alt

উপ-সম্পাদকীয়

কূটনীতি : তখন আর এখন

রহমান মৃধা

: শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা দেশের কূটনৈতিক দায়িত্ব নিলেও কাজটি এখন সরাসরি করে দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশ-বিদেশে। এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে বিশ্ব মহলে সঙ্গে আমার ভাবনায় ঢুকেছে তাহলে পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই যেসব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সহজ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! কারণ পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে তার চর্চা যদি না হয় তখন সে বিদ্যা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আসুন তাহলে চর্চা নিয়ে তুলে ধরি সেকালের একজন মুক্তিযুদ্ধের বার্তা বাহকের জীবন কাহিনী।

আমি তখন খুবই ছোট তারপরও কেনো যেনো মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দেখার স্মৃতি, মনে পড়ে যায় সেই হৃদয় দেবার তিথি। হাল্কা-পাতলা শ্যামলা বর্ণের এক তরুণী মহিলা বাঙালির আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ফরিদপুর ছেড়ে এসেছিলেন আমাদের গ্রামে স্বামীর হাত ধরে, সঙ্গে ফুটফুটে ছোট্ট একটি কন্যা শিশু নিয়ে।

সম্পর্কে তিনি আমার দাদি হলেন, দাদি তো সবাই বয়স হলে হয় কিন্তু এ তরুণী মহিলা দূর-সম্পর্কের দাদার বউ হবার কারণে হলেন আমারও দাদি। শুরুতেই বলেছি বয়স আমার বেশি না তবে দাদির সঙ্গে রং-তামাশা করা যায় এতটুকু বয়স হয়ে গেছে। তা একবার দাদিকে বলেছিলাম, ও দাদি তুমি কি বাঙালি?

দাদি কড়া উত্তরে তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন ‘হ্যাঁ আমি বাঙালি আর তোরা হলি সব পাঞ্জাবি’। যাই হোক প্রতিবেশী দাদা তিনি তেমন স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন না, দিনমজুরের কাজ করতেন। দাদি তার মেয়েকে নিয়ে আমার মাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। দাদির মেয়ের নাম ছিল হাসি, সেক্ষেত্রে হাসির মা বলেই অনেকে তাকে ডাকতেন।

মূলত আমরা তাকে দাদি বলে সম্বোধন করাকে তিনি পছন্দ করতেন না। করবেনই বা কী করে? অল্প বয়সের একজন মহিলাকে দাদি বললে নিশ্চয়ই মন খারাপ হবারই কথা তখন। আর আমি তো তখন ছোট, অতো কিছু বুঝি নাকি?

তবে আমার বড় ভাই মান্নান মৃধা সেটা বুঝতেন সেটা গতকাল টের পেলাম যখন ভাইকে দাদির ব্যাপারে কিছু স্মৃতিচারণ করতে বলেছিলাম। বড় ভাই সবসময় হাসির মা, পরে দাদি শব্দটি যোগ করলেন। যাই হোক হাসির মা দাদি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে বড় ভাই দাদিকে ফ্লাইং বার্ড বলেছেন, বলেছেন ফ্রি ল্যান্সার, বলেছেন অলস, বলেছেন প্রতিবাদী, বলেছেন বার্তা বাহক। কারণ এর সব গুলোই নাকি মূলত বাঙালির বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে ফরিদপুর, যশোর এবং কুষ্টিয়ার মানুষের পুরনো ইতিহাস ঘাটলে সত্যিকারার্থে তখনকার মনীষীদের জীবনী এমনটিই ছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুচিত্রা সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শেখ মুজিবসহ হাজারও উদাহরণ রয়েছে যারা কোনো এক সময় চাপে এবং তাপে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে নানাভাবে বিপ্লবমুখর হয়েছিলেন এবং এরা সবাই কিন্তু তার নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজস্ব মেধার গুণেই আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে দেশ তথা গোটা বিশ্বকে আলো দান করেছেন, যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি চিত্রজগত, পেয়েছি বাঙালির বাঙালিত্ব, পেয়েছি বাংলাদেশ, পেয়েছি বিশ্ব কবি, পেয়েছি জাতির পিতা।

আমার মেমোরিতে যতটুকু তথ্য রয়েছে তাতে মনে হয় হাসির মা দাদি দারিদ্র্য মোচনে নয়, বরং ভালোবাসার টানে ফরিদপুর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন নবগঙ্গা নদীর তীরে নহাটা গ্রামে, গ্রামটি বর্তমান মাগুরা জেলাধীন। দাদি বাঙালির বাঙালিত্বকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের এলাকায় এবং বিদ্রোহের বার্তাবাহক হিসেবে হুঁশিয়ারি সংকেত দিয়েছিলেন সেদিনের সেই প্রথম দেখায় যখন আমার কথার উত্তরে বলেছিলেন ‘তোরা পাঞ্জাবি’।

এই মুহূর্তে স্মৃতির জানালা খুলে চেয়ে দেখছি, যতোুকু আলো আসছে মনে, সে আলোয় দাদির সে রাগান্বিত বার্তা দেখতে পারছি। ভাবছি! তাই বুঝি সেই অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিলাম শুধু আজীবনের মতো পাঞ্জাবি শব্দটাকে মুছে ফেলতে। যে কথা সেই কাজ, সরিয়েছিলাম সেই শাসক গোষ্ঠীকে, মুক্ত করেছিলাম বাঙালির বাঙালিত্বকে। দাদিকে দেখেছি কী প্রচন্ড দক্ষতার সঙ্গে খবর বহন করেছেন ততকালীন মুক্তি বাহিনীর মাঝে। দাদি রাজাকারদের ঘাঁটিতে গিয়েছেন, তথ্য জোগাড় করেছেন, এলাকার কোথায় কি ঘটেছে সেটা সবার আগে প্রচার করেছেন। মনে হতো দাদির কাছে গেলেই সবার আগে সর্বশেষ খবর মিলবে এবং সেটাই হতো সব সময়। দাদির কোনো পুঁথিগত বিদ্যা ছিলো না তবে বিচক্ষণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন তার বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। দাদির কূটনীতি সব সময় তথ্য বহুল এবং ক্রিয়েটিভ বার্তা বহন করেছে তখন।

দাদি আজও বেঁচে আছেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, কঠিন সময়ের মাঝে বেঁচে থাকার কারণ হতে পারে আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের বংশ পরিচয়- অতীতে কী ছিলাম আর বর্তমানে কী হয়েছি।

আমাদের দাদি অতিসাধারণ একজন মানুষ। তার জীবনের ছোটখাটো ঘটনার সঙ্গে আমি মোটামুটি সচেতন তবে আমার বাবা-মা মারা যাবার পর কিছুটা হাল্কা হয়েছে সম্পর্কের। আমার লাস্ট ভ্রমণ সম্ভবত ২০১৪ সালে, দুই দিন নহাটাতে ছিলাম তখন কিন্তু বলতে গেলে পুরো সময়টুকু তার সঙ্গে কেটেছিল আমার। সুখ-দুঃখের অনেক কথা শেয়ার করেছিলেন তখন। কেনো যেন মনে আসেনি তখন দাদিকে প্রশ্ন করে জানতে যে দেশ স্বাধীন হলো, কেউ পেল, কেউ শুধু হারালো কিন্তু দাদি কেন সব চাওয়া পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলো! ৭১ সালের যুদ্ধে হারালেন দাদি তার বাড়ি, ১২-১৩ বছরের মেয়ে হাসিকে এবং পরে তার স্বামীকে পাঞ্জাবিদের নির্মম অত্যাচারের কারণে দাদির হারানোর গল্পের শেষ হয়নি বা সমাজ তথা দেশ থেকে তেমন কিছু পায়নি, কিন্তু কেন? সে আলোচনাও হয়নি। আমার বাবা-মা হারানোর ব্যথা আমার মনে তখন যেভাবে হাহাকার করে ব্যস্ত রেখেছিল আমাকে, দাদি সেটা লক্ষ্য করেছিলেন তাই হয়তো তার দুঃখের কথা শেয়ার করে আমার দুঃখের বোঝা বাড়াতে চেষ্টা করেননি সেদিন!

হঠাৎ দাদির ছোট্ট একটি ভিডিও দেখে মনে হলো তার দারিদ্র্য চরমে। দিনে কোনোক্রমে দু-এক বেলা খেয়ে না-খেয়ে থাকেন। নহাটা বাজারে গিয়ে তার চিকিৎসা করানোর কোনো সাধ্য নেই। তাকে চিকিৎসা করাতে না পারলেও তাকে অবহেলা করা আমাদের ঠিক হবে না।

আমি মনে-প্রাণে আশা করি রাষ্ট্র থেকে শুরু করে আমরা সবাই যেন আমাদের এই বেঁচে থাকা বাঙালি দাদির জন্য কিছু করি একসঙ্গে। আমরা যদি বাংলা দেশে আবারো একটি পয়লা বৈশাখ পাই, যেন বৈশাখের মেলায় অনেক মানুষের ভিড়ে দাদিকেও দেখতে পাই। দাদির মুখে যেন শুনতে পাই মেলায় গিয়েছিলাম শুনলাম এবং দেখলাম একটা ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে, কী দারুণ! বাঁশি যে আসলেই ডাকাতিয়া হয়, এর আগে বিশ্বাস করিনি। এই শীতেই যেন আমরা দাদিকে নতুন করে একটি বিশেষ উপহার দিতে পারি। দাদির জন্য আমরা সবাই ছোট্ট একটি ভালোবাসার সুখের ঘর তৈরি করে দিয়েছি। দাদির মুখে যেন এবারের বৈশাখে নতুন কিছু হাসির কথা শুনতে পাই। শুনতে পাই যেমন দেশের মানুষ গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে, নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছে।

পরিশেষে বলতে চাই, হে বাংলাদেশ! তুমি পঞ্চাশ বছরে যা করতে পারনি তোমার ডিপ্লোমেসি দিয়ে সেটা করেছেন র্বতমান বঙ্গবন্ধু কন্যা গত কয়েক মাস ধরে। গোটা বিশ্বে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তিনি তার নিজস্ব কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। আশা করি দেশের এবং গোটা বিশ্বের কূটনৈতিকবৃন্দ তার এই কূটনৈতিক পারদর্শিতা থেকে কিছু শিখবে এবং তোমাকে বিশ্ব দরবারে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

হে প্রিয় জন্মভূমি তোমাকে আজও প্রতিক্ষণে মনে পড়ে। আজ আমার জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, তবু মনে হয় কী যেন নেই! আমার এই হৃদয়জুড়ে আজ অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে আছে, তোমাকে কাছে না পাওয়ার শূন্যতা। তোমার দেওয়া স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে আজও বেঁচে আছি। একটাই চাওয়া, জীবনের শেষবেলায় হলেও যেন দেখতে পাই তুমি সত্যিকার সোনার বাংলা হয়েছো, যেখানে হাসির মা দাদির মতো কেউ যেন আর পরের দুয়ারে হাত না পাতে শুধু একটু অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের জন্য!

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কূটনীতি : তখন আর এখন

রহমান মৃধা

শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা দেশের কূটনৈতিক দায়িত্ব নিলেও কাজটি এখন সরাসরি করে দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশ-বিদেশে। এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে বিশ্ব মহলে সঙ্গে আমার ভাবনায় ঢুকেছে তাহলে পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই যেসব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সহজ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! কারণ পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে তার চর্চা যদি না হয় তখন সে বিদ্যা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আসুন তাহলে চর্চা নিয়ে তুলে ধরি সেকালের একজন মুক্তিযুদ্ধের বার্তা বাহকের জীবন কাহিনী।

আমি তখন খুবই ছোট তারপরও কেনো যেনো মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দেখার স্মৃতি, মনে পড়ে যায় সেই হৃদয় দেবার তিথি। হাল্কা-পাতলা শ্যামলা বর্ণের এক তরুণী মহিলা বাঙালির আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ফরিদপুর ছেড়ে এসেছিলেন আমাদের গ্রামে স্বামীর হাত ধরে, সঙ্গে ফুটফুটে ছোট্ট একটি কন্যা শিশু নিয়ে।

সম্পর্কে তিনি আমার দাদি হলেন, দাদি তো সবাই বয়স হলে হয় কিন্তু এ তরুণী মহিলা দূর-সম্পর্কের দাদার বউ হবার কারণে হলেন আমারও দাদি। শুরুতেই বলেছি বয়স আমার বেশি না তবে দাদির সঙ্গে রং-তামাশা করা যায় এতটুকু বয়স হয়ে গেছে। তা একবার দাদিকে বলেছিলাম, ও দাদি তুমি কি বাঙালি?

দাদি কড়া উত্তরে তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন ‘হ্যাঁ আমি বাঙালি আর তোরা হলি সব পাঞ্জাবি’। যাই হোক প্রতিবেশী দাদা তিনি তেমন স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন না, দিনমজুরের কাজ করতেন। দাদি তার মেয়েকে নিয়ে আমার মাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। দাদির মেয়ের নাম ছিল হাসি, সেক্ষেত্রে হাসির মা বলেই অনেকে তাকে ডাকতেন।

মূলত আমরা তাকে দাদি বলে সম্বোধন করাকে তিনি পছন্দ করতেন না। করবেনই বা কী করে? অল্প বয়সের একজন মহিলাকে দাদি বললে নিশ্চয়ই মন খারাপ হবারই কথা তখন। আর আমি তো তখন ছোট, অতো কিছু বুঝি নাকি?

তবে আমার বড় ভাই মান্নান মৃধা সেটা বুঝতেন সেটা গতকাল টের পেলাম যখন ভাইকে দাদির ব্যাপারে কিছু স্মৃতিচারণ করতে বলেছিলাম। বড় ভাই সবসময় হাসির মা, পরে দাদি শব্দটি যোগ করলেন। যাই হোক হাসির মা দাদি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে বড় ভাই দাদিকে ফ্লাইং বার্ড বলেছেন, বলেছেন ফ্রি ল্যান্সার, বলেছেন অলস, বলেছেন প্রতিবাদী, বলেছেন বার্তা বাহক। কারণ এর সব গুলোই নাকি মূলত বাঙালির বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে ফরিদপুর, যশোর এবং কুষ্টিয়ার মানুষের পুরনো ইতিহাস ঘাটলে সত্যিকারার্থে তখনকার মনীষীদের জীবনী এমনটিই ছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুচিত্রা সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শেখ মুজিবসহ হাজারও উদাহরণ রয়েছে যারা কোনো এক সময় চাপে এবং তাপে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে নানাভাবে বিপ্লবমুখর হয়েছিলেন এবং এরা সবাই কিন্তু তার নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজস্ব মেধার গুণেই আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে দেশ তথা গোটা বিশ্বকে আলো দান করেছেন, যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি চিত্রজগত, পেয়েছি বাঙালির বাঙালিত্ব, পেয়েছি বাংলাদেশ, পেয়েছি বিশ্ব কবি, পেয়েছি জাতির পিতা।

আমার মেমোরিতে যতটুকু তথ্য রয়েছে তাতে মনে হয় হাসির মা দাদি দারিদ্র্য মোচনে নয়, বরং ভালোবাসার টানে ফরিদপুর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন নবগঙ্গা নদীর তীরে নহাটা গ্রামে, গ্রামটি বর্তমান মাগুরা জেলাধীন। দাদি বাঙালির বাঙালিত্বকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের এলাকায় এবং বিদ্রোহের বার্তাবাহক হিসেবে হুঁশিয়ারি সংকেত দিয়েছিলেন সেদিনের সেই প্রথম দেখায় যখন আমার কথার উত্তরে বলেছিলেন ‘তোরা পাঞ্জাবি’।

এই মুহূর্তে স্মৃতির জানালা খুলে চেয়ে দেখছি, যতোুকু আলো আসছে মনে, সে আলোয় দাদির সে রাগান্বিত বার্তা দেখতে পারছি। ভাবছি! তাই বুঝি সেই অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিলাম শুধু আজীবনের মতো পাঞ্জাবি শব্দটাকে মুছে ফেলতে। যে কথা সেই কাজ, সরিয়েছিলাম সেই শাসক গোষ্ঠীকে, মুক্ত করেছিলাম বাঙালির বাঙালিত্বকে। দাদিকে দেখেছি কী প্রচন্ড দক্ষতার সঙ্গে খবর বহন করেছেন ততকালীন মুক্তি বাহিনীর মাঝে। দাদি রাজাকারদের ঘাঁটিতে গিয়েছেন, তথ্য জোগাড় করেছেন, এলাকার কোথায় কি ঘটেছে সেটা সবার আগে প্রচার করেছেন। মনে হতো দাদির কাছে গেলেই সবার আগে সর্বশেষ খবর মিলবে এবং সেটাই হতো সব সময়। দাদির কোনো পুঁথিগত বিদ্যা ছিলো না তবে বিচক্ষণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন তার বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। দাদির কূটনীতি সব সময় তথ্য বহুল এবং ক্রিয়েটিভ বার্তা বহন করেছে তখন।

দাদি আজও বেঁচে আছেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, কঠিন সময়ের মাঝে বেঁচে থাকার কারণ হতে পারে আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের বংশ পরিচয়- অতীতে কী ছিলাম আর বর্তমানে কী হয়েছি।

আমাদের দাদি অতিসাধারণ একজন মানুষ। তার জীবনের ছোটখাটো ঘটনার সঙ্গে আমি মোটামুটি সচেতন তবে আমার বাবা-মা মারা যাবার পর কিছুটা হাল্কা হয়েছে সম্পর্কের। আমার লাস্ট ভ্রমণ সম্ভবত ২০১৪ সালে, দুই দিন নহাটাতে ছিলাম তখন কিন্তু বলতে গেলে পুরো সময়টুকু তার সঙ্গে কেটেছিল আমার। সুখ-দুঃখের অনেক কথা শেয়ার করেছিলেন তখন। কেনো যেন মনে আসেনি তখন দাদিকে প্রশ্ন করে জানতে যে দেশ স্বাধীন হলো, কেউ পেল, কেউ শুধু হারালো কিন্তু দাদি কেন সব চাওয়া পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলো! ৭১ সালের যুদ্ধে হারালেন দাদি তার বাড়ি, ১২-১৩ বছরের মেয়ে হাসিকে এবং পরে তার স্বামীকে পাঞ্জাবিদের নির্মম অত্যাচারের কারণে দাদির হারানোর গল্পের শেষ হয়নি বা সমাজ তথা দেশ থেকে তেমন কিছু পায়নি, কিন্তু কেন? সে আলোচনাও হয়নি। আমার বাবা-মা হারানোর ব্যথা আমার মনে তখন যেভাবে হাহাকার করে ব্যস্ত রেখেছিল আমাকে, দাদি সেটা লক্ষ্য করেছিলেন তাই হয়তো তার দুঃখের কথা শেয়ার করে আমার দুঃখের বোঝা বাড়াতে চেষ্টা করেননি সেদিন!

হঠাৎ দাদির ছোট্ট একটি ভিডিও দেখে মনে হলো তার দারিদ্র্য চরমে। দিনে কোনোক্রমে দু-এক বেলা খেয়ে না-খেয়ে থাকেন। নহাটা বাজারে গিয়ে তার চিকিৎসা করানোর কোনো সাধ্য নেই। তাকে চিকিৎসা করাতে না পারলেও তাকে অবহেলা করা আমাদের ঠিক হবে না।

আমি মনে-প্রাণে আশা করি রাষ্ট্র থেকে শুরু করে আমরা সবাই যেন আমাদের এই বেঁচে থাকা বাঙালি দাদির জন্য কিছু করি একসঙ্গে। আমরা যদি বাংলা দেশে আবারো একটি পয়লা বৈশাখ পাই, যেন বৈশাখের মেলায় অনেক মানুষের ভিড়ে দাদিকেও দেখতে পাই। দাদির মুখে যেন শুনতে পাই মেলায় গিয়েছিলাম শুনলাম এবং দেখলাম একটা ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে, কী দারুণ! বাঁশি যে আসলেই ডাকাতিয়া হয়, এর আগে বিশ্বাস করিনি। এই শীতেই যেন আমরা দাদিকে নতুন করে একটি বিশেষ উপহার দিতে পারি। দাদির জন্য আমরা সবাই ছোট্ট একটি ভালোবাসার সুখের ঘর তৈরি করে দিয়েছি। দাদির মুখে যেন এবারের বৈশাখে নতুন কিছু হাসির কথা শুনতে পাই। শুনতে পাই যেমন দেশের মানুষ গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে, নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছে।

পরিশেষে বলতে চাই, হে বাংলাদেশ! তুমি পঞ্চাশ বছরে যা করতে পারনি তোমার ডিপ্লোমেসি দিয়ে সেটা করেছেন র্বতমান বঙ্গবন্ধু কন্যা গত কয়েক মাস ধরে। গোটা বিশ্বে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তিনি তার নিজস্ব কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। আশা করি দেশের এবং গোটা বিশ্বের কূটনৈতিকবৃন্দ তার এই কূটনৈতিক পারদর্শিতা থেকে কিছু শিখবে এবং তোমাকে বিশ্ব দরবারে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

হে প্রিয় জন্মভূমি তোমাকে আজও প্রতিক্ষণে মনে পড়ে। আজ আমার জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, তবু মনে হয় কী যেন নেই! আমার এই হৃদয়জুড়ে আজ অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে আছে, তোমাকে কাছে না পাওয়ার শূন্যতা। তোমার দেওয়া স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে আজও বেঁচে আছি। একটাই চাওয়া, জীবনের শেষবেলায় হলেও যেন দেখতে পাই তুমি সত্যিকার সোনার বাংলা হয়েছো, যেখানে হাসির মা দাদির মতো কেউ যেন আর পরের দুয়ারে হাত না পাতে শুধু একটু অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের জন্য!

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

back to top