তবে তারা এখন ‘কিছুটা স্বস্তিতে’ আছে বলছেন পরিকল্পনামন্ত্রী
মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ কম খাচ্ছে। অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ-জাতীয় খাবার। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক সংলাপে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়।
তবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন মূল্যস্ফীতি কমছে আর এতে ‘মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে’ আছে। আর তিনি বলেন, ‘আপনারা কালো মেঘ দেখছেন, আমরা সিলভার লাইনিং দেখছি।’
অনুষ্ঠানে জানানো হয় রাজধানীর চার সদস্যের পরিবারের খাবারের পেছনে এখন মাসে গড়ে খরচ ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। তবে মাছ-মাংস ছাড়া খাবার খেলে খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা, যাকে সিপিডি বলছে ‘কম্প্রোমাইজ ডায়েট’।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে ‘সংকটে অর্থনীতি, কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, ‘অর্থনীতি অর্থমন্ত্রী চালান না, অর্থনীতি পরিকল্পনামন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চালান না। অর্থনীতি বাই রুল বাই অর্ডার চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাই আইন, কারণ উনি (প্রধানমন্ত্রী) সরকারপ্রধান। তার থেকে এসব আইন মেনে আসে। আমি হয়তো আজ অসুস্থ বা অন্য কেউ অসুস্থ হলেন, আমি হয়তো অফিসে গেলাম না। তাই বলে কাজ তো আর পড়ে থাকবে না। আমি বলতে চাই আমরা জেনেশুনেই অর্থনীতি চালাচ্ছি। আমরা কিছু পন্ডিতের সঙ্গে কাজ করে এগুলো শিখেছি।’
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমি একটা গ্রামীণ এলাকা হাওরের প্রতিনিধিত্ব করি। আমি প্রতি সপ্তাহে হাওরে যাই, সেখানে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলি। হাট-বাজারে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে কথা বলি। বর্তমান সরকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। আগে যেভাবে চালের হিসাব করতে দেখেছি এখন তা নেই। যে গ্রামে আমি সাঁতরে স্কুলে গেছি এখন বাচ্চারা মোটরসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। আপনারা কালো মেঘ দেখছেন, আমরা সিলভার লাইনিং দেখছি।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ এটা নিরূপণ করা। মূল্যস্ফীতি কমছে, তবে নিম্নহারে। এতে মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে। বিবিএস সঠিক নয় এটা কেউ বললে তার সঙ্গে আমি বিবাদে যাবো। আমরা সংখ্যা নিয়ে অসত্য কথা বলি না আমাদের ফিগার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও স্বীকার করেছে।’
বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে দাবি করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তারচেয়েও বেশি হারে বাড়ছে স্থানীয় বাজারে। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী।
ড. ফাহমিদা তার প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, ব্যাংকিং সেক্টর বহু বছর ধরেই সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ঋণ খেলাপি বেড়েই চলেছে। সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমাগতভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছ। খেলাপি ঋণের উন্নতি না হলে এ ধরনের ঘাটতি রয়েই যাবে। খেলাপি যা বলা হচ্ছে বাস্তবে এর পরিমাণ অনেক বেশি। আইএমএফসহ সংশ্লিষ্টরা এটা বারবার বলেছে। তাদের ধারণা, সব সূচক যদি বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বর্তমানে যোগ হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সংকট। আর একটি বিষয় হচ্ছে ঋণ ও সঞ্চয়ে আরোপিত সুদের হারও ব্যাংকিং ডিপোজিটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে ফাহমিদা বলেন, মূল্যস্ফীতি যে অবস্থায় ছিল সেখান থেকে আরও ঘনীভূত হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বড় কারণ হলেও আগে থেকেই মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারের পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বড় কারণ। এর ফলে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। আগে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়লে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমতো। কিন্তু এখন দুটোই সমানতালে বেড়ে চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করলেও অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যের ঊর্ধ্বগতি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে চাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি কিংবা গরুর মাংসের মূল্যের ক্ষেত্রে এমন প্রবণতা রয়েছে। অর্থাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হারে বাড়ছে।
অন্যদিকে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে আগে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। কিন্তু এখন সেই জায়গায়ও অস্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মুদ্রার বিনিময় হার, রিজার্ভ ব্যবহারের দুর্বলতা, ট্রেড ইনভয়েসিংয়ের কারণে অর্থ পাচার ইত্যাদি। এসব কারণে এক ধরনের ভঙ্গুরতা লক্ষ্য করা গেছে।
রিজার্ভের বিষয়ে সিপিডি বলছে, রিজার্ভের হিসাব নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রিজার্ভের কারণে এলসি খোলা কিংবা আমদানির ক্ষেত্রে চাপ তৈরি হয়েছে। রপ্তানি বাড়লেও কারেন্ট হিসাব ব্যালেন্স নেতিবাচক। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে এসেছে। বিদেশে মানুষ যাওয়ার প্রবণতা বাড়লেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এখানে হুন্ডি মার্কেটের বিরাটভাবে প্রভাবিত করছে, সরকারের আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা থাকা সত্ত্বেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এটা একটি চিন্তার বিষয়। বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের কারণে অপ্রয়োজনীয় এলসি খোলার প্রবণতা কমেছে।
ফাহমিদা বলেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দেখতে পারছি এনবিআরের রাজস্ব আয় বেড়েছে। এর মধ্যে পরোক্ষ কর অর্থাৎ আমদানি বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে। আর একটি বিষয় হলো এডিপি বাস্তবায়নের হার গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দেখা যাচ্ছে। যা ১২.৮ শতাংশ। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া বড় কারণ বলে দেখা যাচ্ছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রথম চার মাসে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে অর্থ নেয়ার হার বেড়ে যাচ্ছে ও সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। আগামীতে প্রথম কয়েক মাসে মূল্যবৃদ্ধির কারণে রাজস্ব আদায় যেটা বেড়েছে তা স্থিতিশীল কি না। ভর্তুকিটা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সেটাও বড় একটি বিষয়।
প্রবন্ধে বলা হয়, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। এটাকে রেগুলার ডায়েট বলছে সিপিডি। এখানে ১৯টি খাদ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপোষের খাদ্যতালিকা। বেতন প্রতিবছর ৫ শতাংশ বাড়লেও সেটা রেগুলার ডায়েটের ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম বলেও উল্লেখ করা হয়।
ফাহমিদা খাতুন তার প্রবন্ধে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ খাবার খাওয়া কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। এতে উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির লাগামহীন অবস্থার কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি। এটা কমার কোন লক্ষণ নেই। সিপিডি বলছে, মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাত স্থিতিশীলতার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সবুজ উদ্যোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আরও বলা হয়, ব্যাংক খাত দুর্বল এখনও সংস্কারে পদক্ষেপ নেই। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ দেয়ায় অনিয়ম এখনও আছে। এ সংকট মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে লক্ষ্য নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি বলে মনে করে সিপিডি।
সেমিনারে বিশেষ আলোচক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজ রূপালী হক চৌধুরী ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স সলিডারিটির সভাপতি তাসলিমা আক্তার লিমা বক্তব্য রাখেন।
তবে তারা এখন ‘কিছুটা স্বস্তিতে’ আছে বলছেন পরিকল্পনামন্ত্রী
শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২
মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ কম খাচ্ছে। অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ-জাতীয় খাবার। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক সংলাপে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়।
তবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন মূল্যস্ফীতি কমছে আর এতে ‘মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে’ আছে। আর তিনি বলেন, ‘আপনারা কালো মেঘ দেখছেন, আমরা সিলভার লাইনিং দেখছি।’
অনুষ্ঠানে জানানো হয় রাজধানীর চার সদস্যের পরিবারের খাবারের পেছনে এখন মাসে গড়ে খরচ ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। তবে মাছ-মাংস ছাড়া খাবার খেলে খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা, যাকে সিপিডি বলছে ‘কম্প্রোমাইজ ডায়েট’।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে ‘সংকটে অর্থনীতি, কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, ‘অর্থনীতি অর্থমন্ত্রী চালান না, অর্থনীতি পরিকল্পনামন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চালান না। অর্থনীতি বাই রুল বাই অর্ডার চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাই আইন, কারণ উনি (প্রধানমন্ত্রী) সরকারপ্রধান। তার থেকে এসব আইন মেনে আসে। আমি হয়তো আজ অসুস্থ বা অন্য কেউ অসুস্থ হলেন, আমি হয়তো অফিসে গেলাম না। তাই বলে কাজ তো আর পড়ে থাকবে না। আমি বলতে চাই আমরা জেনেশুনেই অর্থনীতি চালাচ্ছি। আমরা কিছু পন্ডিতের সঙ্গে কাজ করে এগুলো শিখেছি।’
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমি একটা গ্রামীণ এলাকা হাওরের প্রতিনিধিত্ব করি। আমি প্রতি সপ্তাহে হাওরে যাই, সেখানে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলি। হাট-বাজারে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে কথা বলি। বর্তমান সরকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। আগে যেভাবে চালের হিসাব করতে দেখেছি এখন তা নেই। যে গ্রামে আমি সাঁতরে স্কুলে গেছি এখন বাচ্চারা মোটরসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। আপনারা কালো মেঘ দেখছেন, আমরা সিলভার লাইনিং দেখছি।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ এটা নিরূপণ করা। মূল্যস্ফীতি কমছে, তবে নিম্নহারে। এতে মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে। বিবিএস সঠিক নয় এটা কেউ বললে তার সঙ্গে আমি বিবাদে যাবো। আমরা সংখ্যা নিয়ে অসত্য কথা বলি না আমাদের ফিগার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও স্বীকার করেছে।’
বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে দাবি করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তারচেয়েও বেশি হারে বাড়ছে স্থানীয় বাজারে। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী।
ড. ফাহমিদা তার প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, ব্যাংকিং সেক্টর বহু বছর ধরেই সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ঋণ খেলাপি বেড়েই চলেছে। সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমাগতভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছ। খেলাপি ঋণের উন্নতি না হলে এ ধরনের ঘাটতি রয়েই যাবে। খেলাপি যা বলা হচ্ছে বাস্তবে এর পরিমাণ অনেক বেশি। আইএমএফসহ সংশ্লিষ্টরা এটা বারবার বলেছে। তাদের ধারণা, সব সূচক যদি বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বর্তমানে যোগ হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সংকট। আর একটি বিষয় হচ্ছে ঋণ ও সঞ্চয়ে আরোপিত সুদের হারও ব্যাংকিং ডিপোজিটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে ফাহমিদা বলেন, মূল্যস্ফীতি যে অবস্থায় ছিল সেখান থেকে আরও ঘনীভূত হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বড় কারণ হলেও আগে থেকেই মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারের পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বড় কারণ। এর ফলে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। আগে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়লে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমতো। কিন্তু এখন দুটোই সমানতালে বেড়ে চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করলেও অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যের ঊর্ধ্বগতি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে চাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি কিংবা গরুর মাংসের মূল্যের ক্ষেত্রে এমন প্রবণতা রয়েছে। অর্থাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হারে বাড়ছে।
অন্যদিকে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে আগে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। কিন্তু এখন সেই জায়গায়ও অস্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মুদ্রার বিনিময় হার, রিজার্ভ ব্যবহারের দুর্বলতা, ট্রেড ইনভয়েসিংয়ের কারণে অর্থ পাচার ইত্যাদি। এসব কারণে এক ধরনের ভঙ্গুরতা লক্ষ্য করা গেছে।
রিজার্ভের বিষয়ে সিপিডি বলছে, রিজার্ভের হিসাব নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রিজার্ভের কারণে এলসি খোলা কিংবা আমদানির ক্ষেত্রে চাপ তৈরি হয়েছে। রপ্তানি বাড়লেও কারেন্ট হিসাব ব্যালেন্স নেতিবাচক। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে এসেছে। বিদেশে মানুষ যাওয়ার প্রবণতা বাড়লেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এখানে হুন্ডি মার্কেটের বিরাটভাবে প্রভাবিত করছে, সরকারের আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা থাকা সত্ত্বেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এটা একটি চিন্তার বিষয়। বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের কারণে অপ্রয়োজনীয় এলসি খোলার প্রবণতা কমেছে।
ফাহমিদা বলেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দেখতে পারছি এনবিআরের রাজস্ব আয় বেড়েছে। এর মধ্যে পরোক্ষ কর অর্থাৎ আমদানি বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে। আর একটি বিষয় হলো এডিপি বাস্তবায়নের হার গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দেখা যাচ্ছে। যা ১২.৮ শতাংশ। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া বড় কারণ বলে দেখা যাচ্ছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রথম চার মাসে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে অর্থ নেয়ার হার বেড়ে যাচ্ছে ও সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। আগামীতে প্রথম কয়েক মাসে মূল্যবৃদ্ধির কারণে রাজস্ব আদায় যেটা বেড়েছে তা স্থিতিশীল কি না। ভর্তুকিটা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সেটাও বড় একটি বিষয়।
প্রবন্ধে বলা হয়, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। এটাকে রেগুলার ডায়েট বলছে সিপিডি। এখানে ১৯টি খাদ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপোষের খাদ্যতালিকা। বেতন প্রতিবছর ৫ শতাংশ বাড়লেও সেটা রেগুলার ডায়েটের ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম বলেও উল্লেখ করা হয়।
ফাহমিদা খাতুন তার প্রবন্ধে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ খাবার খাওয়া কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। এতে উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির লাগামহীন অবস্থার কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি। এটা কমার কোন লক্ষণ নেই। সিপিডি বলছে, মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাত স্থিতিশীলতার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সবুজ উদ্যোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আরও বলা হয়, ব্যাংক খাত দুর্বল এখনও সংস্কারে পদক্ষেপ নেই। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ দেয়ায় অনিয়ম এখনও আছে। এ সংকট মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে লক্ষ্য নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি বলে মনে করে সিপিডি।
সেমিনারে বিশেষ আলোচক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজ রূপালী হক চৌধুরী ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স সলিডারিটির সভাপতি তাসলিমা আক্তার লিমা বক্তব্য রাখেন।