বাংলাভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু এই একাত্তর বছরেও ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। কারা আমাদের গৌরবের ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাদের পরিচিতি তুলে ধরা হয়নি এতদিনেও। কেন ভাষাসৈনিকদের তালিকা এতদিনেও প্রণয়ন করা হয়নি তার উত্তর কারও জানা নেই।
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা, ভাষাসৈনিকদের তালিকা প্রকাশ এবং ভাষা জাদুঘর স্থাপনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট ওই রিটের চূড়ান্ত রায়ে শহীদ মিনারের পাশে গ্রন্থাগারসহ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা এবং জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-সমৃদ্ধ তথ্যপঞ্জিকা রাখা, ভাষা সংগ্রামীদের প্রকৃত তালিকা তৈরি ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ ও মর্যাদা রক্ষাসহ আটটি নির্দেশনা দেয়। কিন্তু একযুগে কয়েক দফা সময় নিয়েও ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি।
হাইকোর্টের আদেশের পরে ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় ভাষাসৈনিকদের তালিকা করার জন্য চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি এক বছর পরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়া ১৪ নারীসহ জীবিত ৬৮ জনকে ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশ করে। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে কিছু নামে তৈরি হয় বিতর্ক।
২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ওই কমিটির বৈঠকের সুপারিশে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে ওই সময় ৫ কোটি জনগণই ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শরিক হয়েছিল বিধায় প্রকৃত ভাষা সংগ্রামীদের সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এত বছর পরে প্রকৃত ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা প্রণয়ন কষ্টসাধ্য এবং দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পর নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা দুরূহ হবে। তালিকা পূর্ণাঙ্গ হবে না বিধায় মামলা মোকদ্দমার উদ্ভব হবে। তবে সেই সময়ে আন্দোলনের অগ্রগামীদের তালিকা বিভিন্ন স্মৃতিকথা, স্মরণিকা এবং ইতিহাস থেকে জানা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ সংবাদকে বলেন, ভাষাসৈনিকদের আজ অনেকেই বেঁচে আছেন। ভাষাসৈনিকরাও কিন্তু সারাদেশ ঘুরে তারাও একটা আনঅফিসিয়ালি তালিকা করেছে। আমরা যদি ৫২’র আন্দোলন নিয়ে ইতিহাস লিখতে পারি, আমাদের গবেষণার বিষয়বস্তু হয় তবে এই তালিকা করা কেন কঠিন হবে।
‘এত বছর পর এই তালিকা করা কি সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে মনজিল মোরশেদ বলেন, কেন সম্ভব না, আমাদের দেশে রাজাকারদের তালিকা হচ্ছে না। সবই সম্ভব, সম্ভব না এমন কোন কথা নাই। হয়তো আপনি বলতে পারেন হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্য হবে কিনা। হতে পারে এটা কঠিন কাজ, কঠিন কাজটাও করতে হবে। যেহেতু আদালতের নির্দেশনা আছে। ঢাকা সিটিতে যারা ভাষাসৈনিক আছেন তাদের দায়িত্ব দিলে তারা দরদ দিয়ে এ কাজটা করবে। দায়িত্ব দিতে হবে প্রকৃত ভাষাসৈনিকদের। আমাকে যদি বলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে আমি তা পারবো না। কারণ আমি মুক্তিযুদ্ধ করিনি। তেমনি যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছেন তাদেরকে নিয়ে কমিটি করতে হবে তাদেরকে দায়িত্ব দিতে হবে। তাহলে এ কাজ করা সহজ হবে।
ভাষাসৈনিকদের তালিকা করার জন্য কেন রিট করেছিলেন জানতে চাইলে মনজিল মোরশেদ বলেন, তৎকালীন সময়ে আমাদের যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি সম্বলিত একটা জায়গা-সেটা ছিল গরু-ছাগলের অভয়ারণ্য। যেন মাদক আসক্ত লোকদের একটা আশ্রয়স্থল, এমন পরিবেশ ছিল। এমন অবস্থা দেখে আর এই শহীদ মিনার একটা ঐতিহাসিক স্থান যাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা ভাষা পেয়েছি তাদেরকে নিয়ে যে স্মৃতিসৌধ এটার মর্যাদা রক্ষা করার প্রয়োজন থেকে আমি এই রিট করি।
মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করার জন্য পদক্ষেপ না নেয়ায় আমরা দুইবার আদালত অবমাননার আবেদন করেছি। ফলে তখনকার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ব্যক্তিগত হাজিরা দিয়েছিলেন। পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। আমরা আবারও যাবো আদালতে।’
মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘রিটের পর আদালত বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়। এর মধ্যে শহীদ মিনারের মর্যাদা রক্ষায় কতগুলো নির্দেশনা ছিল। ওইখানে একটা মিউজিয়াম স্থাপনের নির্দেশনা ছিল। কয়েকটা নির্দেশনা পালন হলেও কয়েকটা এখনও পালন হয়নি। যেমন তালিকা তৈরি হয় না দেখে আমরা আদালতে আবার যাই। তখন তড়িঘড়ি করে একটা তালিকা তৈরি করলো, যা আংশিক তালিকা। এবং বললো যে, বাকিটা তারা তৈরি করে ফেলবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটি আর করা হয়নি।
তিনি বলেন, রিটের অনেক পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা কমিটি তৈরি করে। আসলে হাইকোর্ট যখন নির্দেশনা দেয় তার অনেক পরে তারা কমিটিটা করলো। ওই কমিটির কনভেনর বললেন, এই তালিকা আমরা করতে পারবো না, এটা সম্ভব না। কিন্তু এরপর মিনিস্ট্রি আর কোন উদ্যোগ নেয়নি। দেখেন, কোর্টের নির্দেশনা ছিল কিন্তু কেউ করতে পারলো না। সমস্যা নেই, উনি করতে না পারলে আরেকজন করবে। সেই উদ্যোগও তারা (সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়) নেয়নি। তারা চুপ করে বসে আছে।
ভাষাসৈনিকদের তালিকা করতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যে কমিটি করেছিল তাতে সদস্য ছিলেন ডা. আহমদ রফিক ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
ভাষা সংগ্রামীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করার বিষয়টি জটিল উল্লেখ করে ভাষা সংগ্রামী ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বপ্রদানকারী আহমদ রফিক বলেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে চেষ্টা করা হলেও বিষয়টি আর এগোয়নি। একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। নানা জায়গা থেকে ভাষা সংগ্রামীর দাবি করছিল নানাজন। কিভাবে যাচাই-বাছাই করবো। এমন অবস্থায় আছে বিষয়টি।’
আহমদ রফিক বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণে অবহেলা হয়েছে। সেটা সব আমলেই। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ১৬ খন্ডে প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র সংরক্ষণ, সংকলন বা ইতিহাস ধরে রাখার জন্য কিছুই হয়নি। এখন ইচ্ছা থাকলেও আর সেটা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের বন্ধু-বান্ধব যারা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই আজ প্রয়াত। আমিও এখন অনেক কিছু মনে করতে পারি না।’
ভাষাসৈনিকদের তালিকা কি আদৌ হবে বা করা সম্ভব- এ নিয়ে শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক মুনতাসীর মামুন সংবাদকে বলেন, ৭৫ বছর পর এ ধরনের তালিকা তৈরি সহজ নয়, প্রায় অসম্ভব।
ভাষাসৈনিকদের নামের তালিকা করার দাবি কতদিনের আর তা হলোই না বা কেন, এমন প্রশ্নে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘ভাষাসৈনিকদের নামের তালিকা করার দাবি মনজিল মোরশেদ রিট করার আগে খুব বেশি ছিল না। তালিকা করার বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে অল্প স্বল্প কথা বলেছিল কিন্তু জোরালো কোন দাবি ছিল না। মনজিল মোরশেদ রিট করার পর হাইকোর্ট সুনির্দিষ্টভাবে অর্ডার দিল।’
‘হাইকোর্টের অর্ডারেরও বেশ কিছুদিন পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা কমিটি করে, সেই কমিটিতে আমি ছিলাম। ২/১টা মনে হয় আমরা মিটিংও করেছিলাম। অনেক আগের কথা, অনেক কিছু এখন আর মনে নাই। এভাবে কোন আন্দোলনের তালিকা প্রস্তুত করা যায় না। কারণ সারাদেশে প্রচুর মানুষ এতে অংশ নিয়েছিল। তাহলে এভাবে ভাবলে তো সবাই ভাষাসৈনিক।’
‘আজকে ৭৫ বছর পর কি তালিকা করবো। এগুলোর কোন অর্থ হয় না। আমরা বলেছিলাম, এখন এভাবে তালিকা করা যাবে না। এখন যদি বলা হয় ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের তালিকা করো, তা কি করা সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তো এখন আর তালিকা করছি না। ওগুলো তো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো আর নাই। এগুলো মানে তালিকার বিষয়টা আর এজেন্ডার মধ্যেই নাই।’
‘এসব নিয়ে আলোচনা করা এখন নিরর্থক’ মন্তব্য করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘একটা আন্দোলনে লক্ষাধিক লোক অংশগ্রহণ করে। সবার নাম তো থাকে না। যারা অগ্রণী তাদের নাম থাকে। আমার মনে হয় সম্পূর্ণ তালিকা করা কারও পক্ষে সম্ভব না, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা।
‘একটা কমিটি করা হয়েছিল, তারা এখন আর কেউ নাই। আমি আর আহমদ রফিক বেঁচে আছি আর সবাই মনে হয় মরে গেছে। কমিটিও নাই, আমার সঙ্গে এসব নিয়ে এখন আর কেউ কথাও বলেনি, তাই এ বিষয়ে আর কিছুর বলারও নাই।’
ভাষা সংগ্রামীদের নামের তালিকার ব্যাপারে সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছেন, নামের তালিকা হয়েছে। যে কারণে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা করা তুলনামূলক সহজ ছিল। কিন্তু ভাষা সংগ্রাম যখন হয়েছে তখন তো সে ধরনের কোন তালিকার ব্যাপার ছিল না। ভাষাসৈনিকদের নামের তালিকা তৈরি করার জন্য হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে ভাষাসৈনিকদের কোন সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি। কাদেরকে আমরা ভাষাসৈনিক বলব। যারা সে সময় জেল খেটেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন, কাদেরকে? আর ভাষা আন্দোলন কিন্তু সারাদেশেই হয়েছে। এসব কিছুই আমাদের ভাবতে হবে। ’
সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
বাংলাভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু এই একাত্তর বছরেও ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। কারা আমাদের গৌরবের ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাদের পরিচিতি তুলে ধরা হয়নি এতদিনেও। কেন ভাষাসৈনিকদের তালিকা এতদিনেও প্রণয়ন করা হয়নি তার উত্তর কারও জানা নেই।
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা, ভাষাসৈনিকদের তালিকা প্রকাশ এবং ভাষা জাদুঘর স্থাপনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট ওই রিটের চূড়ান্ত রায়ে শহীদ মিনারের পাশে গ্রন্থাগারসহ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা এবং জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-সমৃদ্ধ তথ্যপঞ্জিকা রাখা, ভাষা সংগ্রামীদের প্রকৃত তালিকা তৈরি ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ ও মর্যাদা রক্ষাসহ আটটি নির্দেশনা দেয়। কিন্তু একযুগে কয়েক দফা সময় নিয়েও ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি।
হাইকোর্টের আদেশের পরে ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় ভাষাসৈনিকদের তালিকা করার জন্য চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি এক বছর পরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়া ১৪ নারীসহ জীবিত ৬৮ জনকে ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশ করে। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে কিছু নামে তৈরি হয় বিতর্ক।
২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ওই কমিটির বৈঠকের সুপারিশে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে ওই সময় ৫ কোটি জনগণই ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শরিক হয়েছিল বিধায় প্রকৃত ভাষা সংগ্রামীদের সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এত বছর পরে প্রকৃত ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা প্রণয়ন কষ্টসাধ্য এবং দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পর নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা দুরূহ হবে। তালিকা পূর্ণাঙ্গ হবে না বিধায় মামলা মোকদ্দমার উদ্ভব হবে। তবে সেই সময়ে আন্দোলনের অগ্রগামীদের তালিকা বিভিন্ন স্মৃতিকথা, স্মরণিকা এবং ইতিহাস থেকে জানা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ সংবাদকে বলেন, ভাষাসৈনিকদের আজ অনেকেই বেঁচে আছেন। ভাষাসৈনিকরাও কিন্তু সারাদেশ ঘুরে তারাও একটা আনঅফিসিয়ালি তালিকা করেছে। আমরা যদি ৫২’র আন্দোলন নিয়ে ইতিহাস লিখতে পারি, আমাদের গবেষণার বিষয়বস্তু হয় তবে এই তালিকা করা কেন কঠিন হবে।
‘এত বছর পর এই তালিকা করা কি সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে মনজিল মোরশেদ বলেন, কেন সম্ভব না, আমাদের দেশে রাজাকারদের তালিকা হচ্ছে না। সবই সম্ভব, সম্ভব না এমন কোন কথা নাই। হয়তো আপনি বলতে পারেন হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্য হবে কিনা। হতে পারে এটা কঠিন কাজ, কঠিন কাজটাও করতে হবে। যেহেতু আদালতের নির্দেশনা আছে। ঢাকা সিটিতে যারা ভাষাসৈনিক আছেন তাদের দায়িত্ব দিলে তারা দরদ দিয়ে এ কাজটা করবে। দায়িত্ব দিতে হবে প্রকৃত ভাষাসৈনিকদের। আমাকে যদি বলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে আমি তা পারবো না। কারণ আমি মুক্তিযুদ্ধ করিনি। তেমনি যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছেন তাদেরকে নিয়ে কমিটি করতে হবে তাদেরকে দায়িত্ব দিতে হবে। তাহলে এ কাজ করা সহজ হবে।
ভাষাসৈনিকদের তালিকা করার জন্য কেন রিট করেছিলেন জানতে চাইলে মনজিল মোরশেদ বলেন, তৎকালীন সময়ে আমাদের যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি সম্বলিত একটা জায়গা-সেটা ছিল গরু-ছাগলের অভয়ারণ্য। যেন মাদক আসক্ত লোকদের একটা আশ্রয়স্থল, এমন পরিবেশ ছিল। এমন অবস্থা দেখে আর এই শহীদ মিনার একটা ঐতিহাসিক স্থান যাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা ভাষা পেয়েছি তাদেরকে নিয়ে যে স্মৃতিসৌধ এটার মর্যাদা রক্ষা করার প্রয়োজন থেকে আমি এই রিট করি।
মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করার জন্য পদক্ষেপ না নেয়ায় আমরা দুইবার আদালত অবমাননার আবেদন করেছি। ফলে তখনকার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ব্যক্তিগত হাজিরা দিয়েছিলেন। পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। আমরা আবারও যাবো আদালতে।’
মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘রিটের পর আদালত বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়। এর মধ্যে শহীদ মিনারের মর্যাদা রক্ষায় কতগুলো নির্দেশনা ছিল। ওইখানে একটা মিউজিয়াম স্থাপনের নির্দেশনা ছিল। কয়েকটা নির্দেশনা পালন হলেও কয়েকটা এখনও পালন হয়নি। যেমন তালিকা তৈরি হয় না দেখে আমরা আদালতে আবার যাই। তখন তড়িঘড়ি করে একটা তালিকা তৈরি করলো, যা আংশিক তালিকা। এবং বললো যে, বাকিটা তারা তৈরি করে ফেলবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটি আর করা হয়নি।
তিনি বলেন, রিটের অনেক পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা কমিটি তৈরি করে। আসলে হাইকোর্ট যখন নির্দেশনা দেয় তার অনেক পরে তারা কমিটিটা করলো। ওই কমিটির কনভেনর বললেন, এই তালিকা আমরা করতে পারবো না, এটা সম্ভব না। কিন্তু এরপর মিনিস্ট্রি আর কোন উদ্যোগ নেয়নি। দেখেন, কোর্টের নির্দেশনা ছিল কিন্তু কেউ করতে পারলো না। সমস্যা নেই, উনি করতে না পারলে আরেকজন করবে। সেই উদ্যোগও তারা (সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়) নেয়নি। তারা চুপ করে বসে আছে।
ভাষাসৈনিকদের তালিকা করতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যে কমিটি করেছিল তাতে সদস্য ছিলেন ডা. আহমদ রফিক ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
ভাষা সংগ্রামীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করার বিষয়টি জটিল উল্লেখ করে ভাষা সংগ্রামী ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বপ্রদানকারী আহমদ রফিক বলেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে চেষ্টা করা হলেও বিষয়টি আর এগোয়নি। একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। নানা জায়গা থেকে ভাষা সংগ্রামীর দাবি করছিল নানাজন। কিভাবে যাচাই-বাছাই করবো। এমন অবস্থায় আছে বিষয়টি।’
আহমদ রফিক বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণে অবহেলা হয়েছে। সেটা সব আমলেই। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ১৬ খন্ডে প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র সংরক্ষণ, সংকলন বা ইতিহাস ধরে রাখার জন্য কিছুই হয়নি। এখন ইচ্ছা থাকলেও আর সেটা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের বন্ধু-বান্ধব যারা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই আজ প্রয়াত। আমিও এখন অনেক কিছু মনে করতে পারি না।’
ভাষাসৈনিকদের তালিকা কি আদৌ হবে বা করা সম্ভব- এ নিয়ে শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক মুনতাসীর মামুন সংবাদকে বলেন, ৭৫ বছর পর এ ধরনের তালিকা তৈরি সহজ নয়, প্রায় অসম্ভব।
ভাষাসৈনিকদের নামের তালিকা করার দাবি কতদিনের আর তা হলোই না বা কেন, এমন প্রশ্নে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘ভাষাসৈনিকদের নামের তালিকা করার দাবি মনজিল মোরশেদ রিট করার আগে খুব বেশি ছিল না। তালিকা করার বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে অল্প স্বল্প কথা বলেছিল কিন্তু জোরালো কোন দাবি ছিল না। মনজিল মোরশেদ রিট করার পর হাইকোর্ট সুনির্দিষ্টভাবে অর্ডার দিল।’
‘হাইকোর্টের অর্ডারেরও বেশ কিছুদিন পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা কমিটি করে, সেই কমিটিতে আমি ছিলাম। ২/১টা মনে হয় আমরা মিটিংও করেছিলাম। অনেক আগের কথা, অনেক কিছু এখন আর মনে নাই। এভাবে কোন আন্দোলনের তালিকা প্রস্তুত করা যায় না। কারণ সারাদেশে প্রচুর মানুষ এতে অংশ নিয়েছিল। তাহলে এভাবে ভাবলে তো সবাই ভাষাসৈনিক।’
‘আজকে ৭৫ বছর পর কি তালিকা করবো। এগুলোর কোন অর্থ হয় না। আমরা বলেছিলাম, এখন এভাবে তালিকা করা যাবে না। এখন যদি বলা হয় ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের তালিকা করো, তা কি করা সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তো এখন আর তালিকা করছি না। ওগুলো তো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো আর নাই। এগুলো মানে তালিকার বিষয়টা আর এজেন্ডার মধ্যেই নাই।’
‘এসব নিয়ে আলোচনা করা এখন নিরর্থক’ মন্তব্য করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘একটা আন্দোলনে লক্ষাধিক লোক অংশগ্রহণ করে। সবার নাম তো থাকে না। যারা অগ্রণী তাদের নাম থাকে। আমার মনে হয় সম্পূর্ণ তালিকা করা কারও পক্ষে সম্ভব না, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা।
‘একটা কমিটি করা হয়েছিল, তারা এখন আর কেউ নাই। আমি আর আহমদ রফিক বেঁচে আছি আর সবাই মনে হয় মরে গেছে। কমিটিও নাই, আমার সঙ্গে এসব নিয়ে এখন আর কেউ কথাও বলেনি, তাই এ বিষয়ে আর কিছুর বলারও নাই।’
ভাষা সংগ্রামীদের নামের তালিকার ব্যাপারে সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছেন, নামের তালিকা হয়েছে। যে কারণে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা করা তুলনামূলক সহজ ছিল। কিন্তু ভাষা সংগ্রাম যখন হয়েছে তখন তো সে ধরনের কোন তালিকার ব্যাপার ছিল না। ভাষাসৈনিকদের নামের তালিকা তৈরি করার জন্য হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে ভাষাসৈনিকদের কোন সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি। কাদেরকে আমরা ভাষাসৈনিক বলব। যারা সে সময় জেল খেটেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন, কাদেরকে? আর ভাষা আন্দোলন কিন্তু সারাদেশেই হয়েছে। এসব কিছুই আমাদের ভাবতে হবে। ’