রেজাউল করিম খোকন
প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডি তৎপরতা বেড়ে গেছে। আর এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলের রেমিট্যান্সে বড় পতন হচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে ভালো রেট পাওয়া এবং খরচ কম হওয়ায় প্রবাসীদের একটি অংশ অবৈধ পন্থা জেনেও হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে। হুন্ডিচক্রে বন্দী হয়ে পড়েছে বৈধপথের রেমিট্যান্স। এর ফলে অর্থ পাচারও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পরিস্থিতির উন্নয়নে জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্সে প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে সরকার। হুন্ডিচক্র বিদেশে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা রেখে দেয় এবং তাদের এজেন্টরা দেশে সুবিধাভোগীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনছে। প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডি তৎপরতা অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
সাধারণত বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। মূলত শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারের জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় কম মূল্য বা বেশি মূল্য দেখানো হয়। অর্থ পাচারের জন্য দেশের বাইরে যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে, তা হুন্ডিচক্র মেটায়। ব্যাংকিং চ্যানেলে কেউ পাঠালেও প্রবাসীর সুবিধাভোগীরা দেশে টাকা পান। বিদেশি হুন্ডি এজেন্ট প্রবাসীর বৈদেশিক মুদ্রা কিনে এখানে টাকা পরিশোধ করে। ব্যবসার পাশাপাশি যারা বিদেশে বাড়ি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেন, তারা নানাভাবে হুন্ডি চক্রের দ্বারস্থ হন।
মাঝখানে করোনার কারণে হুন্ডি বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ব্যাপক কমে গেলে হুন্ডি প্রবণতা কমানোর উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি লেখে সরকার। পাশাপাশি রেমিট্যান্স কমার কারণ অনুসন্ধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৭ সালের শুরুর দিকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দুটি টিম পাঠায়। ওই প্রতিনিধি দল শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বাইরে বেশি অর্থ পাওয়াকে রেমিট্যান্স কমার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরেছিল। তখন রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো ও অর্থ পাচার ঠেকাতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। তবে সরকার রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ না কমিয়ে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়।
হুন্ডি হলো প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয় না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যযুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। বর্তমানে বৈধ পদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মোগল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মোগল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সঙ্গে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি। মোগল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। মোগল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্রাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারতজুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার।
কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধপথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমাতে হবে। হুন্ডি একটি বৈশ্বিক চক্র। যেখানে চাহিদা থাকে, সেখান থেকেই সব সময় অর্থ সংগ্রহ করা হয় না। হয়তো কেউ যুক্তরাষ্ট্রে ডলার কিনতে চাচ্ছেন। দুবাই বা সৌদি আরবের প্রবাসীদের থেকে অর্থ নিয়ে সেখানে পৌঁছে দেন। ফলে সারাবিশ্ব থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানোর উপায় বের করতে হবে।
হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইলেও অনেক সময় ব্যাংকে যেতে পারেন না। আবার প্রবাসের সব শ্রমিকের বৈধ কাগজও নেই। যে কারণে চাইলেও অনেকে ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে পারেন না। সামগ্রিকভাবে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রতি উৎসাহী। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের দুটি প্রধান উপায় হলো পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমাদের আমদানি খরচ বেশি। ফলে এই উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বাড়ানোর সুযোগ কম। সেক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ আসে অবৈধ চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে।
সম্প্রতি রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, মালদ্বীপ থেকে ৬৬ শতাংশ শ্রমিক হুন্ডিতে টাকা পাঠান। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশের ব্যাংক হিসাবই নেই। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ মালদ্বীপে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক আছেন দুই লাখের মতো। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক এক কোটি। সেক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ থেকে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে আসে, অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। আরব আমিরাতের দুবাই, শারজা ও আবুধাবিতে কর্মরত শ্রমিকরা দেশে টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো ছুটি পান না। এজন্য তারা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেন না। বাসার পাশেই হুন্ডি করার সুযোগ আছে, এটাই সহজ পথ। আবার এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে পাঠালে যেখানে প্রতি দিরহামে পাওয়া যায় বেশি টাকা। দুই টাকা বেশি পেতে তারা হুন্ডিতে টাকা পাঠান।
দুবাইয়ের বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক থাকেন। প্রতিটি জায়গাতেই রয়েছে হুন্ডি করার ব্যবস্থা। অবৈধ পথে মানে হুন্ডিতে প্রবাসী আয় আসা বন্ধ হলে দেশে ডলারের সরবরাহ বাড়বে এবং অর্থ পাচার কমবে। এজন্য মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে এখন বেশ কিছু এমএফএস প্রতিষ্ঠান বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনছে। বিশ্বের ৯০টি দেশ থেকে ৮০টির বেশি মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানো যায়। ২০২২ সালে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আয় এসেছে বিকাশের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে নিজের একাউন্ট প্রবাসে থেকেই পরিচালনা করতে পারেন। তবে প্রবাসী শ্রমিকরা অ্যাপস ব্যবহারে এখনও অনেক পিছিয়ে আছেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ভয়ও কাজ করে। সরকারের বেঁধে দেয়া হারের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি। এই অবস্থায় প্রবাসী শ্রমিকেরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে বেশি উৎসাহী হন।
সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়েও তাদের ব্যাংকমুখী করতে পারেনি। হুন্ডি ব্যবসা প্রসারের আরেকটি কারণ দেশ থেকে ব্যাপক হারে অর্থ পাচার হওয়া। পাচারকারীরাই মূলত হুন্ডি ব্যবসায়ীদের অর্থের জোগানদাতা। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে পাচারকারীদের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। সরকার যতই প্রণোদনা দিক না কেন, বাইরের বাজারে তার চেয়ে বেশি দাম পেলে সেখানেই ঝুঁকবেন। বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধের বিকল্প নেই।
হুন্ডি ব্যবসার লাগাম টেনে ধরতে অর্থ পাচার যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারও বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেয়া এখন সময়ের দাবি। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য, বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার। কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধপথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমাতে হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই ২০২৩
প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডি তৎপরতা বেড়ে গেছে। আর এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলের রেমিট্যান্সে বড় পতন হচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে ভালো রেট পাওয়া এবং খরচ কম হওয়ায় প্রবাসীদের একটি অংশ অবৈধ পন্থা জেনেও হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে। হুন্ডিচক্রে বন্দী হয়ে পড়েছে বৈধপথের রেমিট্যান্স। এর ফলে অর্থ পাচারও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পরিস্থিতির উন্নয়নে জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্সে প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে সরকার। হুন্ডিচক্র বিদেশে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা রেখে দেয় এবং তাদের এজেন্টরা দেশে সুবিধাভোগীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনছে। প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডি তৎপরতা অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
সাধারণত বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। মূলত শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারের জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় কম মূল্য বা বেশি মূল্য দেখানো হয়। অর্থ পাচারের জন্য দেশের বাইরে যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে, তা হুন্ডিচক্র মেটায়। ব্যাংকিং চ্যানেলে কেউ পাঠালেও প্রবাসীর সুবিধাভোগীরা দেশে টাকা পান। বিদেশি হুন্ডি এজেন্ট প্রবাসীর বৈদেশিক মুদ্রা কিনে এখানে টাকা পরিশোধ করে। ব্যবসার পাশাপাশি যারা বিদেশে বাড়ি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেন, তারা নানাভাবে হুন্ডি চক্রের দ্বারস্থ হন।
মাঝখানে করোনার কারণে হুন্ডি বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ব্যাপক কমে গেলে হুন্ডি প্রবণতা কমানোর উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি লেখে সরকার। পাশাপাশি রেমিট্যান্স কমার কারণ অনুসন্ধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৭ সালের শুরুর দিকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দুটি টিম পাঠায়। ওই প্রতিনিধি দল শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বাইরে বেশি অর্থ পাওয়াকে রেমিট্যান্স কমার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরেছিল। তখন রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো ও অর্থ পাচার ঠেকাতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। তবে সরকার রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ না কমিয়ে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়।
হুন্ডি হলো প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয় না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যযুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। বর্তমানে বৈধ পদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মোগল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মোগল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সঙ্গে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি। মোগল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। মোগল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্রাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারতজুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার।
কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধপথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমাতে হবে। হুন্ডি একটি বৈশ্বিক চক্র। যেখানে চাহিদা থাকে, সেখান থেকেই সব সময় অর্থ সংগ্রহ করা হয় না। হয়তো কেউ যুক্তরাষ্ট্রে ডলার কিনতে চাচ্ছেন। দুবাই বা সৌদি আরবের প্রবাসীদের থেকে অর্থ নিয়ে সেখানে পৌঁছে দেন। ফলে সারাবিশ্ব থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানোর উপায় বের করতে হবে।
হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইলেও অনেক সময় ব্যাংকে যেতে পারেন না। আবার প্রবাসের সব শ্রমিকের বৈধ কাগজও নেই। যে কারণে চাইলেও অনেকে ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে পারেন না। সামগ্রিকভাবে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রতি উৎসাহী। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের দুটি প্রধান উপায় হলো পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমাদের আমদানি খরচ বেশি। ফলে এই উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বাড়ানোর সুযোগ কম। সেক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ আসে অবৈধ চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে।
সম্প্রতি রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, মালদ্বীপ থেকে ৬৬ শতাংশ শ্রমিক হুন্ডিতে টাকা পাঠান। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশের ব্যাংক হিসাবই নেই। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ মালদ্বীপে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক আছেন দুই লাখের মতো। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক এক কোটি। সেক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ থেকে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে আসে, অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। আরব আমিরাতের দুবাই, শারজা ও আবুধাবিতে কর্মরত শ্রমিকরা দেশে টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো ছুটি পান না। এজন্য তারা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেন না। বাসার পাশেই হুন্ডি করার সুযোগ আছে, এটাই সহজ পথ। আবার এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে পাঠালে যেখানে প্রতি দিরহামে পাওয়া যায় বেশি টাকা। দুই টাকা বেশি পেতে তারা হুন্ডিতে টাকা পাঠান।
দুবাইয়ের বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক থাকেন। প্রতিটি জায়গাতেই রয়েছে হুন্ডি করার ব্যবস্থা। অবৈধ পথে মানে হুন্ডিতে প্রবাসী আয় আসা বন্ধ হলে দেশে ডলারের সরবরাহ বাড়বে এবং অর্থ পাচার কমবে। এজন্য মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে এখন বেশ কিছু এমএফএস প্রতিষ্ঠান বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনছে। বিশ্বের ৯০টি দেশ থেকে ৮০টির বেশি মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানো যায়। ২০২২ সালে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আয় এসেছে বিকাশের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে নিজের একাউন্ট প্রবাসে থেকেই পরিচালনা করতে পারেন। তবে প্রবাসী শ্রমিকরা অ্যাপস ব্যবহারে এখনও অনেক পিছিয়ে আছেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ভয়ও কাজ করে। সরকারের বেঁধে দেয়া হারের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি। এই অবস্থায় প্রবাসী শ্রমিকেরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে বেশি উৎসাহী হন।
সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়েও তাদের ব্যাংকমুখী করতে পারেনি। হুন্ডি ব্যবসা প্রসারের আরেকটি কারণ দেশ থেকে ব্যাপক হারে অর্থ পাচার হওয়া। পাচারকারীরাই মূলত হুন্ডি ব্যবসায়ীদের অর্থের জোগানদাতা। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে পাচারকারীদের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। সরকার যতই প্রণোদনা দিক না কেন, বাইরের বাজারে তার চেয়ে বেশি দাম পেলে সেখানেই ঝুঁকবেন। বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধের বিকল্প নেই।
হুন্ডি ব্যবসার লাগাম টেনে ধরতে অর্থ পাচার যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারও বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেয়া এখন সময়ের দাবি। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য, বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার। কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধপথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমাতে হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]