alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাজনীতির দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য প্রক্রিয়া

শেখর ভট্টাচার্য

: বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
image

দেশের রাজনীতিতে প্রান্তিক মানুষের অবস্থান কী সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে

দেশটিকে ক্রমাগত অচেনা মনে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন এতই অচেনা যে, মাঝে মধ্যে মনে হয় দেশটি কি আমরা স্বপ্নের মধ্যে অর্জন করেছিলাম। স্বপ্ন ভঙ্গের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম বায়ান্ন বছর পূর্বে। এত বড় মুক্তিযুদ্ধ। এত মানুষের আত্মদান। এসব কি ঘোরের মধ্যে ঘটেছিল। ঘোর কি কেটে গেছে। সবচেয়ে বড় সংকটে আছে শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত, যারা বুঝার থেকে অনুভব করে বেশি। এরা অর্জনে আশাবাদী হয় ব্যর্থতার গ্লানি এদের অন্তরকে পোড়ায়। মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধ শেষে জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, ভূখন্ড আমরা অর্জন করেছি। আমরা কী এ অর্জনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। অনেকেই এখন বায়ান্ন বছর পূর্বের সময়কে ব্যবচ্ছেদ করছেন। স্বাধীনতা অর্জনকে চূড়ান্ত বিজয় ভাবা হয়তো ভুল হয়েছিলো। মনে হচ্ছে স্বাধীনতাকে ধারণ করার জন্য আমরা যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। স্বাধীনতার আন্দোলনে জাতি পরিশুদ্ধ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এখন অনেকেরই মনে সন্দেহ হচ্ছে জাতি হিসেবে আমারা পরিশুদ্ধ হতে পারিনি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমরা গিয়েছি কিন্তু সমগ্র জাতিকে সে আন্দোলন ছুঁয়ে যেতে পারেনি। সমাজ সংস্কৃতির যে পরিবর্তন আমরা দেখেছিলাম, সেটা কি আবেগ থেকে উত্থিত? যুক্তি কি ম্রিয়মাণ ছিল।

এসব বিষয় নিয়ে একসময় যারা ভাবতেন তাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি এখন সমাজে নেই। যারা আছেন তারা ক্ষমতালোভী, কর্তৃত্বপরায়ণ নেতৃত্বের অধীন। নিজস্ব বিবেক বলে কিছু নেই। বিবেক তাদের বন্দি অথবা আগাম বিক্রীত। এ কারণে আজ রাষ্ট্র যখন সাধারণ মানুষের দিকে চোখ রাঙায়, রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো জাতীয় অভিভাবক দেখতে পাই না। এক সময় আমাদের একটি নাগরিক সমাজ ছিল। তারা সামরিক শাসকদের অন্যায়, নিপীড়নের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন সামরিক শাসকেরা ভীষণ ভয় করতো তাদের। কেন ভয় করতো? একটি মাত্র কারণ তাদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম। তাদের কেনা যেতো না, তাদের কোন ক্রয় মূল্য ছিল না। তারা প্রকৃত অর্থে নাগরিক সমাজের নেতা ছিলেন।

অনেকেই সামাজিক মাধ্যমকে এড়িয়ে যেতে চান। তারা মনে করেন সামাজিক মাধ্যমে দায়দায়িত্বহীন মানুষেরা সক্রিয়। এসব মানুষদের কথা বিবেচনা করা উচিৎ নয়। মনে রাখতে হবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি একই কথার প্রতিধ্বনি করেন তাহলে সে কথার অন্তর্নিহিত একটি বার্তা আছে। আমরা কি সেই বার্তা শুনতে প্রস্তুত? সাধারণ মানুষের কথা বলার কোন প্ল্যাটফর্ম ছিল না কোন কালে। মনে রাখতে হবে সামাজিক মাধ্যমে ভুল বানানে, ভুল বাক্যে যারা কথা বলেন তারা এ দেশের নাগরিক। অধিকাংশ সংবাদপত্রে আজকাল চিঠিপত্রের কলাম উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলে প্রান্তিক মানুষের কোন অবস্থান নেই। রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতৃত্ব-নির্বাচনে কোন প্রক্রিয়া মানা হয় না। রাজনৈতিক জনসভায় যারা সাধারণ মানুষ হিসেবে উপস্থিত হন তারা সবাই দিনমজুরি না করে, সেই দিন উপস্থিতির মজুরি নিয়ে সভাতে স্লোগান তুলেন। স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক কর্মীর বড় অভাব।

কেনো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনৈতিক জনসভায় অংশগ্রহণ করবে? প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নেই। এজেন্ডা বা আলোচ্য বিষয়ে যারা নেই তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের দল ভাববে কী করে? তারা হাজির হয় এর বিনিময়ে হাজিরা নিয়ে বাড়িতে ফিরে। আমরা সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি বিএনপির জনসভায় এসে অনেকেই আওয়ামী লীগের সেøাগান দিয়ে বসে একই ঘটনা ঘটে, আওয়ামী লীগের জনসভায়ও ঘটে। প্রভাবশলী কিছু মানুষ দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচনের পূর্বে মরিয়া হয়ে ওঠে, তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতি নির্বাচনের আগে সারা দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়। দিন শেষে মানুষের বিজয় হয় না, বিজয় হয় যারা মানুষ জড়ো করতে অর্থ বিনিয়োগ করছে তাদের।

কেনো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনৈতিক জনসভায় অংশগ্রহণ করবে? প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নেই। এজেন্ডা বা আলোচ্য বিষয়ে যারা নেই তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের দল ভাববে কী করে? তারা হাজির হয় এর বিনিময়ে হাজিরা নিয়ে বাড়িতে ফিরে

দেশে সবচেয়ে প্রভাবশালী কারা? এর সরাসরি উত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃস্থানীয় মানুষেরা। যাদের অধিকাংশ কোন কালে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তারা ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করতে চান। ক্ষমতার বলয় হলো সব বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। বিত্তশালীরা বলয়ে প্রবেশের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। কোন দল ক্ষমতায়, তাদের আদর্শ কী, এসব তাদের বিবেচ্য নয়। তারা যেহেতু বিত্তশালী তাই নেতৃত্ব ক্রয় করা তাদের জন্য বড় কোন বিষয় নয়। যারা সারাজীবন গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যারা সামরিক, বেসামরিক আমলা হিসেবে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন, যারা সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বলতে কী বুঝায় তা বুঝেন না, তার এখন নেতার আসনে। পুঁজির সুরক্ষা, পুঁজিকে ক্ষমতার জাদুবলে হাজারগুণ বৃদ্ধি করতে চান তারা। তৃণমূলকর্মী, নেতাদের ডিঙ্গিয়ে উপরের স্তরের পদটি দখল করতে পারেন তারা সহজে। তারা ব্যবসা করেন, সিন্ডিকেট করেন, অবৈধ উপায়ে কালো টাকা রোজগার করেন। পুঁজির সুরক্ষার বিষয়ে সামান্য ঝুঁকি দেখা দিলে বেগমপাড়ায় নিশ্চিন্তে পাড়ি জমান। প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন, সব মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এগুলো তাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মোটেই সাঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

কর্মী থেকে নেতা হওয়ার যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু ছিল, সেই প্রক্রিয়া ভেঙে চূরমার করে তারা এখন নিচ থেকে উপরে উঠা নয়, উপর থেকে উপরে উঠার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ওই যে বলছিলাম দেশটি ক্রমাগত অপরিচিত হয়ে উঠছে এর কারণ হলো- রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের অধিকাংশ মুনাফার লোভে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে মূল্যবোধহীন রাজনীতির প্রচলন করে দেশকে অজানা, অচেনা পথে গিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত, যে পথের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না কোন কালে।

বৃহৎ দলগুলোর মধ্যে যে মতবিরোধ এ বিরোধ কিন্তু আদর্শের নয়। মুনাফালাভের জন্য মুনাফালোভীদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিরোধ। লুণ্ঠনের লোভে মাতাল বৃহত্তর বিত্তবান পরিবার। তারা কেউ আছেন এ দলে আর কেউ অন্য দলে। লড়াই মূলত সোনার হরিণের জন্য। হরিণটা আর কিছু নয়, হরিণ হলো ক্ষমতা। এ লড়াইয়ে তাদের সুবিধাভোগীরা অংশগ্রহণ করে, ছিটেফোঁটা তাদেরও দেয়া হয় স্তর অনুযায়ী। অন্তরে যাদের দেশপ্রেম আছে, যারা সমতার সমাজ কামনা করেন সবাই বিপদ হয়েছে তাদের। এক সময় তারা দাঁড়াতে পারতেন কারণ তাদের বিবেকে আঘাত আসার পূর্বেই মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজ সবাই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। সবচেয়ে হতাশার বিষয় ভ্রান্ত এবং স্বার্থপর নেতৃত্ব আমাদের তরুণ সমাজের ভিতরের মুক্তির চেতনাকে অনেকটা অবদমিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ছাত্র, তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ মূল দলের নেতাদের মতো রাজনীতিকে দেশপ্রেমের অংশ হিসাবে বিবেচনা করছে না। উপচেপড়া পুঁজির ভাগ দিয়ে অনেক ছাত্রনেতাদের বিপথগামী করা হচ্ছে। পুঁজি রক্ষার জন্য আর একটি মোক্ষম উপাদান যুক্ত করা হচ্ছে সেটি হলো ধর্ম। ধর্মীয় চেতনা নয়, ধর্মের নামে অধর্মকে ধর্ম বলে চালিয়ে দিয়ে সারা জাতির সামনে একটি ধুয়াশা তৈরি করা হচ্ছে।

এক সময় আমরা বলতাম ঘুণে ধরা সমাজ, এখন যে সমাজে আমরা বাস করি সেটি ঘুণে ধরা নয়, এটি সাধারণ নাগরিকের জন্য বৈরী সমাজ। সমাজকে সচেতন ভাবে অনড় রাখা হয়েছে। বদ্ধ জলাশয়ের মতো সমাজ। এ সমাজে যে সরকার বদল করলেই পরিবর্তন আসবে এ কথা বলা যাবে না। স্বাধীনতার পূর্বে আমরা অনেক পরিশুদ্ধ হয়েছিলাম। পরিশুদ্ধতা নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত ছিল না। সমাজের মূল্যবোধ ভেতরে ভেতরে প্রায় একই রকম ছিল। আমরা সাপকে ফুল ভেবে পথচলা শুরু করেছিলাম। আমাদের বিভ্রম হয়েছিল। এবার প্রয়োজন হয়েছে সমাজের ভেতরের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। এটি বড় কঠিন কাজ। কাজটি কঠিন বলে এ কাজে ডান, বাম, মধ্য কেউ হাত দিতে চায় না। বিদ্যমান অবস্থাকে ভাঙা এত সহজ নয়। শুধু ভাঙতে জানলেই হবে না, ভাঙার পূর্বে গড়ার মন্ত্র জানতে হবে। কঠিন কাজ আর কঠিন থাকে না যখন মুষ্টিবদ্ধ হাত একত্রিত হয়।

সরকার বদলের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যদি সমাজ বদলের আন্দোলনকে বেগবান করা যায় এবং লক্ষ্যে অবিচল থাকা সম্ভব হয় তাহলে এ কাজটিও অসম্ভব কোন কাজ নয়। সমাজ বদলের আন্দোলন ক্ষীণ হলেও বহমান আছে। সে আন্দোলনকে বেগবান, গণমুখী করতে পারে প্রগতিমুখী রাজনৈতিক দল। সরকার বদল প্রয়োজন। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকদের সঙ্গে ম্যাগনাকার্টার মতো চুক্তি করতে হবে। সে চুক্তিতে লেখা থাকবে রাজনৈতিক দল বা দলগুলো প্রতিক্রিয়ার সংস্কৃতি বর্জন করবে, লুটেরাদের দল থেকে বহিষ্কার করে সমতার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। বিদ্যমান অবস্থা বজায় রেখে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো সরকার বদল গণমানুষের জীবনে কোন অর্থবহ পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। হতাশার দীর্ঘশ্বাস যে আরও দীর্ঘায়িত হবে এটি আমাদের অভিজ্ঞতা বলে দেয়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাজনীতির দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য প্রক্রিয়া

শেখর ভট্টাচার্য

image

দেশের রাজনীতিতে প্রান্তিক মানুষের অবস্থান কী সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে

বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

দেশটিকে ক্রমাগত অচেনা মনে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন এতই অচেনা যে, মাঝে মধ্যে মনে হয় দেশটি কি আমরা স্বপ্নের মধ্যে অর্জন করেছিলাম। স্বপ্ন ভঙ্গের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম বায়ান্ন বছর পূর্বে। এত বড় মুক্তিযুদ্ধ। এত মানুষের আত্মদান। এসব কি ঘোরের মধ্যে ঘটেছিল। ঘোর কি কেটে গেছে। সবচেয়ে বড় সংকটে আছে শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত, যারা বুঝার থেকে অনুভব করে বেশি। এরা অর্জনে আশাবাদী হয় ব্যর্থতার গ্লানি এদের অন্তরকে পোড়ায়। মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধ শেষে জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, ভূখন্ড আমরা অর্জন করেছি। আমরা কী এ অর্জনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। অনেকেই এখন বায়ান্ন বছর পূর্বের সময়কে ব্যবচ্ছেদ করছেন। স্বাধীনতা অর্জনকে চূড়ান্ত বিজয় ভাবা হয়তো ভুল হয়েছিলো। মনে হচ্ছে স্বাধীনতাকে ধারণ করার জন্য আমরা যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। স্বাধীনতার আন্দোলনে জাতি পরিশুদ্ধ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এখন অনেকেরই মনে সন্দেহ হচ্ছে জাতি হিসেবে আমারা পরিশুদ্ধ হতে পারিনি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমরা গিয়েছি কিন্তু সমগ্র জাতিকে সে আন্দোলন ছুঁয়ে যেতে পারেনি। সমাজ সংস্কৃতির যে পরিবর্তন আমরা দেখেছিলাম, সেটা কি আবেগ থেকে উত্থিত? যুক্তি কি ম্রিয়মাণ ছিল।

এসব বিষয় নিয়ে একসময় যারা ভাবতেন তাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি এখন সমাজে নেই। যারা আছেন তারা ক্ষমতালোভী, কর্তৃত্বপরায়ণ নেতৃত্বের অধীন। নিজস্ব বিবেক বলে কিছু নেই। বিবেক তাদের বন্দি অথবা আগাম বিক্রীত। এ কারণে আজ রাষ্ট্র যখন সাধারণ মানুষের দিকে চোখ রাঙায়, রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো জাতীয় অভিভাবক দেখতে পাই না। এক সময় আমাদের একটি নাগরিক সমাজ ছিল। তারা সামরিক শাসকদের অন্যায়, নিপীড়নের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন সামরিক শাসকেরা ভীষণ ভয় করতো তাদের। কেন ভয় করতো? একটি মাত্র কারণ তাদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম। তাদের কেনা যেতো না, তাদের কোন ক্রয় মূল্য ছিল না। তারা প্রকৃত অর্থে নাগরিক সমাজের নেতা ছিলেন।

অনেকেই সামাজিক মাধ্যমকে এড়িয়ে যেতে চান। তারা মনে করেন সামাজিক মাধ্যমে দায়দায়িত্বহীন মানুষেরা সক্রিয়। এসব মানুষদের কথা বিবেচনা করা উচিৎ নয়। মনে রাখতে হবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি একই কথার প্রতিধ্বনি করেন তাহলে সে কথার অন্তর্নিহিত একটি বার্তা আছে। আমরা কি সেই বার্তা শুনতে প্রস্তুত? সাধারণ মানুষের কথা বলার কোন প্ল্যাটফর্ম ছিল না কোন কালে। মনে রাখতে হবে সামাজিক মাধ্যমে ভুল বানানে, ভুল বাক্যে যারা কথা বলেন তারা এ দেশের নাগরিক। অধিকাংশ সংবাদপত্রে আজকাল চিঠিপত্রের কলাম উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলে প্রান্তিক মানুষের কোন অবস্থান নেই। রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতৃত্ব-নির্বাচনে কোন প্রক্রিয়া মানা হয় না। রাজনৈতিক জনসভায় যারা সাধারণ মানুষ হিসেবে উপস্থিত হন তারা সবাই দিনমজুরি না করে, সেই দিন উপস্থিতির মজুরি নিয়ে সভাতে স্লোগান তুলেন। স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক কর্মীর বড় অভাব।

কেনো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনৈতিক জনসভায় অংশগ্রহণ করবে? প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নেই। এজেন্ডা বা আলোচ্য বিষয়ে যারা নেই তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের দল ভাববে কী করে? তারা হাজির হয় এর বিনিময়ে হাজিরা নিয়ে বাড়িতে ফিরে। আমরা সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি বিএনপির জনসভায় এসে অনেকেই আওয়ামী লীগের সেøাগান দিয়ে বসে একই ঘটনা ঘটে, আওয়ামী লীগের জনসভায়ও ঘটে। প্রভাবশলী কিছু মানুষ দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচনের পূর্বে মরিয়া হয়ে ওঠে, তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতি নির্বাচনের আগে সারা দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়। দিন শেষে মানুষের বিজয় হয় না, বিজয় হয় যারা মানুষ জড়ো করতে অর্থ বিনিয়োগ করছে তাদের।

কেনো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনৈতিক জনসভায় অংশগ্রহণ করবে? প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নেই। এজেন্ডা বা আলোচ্য বিষয়ে যারা নেই তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের দল ভাববে কী করে? তারা হাজির হয় এর বিনিময়ে হাজিরা নিয়ে বাড়িতে ফিরে

দেশে সবচেয়ে প্রভাবশালী কারা? এর সরাসরি উত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃস্থানীয় মানুষেরা। যাদের অধিকাংশ কোন কালে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তারা ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করতে চান। ক্ষমতার বলয় হলো সব বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। বিত্তশালীরা বলয়ে প্রবেশের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। কোন দল ক্ষমতায়, তাদের আদর্শ কী, এসব তাদের বিবেচ্য নয়। তারা যেহেতু বিত্তশালী তাই নেতৃত্ব ক্রয় করা তাদের জন্য বড় কোন বিষয় নয়। যারা সারাজীবন গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যারা সামরিক, বেসামরিক আমলা হিসেবে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন, যারা সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বলতে কী বুঝায় তা বুঝেন না, তার এখন নেতার আসনে। পুঁজির সুরক্ষা, পুঁজিকে ক্ষমতার জাদুবলে হাজারগুণ বৃদ্ধি করতে চান তারা। তৃণমূলকর্মী, নেতাদের ডিঙ্গিয়ে উপরের স্তরের পদটি দখল করতে পারেন তারা সহজে। তারা ব্যবসা করেন, সিন্ডিকেট করেন, অবৈধ উপায়ে কালো টাকা রোজগার করেন। পুঁজির সুরক্ষার বিষয়ে সামান্য ঝুঁকি দেখা দিলে বেগমপাড়ায় নিশ্চিন্তে পাড়ি জমান। প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন, সব মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এগুলো তাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মোটেই সাঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

কর্মী থেকে নেতা হওয়ার যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু ছিল, সেই প্রক্রিয়া ভেঙে চূরমার করে তারা এখন নিচ থেকে উপরে উঠা নয়, উপর থেকে উপরে উঠার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ওই যে বলছিলাম দেশটি ক্রমাগত অপরিচিত হয়ে উঠছে এর কারণ হলো- রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের অধিকাংশ মুনাফার লোভে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে মূল্যবোধহীন রাজনীতির প্রচলন করে দেশকে অজানা, অচেনা পথে গিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত, যে পথের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না কোন কালে।

বৃহৎ দলগুলোর মধ্যে যে মতবিরোধ এ বিরোধ কিন্তু আদর্শের নয়। মুনাফালাভের জন্য মুনাফালোভীদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিরোধ। লুণ্ঠনের লোভে মাতাল বৃহত্তর বিত্তবান পরিবার। তারা কেউ আছেন এ দলে আর কেউ অন্য দলে। লড়াই মূলত সোনার হরিণের জন্য। হরিণটা আর কিছু নয়, হরিণ হলো ক্ষমতা। এ লড়াইয়ে তাদের সুবিধাভোগীরা অংশগ্রহণ করে, ছিটেফোঁটা তাদেরও দেয়া হয় স্তর অনুযায়ী। অন্তরে যাদের দেশপ্রেম আছে, যারা সমতার সমাজ কামনা করেন সবাই বিপদ হয়েছে তাদের। এক সময় তারা দাঁড়াতে পারতেন কারণ তাদের বিবেকে আঘাত আসার পূর্বেই মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজ সবাই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। সবচেয়ে হতাশার বিষয় ভ্রান্ত এবং স্বার্থপর নেতৃত্ব আমাদের তরুণ সমাজের ভিতরের মুক্তির চেতনাকে অনেকটা অবদমিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ছাত্র, তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ মূল দলের নেতাদের মতো রাজনীতিকে দেশপ্রেমের অংশ হিসাবে বিবেচনা করছে না। উপচেপড়া পুঁজির ভাগ দিয়ে অনেক ছাত্রনেতাদের বিপথগামী করা হচ্ছে। পুঁজি রক্ষার জন্য আর একটি মোক্ষম উপাদান যুক্ত করা হচ্ছে সেটি হলো ধর্ম। ধর্মীয় চেতনা নয়, ধর্মের নামে অধর্মকে ধর্ম বলে চালিয়ে দিয়ে সারা জাতির সামনে একটি ধুয়াশা তৈরি করা হচ্ছে।

এক সময় আমরা বলতাম ঘুণে ধরা সমাজ, এখন যে সমাজে আমরা বাস করি সেটি ঘুণে ধরা নয়, এটি সাধারণ নাগরিকের জন্য বৈরী সমাজ। সমাজকে সচেতন ভাবে অনড় রাখা হয়েছে। বদ্ধ জলাশয়ের মতো সমাজ। এ সমাজে যে সরকার বদল করলেই পরিবর্তন আসবে এ কথা বলা যাবে না। স্বাধীনতার পূর্বে আমরা অনেক পরিশুদ্ধ হয়েছিলাম। পরিশুদ্ধতা নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত ছিল না। সমাজের মূল্যবোধ ভেতরে ভেতরে প্রায় একই রকম ছিল। আমরা সাপকে ফুল ভেবে পথচলা শুরু করেছিলাম। আমাদের বিভ্রম হয়েছিল। এবার প্রয়োজন হয়েছে সমাজের ভেতরের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। এটি বড় কঠিন কাজ। কাজটি কঠিন বলে এ কাজে ডান, বাম, মধ্য কেউ হাত দিতে চায় না। বিদ্যমান অবস্থাকে ভাঙা এত সহজ নয়। শুধু ভাঙতে জানলেই হবে না, ভাঙার পূর্বে গড়ার মন্ত্র জানতে হবে। কঠিন কাজ আর কঠিন থাকে না যখন মুষ্টিবদ্ধ হাত একত্রিত হয়।

সরকার বদলের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যদি সমাজ বদলের আন্দোলনকে বেগবান করা যায় এবং লক্ষ্যে অবিচল থাকা সম্ভব হয় তাহলে এ কাজটিও অসম্ভব কোন কাজ নয়। সমাজ বদলের আন্দোলন ক্ষীণ হলেও বহমান আছে। সে আন্দোলনকে বেগবান, গণমুখী করতে পারে প্রগতিমুখী রাজনৈতিক দল। সরকার বদল প্রয়োজন। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকদের সঙ্গে ম্যাগনাকার্টার মতো চুক্তি করতে হবে। সে চুক্তিতে লেখা থাকবে রাজনৈতিক দল বা দলগুলো প্রতিক্রিয়ার সংস্কৃতি বর্জন করবে, লুটেরাদের দল থেকে বহিষ্কার করে সমতার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। বিদ্যমান অবস্থা বজায় রেখে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো সরকার বদল গণমানুষের জীবনে কোন অর্থবহ পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। হতাশার দীর্ঘশ্বাস যে আরও দীর্ঘায়িত হবে এটি আমাদের অভিজ্ঞতা বলে দেয়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top