বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আলোচনার ঝড় তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। আলোচিত এই চুরির ঘটনার ৭ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ।
এখন পর্যন্ত চুরি যাওয়া এ অর্থের মধ্যে ফেরত আনা গেছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বাকি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার (টাকার অঙ্কে ৫৬০ কোটি টাকা) উদ্ধারে এখনও কোন সুরাহা হয়নি।
শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল পুরো অর্থ দুই-তিন বছরের মধ্যে ফেরত আনা সম্ভব হবে। চুরির প্রথম বছর শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের স্বেচ্ছায় দেয়া অর্থের বাইরে আর এক টাকাও উদ্ধার হয়নি। ফিলিপাইন থেকে অর্থ ফেরতে কোন অগ্রগতি না থাকায় এখন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশের মামলা চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘দুটি মামলায় পক্ষে রায় পেয়েছে। সেই রায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ফিনিপাইলের উকিলকে বলে দিয়েছে আমাদের উকিলের সঙ্গে বসে সমাধান করতে। আদালত গত ২ ফেব্রুয়ারি বসার তারিখ ছিল। কিন্তু ফিলিপাইন এখনও বসেনি। এখন সামনে শুনানি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমরা আমাদের অর্থ ফেরত পাবো। এছাড়া আমরা আইনের লড়াই চালিয়ে যাবো যতদিন পর্যন্ত অর্থ ফেরত না পাবো।’
রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারে অগ্রগতি না হওয়াতে গত জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানকে বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, রিজার্ভ থেকে চুরির অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য শুরুর দিকে ফিলিপাইন ব্যাপক সহায়তা করছিল। দেশটির বিভিন্ন সংস্থা তখন বাংলাদেশের পক্ষে ১২টি মামলা করে। তবে দেশটির সরকার পরিবর্তনের পর সেই তৎপরতায় ভাটা পড়ে। সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। যে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে তৃতীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ।
প্রথমে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে বাংলাদেশের পক্ষে একটি মামলা দায়ের করে নিয়োগকৃত ল’ ফার্ম কোজেন ও’কনর। তবে ২০২০ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ওই আদালত জানিয়ে দেয় মামলাটি তাদের কোর্টের এখতিয়ারাধীন নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাইবার হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির প্রয়াস চালায় দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে বানান বিভ্রাটের কারণে রাউটিং ব্যাংকের সন্দেহ হলে দুর্বৃত্তরা শ্রীলঙ্কামুখী ২ কোটি ডলার হাতিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ম্যানিলাভিত্তিক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) হয়ে প্রবেশ করে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ক্যাসিনোয়।
রিজার্ভ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে চুরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক একদিন পরে চুরির তথ্য জানতে পারে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা গোপন রাখে আরও ২৪ দিন। আর বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় চুরি যাওয়ার ৩৩তম দিনে।
এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলেও বাংলাদেশেও কারও বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয় রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অরক্ষিত, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন দায়িত্বহীন। আর চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটানো হয় আন্তর্জাতিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক সুইফট সার্ভারের সঙ্গে স্থানীয় লেনদেনের নেটওয়ার্ক জুড়ে দিয়ে।
তিন বছর পর মামলা করে বাংলাদেশ
রিজার্ভ চুরির তিন বছর পর ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা করে বাংলাদেশ। মামলায় ফিলিপাইনের পাঁচটি আর্থিক ও ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠান, দেশটির ১২ জন, তিন জন চীনা নাগরিকসহ মোট ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই আদালতে সব পক্ষ প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দেয়। ২০২০ সালের ২০ মার্চ আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয় যে উদ্দেশ্যে মামলাটি করা হয়েছে তা ওই আদালতের এখতিয়ারাধীন না। তবে স্টেট আদালতে মামলা চলতে পারে বলে মত দেন ফেডারেল আদালত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট আদালতে মামলায় একই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আসামি করে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ফিলিপাইনের আদালতে ১২ মামলা চলছে
জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের মধ্যে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার নিয়ে ফিলিপাইনের আদালতে কমপক্ষে ১২টি মামলা চলমান। এর মধ্যে বড় অঙ্কের অর্থ জব্দও করে রেখেছেন দেশটির আদালত। তবে এসব মামলার অগ্রগতি খুবই মন্থর। ফলে ফিলিপাইনের মামলার মাধ্যমে টাকা আদায়ের কোন সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আলোর মুখ দেখলো না ফরাসউদ্দিন কমিটির প্রতিবেদন
রিজার্ভ চুরির বিষয়টি জানাজানি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। একই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক মতিঝিল থানায় মামলা করে এবং পরদিন মামলা হস্তান্তর করা হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির কাছে।
ফরাসউদ্দিন কমিটি কাজ শুরু করে ২০ মার্চ থেকে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে, একই বছরের ৩০ মে তদন্ত প্রতিবেদন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পেশ করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার ফরাসউদ্দিন কমিটির সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এমনকি অনুসন্ধান শেষ করে অভিযোগপত্রও দেয়নি সিআইডি। এ কারণে দেশের মানুষ আজও জানতে পারেনি রিজার্ভ চুরির নেপথ্যে কারা ছিল।
‘দায়ী’ একটি ত্রুটিযুক্ত প্রিন্টার
মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের দশম তলায় অত্যন্ত সুরক্ষিত ঘরের অভ্যন্তরে বসানো ছিল প্রিন্টারটি। কোটি কোটি ডলারের ট্রান্সফার ব্যাংকের বাইরে ও ভেতরে প্রবাহিত হওয়ার রেকর্ড ছাপানো হতো এটি দিয়ে। শুরুতে কর্মকর্তাদের কাছে ত্রুটিপূর্ণ এ প্রিন্টার ছিল কেবল একটি ঝামেলা। প্রযুক্তির সমস্যা ছাড়া তেমন একটা বড় ব্যাপার বলে মনে হয়নি কারও। চুরি যাওয়ার পর ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট থেকে প্রিন্টারটি কাজ করছিল না। এদিন কেউ বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথাব্যথা দেখাননি। সে সময় ডিউটি ম্যানেজার ছিলেন জুবায়ের বিন হুদা। পরে তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, ‘আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে এটি অন্য যেকোন দিনের মতো একটি সাধারণ সমস্যা, এর আগেও এমন হয়েছে।’
ঘটনা রাত ৮টায়
হ্যাকাররা ঘটনা ঘটায় মূলত বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৮টায়, সে সময় ছিল নিউইয়র্কে বৃহস্পতিবার সকাল। অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তখন সব কার্যক্রম চলছে। অন্যদিকে, শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি। শনিবার যখন বাংলাদেশে চুরিটি উদ্ঘাটন শুরু হয়, এর মধ্যে আবার নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়ে যায়।
টার্গেট ফিলিপাইনের ম্যানিলা
হ্যাকাররা চুরির টাকা সরানোর জন্য ফিলিপাইনের ম্যানিলাকে বেছে নেয়। কারণ ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার ছিল লুনার ইয়ারের প্রথম দিন। এশিয়ায় ছুটির দিন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের ছুটি ও সময়ের ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে পাঁচটা দিন হাতে পেয়েছিল হ্যাকাররা। ধারণা করা হয়, কয়েক বছর ধরে এই হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনা করেছিল হ্যাকাররা।
ভুল বানানে ‘রক্ষা’ পেয়েছে অল্পকিছু
ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) খোলা ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ ডলার এবং শ্রীলঙ্কার শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে আরও ২ কোটি ডলার স্থানান্তরের আদেশ দেয়া হলেও ইংরেজি ‘ফাউন্ডেশন’ বানানে ‘ও’ অক্ষরটি ছিল না। এই ভুল বানানের কারণে শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে পাঠানো অর্থ স্থানান্তর হওয়ার আগেই আটকে যায়, যা পরে ফেরত আসে। কিন্তু ফিলিপাইনে পাঠানো চারটি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়ে যায়।
শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আলোচনার ঝড় তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। আলোচিত এই চুরির ঘটনার ৭ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ।
এখন পর্যন্ত চুরি যাওয়া এ অর্থের মধ্যে ফেরত আনা গেছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বাকি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার (টাকার অঙ্কে ৫৬০ কোটি টাকা) উদ্ধারে এখনও কোন সুরাহা হয়নি।
শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল পুরো অর্থ দুই-তিন বছরের মধ্যে ফেরত আনা সম্ভব হবে। চুরির প্রথম বছর শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের স্বেচ্ছায় দেয়া অর্থের বাইরে আর এক টাকাও উদ্ধার হয়নি। ফিলিপাইন থেকে অর্থ ফেরতে কোন অগ্রগতি না থাকায় এখন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশের মামলা চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘দুটি মামলায় পক্ষে রায় পেয়েছে। সেই রায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ফিনিপাইলের উকিলকে বলে দিয়েছে আমাদের উকিলের সঙ্গে বসে সমাধান করতে। আদালত গত ২ ফেব্রুয়ারি বসার তারিখ ছিল। কিন্তু ফিলিপাইন এখনও বসেনি। এখন সামনে শুনানি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমরা আমাদের অর্থ ফেরত পাবো। এছাড়া আমরা আইনের লড়াই চালিয়ে যাবো যতদিন পর্যন্ত অর্থ ফেরত না পাবো।’
রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারে অগ্রগতি না হওয়াতে গত জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানকে বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, রিজার্ভ থেকে চুরির অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য শুরুর দিকে ফিলিপাইন ব্যাপক সহায়তা করছিল। দেশটির বিভিন্ন সংস্থা তখন বাংলাদেশের পক্ষে ১২টি মামলা করে। তবে দেশটির সরকার পরিবর্তনের পর সেই তৎপরতায় ভাটা পড়ে। সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। যে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে তৃতীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ।
প্রথমে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে বাংলাদেশের পক্ষে একটি মামলা দায়ের করে নিয়োগকৃত ল’ ফার্ম কোজেন ও’কনর। তবে ২০২০ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ওই আদালত জানিয়ে দেয় মামলাটি তাদের কোর্টের এখতিয়ারাধীন নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাইবার হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির প্রয়াস চালায় দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে বানান বিভ্রাটের কারণে রাউটিং ব্যাংকের সন্দেহ হলে দুর্বৃত্তরা শ্রীলঙ্কামুখী ২ কোটি ডলার হাতিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ম্যানিলাভিত্তিক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) হয়ে প্রবেশ করে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ক্যাসিনোয়।
রিজার্ভ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে চুরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক একদিন পরে চুরির তথ্য জানতে পারে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা গোপন রাখে আরও ২৪ দিন। আর বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় চুরি যাওয়ার ৩৩তম দিনে।
এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলেও বাংলাদেশেও কারও বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয় রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অরক্ষিত, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন দায়িত্বহীন। আর চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটানো হয় আন্তর্জাতিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক সুইফট সার্ভারের সঙ্গে স্থানীয় লেনদেনের নেটওয়ার্ক জুড়ে দিয়ে।
তিন বছর পর মামলা করে বাংলাদেশ
রিজার্ভ চুরির তিন বছর পর ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা করে বাংলাদেশ। মামলায় ফিলিপাইনের পাঁচটি আর্থিক ও ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠান, দেশটির ১২ জন, তিন জন চীনা নাগরিকসহ মোট ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই আদালতে সব পক্ষ প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দেয়। ২০২০ সালের ২০ মার্চ আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয় যে উদ্দেশ্যে মামলাটি করা হয়েছে তা ওই আদালতের এখতিয়ারাধীন না। তবে স্টেট আদালতে মামলা চলতে পারে বলে মত দেন ফেডারেল আদালত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট আদালতে মামলায় একই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আসামি করে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ফিলিপাইনের আদালতে ১২ মামলা চলছে
জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের মধ্যে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার নিয়ে ফিলিপাইনের আদালতে কমপক্ষে ১২টি মামলা চলমান। এর মধ্যে বড় অঙ্কের অর্থ জব্দও করে রেখেছেন দেশটির আদালত। তবে এসব মামলার অগ্রগতি খুবই মন্থর। ফলে ফিলিপাইনের মামলার মাধ্যমে টাকা আদায়ের কোন সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আলোর মুখ দেখলো না ফরাসউদ্দিন কমিটির প্রতিবেদন
রিজার্ভ চুরির বিষয়টি জানাজানি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। একই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক মতিঝিল থানায় মামলা করে এবং পরদিন মামলা হস্তান্তর করা হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির কাছে।
ফরাসউদ্দিন কমিটি কাজ শুরু করে ২০ মার্চ থেকে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে, একই বছরের ৩০ মে তদন্ত প্রতিবেদন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পেশ করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার ফরাসউদ্দিন কমিটির সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এমনকি অনুসন্ধান শেষ করে অভিযোগপত্রও দেয়নি সিআইডি। এ কারণে দেশের মানুষ আজও জানতে পারেনি রিজার্ভ চুরির নেপথ্যে কারা ছিল।
‘দায়ী’ একটি ত্রুটিযুক্ত প্রিন্টার
মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের দশম তলায় অত্যন্ত সুরক্ষিত ঘরের অভ্যন্তরে বসানো ছিল প্রিন্টারটি। কোটি কোটি ডলারের ট্রান্সফার ব্যাংকের বাইরে ও ভেতরে প্রবাহিত হওয়ার রেকর্ড ছাপানো হতো এটি দিয়ে। শুরুতে কর্মকর্তাদের কাছে ত্রুটিপূর্ণ এ প্রিন্টার ছিল কেবল একটি ঝামেলা। প্রযুক্তির সমস্যা ছাড়া তেমন একটা বড় ব্যাপার বলে মনে হয়নি কারও। চুরি যাওয়ার পর ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট থেকে প্রিন্টারটি কাজ করছিল না। এদিন কেউ বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথাব্যথা দেখাননি। সে সময় ডিউটি ম্যানেজার ছিলেন জুবায়ের বিন হুদা। পরে তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, ‘আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে এটি অন্য যেকোন দিনের মতো একটি সাধারণ সমস্যা, এর আগেও এমন হয়েছে।’
ঘটনা রাত ৮টায়
হ্যাকাররা ঘটনা ঘটায় মূলত বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৮টায়, সে সময় ছিল নিউইয়র্কে বৃহস্পতিবার সকাল। অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তখন সব কার্যক্রম চলছে। অন্যদিকে, শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি। শনিবার যখন বাংলাদেশে চুরিটি উদ্ঘাটন শুরু হয়, এর মধ্যে আবার নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়ে যায়।
টার্গেট ফিলিপাইনের ম্যানিলা
হ্যাকাররা চুরির টাকা সরানোর জন্য ফিলিপাইনের ম্যানিলাকে বেছে নেয়। কারণ ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার ছিল লুনার ইয়ারের প্রথম দিন। এশিয়ায় ছুটির দিন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের ছুটি ও সময়ের ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে পাঁচটা দিন হাতে পেয়েছিল হ্যাকাররা। ধারণা করা হয়, কয়েক বছর ধরে এই হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনা করেছিল হ্যাকাররা।
ভুল বানানে ‘রক্ষা’ পেয়েছে অল্পকিছু
ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) খোলা ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ ডলার এবং শ্রীলঙ্কার শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে আরও ২ কোটি ডলার স্থানান্তরের আদেশ দেয়া হলেও ইংরেজি ‘ফাউন্ডেশন’ বানানে ‘ও’ অক্ষরটি ছিল না। এই ভুল বানানের কারণে শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে পাঠানো অর্থ স্থানান্তর হওয়ার আগেই আটকে যায়, যা পরে ফেরত আসে। কিন্তু ফিলিপাইনে পাঠানো চারটি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়ে যায়।