জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শুধু শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে
গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ বছর মৌসুমের আগে সংক্রমণ শুরু হওয়ায় সিটি করপোরেশন সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না। এছাড়া সাময়িক বা মৌসুমি রোগ বিধায় স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে দীর্ঘমেয়াদি কোন ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের মনোযোগ না থাকায় ডেঙ্গু রোগটা এবার জেঁকে বসেছে। এবারের বৃষ্টিও এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী, প্রায় প্রতিদিনই হালকা ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে, মুষলধারে বৃষ্টি হলে এডিস মশার লার্ভা ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে যেত, মশা ডিম পেড়ে বংশ বিস্তারের সুযোগ পেত না।
এবার শুধু শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বর্তমানে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০ কোটি লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু এই সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার বেশ কয়েকটি জায়গায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে; এশিয়ায় সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ দেখা গেছে, ডেঙ্গুর ভয়াবহ অবস্থা মোকাবিলায় ফিলিপিন্স জাতীয় মহামারী ঘোষণা করেছে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এবার বাংলাদেশ সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গু সংক্রমণের কবলে পড়েছে এবং এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য সংস্থাটি জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেছে। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে সিটি করপোরেশনের ভাষায় ‘চিরুনি অভিযান’ চলছে, তাদের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত মশার ওষুধ দেয়া হচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেককে জরিমানাও করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম আমরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখছিও। সিটি করপোরেশনের নানা কর্মকান্ড চলমান থাকা সত্ত্বেও ডেঙ্গু রোগী দিনদিন বাড়ছে। এর ফলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিয়ে নাগরিকদের মনে কোন স্বস্তি আসছে না।
টিভিতে দেখলাম, কীটতত্ত্ববিদরা সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রমের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিবৃতি দিচ্ছেন। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলছেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রাণালয় এবং সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠকে এই কীটতত্ত্ববিদরা সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধের কার্যক্রম নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেন না, ভিন্নমতও পোষণ করেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিমালা অনুসরণ করেই ডেঙ্গু প্রতিরোধের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ড্রোন দিয়ে ময়লা পানিতে এডিস মশার লার্ভা খুঁজছে; আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কী বলে তা তারা নিজে বোঝে কিনা সন্দেহ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রত্যাশা করছে, কেউ তাদের লার্ভার খবর দেবে, তারপর তারা ব্যবস্থা নেবে। তারা প্রায়ই জনগণকে সবক দেন; কিন্তু সবকের চেয়ে নিজেদের কাজটুকু করলেই জনগণের আস্থা বাড়বে।
অবশ্য ওষুধ দিয়েও লাভ হচ্ছে বলে মনে হয় না; তাই ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর জন্য হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও প্রচুর রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে। একদিকে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, অন্যদিকে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। প্রায় পৌনে দুই লাখ লোক এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত, প্রায় আটশ লোক মারা গেছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদের অনুসরণে ডেঙ্গু ভাইরাসের রূপান্তর হচ্ছে; চরিত্র বদলাচ্ছে। একই ভাইরাসের চেহারা ও আক্রমণ করার শক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়ায় রূপান্তরিত ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীর ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো- এবার ডেঙ্গু রোগের লক্ষণও বদলে গেছে। কয়েক বছর আগে আমার এক ভাবি ডেঙ্গু রোগে মারা গেছেন, সারারাত আমি তার চিৎকার শুনেছি, তার ছিল প্রচন্ড জ্বর, অসহনীয় মাথা ও গায়ের ব্যথা; কিন্তু এবারে ডেঙ্গুর রোগীর গায়ের তাপমাত্রা এবং শরীরের ব্যথা অসহনীয় নয়, অথচ সামান্য জ্বরেই মস্তিষ্ক, হার্ট এবং কিডনি আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসকরা এই রোগের ক্ষেত্রে অসহায়, কারণ ডেঙ্গু রোগের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা নেই। শুধু ভাইরাস নয়, এডিস মশাও তাদের চরিত্র বদলাচ্ছে- আগে আমাদের বলা হতো এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে, এখন শোনা যায় তারা ময়লা পানিতেও ডিম পাড়ে; আগে বলা হয়েছে, এডিস মশা শুধু দিনে বিশেষ করে ভোর বেলা ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, এখন শোনা যায় তারা রাতেও কামড়ায়; আগে মনে করা হতো, বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার বংশবিস্তার শুরু হয়, এখন বলা হচ্ছে, পানি জমা থাকলে সারা বছরই ডিম পাড়তে পারে; তাই এবার বর্ষা আগমনের আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে।
যে বাঙালিরা বায়ান্ন ও একাত্তরে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত হয়নি সেই বাঙালিরা আজ একটি ছোট্ট মশার ভয়ে আতঙ্কিত। আতঙ্ক হওয়ার প্রধান কারণ মৃত্যুভয়, এবার মৃত্যু হার তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। মৃত্যুভয় ছাড়াও আতঙ্ক হওয়ার বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক; কারণ হাসপাতালে শয্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া হাসপাতালে মশারি টাঙিয়ে রাখার ভয়ানক দৃশ্য, স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট ইত্যাদি সংবাদচিত্র সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক কান্তা বিশ্বাসের সবেমাত্র দাম্পত্য জীবনের শুরু, তিনি ছিলেন আট মাসের গর্ভবতী, গর্ভের শিশুটিকে নিয়েই কান্তা বিশ্বাসের জীবনের অবসান ঘটাল ডেঙ্গু।
এমন মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ অহরহ পেতে থাকলে আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। বুদ্ধিমান, বলবান একটি মানুষের জীবননাশে একটি ছোট্ট মশা কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা এ বছর সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ক্ষুদ্র এই মশার কামড়ে মারা গেছেন বাদশাহ নমরুদ, মহাবীর আলেকজান্ডার, দুঃসাহসিক নাবিক ভাস্কো দা গামা, কবি লর্ড বায়রণ, কবি দান্তে, রোমান সম্রাট পঞ্চম হেনরি। রক্ত পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও আমার এককালের সহকর্মী ডাক্তার আলী আজম আমার ডেঙ্গু সন্দেহ করলেন; কারণ রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা না পড়লেও ডেঙ্গুর সব লক্ষণ আমার মধ্যে ছিল। দেশজুড়ে বিরাজমান আতঙ্ক ও অস্বস্তিকর অবস্থার কারণে আমার ডেঙ্গু না হওয়া সত্ত্বেও ডেঙ্গুর মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণে আমি প্রায় ২০ দিন শয্যাশায়ী ছিলাম। জ্বর এবং গায়ের ব্যথা না থাকলেও আমি এখনো এডিস মশার ভয়ে আতঙ্কিত; কারণ আমার অজান্তে আমার একবার ডেঙ্গু হয়েছিল। ভয়টা এই কারণেই যে, দ্বিতীয়বারে আক্রান্ত রোগীই এবার বেশি মারা যাচ্ছে।
আতঙ্ক এত ভয়ানকভাবে মনে গেঁথে গেছে যে, পায়ে বা হাতে একটু চুলকালেই মনে হয় এডিস মশা কামড় দিয়েছে, শুয়ে বা বসে পড়ার সময় মশার ভনভন শব্দ শুনলেই পত্রিকা পড়া হারাম হয়ে যায়। এমনিতেই আমার মশাভীতি রয়েছে, মশা না থাকলেও মশারি ছাড়া আমার ঘুম আসে না। এখন সকাল হলেও মশারি আর খুলি না। এই ভয়কে উপজীব্য করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী হরেক রকমের ব্যবসা করে যাচ্ছেন। ফেইসবুকে প্রচার হচ্ছে, এডিস মশা হাঁটুর ওপর উঠতে পারে না- তাই হাঁটু পর্যন্ত নারিকেল তেল মাখলেই এই মশার কামড় থেকে বাঁচা যাবে।
কিন্তু নারিকেল তেলের ঘনত্ব তো আলকাতরার মতো গাঢ় নয়, মশার হুল ফোটাতে তা বাধা হবে কেন? দ্বিতীয়ত হাঁটুর উপরে উঠতে না পারলে বহুতল ভবনের উপরের তলায় এডিস মশার অস্তিত্ব থাকে কেন? অ্যারোসল, কয়েল শিশুদের স্বাস্থ্যগত হুমকির কারণ হলেও এখন অবিরত কয়েল জ্বালিয়ে রাখা হয়, অ্যারোসল ছিটানো হয়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মশারির বিক্রি। স্যালাইন ব্যবসা এখন জমজমাট, ডেঙ্গু রোগের কোন সুনির্দিষ্ট ওষুধ না থাকায় সব রোগীকে স্যালাইন দিয়ে শক্ত রাখা হচ্ছে। ফেসবুকের প্রেসক্রিপশনে আমাদের ছাদের পেঁপে পাতা শেষ।
কিছু ভদ্রলোক ফেসবুকে আবার এই আতঙ্কিত লোকদের পরকালের ভয় দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করেননি। অনেক বলছেন এই ভাইরাস সৃষ্টিকর্তার গজব। তবে এই গজবে এডিস মশাগুলো যদি শুধু ধর্ষক, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারীদের কামড়া তো তাহলে এমন গজবে জনগণ খুশি হতো। এডিস মশার লার্ভা খেয়ে ফেলার জন্য গাপ্পি, তেলাপিয়া মাছ চাষের সুপারিশ করা হয়েছ; কিন্তু এডিস মশা নাকি পুকুর, ডোবা, খাল, বিলে ডিমই পাড়ে না। এই ধারণা সত্য না-ও হতে পারে, কারণ এখন নাকি নালা-নর্দমার ময়লা পানিতেও এডিস মশা ডিম পাড়ে।
তাই সিটি করপোরেশনকে এখন নালা-নর্দমায়ও ওষুধ ছিটাতে হচ্ছে। ঢাকায় পানি সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়, যেসব এলাকায় নিয়মিত ওয়াসার পানি সরবরাহ থাকে না সেই সবাই এলাকার বাসিন্দারা তাদের বাথরুম বা টয়লেটে ড্রাম ও বালতির মধ্যে পানি ধরে রাখে; এসব পাত্রের পানি কয়েকদিন ব্যবহৃত না হলে সেখানে ডিম পাড়ার জন্য এডিস মশা বাসা বাঁধতে পারে। ইদানীং পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বেড়ে গেছে, পলিথিনের ওপর বৃষ্টির পানি পড়লে তা বহুদিন থেকে যায়। যারা বাড়ি নির্মাণ করছেন তারা নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য খোলা জলাধার তৈরি করেন, এসব জলাধার এডিস মশার ডিম পাড়ার জন্য উত্তম স্থান। বাড়ি-গাড়ি-এসি-ফ্রিজ ইত্যাদির নির্গত পানি জমাটবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকলে তাও এডিস মশার ডিম পাড়ার জন্য উপযোগী স্থান।
আজকাল প্রায় সব বাড়ির ছাদে বাগান আছে, প্রতিদিন গাছে পানি দেয়া হয়। এই পানি জমিয়ে রাখা হলে এডিস মশা নির্মূল করা সহজ হবে না। প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশা নাকি গরম, আর্দ্র ও অপেক্ষাকৃত অন্ধকার পরিবেশ থাকতে পছন্দ করে; তাই এরা বিশ্রাম নেয় সোফা বা বিছানার নিচে। তাই রাস্তায় ওষুধ দিয়ে মেয়র ডেঙ্গু রোগের প্রদুর্ভাব কমাতে পারবেন বলে মনে হয় না। মেয়রের ওষুধ ভবনের দশ, পনের তলায় পৌঁছবে না। সিটি করপোরেশনের প্রচেষ্টায় রাস্তার ঘটি-বাটি, অব্যবহৃত পাত্র ধ্বংস করা গেলেও আমাদের বাড়ির ছাদের উপর তৈরি করা বাগানে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। কিভাবে, কোথায়, কী কারণে এডিস মশার বিস্তার হয় তা কমবেশি আমরা সবাই জানি। তাই শুধু সচেতন হলেই হবে না, এজন্য দরকার আপনার, আমার সবার মানসিকতার পরিবর্তন।
[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শুধু শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে
শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ বছর মৌসুমের আগে সংক্রমণ শুরু হওয়ায় সিটি করপোরেশন সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না। এছাড়া সাময়িক বা মৌসুমি রোগ বিধায় স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে দীর্ঘমেয়াদি কোন ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের মনোযোগ না থাকায় ডেঙ্গু রোগটা এবার জেঁকে বসেছে। এবারের বৃষ্টিও এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী, প্রায় প্রতিদিনই হালকা ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে, মুষলধারে বৃষ্টি হলে এডিস মশার লার্ভা ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে যেত, মশা ডিম পেড়ে বংশ বিস্তারের সুযোগ পেত না।
এবার শুধু শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বর্তমানে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০ কোটি লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু এই সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার বেশ কয়েকটি জায়গায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে; এশিয়ায় সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ দেখা গেছে, ডেঙ্গুর ভয়াবহ অবস্থা মোকাবিলায় ফিলিপিন্স জাতীয় মহামারী ঘোষণা করেছে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এবার বাংলাদেশ সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গু সংক্রমণের কবলে পড়েছে এবং এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য সংস্থাটি জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেছে। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে সিটি করপোরেশনের ভাষায় ‘চিরুনি অভিযান’ চলছে, তাদের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত মশার ওষুধ দেয়া হচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেককে জরিমানাও করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম আমরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখছিও। সিটি করপোরেশনের নানা কর্মকান্ড চলমান থাকা সত্ত্বেও ডেঙ্গু রোগী দিনদিন বাড়ছে। এর ফলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিয়ে নাগরিকদের মনে কোন স্বস্তি আসছে না।
টিভিতে দেখলাম, কীটতত্ত্ববিদরা সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রমের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিবৃতি দিচ্ছেন। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলছেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রাণালয় এবং সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠকে এই কীটতত্ত্ববিদরা সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধের কার্যক্রম নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেন না, ভিন্নমতও পোষণ করেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিমালা অনুসরণ করেই ডেঙ্গু প্রতিরোধের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ড্রোন দিয়ে ময়লা পানিতে এডিস মশার লার্ভা খুঁজছে; আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কী বলে তা তারা নিজে বোঝে কিনা সন্দেহ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রত্যাশা করছে, কেউ তাদের লার্ভার খবর দেবে, তারপর তারা ব্যবস্থা নেবে। তারা প্রায়ই জনগণকে সবক দেন; কিন্তু সবকের চেয়ে নিজেদের কাজটুকু করলেই জনগণের আস্থা বাড়বে।
অবশ্য ওষুধ দিয়েও লাভ হচ্ছে বলে মনে হয় না; তাই ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর জন্য হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও প্রচুর রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে। একদিকে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, অন্যদিকে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। প্রায় পৌনে দুই লাখ লোক এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত, প্রায় আটশ লোক মারা গেছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদের অনুসরণে ডেঙ্গু ভাইরাসের রূপান্তর হচ্ছে; চরিত্র বদলাচ্ছে। একই ভাইরাসের চেহারা ও আক্রমণ করার শক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়ায় রূপান্তরিত ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীর ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো- এবার ডেঙ্গু রোগের লক্ষণও বদলে গেছে। কয়েক বছর আগে আমার এক ভাবি ডেঙ্গু রোগে মারা গেছেন, সারারাত আমি তার চিৎকার শুনেছি, তার ছিল প্রচন্ড জ্বর, অসহনীয় মাথা ও গায়ের ব্যথা; কিন্তু এবারে ডেঙ্গুর রোগীর গায়ের তাপমাত্রা এবং শরীরের ব্যথা অসহনীয় নয়, অথচ সামান্য জ্বরেই মস্তিষ্ক, হার্ট এবং কিডনি আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসকরা এই রোগের ক্ষেত্রে অসহায়, কারণ ডেঙ্গু রোগের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা নেই। শুধু ভাইরাস নয়, এডিস মশাও তাদের চরিত্র বদলাচ্ছে- আগে আমাদের বলা হতো এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে, এখন শোনা যায় তারা ময়লা পানিতেও ডিম পাড়ে; আগে বলা হয়েছে, এডিস মশা শুধু দিনে বিশেষ করে ভোর বেলা ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, এখন শোনা যায় তারা রাতেও কামড়ায়; আগে মনে করা হতো, বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার বংশবিস্তার শুরু হয়, এখন বলা হচ্ছে, পানি জমা থাকলে সারা বছরই ডিম পাড়তে পারে; তাই এবার বর্ষা আগমনের আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে।
যে বাঙালিরা বায়ান্ন ও একাত্তরে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত হয়নি সেই বাঙালিরা আজ একটি ছোট্ট মশার ভয়ে আতঙ্কিত। আতঙ্ক হওয়ার প্রধান কারণ মৃত্যুভয়, এবার মৃত্যু হার তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। মৃত্যুভয় ছাড়াও আতঙ্ক হওয়ার বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক; কারণ হাসপাতালে শয্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া হাসপাতালে মশারি টাঙিয়ে রাখার ভয়ানক দৃশ্য, স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট ইত্যাদি সংবাদচিত্র সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক কান্তা বিশ্বাসের সবেমাত্র দাম্পত্য জীবনের শুরু, তিনি ছিলেন আট মাসের গর্ভবতী, গর্ভের শিশুটিকে নিয়েই কান্তা বিশ্বাসের জীবনের অবসান ঘটাল ডেঙ্গু।
এমন মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ অহরহ পেতে থাকলে আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। বুদ্ধিমান, বলবান একটি মানুষের জীবননাশে একটি ছোট্ট মশা কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা এ বছর সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ক্ষুদ্র এই মশার কামড়ে মারা গেছেন বাদশাহ নমরুদ, মহাবীর আলেকজান্ডার, দুঃসাহসিক নাবিক ভাস্কো দা গামা, কবি লর্ড বায়রণ, কবি দান্তে, রোমান সম্রাট পঞ্চম হেনরি। রক্ত পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও আমার এককালের সহকর্মী ডাক্তার আলী আজম আমার ডেঙ্গু সন্দেহ করলেন; কারণ রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা না পড়লেও ডেঙ্গুর সব লক্ষণ আমার মধ্যে ছিল। দেশজুড়ে বিরাজমান আতঙ্ক ও অস্বস্তিকর অবস্থার কারণে আমার ডেঙ্গু না হওয়া সত্ত্বেও ডেঙ্গুর মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণে আমি প্রায় ২০ দিন শয্যাশায়ী ছিলাম। জ্বর এবং গায়ের ব্যথা না থাকলেও আমি এখনো এডিস মশার ভয়ে আতঙ্কিত; কারণ আমার অজান্তে আমার একবার ডেঙ্গু হয়েছিল। ভয়টা এই কারণেই যে, দ্বিতীয়বারে আক্রান্ত রোগীই এবার বেশি মারা যাচ্ছে।
আতঙ্ক এত ভয়ানকভাবে মনে গেঁথে গেছে যে, পায়ে বা হাতে একটু চুলকালেই মনে হয় এডিস মশা কামড় দিয়েছে, শুয়ে বা বসে পড়ার সময় মশার ভনভন শব্দ শুনলেই পত্রিকা পড়া হারাম হয়ে যায়। এমনিতেই আমার মশাভীতি রয়েছে, মশা না থাকলেও মশারি ছাড়া আমার ঘুম আসে না। এখন সকাল হলেও মশারি আর খুলি না। এই ভয়কে উপজীব্য করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী হরেক রকমের ব্যবসা করে যাচ্ছেন। ফেইসবুকে প্রচার হচ্ছে, এডিস মশা হাঁটুর ওপর উঠতে পারে না- তাই হাঁটু পর্যন্ত নারিকেল তেল মাখলেই এই মশার কামড় থেকে বাঁচা যাবে।
কিন্তু নারিকেল তেলের ঘনত্ব তো আলকাতরার মতো গাঢ় নয়, মশার হুল ফোটাতে তা বাধা হবে কেন? দ্বিতীয়ত হাঁটুর উপরে উঠতে না পারলে বহুতল ভবনের উপরের তলায় এডিস মশার অস্তিত্ব থাকে কেন? অ্যারোসল, কয়েল শিশুদের স্বাস্থ্যগত হুমকির কারণ হলেও এখন অবিরত কয়েল জ্বালিয়ে রাখা হয়, অ্যারোসল ছিটানো হয়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মশারির বিক্রি। স্যালাইন ব্যবসা এখন জমজমাট, ডেঙ্গু রোগের কোন সুনির্দিষ্ট ওষুধ না থাকায় সব রোগীকে স্যালাইন দিয়ে শক্ত রাখা হচ্ছে। ফেসবুকের প্রেসক্রিপশনে আমাদের ছাদের পেঁপে পাতা শেষ।
কিছু ভদ্রলোক ফেসবুকে আবার এই আতঙ্কিত লোকদের পরকালের ভয় দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করেননি। অনেক বলছেন এই ভাইরাস সৃষ্টিকর্তার গজব। তবে এই গজবে এডিস মশাগুলো যদি শুধু ধর্ষক, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারীদের কামড়া তো তাহলে এমন গজবে জনগণ খুশি হতো। এডিস মশার লার্ভা খেয়ে ফেলার জন্য গাপ্পি, তেলাপিয়া মাছ চাষের সুপারিশ করা হয়েছ; কিন্তু এডিস মশা নাকি পুকুর, ডোবা, খাল, বিলে ডিমই পাড়ে না। এই ধারণা সত্য না-ও হতে পারে, কারণ এখন নাকি নালা-নর্দমার ময়লা পানিতেও এডিস মশা ডিম পাড়ে।
তাই সিটি করপোরেশনকে এখন নালা-নর্দমায়ও ওষুধ ছিটাতে হচ্ছে। ঢাকায় পানি সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়, যেসব এলাকায় নিয়মিত ওয়াসার পানি সরবরাহ থাকে না সেই সবাই এলাকার বাসিন্দারা তাদের বাথরুম বা টয়লেটে ড্রাম ও বালতির মধ্যে পানি ধরে রাখে; এসব পাত্রের পানি কয়েকদিন ব্যবহৃত না হলে সেখানে ডিম পাড়ার জন্য এডিস মশা বাসা বাঁধতে পারে। ইদানীং পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বেড়ে গেছে, পলিথিনের ওপর বৃষ্টির পানি পড়লে তা বহুদিন থেকে যায়। যারা বাড়ি নির্মাণ করছেন তারা নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য খোলা জলাধার তৈরি করেন, এসব জলাধার এডিস মশার ডিম পাড়ার জন্য উত্তম স্থান। বাড়ি-গাড়ি-এসি-ফ্রিজ ইত্যাদির নির্গত পানি জমাটবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকলে তাও এডিস মশার ডিম পাড়ার জন্য উপযোগী স্থান।
আজকাল প্রায় সব বাড়ির ছাদে বাগান আছে, প্রতিদিন গাছে পানি দেয়া হয়। এই পানি জমিয়ে রাখা হলে এডিস মশা নির্মূল করা সহজ হবে না। প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশা নাকি গরম, আর্দ্র ও অপেক্ষাকৃত অন্ধকার পরিবেশ থাকতে পছন্দ করে; তাই এরা বিশ্রাম নেয় সোফা বা বিছানার নিচে। তাই রাস্তায় ওষুধ দিয়ে মেয়র ডেঙ্গু রোগের প্রদুর্ভাব কমাতে পারবেন বলে মনে হয় না। মেয়রের ওষুধ ভবনের দশ, পনের তলায় পৌঁছবে না। সিটি করপোরেশনের প্রচেষ্টায় রাস্তার ঘটি-বাটি, অব্যবহৃত পাত্র ধ্বংস করা গেলেও আমাদের বাড়ির ছাদের উপর তৈরি করা বাগানে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। কিভাবে, কোথায়, কী কারণে এডিস মশার বিস্তার হয় তা কমবেশি আমরা সবাই জানি। তাই শুধু সচেতন হলেই হবে না, এজন্য দরকার আপনার, আমার সবার মানসিকতার পরিবর্তন।
[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]