তরিকুল ইসলাম
বাংলাদেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণতহয়েছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। ঈদের আনন্দযাত্রা প্রায়ই বিষাদে রূপ নিচ্ছে, যখন প্রিয়জনের হাসিমুখের পরিবর্তে বাড়ির উঠানে ফিরছে নিথর দেহ। বিশেষ করে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩১ হাজার মানুষ মারা যান এবং আহত হন ৩ লাখেরও বেশি। এই প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ও আঘাত কমাতে জরুরি একটি শক্তিশালী ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’।
ঈদে দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, গত ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ৮ দিনে ১১০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩২ জন নিহত এবং ২০৮ জন আহত হয়েছেন। বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে, ঈদের আগে-পরে ১৫ দিনে ৩১৫টি দুর্ঘটনায় ৩২২ জন নিহত এবং ৮২৬ জন আহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যে, ১১ দিনে ২৫৭টি দুর্ঘটনায় ২৪৯ জনের মৃত্যু এবং ৫৫৩ জন আহত হয়েছেন। এই মৃত্যু ও আঘাতের সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে অগণিত পরিবারের শোক ও ক্ষতি।
দুর্ঘটনার কারণ
এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে :
ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন : ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল।
বেপরোয়া গতি : চালকদের অতিরিক্ত গতি এবং গতিসীমা না মানা।
চালকদের অদক্ষতা ও অসচেতনতা : অপ্রশিক্ষিত চালক, ভুয়া লাইসেন্স, এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা।
মদ্যপান ও অসুস্থতা : মদ্যপ অবস্থায় বা শারীরিক মানসিক অসুস্থতায় গাড়ি চালানো।
মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা : মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, এবং স্বল্পগতির যানবাহনের অবাধ চলাচল।
অনিয়মিত পার্কিং ও ওভারটেকিং : যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, অতিরিক্ত যাত্রী বা পণ্য পরিবহণ, এবং বেপরোয়া ওভারটেকিং।
জনসচেতনতার অভাব : সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান।
বর্তমান ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২’এ সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়া হয়নি। গাড়ির গতিসীমা, সিটবেল্ট, মানসম্মত হেলমেট, শিশু আসন, এবং মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব রয়েছে। ফলে, সড়কে বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ জরুরি :
কঠোর গতি নিয়ন্ত্রণ : স্পিডগান ব্যবহার করে গতিসীমা মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং অতিরিক্ত গতির জন্য কঠোর শাস্তি প্রয়োগ।
যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিতকরণ : ত্রুটিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা।
মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণ : মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, এবং স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ।
চালক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা : চালকদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।
পুলিশি নজরদারি জোরদার : ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি : সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন ও সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রচারণা।
শক্তিশালী আইন প্রণয়ন : ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তার কাঠামো শক্তিশালী করা।
বৈশ্বিক লক্ষ্য ও বাংলাদেশ
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং গ্লোবাল প্ল্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি২০২৩ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৮৭ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে বাংলাদেশকে শক্তিশালী নীতি, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমানে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এবং ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২’ থাকলেও সড়ক নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন এবং এর কঠোর বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
উপসংহার
সড়ক দুর্ঘটনা এখন মহামারী রূপ নিয়েছে। আনন্দযাত্রা যেন বিষাদে রূপ না নেয়, তার জন্য সরকার, পুলিশ, এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, যা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির কারণ, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনসচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং প্রযুক্তিগত সমাধানের মাধ্যমে সড়ককে নিরাপদ করা সম্ভব। প্রতিটি ঈদ ও উৎসব যেন হয় নিরাপদ, উৎকণ্ঠাহীন, এবং আনন্দময়Ñএই প্রত্যাশায় সবাইকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার শবযাত্রা থামাতে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা এবং জনগণের সহযোগিতা অপরিহার্য।
[লেখক : অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেফটি প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ]
তরিকুল ইসলাম
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
বাংলাদেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণতহয়েছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। ঈদের আনন্দযাত্রা প্রায়ই বিষাদে রূপ নিচ্ছে, যখন প্রিয়জনের হাসিমুখের পরিবর্তে বাড়ির উঠানে ফিরছে নিথর দেহ। বিশেষ করে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩১ হাজার মানুষ মারা যান এবং আহত হন ৩ লাখেরও বেশি। এই প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ও আঘাত কমাতে জরুরি একটি শক্তিশালী ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’।
ঈদে দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, গত ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ৮ দিনে ১১০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩২ জন নিহত এবং ২০৮ জন আহত হয়েছেন। বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে, ঈদের আগে-পরে ১৫ দিনে ৩১৫টি দুর্ঘটনায় ৩২২ জন নিহত এবং ৮২৬ জন আহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যে, ১১ দিনে ২৫৭টি দুর্ঘটনায় ২৪৯ জনের মৃত্যু এবং ৫৫৩ জন আহত হয়েছেন। এই মৃত্যু ও আঘাতের সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে অগণিত পরিবারের শোক ও ক্ষতি।
দুর্ঘটনার কারণ
এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে :
ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন : ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল।
বেপরোয়া গতি : চালকদের অতিরিক্ত গতি এবং গতিসীমা না মানা।
চালকদের অদক্ষতা ও অসচেতনতা : অপ্রশিক্ষিত চালক, ভুয়া লাইসেন্স, এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা।
মদ্যপান ও অসুস্থতা : মদ্যপ অবস্থায় বা শারীরিক মানসিক অসুস্থতায় গাড়ি চালানো।
মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা : মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, এবং স্বল্পগতির যানবাহনের অবাধ চলাচল।
অনিয়মিত পার্কিং ও ওভারটেকিং : যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, অতিরিক্ত যাত্রী বা পণ্য পরিবহণ, এবং বেপরোয়া ওভারটেকিং।
জনসচেতনতার অভাব : সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান।
বর্তমান ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২’এ সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়া হয়নি। গাড়ির গতিসীমা, সিটবেল্ট, মানসম্মত হেলমেট, শিশু আসন, এবং মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব রয়েছে। ফলে, সড়কে বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ জরুরি :
কঠোর গতি নিয়ন্ত্রণ : স্পিডগান ব্যবহার করে গতিসীমা মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং অতিরিক্ত গতির জন্য কঠোর শাস্তি প্রয়োগ।
যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিতকরণ : ত্রুটিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা।
মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণ : মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, এবং স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ।
চালক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা : চালকদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।
পুলিশি নজরদারি জোরদার : ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি : সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন ও সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রচারণা।
শক্তিশালী আইন প্রণয়ন : ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তার কাঠামো শক্তিশালী করা।
বৈশ্বিক লক্ষ্য ও বাংলাদেশ
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং গ্লোবাল প্ল্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি২০২৩ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৮৭ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে বাংলাদেশকে শক্তিশালী নীতি, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমানে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এবং ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২’ থাকলেও সড়ক নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন এবং এর কঠোর বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
উপসংহার
সড়ক দুর্ঘটনা এখন মহামারী রূপ নিয়েছে। আনন্দযাত্রা যেন বিষাদে রূপ না নেয়, তার জন্য সরকার, পুলিশ, এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, যা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির কারণ, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনসচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং প্রযুক্তিগত সমাধানের মাধ্যমে সড়ককে নিরাপদ করা সম্ভব। প্রতিটি ঈদ ও উৎসব যেন হয় নিরাপদ, উৎকণ্ঠাহীন, এবং আনন্দময়Ñএই প্রত্যাশায় সবাইকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার শবযাত্রা থামাতে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা এবং জনগণের সহযোগিতা অপরিহার্য।
[লেখক : অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেফটি প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ]