শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাংলদেশের মানুষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই জনপদের মানুষ তাদের আবহমানকালের সংস্কৃতিক চেতনাকে সমুন্নত রাখতে লড়াই করেছে উপনিবেশিকদের শাসকদের বিরুদ্ধে। সংস্কৃতিক শব্দটির আভিধানিক অর্থ মানবীয় বৈশিষ্ট এর উৎকর্ষ সাধন। সংস্কৃতি বা কৃষ্টি হলো সেই জটিল সামগ্রিকতা যাতে অর্ন্তগত আছে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, রাজনীতি, আচার এবং সমাজের একজন সদস্য হিসাবে মানুষ দ্বারা অর্জিত সম্ভাব্য সামর্থ্য বা অভ্যাস।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে একটি সংস্কৃতি রক্ষার যুদ্ধ বললেও ভুল হবে না। কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লেখ আছে যে স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতা এই জনপদের প্রাচীন ঐতিহ্য। পাকিস্তানের শাসকরা মৌলবাদ ধর্মীয় আচ্ছাদনে এই ঐতিহ্যকে বিলীন করার অপপ্রয়াস চালায়। কোন জাতির অস্তিত্বকে বিনাশ করতে চাইলে তার সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। পাকিস্তানিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটাই। পাকিস্তানি শাসকদের এই উদ্দেশ্যকে প্রতিহত করতে সেই সময় গড়ে উঠে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। বর্তমানেও উদীচী বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬৮ সালে বিপ্লবী কথা সাহিত্যিক সত্যেন সেন এই সংগঠনটি গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে রণেশ দাস গুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ এদেশের বেশ কিছু তরুণ সংগঠনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। উদীচী গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল অধিকার, স্বাধীনতা, সাম্যের সমাজ নির্মাণ। এই লক্ষকে সামনে রেখে আজও উদীচী লড়াই সংগ্রাম করে আসছে। উদীচী ৬৮, ৬৯, ৭০, বাঙালি জাতির মুক্তির চেতনায় গড়ে তুলেছিল সাংস্কৃতি সংগ্রাম। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে উদীচীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। উদীচীর গন সংগীত গুলো এই জনপদের মানুষকে মুক্তির লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ করার জন্য উদ্ধুদ্ধ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গনতন্ত্র, মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এর আগ্রাসনকে রুখতে চালাচ্ছে উদীচীর সংগ্রাম। এই লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন উদীচীর বহু কর্মী। বার বার আঘাত হানা হয়েছে উদীচীর কর্মকান্ডে। বাংলাজনপদের সংস্কৃতির ধারাটা অক্ষুণ্ন রাখতে এবং মানব মুক্তির লক্ষে শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে উদীচীর লড়াই সংগ্রাম অব্যহত আছে।
ষাট দশকে ফৌজি পাক-সরকার তৎকালী পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলা জনপদে) রবীন্দ্র সংগীত ও রবীন্দ্র সাহিত্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘোষণার প্রতিবাদী এদেশের শিল্পী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীরা প্রতিবাদ করেন। প্রবাদ প্রতীম রবিন্দ্র সংগীত শিল্পী কলিম শরাফী শিল্পী, কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে গড়ে তোলেন ছায়ানট। তখন থেকে ফৌজি পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছায়ানটের কর্মীরা রবিন্দ্র সংগীত, নাটক ও নৃত্যনাট্যর চর্চা শুরু করেন। ফৌজি পাকিস্তানি সরকার ছায়ানটের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এই নিষেধাজ্ঞা উপক্ষো করে জেলায় জেলায় গড়ে উঠে ছায়ানটের শাখা। পাকিস্তানিদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র নাথের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ নেয় প্রগতিশীল সংগঠকরা। ১৯৬১ সালে কবি সুফিয়া কামালকে সভাপতি ফরিদ হাসানকে সম্পাদক করে শুরু হয় ছায়ানটের প্রাতিষ্ঠানিক পথ চলা। ঐ সময় সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, জহুর হোসেন চৌধুরী, সাঈদুল হাসান, সাইফুদ্দিন আহামেদ মানিক, মিজানুর রহমান ছানা, মোখলেছুর রহমান, কামাল লোহানী, ওয়াহিদুল হক, সানজিদা খাতুন, আহামেদুর রহমান প্রমুখ। ১৯৬১ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এর মিলানায়তনে ছায়ানটের প্রথম গানের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬১ সাল, বাংলা ১৩৭১ সালের ১ বৈশাখ উদযাপনের সূচনা করে ছায়ানট। বাংলা নববর্ষে দিনটি উদযাপনের জন্য ছায়ানট স্থানটি নির্বাচন করেছিল রমনা বটমূল। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় ছায়াটের ভুমিকা অপরিসীম। ছায়ানটের কর্মীরা অস্ত্র হাতে নিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্বে অংশ নেয়।
বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ মূলত একটি সাহিত্য সংগঠন। তবে সংগঠনটির জন্ম হয়, সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িকতাকে ও রাজনৈতিক পরাধীনতার শৃংখল ভাঙ্গতে এই সংঘের জন্ম। যেহেতু এটি একটি আর্ন্তজাতিক সংগঠন তাই প্রতিটি জনপদের সংস্কৃতির মূল ধারাটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুক্তির লড়াই করাটা ছিল মূল কাজ। সংগঠটির ইতিহাস অনেক পুরোনো। সারা দুনিয়ার ফ্যাসিবাদীদের রুখতে এই সংগঠনটির জন্ম হয় ১৯৩৫ সালের ২১ জুন। ফ্রান্সের প্যারিস শহরে বিশ্বের লেখক, সাহিত্যিক, কবি শিল্পীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল আর্ন্তজাতিক প্রগেসিভ রাইটার গিল্ড। এই রাইটার গিল্ডের পথ বেয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে লেখক সংঘের জন্ম। ১৯৩৫ সালের গোড়ার দিকে লন্ডনে ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ নামে একটি সাহিত্য সভা গঠিত হয়। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৬ সালে সাজ্জাদ জহিরের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়, নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ। ১৯৩৬ সালে জুন মাসে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়, বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘের। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৯ সালে সোমেন চন্দ, সতীশ পাকড়াশী, জ্যোতির্ময় সেন, রণেশ দাশগুপ্তের উদ্যোগে গঠিত হয় পূর্ব বাংলায় ঢাকা লেখক সংঘ। প্রগতি লেখক সংঘ সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী সাম্যবাদী রাজনৈতিক আর্দশের বিশ্বাসী একটি সংগঠন। অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যবাদ ও মানবতাবাদ এই সংঘের মূলমন্ত্র। এক সময় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই লেখক সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তখন প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি ও সাধারন সমপাদক ছিলেন মুন্সী প্রেম চাদ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সংঘটি ফৌজি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। লেখক সংঘের সদস্যরা লেখনীর মাধ্যমে মৌলবাদে দুষ্ঠ পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম জনগনের মাঝে তুলে ধরতেন। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে সংঘের কর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রতিটি সংগ্রামে সংঘের কর্মীরা যুক্ত রয়েছেন।
খেলাঘর একটি শিশু সংগঠন। শিশুকিশোরদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য খেলাঘর কাজ করে। অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষ গঙে তোলা সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। খেলাঘর শিশুকিশোরদের সুস্থ দেহ ও মন গঠন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির চর্চা এবং সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিভার বিকাশ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষার প্রসারে আগ্রহী এবং প্রীতি, ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার ওপর গুরুত্বারোপ করে। এই সংগঠনটি পৃথিবীর সবাই শান্তি, স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে একাত্মতার ওপর ভিত্তি করে সবাই কর্মকান্ড বিন্যস্ত করে। খেলাঘরের জন্ম ১৯৫২ সালের ২ মে। এই দিন দৈনিক সংবাদ-এর সাপ্তাহিক শিশু সাহিত্যপাতা খেলাঘর আত্মপ্রকাশ করে। খেলাঘরকে ঘিরে একদল তরুণ ও উদীয়মান লিখিয়ে ভিড় জমায়। কবি হাবিবুর রহমান ছিলেন খেলাঘরের ‘ভাইয়া’। দৈনিক সংবাদের বংশাল অফিসে খেলাঘর আসর গড়ে উঠে। একে কেন্দ্র করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শাখা খেলাঘর আসর গড়ে উঠতে থাকে। পুরনো ঢাকার জেলখানা রোডে দীন মোহাম্মদ নবীর নেতৃত্বে প্রথম শাখা আসর গঠিত হয় ‘আমাদের খেলাঘর’ নামে। ১৯৫৬ সালের ২২ জুলাই দৈনিক সংবাদের অফিসে এক নির্বাচনী সভায় কেন্দ্রীয় খেলাঘর পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। সাংবাদিক সৈয়দ নূরউদ্দিন ও তরুণ লেখক আল কামাল আব্দুল ওহাব নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে মুহম্মদ সফিউল্লাহ সভাপতি ও আল কামাল আব্দুল ওহাব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫২-৬০ সময়কালে সাহিত্যচর্চা ছিল খেলাঘরের প্রধান কাজ। ১৯৬৪ সালে বজলুর রহমান খেলাঘরের ভাইয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর খেলাঘর সমাজভিত্তিক শিশু সংগঠনের রূপ নেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং শোষণমুক্ত সমাজ এই সময়ে খেলাঘরের মৌলিক চেতনা হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালে খেলাঘর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্ত স্বদেশে খেলাঘর স্লোগান তৈরি করে ‘এসো গড়ি খেলাঘর, এসো গড়ি বাংলাদেশ’। সংগঠন, শিক্ষা, শিশুর আইনি অধিকার, শিশুর স্বাস্থ্য (শারীরিক ও মানসিক), বিজ্ঞান ও পরিবেশ, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ যুগ-পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এই যুগ-পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত এবং অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবতাবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী ]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩
বাংলদেশের মানুষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই জনপদের মানুষ তাদের আবহমানকালের সংস্কৃতিক চেতনাকে সমুন্নত রাখতে লড়াই করেছে উপনিবেশিকদের শাসকদের বিরুদ্ধে। সংস্কৃতিক শব্দটির আভিধানিক অর্থ মানবীয় বৈশিষ্ট এর উৎকর্ষ সাধন। সংস্কৃতি বা কৃষ্টি হলো সেই জটিল সামগ্রিকতা যাতে অর্ন্তগত আছে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, রাজনীতি, আচার এবং সমাজের একজন সদস্য হিসাবে মানুষ দ্বারা অর্জিত সম্ভাব্য সামর্থ্য বা অভ্যাস।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে একটি সংস্কৃতি রক্ষার যুদ্ধ বললেও ভুল হবে না। কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লেখ আছে যে স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতা এই জনপদের প্রাচীন ঐতিহ্য। পাকিস্তানের শাসকরা মৌলবাদ ধর্মীয় আচ্ছাদনে এই ঐতিহ্যকে বিলীন করার অপপ্রয়াস চালায়। কোন জাতির অস্তিত্বকে বিনাশ করতে চাইলে তার সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। পাকিস্তানিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটাই। পাকিস্তানি শাসকদের এই উদ্দেশ্যকে প্রতিহত করতে সেই সময় গড়ে উঠে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। বর্তমানেও উদীচী বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬৮ সালে বিপ্লবী কথা সাহিত্যিক সত্যেন সেন এই সংগঠনটি গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে রণেশ দাস গুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ এদেশের বেশ কিছু তরুণ সংগঠনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। উদীচী গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল অধিকার, স্বাধীনতা, সাম্যের সমাজ নির্মাণ। এই লক্ষকে সামনে রেখে আজও উদীচী লড়াই সংগ্রাম করে আসছে। উদীচী ৬৮, ৬৯, ৭০, বাঙালি জাতির মুক্তির চেতনায় গড়ে তুলেছিল সাংস্কৃতি সংগ্রাম। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে উদীচীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। উদীচীর গন সংগীত গুলো এই জনপদের মানুষকে মুক্তির লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ করার জন্য উদ্ধুদ্ধ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গনতন্ত্র, মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এর আগ্রাসনকে রুখতে চালাচ্ছে উদীচীর সংগ্রাম। এই লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন উদীচীর বহু কর্মী। বার বার আঘাত হানা হয়েছে উদীচীর কর্মকান্ডে। বাংলাজনপদের সংস্কৃতির ধারাটা অক্ষুণ্ন রাখতে এবং মানব মুক্তির লক্ষে শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে উদীচীর লড়াই সংগ্রাম অব্যহত আছে।
ষাট দশকে ফৌজি পাক-সরকার তৎকালী পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলা জনপদে) রবীন্দ্র সংগীত ও রবীন্দ্র সাহিত্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘোষণার প্রতিবাদী এদেশের শিল্পী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীরা প্রতিবাদ করেন। প্রবাদ প্রতীম রবিন্দ্র সংগীত শিল্পী কলিম শরাফী শিল্পী, কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে গড়ে তোলেন ছায়ানট। তখন থেকে ফৌজি পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছায়ানটের কর্মীরা রবিন্দ্র সংগীত, নাটক ও নৃত্যনাট্যর চর্চা শুরু করেন। ফৌজি পাকিস্তানি সরকার ছায়ানটের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এই নিষেধাজ্ঞা উপক্ষো করে জেলায় জেলায় গড়ে উঠে ছায়ানটের শাখা। পাকিস্তানিদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র নাথের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ নেয় প্রগতিশীল সংগঠকরা। ১৯৬১ সালে কবি সুফিয়া কামালকে সভাপতি ফরিদ হাসানকে সম্পাদক করে শুরু হয় ছায়ানটের প্রাতিষ্ঠানিক পথ চলা। ঐ সময় সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, জহুর হোসেন চৌধুরী, সাঈদুল হাসান, সাইফুদ্দিন আহামেদ মানিক, মিজানুর রহমান ছানা, মোখলেছুর রহমান, কামাল লোহানী, ওয়াহিদুল হক, সানজিদা খাতুন, আহামেদুর রহমান প্রমুখ। ১৯৬১ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এর মিলানায়তনে ছায়ানটের প্রথম গানের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬১ সাল, বাংলা ১৩৭১ সালের ১ বৈশাখ উদযাপনের সূচনা করে ছায়ানট। বাংলা নববর্ষে দিনটি উদযাপনের জন্য ছায়ানট স্থানটি নির্বাচন করেছিল রমনা বটমূল। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় ছায়াটের ভুমিকা অপরিসীম। ছায়ানটের কর্মীরা অস্ত্র হাতে নিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্বে অংশ নেয়।
বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ মূলত একটি সাহিত্য সংগঠন। তবে সংগঠনটির জন্ম হয়, সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িকতাকে ও রাজনৈতিক পরাধীনতার শৃংখল ভাঙ্গতে এই সংঘের জন্ম। যেহেতু এটি একটি আর্ন্তজাতিক সংগঠন তাই প্রতিটি জনপদের সংস্কৃতির মূল ধারাটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুক্তির লড়াই করাটা ছিল মূল কাজ। সংগঠটির ইতিহাস অনেক পুরোনো। সারা দুনিয়ার ফ্যাসিবাদীদের রুখতে এই সংগঠনটির জন্ম হয় ১৯৩৫ সালের ২১ জুন। ফ্রান্সের প্যারিস শহরে বিশ্বের লেখক, সাহিত্যিক, কবি শিল্পীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল আর্ন্তজাতিক প্রগেসিভ রাইটার গিল্ড। এই রাইটার গিল্ডের পথ বেয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে লেখক সংঘের জন্ম। ১৯৩৫ সালের গোড়ার দিকে লন্ডনে ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ নামে একটি সাহিত্য সভা গঠিত হয়। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৬ সালে সাজ্জাদ জহিরের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়, নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ। ১৯৩৬ সালে জুন মাসে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়, বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘের। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৯ সালে সোমেন চন্দ, সতীশ পাকড়াশী, জ্যোতির্ময় সেন, রণেশ দাশগুপ্তের উদ্যোগে গঠিত হয় পূর্ব বাংলায় ঢাকা লেখক সংঘ। প্রগতি লেখক সংঘ সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী সাম্যবাদী রাজনৈতিক আর্দশের বিশ্বাসী একটি সংগঠন। অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যবাদ ও মানবতাবাদ এই সংঘের মূলমন্ত্র। এক সময় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই লেখক সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তখন প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি ও সাধারন সমপাদক ছিলেন মুন্সী প্রেম চাদ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সংঘটি ফৌজি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। লেখক সংঘের সদস্যরা লেখনীর মাধ্যমে মৌলবাদে দুষ্ঠ পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম জনগনের মাঝে তুলে ধরতেন। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে সংঘের কর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রতিটি সংগ্রামে সংঘের কর্মীরা যুক্ত রয়েছেন।
খেলাঘর একটি শিশু সংগঠন। শিশুকিশোরদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য খেলাঘর কাজ করে। অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষ গঙে তোলা সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। খেলাঘর শিশুকিশোরদের সুস্থ দেহ ও মন গঠন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির চর্চা এবং সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিভার বিকাশ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষার প্রসারে আগ্রহী এবং প্রীতি, ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার ওপর গুরুত্বারোপ করে। এই সংগঠনটি পৃথিবীর সবাই শান্তি, স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে একাত্মতার ওপর ভিত্তি করে সবাই কর্মকান্ড বিন্যস্ত করে। খেলাঘরের জন্ম ১৯৫২ সালের ২ মে। এই দিন দৈনিক সংবাদ-এর সাপ্তাহিক শিশু সাহিত্যপাতা খেলাঘর আত্মপ্রকাশ করে। খেলাঘরকে ঘিরে একদল তরুণ ও উদীয়মান লিখিয়ে ভিড় জমায়। কবি হাবিবুর রহমান ছিলেন খেলাঘরের ‘ভাইয়া’। দৈনিক সংবাদের বংশাল অফিসে খেলাঘর আসর গড়ে উঠে। একে কেন্দ্র করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শাখা খেলাঘর আসর গড়ে উঠতে থাকে। পুরনো ঢাকার জেলখানা রোডে দীন মোহাম্মদ নবীর নেতৃত্বে প্রথম শাখা আসর গঠিত হয় ‘আমাদের খেলাঘর’ নামে। ১৯৫৬ সালের ২২ জুলাই দৈনিক সংবাদের অফিসে এক নির্বাচনী সভায় কেন্দ্রীয় খেলাঘর পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। সাংবাদিক সৈয়দ নূরউদ্দিন ও তরুণ লেখক আল কামাল আব্দুল ওহাব নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে মুহম্মদ সফিউল্লাহ সভাপতি ও আল কামাল আব্দুল ওহাব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫২-৬০ সময়কালে সাহিত্যচর্চা ছিল খেলাঘরের প্রধান কাজ। ১৯৬৪ সালে বজলুর রহমান খেলাঘরের ভাইয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর খেলাঘর সমাজভিত্তিক শিশু সংগঠনের রূপ নেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং শোষণমুক্ত সমাজ এই সময়ে খেলাঘরের মৌলিক চেতনা হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালে খেলাঘর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্ত স্বদেশে খেলাঘর স্লোগান তৈরি করে ‘এসো গড়ি খেলাঘর, এসো গড়ি বাংলাদেশ’। সংগঠন, শিক্ষা, শিশুর আইনি অধিকার, শিশুর স্বাস্থ্য (শারীরিক ও মানসিক), বিজ্ঞান ও পরিবেশ, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ যুগ-পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এই যুগ-পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত এবং অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবতাবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী ]