বাবুল রবিদাস
এখনো আমরা সমাজে কন্যা শিশুর জন্মকে অবহেলার চোখে দেখি। তাই বিশেষ করে আমাদের হিন্দু সমাজে কন্যার পিতাকে হেয়প্রতিপন্ন ও অবহেলা করা হয়। হিন্দু সমাজের কন্যার পিতামাতাদের মাথা নিচু করে চলতে হয়। কেননা বলা হয় ‘পুত্রহীনে স্বর্গে নাহি বাস’ । এ কুসংস্কারগুলো শহর এলাকা থেকে গ্রামে বেশি লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু আইনে নারীরা পৈতৃকসূত্রে ও স্বামীর প্রাপ্ত সম্পত্তিতে পূর্ণ স্বত্বে ওয়ারিশ হন না। তারা শুধুমাত্র জীবন স্বত্বের অধিকারী হন। কন্যা সন্তানদের প্রতি এটা বৈষম্যমূলক আচরণ বলে অনেকে অভিমত দেন। সাবালিকা কন্যাকে অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে তার দায়দায়িত্ব স্বামীর হাতে সম্প্রদান করে চিরতরে মুক্ত হয়ে যান এবং সম্পত্তির ওয়ারিশ থেকে কন্যারা চিরতরে বঞ্চিত হন।
পুত্র সন্তানরা সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ওয়ারিশ বা মালিক হয়ে যান। অর্থাৎ একমুখী নীতি ও সমর্থন পূত্র সন্তানদের প্রতি। সমাজে কন্যা সন্তানের তুলনায় পুত্র সন্তান কাক্সিক্ষত হওয়ার কারণে নারী পুরুষের অনুপাতে ফারাক দেখা যায়। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে প্রায় কন্যা শিশুকে মাটিচাপা বা গলাটিপে হত্যার তথ্য আসে গণমাধ্যমে। ভারতে গর্ভপাত ঘটিয়ে বছরে প্রায় চার (৪) লাখ ৬০ (ষাট) হাজার কন্যা হত্যা করা হয়। এ কারণে দেশটিতে গর্ভাবস্থায় জটিলতা ছাড়া ভিন্ন কারণে আল্ট্রাসনোগ্রাম (ডাক্তারি পরীক্ষায় গর্ভে ছেলে বা মেয়ের ছবি) নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বর্তমান ভারতে আইন করে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে সমানাধিকার দেয়া হয়েছে। হিন্দু নারীরা ডিভোর্স দিতে পারে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- স্ত্রী স্বামীর দাসি বা সম্পত্তি নন। অর্থাৎ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি বা দাসি নন। এজন্য বলপূর্বক তাকে যেখানে খুশি থাকতে বাধ্য করা যাবে না। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি হিন্দু সমাজে দাস-দাসি প্রথা বা সতীদাহ প্রথা এবং কৌলিন্য অকৌলিন্য প্রথা ছিল। কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকরা এগুলোকে কুসংস্কার বলেছেন। তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রী রাই ফুলে, বি আর ড. আম্বেকর, গুরু রবিদাস অন্যতম। তারা নারীদের কু-প্রথা থেকে উত্তোলন করে সমাজে তাদের মযার্দা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছেন।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন হিন্দু সমাজের জন্য হিন্দু আইন ভারতের মতো সংস্কার করার দাবি তুলেছেন। হিন্দুদের জন্য উত্তরাধিকার আইন করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন- আপনাদের যেটা সমস্যা আপনাদের কোন উত্তরাধিকার আইন নেই, সূত্র নেই এটা তো ঠিক, একজন মারা গেলে তার স্ত্রী সম্পদ পাবে না বা ছেলেমেয়ে পাবে না, অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াবে। সম্পত্তি থাকতেও ভোগ করতে পারবে না, জীবন চালাতে পারবে না- এটা হতে পারে না।
দেশে নারীশিক্ষার প্রতি যথেষ্ঠ নজর দেয়া হয়েছে। সে কারণেই সব ক্ষেত্রে নারীদের অবদান পুরুষের সমান। অথচ হিন্দু ধর্মীয় আইনে দেখা যাচ্ছে কন্যা সন্তান পিতামাতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার বিয়ের পর স্বামীর সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায় স্বামী বা পিতামাতার সম্পত্তিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ নারীদের যথাযথ অধিকার নিশ্চিতে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আইনি নোটিশ দেয়া হয়।
উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে বাংলাদেশে হিন্দু নারী কিছুই পান না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে আইন করে হিন্দু নারীদের সমানাধিকার দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও এ আইন হওয়া উচিৎ; যাতে হিন্দু নারীরা আর বঞ্চিত না হন। তবে ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু নারী-পুরুষ উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার হারাবেন এ বিধান রেখেই দ্রুত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পাশ করা হোক।
হিন্দু আইন সংশোধন প্রশ্নে নেতারা কেন বিভক্ত সেটা একটা প্রশ্ন। পৃথিবীতে যত ভালো কাজই হোক না কেন কেউ কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করে। যারা শিক্ষিত অথচ জ্ঞানী নয়, তারাই মূলত পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী। তাই হিন্দু আইন সংস্কারে বিরোধিতা যুক্তিসঙ্গত বলছেন এবং হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন সামাজিক ও ধর্মীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলেন। তারা সংসদের বিরোধী দলের মতো আচরণ করছেন। যেমন- সংসদে সরকারি দল যত ভালো আইনই তৈরি করুক না কেন বিরোধী দল এর বিরোধিতা করবেই।
পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে হিন্দু নারী তথা কন্যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে সমানাধিকার উত্তরাধিকার বাস্তবায়ন বহু পূূর্বেই হয়েছে। অতএব আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? নেতা, ভুক্তভোগী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও হিন্দু কন্যা সন্তানদের জন্য আইন সংশোধন চেয়েছেন।
ভারতে ধর্মীয় আইন সংস্কারের ইস্যুটি দেশটির ধর্মীয় নেতারা মেনে নিয়েছেন। এটাই আমাদের দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন নারী অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করলে বাড়ির মূল জমির বাহিরে কৃষিজমি তাকে দেয়া যেতে পারে। কিংবা আলোচনার মাধ্যমে অন্য সমাধান করা যেতে পারে।
হিন্দু নারীর অধিকার নিয়ে রক্ষণশীলতার চেয়ে আতঙ্ক বেশি। দ্রুত জাতীয় সংসদে হিন্দু নারী ও পুরুষের সমানাধিকার আইন পাশ করলে হিন্দু নারীরা উপকৃত হবেন ও হিংসা, ঘৃণা, অবহেলার শিকার হবেন না।
[লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
এখনো আমরা সমাজে কন্যা শিশুর জন্মকে অবহেলার চোখে দেখি। তাই বিশেষ করে আমাদের হিন্দু সমাজে কন্যার পিতাকে হেয়প্রতিপন্ন ও অবহেলা করা হয়। হিন্দু সমাজের কন্যার পিতামাতাদের মাথা নিচু করে চলতে হয়। কেননা বলা হয় ‘পুত্রহীনে স্বর্গে নাহি বাস’ । এ কুসংস্কারগুলো শহর এলাকা থেকে গ্রামে বেশি লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু আইনে নারীরা পৈতৃকসূত্রে ও স্বামীর প্রাপ্ত সম্পত্তিতে পূর্ণ স্বত্বে ওয়ারিশ হন না। তারা শুধুমাত্র জীবন স্বত্বের অধিকারী হন। কন্যা সন্তানদের প্রতি এটা বৈষম্যমূলক আচরণ বলে অনেকে অভিমত দেন। সাবালিকা কন্যাকে অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে তার দায়দায়িত্ব স্বামীর হাতে সম্প্রদান করে চিরতরে মুক্ত হয়ে যান এবং সম্পত্তির ওয়ারিশ থেকে কন্যারা চিরতরে বঞ্চিত হন।
পুত্র সন্তানরা সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ওয়ারিশ বা মালিক হয়ে যান। অর্থাৎ একমুখী নীতি ও সমর্থন পূত্র সন্তানদের প্রতি। সমাজে কন্যা সন্তানের তুলনায় পুত্র সন্তান কাক্সিক্ষত হওয়ার কারণে নারী পুরুষের অনুপাতে ফারাক দেখা যায়। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে প্রায় কন্যা শিশুকে মাটিচাপা বা গলাটিপে হত্যার তথ্য আসে গণমাধ্যমে। ভারতে গর্ভপাত ঘটিয়ে বছরে প্রায় চার (৪) লাখ ৬০ (ষাট) হাজার কন্যা হত্যা করা হয়। এ কারণে দেশটিতে গর্ভাবস্থায় জটিলতা ছাড়া ভিন্ন কারণে আল্ট্রাসনোগ্রাম (ডাক্তারি পরীক্ষায় গর্ভে ছেলে বা মেয়ের ছবি) নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বর্তমান ভারতে আইন করে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে সমানাধিকার দেয়া হয়েছে। হিন্দু নারীরা ডিভোর্স দিতে পারে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- স্ত্রী স্বামীর দাসি বা সম্পত্তি নন। অর্থাৎ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি বা দাসি নন। এজন্য বলপূর্বক তাকে যেখানে খুশি থাকতে বাধ্য করা যাবে না। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি হিন্দু সমাজে দাস-দাসি প্রথা বা সতীদাহ প্রথা এবং কৌলিন্য অকৌলিন্য প্রথা ছিল। কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকরা এগুলোকে কুসংস্কার বলেছেন। তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রী রাই ফুলে, বি আর ড. আম্বেকর, গুরু রবিদাস অন্যতম। তারা নারীদের কু-প্রথা থেকে উত্তোলন করে সমাজে তাদের মযার্দা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছেন।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন হিন্দু সমাজের জন্য হিন্দু আইন ভারতের মতো সংস্কার করার দাবি তুলেছেন। হিন্দুদের জন্য উত্তরাধিকার আইন করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন- আপনাদের যেটা সমস্যা আপনাদের কোন উত্তরাধিকার আইন নেই, সূত্র নেই এটা তো ঠিক, একজন মারা গেলে তার স্ত্রী সম্পদ পাবে না বা ছেলেমেয়ে পাবে না, অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াবে। সম্পত্তি থাকতেও ভোগ করতে পারবে না, জীবন চালাতে পারবে না- এটা হতে পারে না।
দেশে নারীশিক্ষার প্রতি যথেষ্ঠ নজর দেয়া হয়েছে। সে কারণেই সব ক্ষেত্রে নারীদের অবদান পুরুষের সমান। অথচ হিন্দু ধর্মীয় আইনে দেখা যাচ্ছে কন্যা সন্তান পিতামাতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার বিয়ের পর স্বামীর সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায় স্বামী বা পিতামাতার সম্পত্তিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ নারীদের যথাযথ অধিকার নিশ্চিতে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আইনি নোটিশ দেয়া হয়।
উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে বাংলাদেশে হিন্দু নারী কিছুই পান না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে আইন করে হিন্দু নারীদের সমানাধিকার দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও এ আইন হওয়া উচিৎ; যাতে হিন্দু নারীরা আর বঞ্চিত না হন। তবে ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু নারী-পুরুষ উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার হারাবেন এ বিধান রেখেই দ্রুত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পাশ করা হোক।
হিন্দু আইন সংশোধন প্রশ্নে নেতারা কেন বিভক্ত সেটা একটা প্রশ্ন। পৃথিবীতে যত ভালো কাজই হোক না কেন কেউ কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করে। যারা শিক্ষিত অথচ জ্ঞানী নয়, তারাই মূলত পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী। তাই হিন্দু আইন সংস্কারে বিরোধিতা যুক্তিসঙ্গত বলছেন এবং হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন সামাজিক ও ধর্মীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলেন। তারা সংসদের বিরোধী দলের মতো আচরণ করছেন। যেমন- সংসদে সরকারি দল যত ভালো আইনই তৈরি করুক না কেন বিরোধী দল এর বিরোধিতা করবেই।
পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে হিন্দু নারী তথা কন্যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে সমানাধিকার উত্তরাধিকার বাস্তবায়ন বহু পূূর্বেই হয়েছে। অতএব আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? নেতা, ভুক্তভোগী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও হিন্দু কন্যা সন্তানদের জন্য আইন সংশোধন চেয়েছেন।
ভারতে ধর্মীয় আইন সংস্কারের ইস্যুটি দেশটির ধর্মীয় নেতারা মেনে নিয়েছেন। এটাই আমাদের দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন নারী অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করলে বাড়ির মূল জমির বাহিরে কৃষিজমি তাকে দেয়া যেতে পারে। কিংবা আলোচনার মাধ্যমে অন্য সমাধান করা যেতে পারে।
হিন্দু নারীর অধিকার নিয়ে রক্ষণশীলতার চেয়ে আতঙ্ক বেশি। দ্রুত জাতীয় সংসদে হিন্দু নারী ও পুরুষের সমানাধিকার আইন পাশ করলে হিন্দু নারীরা উপকৃত হবেন ও হিংসা, ঘৃণা, অবহেলার শিকার হবেন না।
[লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, জয়পুরহাট]