alt

উপ-সম্পাদকীয়

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(গতকালের পর)

পাতিবুনিয়া গণহত্যা : পাতিবুনিয়া গ্রামটি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ঝিলা নদীর তীরে গ্রামটির অবস্থান। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধপন্থি সশস্ত্র বামপন্থীরা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করছিল। সশস্ত্র এই বামপন্থীদের স্থানীয় নেতা ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) খুলনা জেলার সাধারন সম্পাদক শেখ আবদুল মজিদ। তার নাম অনুসারে এই বামপন্থীরা ‘মজিদ বাহিনী’ নামেও পরিচিতি অর্জন করেছিল। তিনি পার্টির নির্দেশ উপেক্ষা করে একটি বাহিনী-সহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ পাতিবুনিয়ায় অবস্থানরত এই বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা ঝিলা নদীতে পাকিস্তানি সেনা, বিহারী ও রাজাকারদের একটি লঞ্চ আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয়। এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন রাজাকার মারা যায় এবং কিছু গোলাবারুদ-সহ ১১টি রাইফেল মুুক্তিসংগ্রামীদের হস্তগত হয়।

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি গানবোট নিয়ে পাতিবুনিয়া আক্রমণ করে। বিকেল পাঁচটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা গানবোট থেকে পাতিবুনিয়া গ্রামের ওপর গুলি ও শেল নিক্ষেপ করা শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ গোলা নিক্ষেপের পর স্থলভাগ থেকে পাল্টা আক্রমণের কোনো আলামত না দেখে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের মধ্যে রাজাকারদের নামিয়ে দেয়।

রাজাকাররা গ্রামে ঢুকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালানো শুরু করে। প্রথমে তারা গোলক রায়, পুলিন রায় প্রমুখের বাড়ি প্রবেশ করে সেখানে কাউকে না পেয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামের মানুষ এ সময়ে ভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। অনুমতি রায় নামক জনৈকা বৃদ্ধা মলিনা রায় নামক তার তিন বছরের এক পৌত্রীকে কোলে নিয়ে বিলের মধ্য দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। রাজাকাররা তার পিছু ধাওয়া করে শিশুটি-সহ তাকে গুলি করে। প্রথম গুলিটি লাগে শিশু মলিনার গায়ে। অনুমতি রায় রক্তাক্ত অবস্থায় শিশুটিকে বুকে চেপে ধরেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাজাকাররা তাকে গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মারা যাওয়ার সময়ও তার কোলে ছিল মলিনা রায়ের রক্তাক্ত লাশ।

রাজাকাররা এরপর গ্রামের উত্তর পাড়ার সরদার বাড়িতে প্রবেশ করে। ঐ বাড়ির লোকেরা তখন বাড়ির পশ্চিম পাশের আউশ ধানের ক্ষেত ও খালের ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাজাকাররা গুলি করতে করতে ধান ক্ষেতে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে সরদার বাড়ির তিনজন ও মন্টু কুমার নামে এক মুক্তিসংগ্রামীকে হত্যা করে।

তাদের হত্যা করে চলে যাওয়ার সময় রাজাকাররা ঐ গ্রামের মনোহর মন্ডলের কয়েকটি পোষা হাঁস ধরে নিয়ে যায়। রাজাকররা যখন হাঁস ধরার চেষ্টা করছিল, তখন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। রাজাকারদের তাড়া খেয়ে একটি হাঁস উড়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি গাছের আড়ালে গিয়ে পড়ে। রাজাকাররাও হাঁসের পেছনে পেছনে দৌড়ে সেখানে গিয়ে হাজির হয়। দুর্ভাগ্যবশত ঐ গাছের আড়ালে সরদার বাড়ির মহেন্দ্রনাথ সরদার লুকিয়ে ছিলেন। রাজাকাররা তাকে দেখামাত্র চার-পাঁচ গজ দূর থেকে গুলি করে। বাবু মহেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারান।

এ গণহত্যার পরে রাজাকাররা যখন গানবোটে ফিরে যাচ্ছিল, তখন স্থানীয় পি কে বলাবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনন্ত কুমার রায়কে সপরিবারে বিলে একটি ঝোঁপের আড়ালে দেখতে পায়। তাকে লক্ষ করে রাজাকাররা অস্ত্র তাক করে এগিয়ে যায় এবং অনন্ত রায়কে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকারদের আরেকটি দল সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাটি গ্রামের জোবেদ আলী কাজী নামক মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠককে আটক করে। পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যক্তি হিন্দু অধ্যুষিত পাতিবুনিয়া গ্রামে আশ্রয় নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের মানসিকভাবে শক্তি জোগাতেন। বিশেষ করে একাত্তরে বাংলাদেশের একক সর্ববৃহৎ চুকনগর গণহত্যার পর তিনি এ অঞ্চলের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে আসছিলেন।

অনন্ত কুমার রায় ও জোবেদ আলী কাজীকে রাজাকাররা গানবোটে করে নিয়ে যায়। অনন্ত রায়কে গাবতলা গ্রামে নিয়ে নদীর চরে নামিয়ে চলে যেতে বলে। অনন্ত রায় যখন সরল বিশ্বাসে চরের কাঁদার মধ্য দিয়ে হেঁটে তীরের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার লাশ পড়েছিল নদীর চরের উপর, পরে তা কোথায় ভেসে যায় কেউ জানে না। জোবেদ আলীকে পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন করে হত্যা করে।

শোভনা গণহত্যা : বর্তমান খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি গ্রাম শোভনা। পাতিবুুনিয়া গণহত্যার কিছুদিন পর ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এ গ্রামে গণহত্যা চালায় শত্রুবাহিনী। সেদিন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসর কতিপয় রাজাকার শোভনার চারপাশ দিয়ে ভদ্রা, ঘ্যাংরাইল ও ঝিলা নদীর বিভিন্ন শাখা দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শোভনায় আক্রমণ করে। সেদিন সম্ভবত তাদের বড় কোনো অভিযানের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু রাস্তা কর্দমাক্ত থাকায় পাকিস্তানি সেনারা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। শোভনা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে এবং পার্শ্ববর্তী ভদ্রদিয়া গ্রামে এদিন তারা অনেকগুলো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শোভনা গণহত্যায় মোট ৪৩ জন শহীদ হয়েছিলেন বলে জানা যায়।

কানকাটি গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা বিরোধীরা কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের কানকাটি গ্রামে নারকীয় তান্ডব চালায়। ওই দিন একটি হিন্দু পরিবারের ৭ জনসহ ৮ নিরীহ গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এখনও কান্না থামছে না বেঁচে থাকা সংখ্যালঘু এ পরিবারের স্বজনদের।

স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় হামলা-লুটপাট চালায়। তখন কানকাটি গ্রামের সুরেশ চন্দ্র সরকার ছিলেন এলাকার মাতব্বর। প্রগতিশীল রাজনীতিক হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক (পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন) সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় কানকাটিবাসীর জন্য। মে মাসের প্রথম দিকে হানাদার বাহিনী এ গ্রামে নির্বিচারে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর ওই গ্রামে দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। (চলবে)

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

বৃহস্পতিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(গতকালের পর)

পাতিবুনিয়া গণহত্যা : পাতিবুনিয়া গ্রামটি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ঝিলা নদীর তীরে গ্রামটির অবস্থান। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধপন্থি সশস্ত্র বামপন্থীরা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করছিল। সশস্ত্র এই বামপন্থীদের স্থানীয় নেতা ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) খুলনা জেলার সাধারন সম্পাদক শেখ আবদুল মজিদ। তার নাম অনুসারে এই বামপন্থীরা ‘মজিদ বাহিনী’ নামেও পরিচিতি অর্জন করেছিল। তিনি পার্টির নির্দেশ উপেক্ষা করে একটি বাহিনী-সহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ পাতিবুনিয়ায় অবস্থানরত এই বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা ঝিলা নদীতে পাকিস্তানি সেনা, বিহারী ও রাজাকারদের একটি লঞ্চ আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয়। এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন রাজাকার মারা যায় এবং কিছু গোলাবারুদ-সহ ১১টি রাইফেল মুুক্তিসংগ্রামীদের হস্তগত হয়।

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি গানবোট নিয়ে পাতিবুনিয়া আক্রমণ করে। বিকেল পাঁচটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা গানবোট থেকে পাতিবুনিয়া গ্রামের ওপর গুলি ও শেল নিক্ষেপ করা শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ গোলা নিক্ষেপের পর স্থলভাগ থেকে পাল্টা আক্রমণের কোনো আলামত না দেখে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের মধ্যে রাজাকারদের নামিয়ে দেয়।

রাজাকাররা গ্রামে ঢুকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালানো শুরু করে। প্রথমে তারা গোলক রায়, পুলিন রায় প্রমুখের বাড়ি প্রবেশ করে সেখানে কাউকে না পেয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামের মানুষ এ সময়ে ভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। অনুমতি রায় নামক জনৈকা বৃদ্ধা মলিনা রায় নামক তার তিন বছরের এক পৌত্রীকে কোলে নিয়ে বিলের মধ্য দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। রাজাকাররা তার পিছু ধাওয়া করে শিশুটি-সহ তাকে গুলি করে। প্রথম গুলিটি লাগে শিশু মলিনার গায়ে। অনুমতি রায় রক্তাক্ত অবস্থায় শিশুটিকে বুকে চেপে ধরেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাজাকাররা তাকে গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মারা যাওয়ার সময়ও তার কোলে ছিল মলিনা রায়ের রক্তাক্ত লাশ।

রাজাকাররা এরপর গ্রামের উত্তর পাড়ার সরদার বাড়িতে প্রবেশ করে। ঐ বাড়ির লোকেরা তখন বাড়ির পশ্চিম পাশের আউশ ধানের ক্ষেত ও খালের ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাজাকাররা গুলি করতে করতে ধান ক্ষেতে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে সরদার বাড়ির তিনজন ও মন্টু কুমার নামে এক মুক্তিসংগ্রামীকে হত্যা করে।

তাদের হত্যা করে চলে যাওয়ার সময় রাজাকাররা ঐ গ্রামের মনোহর মন্ডলের কয়েকটি পোষা হাঁস ধরে নিয়ে যায়। রাজাকররা যখন হাঁস ধরার চেষ্টা করছিল, তখন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। রাজাকারদের তাড়া খেয়ে একটি হাঁস উড়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি গাছের আড়ালে গিয়ে পড়ে। রাজাকাররাও হাঁসের পেছনে পেছনে দৌড়ে সেখানে গিয়ে হাজির হয়। দুর্ভাগ্যবশত ঐ গাছের আড়ালে সরদার বাড়ির মহেন্দ্রনাথ সরদার লুকিয়ে ছিলেন। রাজাকাররা তাকে দেখামাত্র চার-পাঁচ গজ দূর থেকে গুলি করে। বাবু মহেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারান।

এ গণহত্যার পরে রাজাকাররা যখন গানবোটে ফিরে যাচ্ছিল, তখন স্থানীয় পি কে বলাবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনন্ত কুমার রায়কে সপরিবারে বিলে একটি ঝোঁপের আড়ালে দেখতে পায়। তাকে লক্ষ করে রাজাকাররা অস্ত্র তাক করে এগিয়ে যায় এবং অনন্ত রায়কে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকারদের আরেকটি দল সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাটি গ্রামের জোবেদ আলী কাজী নামক মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠককে আটক করে। পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যক্তি হিন্দু অধ্যুষিত পাতিবুনিয়া গ্রামে আশ্রয় নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের মানসিকভাবে শক্তি জোগাতেন। বিশেষ করে একাত্তরে বাংলাদেশের একক সর্ববৃহৎ চুকনগর গণহত্যার পর তিনি এ অঞ্চলের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে আসছিলেন।

অনন্ত কুমার রায় ও জোবেদ আলী কাজীকে রাজাকাররা গানবোটে করে নিয়ে যায়। অনন্ত রায়কে গাবতলা গ্রামে নিয়ে নদীর চরে নামিয়ে চলে যেতে বলে। অনন্ত রায় যখন সরল বিশ্বাসে চরের কাঁদার মধ্য দিয়ে হেঁটে তীরের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার লাশ পড়েছিল নদীর চরের উপর, পরে তা কোথায় ভেসে যায় কেউ জানে না। জোবেদ আলীকে পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন করে হত্যা করে।

শোভনা গণহত্যা : বর্তমান খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি গ্রাম শোভনা। পাতিবুুনিয়া গণহত্যার কিছুদিন পর ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এ গ্রামে গণহত্যা চালায় শত্রুবাহিনী। সেদিন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসর কতিপয় রাজাকার শোভনার চারপাশ দিয়ে ভদ্রা, ঘ্যাংরাইল ও ঝিলা নদীর বিভিন্ন শাখা দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শোভনায় আক্রমণ করে। সেদিন সম্ভবত তাদের বড় কোনো অভিযানের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু রাস্তা কর্দমাক্ত থাকায় পাকিস্তানি সেনারা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। শোভনা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে এবং পার্শ্ববর্তী ভদ্রদিয়া গ্রামে এদিন তারা অনেকগুলো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শোভনা গণহত্যায় মোট ৪৩ জন শহীদ হয়েছিলেন বলে জানা যায়।

কানকাটি গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা বিরোধীরা কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের কানকাটি গ্রামে নারকীয় তান্ডব চালায়। ওই দিন একটি হিন্দু পরিবারের ৭ জনসহ ৮ নিরীহ গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এখনও কান্না থামছে না বেঁচে থাকা সংখ্যালঘু এ পরিবারের স্বজনদের।

স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় হামলা-লুটপাট চালায়। তখন কানকাটি গ্রামের সুরেশ চন্দ্র সরকার ছিলেন এলাকার মাতব্বর। প্রগতিশীল রাজনীতিক হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক (পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন) সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় কানকাটিবাসীর জন্য। মে মাসের প্রথম দিকে হানাদার বাহিনী এ গ্রামে নির্বিচারে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর ওই গ্রামে দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। (চলবে)

back to top