে বাড়বে? এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল জলিল বলেন, ‘সবার প্রস্তাব আসলে সেগুলো টেকনিক্যাল কমিটি যাচাই-বাছাই করবে। এরপর আইন অনুযায়ী গণশুনানির আয়োজন করা হবে। সবকিছু আইন অনুযায়ী হবে।
বিইআরসির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘আসলে কোম্পানিগুলো চাইলেই তো আর গ্যাসের দাম ডাবল হবে না। প্রস্তাবের ভিত্তি কী সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করা হবে। এর আগেও তারা বেশি পরিমাণ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে কমিশন পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে শুনানি করে সীমিতই দাম বাড়িয়েছিল।
কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ ও সারে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার চার টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা (১২৫%) করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। শিল্পে ব্যবহৃত ক্যাপটিভে দাম ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা (১১৬) এবং শিল্পে ও চা বাগানে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা (১১৬%) করার প্রস্তাব এসেছে।
হোটেল-রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে ৫০ টাকা (১১৭%), ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭ টাকা চার পয়সা থেকে ৩৭ টাকা দুই পয়সা (১১৭%), সিএনজিতে ৩৫ টাকা থেকে ৭৫-৭৬ টাকা (১১৪%) এবং আবাসিক মিটারে ১২ টাকা ৬০২ পয়সা থেকে ২৭ টাকা ৩৭ পয়সা (১১৫%) করার প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। একই সঙ্গে তিতাস তার পরিচালন মার্জিন ২৫ পয়সা থেকে বড়িয়ে ৩৮ পয়সা, জালালাবাদ ৫৫.১৮ পয়সা এবং বাখরাবাদ ২৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৬.৮৪ পয়সা করার আবেদন করেছে।
২০১৯ সালের ১ জুলাই সর্বশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। তখন আবাসিক খাতে দুই চুলার খরচ ৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা করা হয়। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, ক্যাপটিভ পাওয়ার, শিল্প ও চা বাগানে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম গড়ে ৩২.০৮ শতাংশ বাড়ানো হয়।
দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে কোম্পানিগুলোর যুক্তি
এবার বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের প্রস্তাবে মূল্য নির্ধারণের ব্যাখ্যায় বলেছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে দেশি-বিদেশি গ্যাস কেনা ও সরবরাহ, পরিচালন ব্যয়, ভ্যাট-ট্যাক্স এবং নানা চার্জ মিলিয়ে ৬৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
এর মধ্যে বছরে ৮৭৮ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানিতে ৪৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটার এলএনজিতে ব্যয় ৫০ টাকা ৩৮ পয়সা, যার মধ্যে ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা ৬৯ পয়সা, আমদানি পর্যায়ে মূসক পাঁচ টাকা ৫০ পয়সা, অগ্রিম আয়কর ৭৪ পয়সা, ফাইন্যান্সিং ব্যয় এক টাকা ৪৪ পয়সা, ব্যাংক চার্জ ও কমিশন ৫৯ পয়সা, রিগ্যাসিফিকেশন ব্যয় এক টাকা ৮৬ পয়সা, অপারেশনাল ব্যয় পাঁচ পয়সা এবং ভোক্তা পর্যায়ে উৎসে কর তিন টাকা ৫২ পয়সা (৭ শতাংশ)।
দেশে যেসব বিদেশি গ্যাস কোম্পানি (আইওসি) গ্যাস উত্তোলন করছে, তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনতে ব্যয় হবে প্রতি ঘনমিটারে দুই টাকা ৯১ পয়সা। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফএল) এবং বাপেক্সের পরিচলন ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৮৭.৯৮ পয়সা, ৩৩.৮৩ পয়সা এবং চার টাকা ৫৫ পয়সা।
এছাড়া প্রতি ঘনমিটারে পরিচলন মার্জিন সঞ্চালন কোম্পানির (জিটিসিএল) ৮৬.৪৮ পয়সা, বিতরণ কোম্পানির ২৭.৪৯ পয়সা ধরা হয়েছে। প্রতি ঘনমিটারে পেট্রোবাংলার পরিচলন ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় পয়সা, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে ৪৬.১৪ পয়সা এবং জ্বালানি উন্নয়ন তহবিলে ৮৮.৭০ পয়সা চার্জ ধরা হয়েছে। সরকারের হিস্যা হিসাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়েছে।
দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখন পাওয়া যাচ্ছে ২৩৩ কোটি ঘনফুট। বঙ্গোপসাগরে থাকা দুটি ভাসমান এলএনজি প্রক্রিয়াকরণ টার্মিনালের মাধ্যমে পাওয়া যায় ৬০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। পেট্রোবাংলার বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২০) অনুযায়ী, উৎপাদিত ও আমদানিকৃত গ্যাসের মধ্যে বিদ্যুতে ব্যবহৃত হয় ৪৫.৯ শতাংশ, সারে ৫.৫ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.২ শতাংশ, শিল্পে ১৫.৭ শতাংশ, বাণিজ্যিকে ০.৭ শতাংশ সিএনজিতে ৩.৬ শতাংশ. বাসাবাড়িতে ১৩.৩ শতাংশ এবং চা বাগানে ০.১ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
পেট্রোবাংলার অধীনে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৯টি। সবাইকে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে পারলে অনেক গ্যাস সাশ্রয় হয় জানিয়ে বিইআরসির দ্রুত সবাইকে পিপ্রেইড মিটার দিতে কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয়। তবে এখনো ৯১ শতাংশের বেশি গ্রাহকে প্রি-পেইড মিটার পাননি। এদিকে রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে কয়েক লাখ অবৈধ সংযোগ রয়ে গেছে, যা পুরোপুরি উচ্ছেদ করা যায়নি।