alt

জাতীয়

রানা প্লাজা : সেই বিভীষিকা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় ইয়াসমিন, রুবি, জেসমিনদের

জাহিদা পারভেজ ছন্দা : শনিবার, ২৩ এপ্রিল ২০২২

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, অন্য দিনের মতোই কর্মচঞ্চল আলো ঝলমলে ছিল দিনটা। প্রতিদিনের মতোই সাভারের রানা প্লাজার আটতলা ভবনজুড়ে ছিল কর্মব্যস্ততা। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট শব্দ আর প্রচন্ড ঝাকুনি দিয়ে মুহূর্তেই পুরো ভবনটি ধসে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভবনের কয়েকটি তলা মাটির নিচে চলে যায়।

এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় দুই হাজার ৪৩৮ জনকে। নিখোঁজ হন ১৮২ জন শ্রমিক। দেশের গার্মেন্ট খাতে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিগুলোর একটি সাভারের এই রানা প্লাজা ধস।

সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় রানা প্লাজায় কাজ করা শ্রমিকদের, তাদের স্বজনদের। আজও অনেকে ঘুমাতে পারেন না। ৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া বিভীষিকার সেই সকাল আজও তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের।

রানা প্লাজায় একটি তৈরি পোশাকের কারখানায় কাজ করতেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইয়াসমিন বেগম। ২০০৯ এ অপারেটর হিসেবে কাজে যোগ দেন। এক মেয়ে মমতা আর ছেলে বাবুকে নিয়ে সংসার বেশ গুছিয়ে ফেলেছিলেন। স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করেছিল। কয়েক বছরের একটু একটু করে বোনা স্বপ্ন নিমিষেই চুরমার হয়ে যায়।

ওই দিনের ভয়াবহতা আজও ঘুমাতে দেয় না ইয়াসমিনকে। সেদিনের বিকট শব্দ, আর্তচিৎকার আজও তার কানে বাজে। আজও কুঁকড়ে ওঠেন ওইদিনের কথা মনে করে।

তিনি বলেন, ‘ঘুমাইলে মনে হয় বিল্ডিং ভাইঙা পড়তাছে। আবার কখনো মনে হয় নদীতে পাইড়া যাইতাছি। বড়, উচা বিল্ডিং দেখলেই এহন ভয় লাগে। আমি ভালো নাই। বুকে ব্যথা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বইলে আর দাঁড়াইতে পারি না। মাথা ঝিম ঝিম করে। কতো স্বপ্ন আছিল, পোলা মাইয়ারে লেখাপড়া করায়া ভালো চাকরি করামু। সব শ্যাষ হয়া গেছে আমগোর। অভাবের কারণে ছোট বয়সে মেয়ের বিয়া দিয়া দিছি। মেয়েটার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা ছিল। ছেলেটার বই-খাতা কিন্যা দিতে পারি না। এখন এই পঙ্গু জীবন বোঝা হয়া গেছে। আমি যখন কাজ করতাম তখন অভাব ছিল না। সুখেই ছিলাম’

ইয়াসমিন আবারো কাজ করতে চান। তার কথায়, ‘সাহস কইরা আবার গার্মেন্টে ঢুকছিলাম, কিন্তু কাজ করতে পারি না। ভয় লাগে, বুক ধরফর করে, মাথা ঘুরায়।’

প্রতি মাসে সাভারের সিআরপি থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ আনেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বামী পাকিজা টেক্সটাইলে হেলপারের কাজ করে। শাশুড়ি আর ছেলে নিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনেক কষ্টে আছি। কাজ দিলেও করতে পারি না। আর দেশে বেশি কাম কাজও নাই। এহন ভাবি, এত কষ্টের চাইতে মরাই ভালো ছিল।’ ছেলেকে নিয়ে সাভারে থাকেন মোছাম্মৎ জেসমিন। ওইদিনের কথা বলতে গেলে আজও গা শিউড়ে ওঠে তার। ‘ওইদিন যখন জ্ঞান ফিরছে তখন দেখি মাথা ব্যান্ডেজ করা। আমি হাসপাতালে। নড়তে চড়তে পারি না। ডাক্তার কয় আমার মেরুদন্ডের হাড় ফাইটা গেছে। সেই থিক্যা আমি অসুস্থ। খুবই অসুস্থ্। মাথায় আঘাত পাওনে বেশিক্ষণ তাকায় থাকতে পারি না। বেশিক্ষণ বইসা থাকলে পা ফুইলা যায়। পা ফেলাইতে পারি না। আমার এই অবস্থা দেইখা আমার স্বামী আমারে আর পোলারে ছাইড়া চইলা গেছে।’

সাভারে বড় বোনের বাসায় থাকেন জেসমিন। মাসে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। মাঝে মাঝে ওষুধ কিনতে পারেন না বলে ছেদ পড়ে চিকিৎসায়।

তিনি বলেন, ‘চেষ্টা করছিলাম কাজে যোগ দেওনের। কিন্তু এত শরীর খারাপ লাগে। বাসার কাজই করতে পারি না অনেক সময়। এহনো ঠিকমতো শান্তি কইরা ঘুমাইতে পারি না। ঘুমের ওষুধ খাওন লাগে। এহনো ভয় লাগে। মনে হয় বিল্ডিং ভাইঙা পড়বো।’

রুবি বেগম শারীরিক, মানসিক নানা সমস্যায় ভুগছেন। একটা প্রশ্ন করলে আরেকটা উত্তর দেন। কখনো গুছিয়ে কথা বলেন তো কখনো এলোমেলো। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর ধীর ধীরে তিনি যেন বাস্তবে ফেরেন। বেশিরভাগ সময় কথার জবাব দেন ‘হ্যাঁ’, ‘হুম’, ‘না’ শব্দে। আবার কখনো উত্তরই দিচ্ছিলেন না। তার সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কথা বলার পর স্ববাভিকভাবে কথা বলেন রানা প্লাজায় আহত রুবি বেগম।

কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই আস্তে করে বলেন, ‘ভালো নাই। পা আর বুকে ব্যথা, কষ্ট।’ পাকিজা টেক্সটাইলের কাছে থাকেন রুবি। তার শারীরিক মানসিক অবস্থার কারণে একমাত্র মেয়েকে গ্রামে দাদুর কাছে রেখে এসেছেন। স্বামী তার সঙ্গে থাকেন ঠিকই, কিন্তু ভরণ-পোষণে চরম উদাসীন।

এজন্য রুবি আবারো কাজ করতে চান। আবারো মেশিনের খটাখট শব্দে মাততে চান। ব্যস্ততা চান। কিন্তু শরীর আর মন সায় দেয় না। যখন একটু সুস্থ মনে হয়, ভালো লাগে, কাজ করতে ছুটে যান। তবে রুবি বললেন পনেরো-কুড়ি দিন কোনভাবে কাজ করতে পারেন কিন্তু তারপরই ‘পইড়া যাই, পা ফুইলা যায়, মাথা বনবন করে। কিচ্ছু মনে থাকে না। কিছু বালা লাগে না।’ কেঁদে ফেলেন রুবি। আর বার বার বলতে থাকেন ‘মরলেই বালা আছিলো।’

তাদের সবার অভিযোগ, ঘটনার পর পরই কেউ কেউ খোঁজখবর করলেও এখন আর কেউই তাদের কোন খোঁজ নেন না। পরিবার আজ তাদের বোঝা মনে করে।

ইয়াসমিন, জেসমিন, রুবির মতো অনেকেই তাদের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা পাড়ি দিচ্ছেন বলে জানান তারা। মানবেতর জীবন তাদের।

স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের অনেকেই কিছু কিছু সহায়তা পেলেও ইয়াসমিন, জেসমিন বা রুবি কেউই কোন সহায়তা পাননি।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের নিয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এ মাসের ১৮ এপ্রিল একটা জরিপ প্রকাশ করে। এই জরিপ থেকে জানা যায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৫৬.৫ শতাংশের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে যা গত বছর ছিল ১৪ শতাংশ।

গত বছরগুলোতে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হলেও এ বছর অবনতি ঘটেছে। গতবছর যেখানে মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত ছিলেন ১২.৫ শতাংশ, এ বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮.৫ শতাংশে। ৩১ শতাংশ বলেছেন তাদের মানসিক অবস্থা ‘প্রায় স্থিতিশীল’ এবং ২০.৫ শতাংশ ‘সম্পূর্ণ স্থিতিশীল’।

রানা প্লাজায় দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৩ শতাংশ বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৪৭ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থানে নিযুক্ত রয়েছেন। এদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ বলেছেন শারীরিক অক্ষমতার কারণে তারা কাজ করতে পারেন না এবং ১০ শতাংশ এখনও মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বেঁচে যাওয়া ২০০ জনকে নিয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এই জরিপ করে।

রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর দেশের প্রায় প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই নড়েচড়ে বসে। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিরাপদ রাখতে আন্দোলন শুরু করে। ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার পাশাপাশি নিহত ও আহতদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিও করে তারা।

ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার পর সরকারসহ অনেকেই আহত নিহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি অভিযোগ এনে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘রানা প্লাজার এখনও অনেক শ্রমিক রয়েছে যারা ক্ষতিপূরণ পায়নি। সরকার তাদের কোন কমিটমেন্ট পূরণ করেনি। দ্রুত ওইসব শ্রমিকদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।’

এছাড়া সরকার সোহেল রানার যেসব সম্পত্তি জব্দ করেছে সেসব সম্পতি নিহত ও আহত পরিবারের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার দাবি জানান তিনি।

ছবি

সিরিয়া ও বাংলাদেশে আইএস তহবিলে অর্থ পাঠাত মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার ৩৬ বাংলাদেশি

ছবি

দেশে ফিরেছেন ৬৫ হাজার হাজি, হজে গিয়ে মৃত্যু ৪২ জনের

ছবি

কোভিড পরীক্ষার ফি কমাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ছবি

স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ইভিএম বাদ, নতুন নীতিমালায় বড় পরিবর্তন

ছবি

হত্যাকারীদের বিচার না করে নির্বাচন নয়: নাহিদ

দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন মহামারীর পর্যায়ে: উপদেষ্টা

শ্রীপুরে বই আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার শিক্ষার্থী, শিক্ষক কারাগারে

ওসমানী হাসপাতালের বারান্দায় দুই নারীর সন্তান প্রসব, এক নবজাতকের মৃত্যু

বিএমইটির ৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা

ছবি

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর অভিযানে কেএনএফ কমান্ডারসহ নিহত ২

ছবি

সিলেটে পাথর কোয়ারী ‘দখল’: সবার স্বপ্ন এক

তাভেল্লা হত্যা: তিনজনের যাবজ্জীবন

ছবি

‘অপরাধকে লেবাস দিয়ে কালারিং করার প্রয়োজন নাই’

সরকারি কর্মচারীদের তদন্ত ছাড়া শাস্তি নয়, অধ্যাদেশ সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন

রোহিঙ্গা নাগরিক মোস্তফা ‘পাচ্ছেন জুলাই শহীদের স্বীকৃতি’

কলাবাগানে ভাঙচুর-চাঁদাবাজি: বরখাস্ত ওসি ও এসআইদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে সিআইডি

এনবিআরের আরও ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শুরু

ভোটের আগে টেলিকম নীতিমালা নিয়ে বিএনপির উদ্বেগ

ছবি

কুমিল্লার মুরাদনগরে এবার গণপিটুনি, দুই সন্তানসহ নিহত হলেন নারী

কোনো সেনা সদস্য ‘গুমে’ জড়িত থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা : সেনা সদর

স্থানীয় সরকার নির্বাচন: ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা প্রকাশ

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিধান ও বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ইস্যুতে ‘ঐকমত্য’

ছবি

বৃষ্টি ও ঝুঁকির কারণে কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলল পানি উন্নয়ন বোর্ড

ছবি

পটিয়ার ঘটনায় ওসির স্থায়ী অপসারণসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা

ছবি

উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের বাছাই পরীক্ষার ফল প্রকাশ

ছবি

মালয়েশিয়ায় আটক বাংলাদেশিদের বিষয়ে জানতে চেয়েছে সরকার : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩৫৮

ছবি

৯ কোটি টাকার অনুদান, পিচিং নিয়ে নির্মাতাদের অভিযোগ

ছবি

তাভেল্লা হত্যা: তিনজনের যাবজ্জীবন, বিএনপি নেতা কাইয়ুমসহ চারজন খালাস

ছবি

জুলাই স্মৃতি উদযাপনে ‘ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট’ কর্মসূচি বাতিল

ছবি

সংস্কার নিয়ে ৫৩ বছরে এমন আলোচনার সুযোগ হয়নি: আলী রীয়াজ

ছবি

জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ব্যাপকতা ও প্রভাবের মুখে শহর: ঝুঁকি হ্রাসে ঢাকায় আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের উদ্বোধন

ছবি

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পূর্ণ সমর্থন’ রয়েছে: রাষ্ট্রদূত

ছবি

সাবেক এমপি ও ক্রিকেট অধিনায়ক দুর্জয় গ্রেপ্তার

সাবেক সিইসি নূরুল হুদার জামিন নামঞ্জুর

‘দুর্নীতি করতে বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর প্রক্রিয়া জটিল করা হয়’

tab

জাতীয়

রানা প্লাজা : সেই বিভীষিকা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় ইয়াসমিন, রুবি, জেসমিনদের

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

শনিবার, ২৩ এপ্রিল ২০২২

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, অন্য দিনের মতোই কর্মচঞ্চল আলো ঝলমলে ছিল দিনটা। প্রতিদিনের মতোই সাভারের রানা প্লাজার আটতলা ভবনজুড়ে ছিল কর্মব্যস্ততা। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট শব্দ আর প্রচন্ড ঝাকুনি দিয়ে মুহূর্তেই পুরো ভবনটি ধসে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভবনের কয়েকটি তলা মাটির নিচে চলে যায়।

এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় দুই হাজার ৪৩৮ জনকে। নিখোঁজ হন ১৮২ জন শ্রমিক। দেশের গার্মেন্ট খাতে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিগুলোর একটি সাভারের এই রানা প্লাজা ধস।

সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় রানা প্লাজায় কাজ করা শ্রমিকদের, তাদের স্বজনদের। আজও অনেকে ঘুমাতে পারেন না। ৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া বিভীষিকার সেই সকাল আজও তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের।

রানা প্লাজায় একটি তৈরি পোশাকের কারখানায় কাজ করতেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইয়াসমিন বেগম। ২০০৯ এ অপারেটর হিসেবে কাজে যোগ দেন। এক মেয়ে মমতা আর ছেলে বাবুকে নিয়ে সংসার বেশ গুছিয়ে ফেলেছিলেন। স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করেছিল। কয়েক বছরের একটু একটু করে বোনা স্বপ্ন নিমিষেই চুরমার হয়ে যায়।

ওই দিনের ভয়াবহতা আজও ঘুমাতে দেয় না ইয়াসমিনকে। সেদিনের বিকট শব্দ, আর্তচিৎকার আজও তার কানে বাজে। আজও কুঁকড়ে ওঠেন ওইদিনের কথা মনে করে।

তিনি বলেন, ‘ঘুমাইলে মনে হয় বিল্ডিং ভাইঙা পড়তাছে। আবার কখনো মনে হয় নদীতে পাইড়া যাইতাছি। বড়, উচা বিল্ডিং দেখলেই এহন ভয় লাগে। আমি ভালো নাই। বুকে ব্যথা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বইলে আর দাঁড়াইতে পারি না। মাথা ঝিম ঝিম করে। কতো স্বপ্ন আছিল, পোলা মাইয়ারে লেখাপড়া করায়া ভালো চাকরি করামু। সব শ্যাষ হয়া গেছে আমগোর। অভাবের কারণে ছোট বয়সে মেয়ের বিয়া দিয়া দিছি। মেয়েটার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা ছিল। ছেলেটার বই-খাতা কিন্যা দিতে পারি না। এখন এই পঙ্গু জীবন বোঝা হয়া গেছে। আমি যখন কাজ করতাম তখন অভাব ছিল না। সুখেই ছিলাম’

ইয়াসমিন আবারো কাজ করতে চান। তার কথায়, ‘সাহস কইরা আবার গার্মেন্টে ঢুকছিলাম, কিন্তু কাজ করতে পারি না। ভয় লাগে, বুক ধরফর করে, মাথা ঘুরায়।’

প্রতি মাসে সাভারের সিআরপি থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ আনেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বামী পাকিজা টেক্সটাইলে হেলপারের কাজ করে। শাশুড়ি আর ছেলে নিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনেক কষ্টে আছি। কাজ দিলেও করতে পারি না। আর দেশে বেশি কাম কাজও নাই। এহন ভাবি, এত কষ্টের চাইতে মরাই ভালো ছিল।’ ছেলেকে নিয়ে সাভারে থাকেন মোছাম্মৎ জেসমিন। ওইদিনের কথা বলতে গেলে আজও গা শিউড়ে ওঠে তার। ‘ওইদিন যখন জ্ঞান ফিরছে তখন দেখি মাথা ব্যান্ডেজ করা। আমি হাসপাতালে। নড়তে চড়তে পারি না। ডাক্তার কয় আমার মেরুদন্ডের হাড় ফাইটা গেছে। সেই থিক্যা আমি অসুস্থ। খুবই অসুস্থ্। মাথায় আঘাত পাওনে বেশিক্ষণ তাকায় থাকতে পারি না। বেশিক্ষণ বইসা থাকলে পা ফুইলা যায়। পা ফেলাইতে পারি না। আমার এই অবস্থা দেইখা আমার স্বামী আমারে আর পোলারে ছাইড়া চইলা গেছে।’

সাভারে বড় বোনের বাসায় থাকেন জেসমিন। মাসে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। মাঝে মাঝে ওষুধ কিনতে পারেন না বলে ছেদ পড়ে চিকিৎসায়।

তিনি বলেন, ‘চেষ্টা করছিলাম কাজে যোগ দেওনের। কিন্তু এত শরীর খারাপ লাগে। বাসার কাজই করতে পারি না অনেক সময়। এহনো ঠিকমতো শান্তি কইরা ঘুমাইতে পারি না। ঘুমের ওষুধ খাওন লাগে। এহনো ভয় লাগে। মনে হয় বিল্ডিং ভাইঙা পড়বো।’

রুবি বেগম শারীরিক, মানসিক নানা সমস্যায় ভুগছেন। একটা প্রশ্ন করলে আরেকটা উত্তর দেন। কখনো গুছিয়ে কথা বলেন তো কখনো এলোমেলো। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর ধীর ধীরে তিনি যেন বাস্তবে ফেরেন। বেশিরভাগ সময় কথার জবাব দেন ‘হ্যাঁ’, ‘হুম’, ‘না’ শব্দে। আবার কখনো উত্তরই দিচ্ছিলেন না। তার সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কথা বলার পর স্ববাভিকভাবে কথা বলেন রানা প্লাজায় আহত রুবি বেগম।

কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই আস্তে করে বলেন, ‘ভালো নাই। পা আর বুকে ব্যথা, কষ্ট।’ পাকিজা টেক্সটাইলের কাছে থাকেন রুবি। তার শারীরিক মানসিক অবস্থার কারণে একমাত্র মেয়েকে গ্রামে দাদুর কাছে রেখে এসেছেন। স্বামী তার সঙ্গে থাকেন ঠিকই, কিন্তু ভরণ-পোষণে চরম উদাসীন।

এজন্য রুবি আবারো কাজ করতে চান। আবারো মেশিনের খটাখট শব্দে মাততে চান। ব্যস্ততা চান। কিন্তু শরীর আর মন সায় দেয় না। যখন একটু সুস্থ মনে হয়, ভালো লাগে, কাজ করতে ছুটে যান। তবে রুবি বললেন পনেরো-কুড়ি দিন কোনভাবে কাজ করতে পারেন কিন্তু তারপরই ‘পইড়া যাই, পা ফুইলা যায়, মাথা বনবন করে। কিচ্ছু মনে থাকে না। কিছু বালা লাগে না।’ কেঁদে ফেলেন রুবি। আর বার বার বলতে থাকেন ‘মরলেই বালা আছিলো।’

তাদের সবার অভিযোগ, ঘটনার পর পরই কেউ কেউ খোঁজখবর করলেও এখন আর কেউই তাদের কোন খোঁজ নেন না। পরিবার আজ তাদের বোঝা মনে করে।

ইয়াসমিন, জেসমিন, রুবির মতো অনেকেই তাদের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা পাড়ি দিচ্ছেন বলে জানান তারা। মানবেতর জীবন তাদের।

স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের অনেকেই কিছু কিছু সহায়তা পেলেও ইয়াসমিন, জেসমিন বা রুবি কেউই কোন সহায়তা পাননি।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের নিয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এ মাসের ১৮ এপ্রিল একটা জরিপ প্রকাশ করে। এই জরিপ থেকে জানা যায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৫৬.৫ শতাংশের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে যা গত বছর ছিল ১৪ শতাংশ।

গত বছরগুলোতে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হলেও এ বছর অবনতি ঘটেছে। গতবছর যেখানে মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত ছিলেন ১২.৫ শতাংশ, এ বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮.৫ শতাংশে। ৩১ শতাংশ বলেছেন তাদের মানসিক অবস্থা ‘প্রায় স্থিতিশীল’ এবং ২০.৫ শতাংশ ‘সম্পূর্ণ স্থিতিশীল’।

রানা প্লাজায় দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৩ শতাংশ বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৪৭ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থানে নিযুক্ত রয়েছেন। এদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ বলেছেন শারীরিক অক্ষমতার কারণে তারা কাজ করতে পারেন না এবং ১০ শতাংশ এখনও মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বেঁচে যাওয়া ২০০ জনকে নিয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এই জরিপ করে।

রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর দেশের প্রায় প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই নড়েচড়ে বসে। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিরাপদ রাখতে আন্দোলন শুরু করে। ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার পাশাপাশি নিহত ও আহতদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিও করে তারা।

ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার পর সরকারসহ অনেকেই আহত নিহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি অভিযোগ এনে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘রানা প্লাজার এখনও অনেক শ্রমিক রয়েছে যারা ক্ষতিপূরণ পায়নি। সরকার তাদের কোন কমিটমেন্ট পূরণ করেনি। দ্রুত ওইসব শ্রমিকদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।’

এছাড়া সরকার সোহেল রানার যেসব সম্পত্তি জব্দ করেছে সেসব সম্পতি নিহত ও আহত পরিবারের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার দাবি জানান তিনি।

back to top