গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
* আমাদের সামাজিক পরিস্থিতি অনেক জটিল, তাই বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না : চুমকি
* বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক ব্যাধি, সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে : ফওজিয়া মোসলেম
* বাল্যবিয়ের পরই নানা জটিলতায় পড়তে হয় মেয়েদের : মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম
বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। দেশের বেসরকারী সংস্থাগুলোও বলছে, করোনাকালীন সময় বাল্যবিয়ে বাড়ছে। এর সঙ্গে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে। কেউ বলছে বাল্যবিয়ের কারনে শিক্ষার্থী ঝড়ে পরছে। আবার কেউ কেউ বলছে, ঝড়ে পড়ার কারনে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। আর সামাজিক বাস্তবতায় বাল্যবিয়ের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা যাচ্ছে না। বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে এ সম্পর্কিত আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সমাজের সচেতনতা বাড়ানো জরুরী। বুধবার (৩১ মে) রাজধানীর প্রেস ইন্সটিটিউটে ওয়াল্ড ভিশন ও সংবাদ যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ: আমরা কী করছি, সমাজ ও রাষ্ট্র কি ভাবছে?’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এমপি। দৈনিক সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার করিমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম চৌধুরী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোসা. ফেরদৌসী বেগম, একুশে পদক প্রাপ্ত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সায়েবা আক্তার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আয়শা সিদ্দিকী।
সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন ওয়ার্ল্ড ভিশনের পক্ষে রনেট লিও গোমেজ। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রাণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম অফিসার হালিমা বেগম, ওয়ার্ল্ড ভিশনের পক্ষে রনেট লিও গোমেজ, আরবান প্রোগ্রামের টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর মানস বিশ্বাস, এডভোকেসী কো-অর্ডিনেটর মীর রেজাউল করিম, ব্লাস্টের সমন্বয়কারী (ফরিদপুর ইউনিট) এডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী, বাল্যবিয়ের ভুক্তভোগী আফরোজা সরকার ও বিভিন্ন শিশু সংগঠনের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকবৃন্দ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘দেশে বাল্যবিয়ে কমেছে এবং এ বিষয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। যদিও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আমাদের সামাজিক পরিস্থিতি অনেক জটিল। তাই বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না।’ তার ভাষ্য, ১৮ বছরের আগে বিয়ে করা যাবে না, এ বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু মেয়েদের পালানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।
বৈঠকে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে একটি ভাল আইন হয়েছে, কিন্তু সেই আইনে ফাঁকও আছে।’ আইনটির ১৯ ধারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে বাবা-মা বা অভিভাবকের সম্মতিতে আদালতে সম্মতি নিয়ে রেপিস্টের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁক যদি বন্ধ না করা যায় তবেই বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’
এই প্রসঙ্গ টেনে মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, সামাজিক প্রেক্ষপটসহ অনেককিছু বিচারবিশ্লেষণ করে ‘স্পেশাল কিছু’ কেইস ১৯ এর ধারা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা যে নীতিমালা করেছি তার কোথাও লিখা নাই যে রেপিস্টের সাথে বিয়ের জন্য এটা করা হয়েছে। যখনই করলাম সাথে সাথেই সবাই ঘুরেফিরে সেই রেপিস্টদের কাছে চলে যাচ্ছে। রেইপ তো আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। যখন এটি করবে তখন বিচার হবে। পানিশমেন্ট হবে। কিন্তু তার প্রসঙ্গ আসছে কিভাবে?’
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিয়ে চুমকি বলেন, ‘অভিভবকরাই গোপনে বিয়ে দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে সব কাগজপত্র ঠিকঠাক। তাদের কোন দোষই নেই। কিন্তু দেখা গেল, কয়েকদিন যেতে না যেতেই সেই বিয়ে টিকছে না। ডির্ভোস হয়ে যাচ্ছে। একারণে সমাজে অনেক জটিলতা রয়েছে।’
বক্তব্যের এক পর্যায়ে বাল্য বিয়ের জন্য কাজীদের ‘দায়ী’ করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। একই সঙ্গে তিনি প্রশ্ন তোলেন, এতো এতো বাল্য বিয়ে হচ্ছে কিন্তু কতজন কাজীর শাস্তির আওতায় এসেছে। তিনি কাজীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিও জানান তিনি।
তবে এ বিষয়ে বৈঠকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আয়শা সিদ্দিকী বলেন, ‘কাজীদের বিচারের আওতায় আনা জটিল বিষয়। এক কাজীর অধীনে অনেক কাজী কাজ করছেন। কিন্তু যাদের কারোই লাইন্সেস নেই। এমন হলে এদের বিচারের আওতায় কিভাবে আনবে। তাছাড়া দেখা যায় অনেক কাজীর খোজঁই পাওয়া যায় না।’
সভায় মহিলা পরিষদের ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘বাল্য বিয়ে একটি সংকট, এটা আমরা আগে জানতাম না। এটা এখন জানছি, এইটাই বড় অগ্রগতি। এটা ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাল্য একটি সামাজিক ব্যাধী, এটি সামাজিকভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুমকির মতে, মেয়েদের বা অভিভাবকদের সচেতন করার চেয়ে আগামী প্রজন্মেকে সচেতন করা জরুরী। একই সঙ্গে যারা বিয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তাদের বুঝানো দরকার। তিনি বলেন, ‘আমরা হয়ত বাল্যবিয়ে বন্ধে মেয়েটাকে বুঝাচ্ছি বা মেয়ের অভিভাবকে বুঝাচ্ছি। কিন্তু ওই ছেলেটার জায়গা পর্যন্ত আমরা যাচ্ছি না। এই জায়গাগুলো গুরুত্ব দিতে হবে।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম চৌধুরী মনে করেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সন্তান ও অভিভাবকের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সন্তানের চাওয়া বুঝতে হবে এবং বুঝাতে হবে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সায়েবা আক্তার তার অভিজ্ঞতা তুলে বলেন, ‘বাল্য বিয়ের পরই নানা জটিলতা পড়তে হয় মেয়েদের। নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অল্প বয়সে গর্ভধারণে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু দুটোই ঘটছে।’
ব্লাস্টের ফরিদপুর ইউনিটের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন এডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী। তিনি তার বক্তব্যে অভিযোগ করেন, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি করা হলেও সেগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ে দেখতে পান না।
এ প্রসঙ্গে যুগ্ম সচিব ফেরদৌসী বেগম বলেন, তাদের কার্যক্রম ইউনিয়নসহ সব পর্যায়েই রয়েছে। তারা উঠুন বৈঠকসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাল্য বিয়ে নামক সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করা সম্ভব হবে। এজন্য অনেক প্রদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আয়শা সিদ্দিকীর কাছে বৈঠকের সঞ্চালক সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার করিম প্রশ্ন করেন, অধিদপ্তর থেকে বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে কতটুকু প্রতিরোধ হচ্ছে?
এ প্রসঙ্গে উপ-পরিচালক আয়শা সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রমের ফলে বর্তমানে বাল্য বিয়ে অনেক কমেছে। করোনাকালীন সময়ে কিছুটা বাড়লেও এখন এ বিষয়ে মানুষ সচেতন হয়ে গেছে। এখন যা হচ্ছে তা আগের তুলনায় কম।’
বৈঠকের স্বাগত বক্তব্যে ওয়ার্ল্ড ভিশনের রনেট লিও গোমেজ জানান, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী বাল্যবিবাহে বাংলাদেশ এশিয়ায় শীর্ষে। আর বিশ্বের ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
গোমেজ বলেন, ‘বাল্য বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবসময় বিশ্বের সেরা দশের মধ্যে থাকছে। এটি দেশের জন্য কোনভাবেই সম্মানজনক নয়।’
বুধবার, ৩১ মে ২০২৩
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
* আমাদের সামাজিক পরিস্থিতি অনেক জটিল, তাই বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না : চুমকি
* বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক ব্যাধি, সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে : ফওজিয়া মোসলেম
* বাল্যবিয়ের পরই নানা জটিলতায় পড়তে হয় মেয়েদের : মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম
বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। দেশের বেসরকারী সংস্থাগুলোও বলছে, করোনাকালীন সময় বাল্যবিয়ে বাড়ছে। এর সঙ্গে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে। কেউ বলছে বাল্যবিয়ের কারনে শিক্ষার্থী ঝড়ে পরছে। আবার কেউ কেউ বলছে, ঝড়ে পড়ার কারনে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। আর সামাজিক বাস্তবতায় বাল্যবিয়ের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা যাচ্ছে না। বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে এ সম্পর্কিত আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সমাজের সচেতনতা বাড়ানো জরুরী। বুধবার (৩১ মে) রাজধানীর প্রেস ইন্সটিটিউটে ওয়াল্ড ভিশন ও সংবাদ যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ: আমরা কী করছি, সমাজ ও রাষ্ট্র কি ভাবছে?’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এমপি। দৈনিক সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার করিমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম চৌধুরী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোসা. ফেরদৌসী বেগম, একুশে পদক প্রাপ্ত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সায়েবা আক্তার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আয়শা সিদ্দিকী।
সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন ওয়ার্ল্ড ভিশনের পক্ষে রনেট লিও গোমেজ। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রাণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম অফিসার হালিমা বেগম, ওয়ার্ল্ড ভিশনের পক্ষে রনেট লিও গোমেজ, আরবান প্রোগ্রামের টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর মানস বিশ্বাস, এডভোকেসী কো-অর্ডিনেটর মীর রেজাউল করিম, ব্লাস্টের সমন্বয়কারী (ফরিদপুর ইউনিট) এডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী, বাল্যবিয়ের ভুক্তভোগী আফরোজা সরকার ও বিভিন্ন শিশু সংগঠনের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকবৃন্দ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘দেশে বাল্যবিয়ে কমেছে এবং এ বিষয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। যদিও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আমাদের সামাজিক পরিস্থিতি অনেক জটিল। তাই বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না।’ তার ভাষ্য, ১৮ বছরের আগে বিয়ে করা যাবে না, এ বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু মেয়েদের পালানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।
বৈঠকে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে একটি ভাল আইন হয়েছে, কিন্তু সেই আইনে ফাঁকও আছে।’ আইনটির ১৯ ধারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে বাবা-মা বা অভিভাবকের সম্মতিতে আদালতে সম্মতি নিয়ে রেপিস্টের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁক যদি বন্ধ না করা যায় তবেই বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’
এই প্রসঙ্গ টেনে মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, সামাজিক প্রেক্ষপটসহ অনেককিছু বিচারবিশ্লেষণ করে ‘স্পেশাল কিছু’ কেইস ১৯ এর ধারা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা যে নীতিমালা করেছি তার কোথাও লিখা নাই যে রেপিস্টের সাথে বিয়ের জন্য এটা করা হয়েছে। যখনই করলাম সাথে সাথেই সবাই ঘুরেফিরে সেই রেপিস্টদের কাছে চলে যাচ্ছে। রেইপ তো আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। যখন এটি করবে তখন বিচার হবে। পানিশমেন্ট হবে। কিন্তু তার প্রসঙ্গ আসছে কিভাবে?’
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিয়ে চুমকি বলেন, ‘অভিভবকরাই গোপনে বিয়ে দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে সব কাগজপত্র ঠিকঠাক। তাদের কোন দোষই নেই। কিন্তু দেখা গেল, কয়েকদিন যেতে না যেতেই সেই বিয়ে টিকছে না। ডির্ভোস হয়ে যাচ্ছে। একারণে সমাজে অনেক জটিলতা রয়েছে।’
বক্তব্যের এক পর্যায়ে বাল্য বিয়ের জন্য কাজীদের ‘দায়ী’ করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। একই সঙ্গে তিনি প্রশ্ন তোলেন, এতো এতো বাল্য বিয়ে হচ্ছে কিন্তু কতজন কাজীর শাস্তির আওতায় এসেছে। তিনি কাজীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিও জানান তিনি।
তবে এ বিষয়ে বৈঠকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আয়শা সিদ্দিকী বলেন, ‘কাজীদের বিচারের আওতায় আনা জটিল বিষয়। এক কাজীর অধীনে অনেক কাজী কাজ করছেন। কিন্তু যাদের কারোই লাইন্সেস নেই। এমন হলে এদের বিচারের আওতায় কিভাবে আনবে। তাছাড়া দেখা যায় অনেক কাজীর খোজঁই পাওয়া যায় না।’
সভায় মহিলা পরিষদের ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘বাল্য বিয়ে একটি সংকট, এটা আমরা আগে জানতাম না। এটা এখন জানছি, এইটাই বড় অগ্রগতি। এটা ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাল্য একটি সামাজিক ব্যাধী, এটি সামাজিকভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুমকির মতে, মেয়েদের বা অভিভাবকদের সচেতন করার চেয়ে আগামী প্রজন্মেকে সচেতন করা জরুরী। একই সঙ্গে যারা বিয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তাদের বুঝানো দরকার। তিনি বলেন, ‘আমরা হয়ত বাল্যবিয়ে বন্ধে মেয়েটাকে বুঝাচ্ছি বা মেয়ের অভিভাবকে বুঝাচ্ছি। কিন্তু ওই ছেলেটার জায়গা পর্যন্ত আমরা যাচ্ছি না। এই জায়গাগুলো গুরুত্ব দিতে হবে।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম চৌধুরী মনে করেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সন্তান ও অভিভাবকের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সন্তানের চাওয়া বুঝতে হবে এবং বুঝাতে হবে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সায়েবা আক্তার তার অভিজ্ঞতা তুলে বলেন, ‘বাল্য বিয়ের পরই নানা জটিলতা পড়তে হয় মেয়েদের। নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অল্প বয়সে গর্ভধারণে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু দুটোই ঘটছে।’
ব্লাস্টের ফরিদপুর ইউনিটের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন এডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী। তিনি তার বক্তব্যে অভিযোগ করেন, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি করা হলেও সেগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ে দেখতে পান না।
এ প্রসঙ্গে যুগ্ম সচিব ফেরদৌসী বেগম বলেন, তাদের কার্যক্রম ইউনিয়নসহ সব পর্যায়েই রয়েছে। তারা উঠুন বৈঠকসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাল্য বিয়ে নামক সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করা সম্ভব হবে। এজন্য অনেক প্রদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আয়শা সিদ্দিকীর কাছে বৈঠকের সঞ্চালক সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার করিম প্রশ্ন করেন, অধিদপ্তর থেকে বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে কতটুকু প্রতিরোধ হচ্ছে?
এ প্রসঙ্গে উপ-পরিচালক আয়শা সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রমের ফলে বর্তমানে বাল্য বিয়ে অনেক কমেছে। করোনাকালীন সময়ে কিছুটা বাড়লেও এখন এ বিষয়ে মানুষ সচেতন হয়ে গেছে। এখন যা হচ্ছে তা আগের তুলনায় কম।’
বৈঠকের স্বাগত বক্তব্যে ওয়ার্ল্ড ভিশনের রনেট লিও গোমেজ জানান, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী বাল্যবিবাহে বাংলাদেশ এশিয়ায় শীর্ষে। আর বিশ্বের ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
গোমেজ বলেন, ‘বাল্য বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবসময় বিশ্বের সেরা দশের মধ্যে থাকছে। এটি দেশের জন্য কোনভাবেই সম্মানজনক নয়।’