গৌতম রায়
নিয়োগ দুর্নীতি তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসবার পর থেকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে, যা নিয়ে এখন প্রতিবাদে লেখা কোনো শব্দই বুঝি বা আর যথেষ্ট নয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন তৃণমূলের জামানাতে যে কোনো স্তরেই সরকারি চাকরি যারা পেয়েছেন, তাদের ভিতর একটা বড় অংশ আদালতের নির্দেশে চাকরি হারিয়েছেন বা হারাতে চলেছেন। আর একটা বড় অংশ এখন প্রবল অনিশ্চয়তার ভিতরে দিন কাটাচ্ছেন। প্রত্যেকেরই আশঙ্কা কবে বা যায় সরকারি চাকরি। পরিস্থিতি এখন পশ্চিমবঙ্গে এমনই দাঁড়িয়েছে যে, যারা নিজেদের যোগ্যতায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন, সেই সব মানুষদেরও এখন সাধারণের সন্দেহের দৃষ্টির এক কদর্যতার ভিতর দিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এমনই এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ভিতরে মমতা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষকে এনে ফেলেছেন।
নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে বামফ্রন্ট সরকার, তাদের শাসনকালের মধ্যবর্তী সময়ে স্কুল, কলেজে সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেন। তার আগে স্কুল, কলেজের পরিচালন সমিতির মাধ্যমে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল, সেই প্রক্রিয়া তে স্বচ্ছতার অভাবের বিষয়টি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার বা তাদের প্রধান পরিচালক সিপিআই (এম) সময়ের নিরিখে অনুভব করেছিল। সেই অনুভূতির জেরেই তারা সার্ভিস কমিশন তৈরি করে। প্রাথমিক শিক্ষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও সময়ের নিরিখে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করে বাস্তুঘুঘুদের বাসা ভেঙেছিল বামফ্রন্ট সরকারই।
বর্তমান সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসবার সঙ্গে সঙ্গেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য হয়, এসব সার্ভিস কমিশনগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে পেছনের দরজা দিয়ে চড়া দামে চাকরি প্রার্থীদের পাইয়ে দেওয়া যায় চাকরি। প্রাথমিকের কেরানি থেকে কার্যত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রত্যেকটি পদে চাকরির জন্যেই মূখ্য মন্ত্রীর অনুপ্রেরণাতে চলা তার দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা এখন বিভিন্ন ধরনের ‘রেট’ ঠিক করে দিয়েছে। সেই ‘রেট’ যেই-ই পূর্ণ করতে পারবে, তা সে সিপিআই (এম), বিজেপি, আরএসপি, তৃণমূল- কোনোটাই দেখবার দরকার নেই শাসক শিবিরের, সেই লোকটির চাকরি পাকা। এই গোটা পদ্ধতিটাই এখন সিবিআই, ইডির তদন্ত এবং হাইকোর্টের অত্যন্ত সদর্থচ ভূমিকাতে এখন প্রায় সবস্তরের নাগলিকই বুঝতে পারছেন।
মমতা ক্ষমতায় আসবার পর সরকারি স্তরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কটা চাকরি স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়েছে, সেটাই এখন দেখবার বিষয়। প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকরির ক্ষেত্রে মমতার শিক্ষামন্ত্রীসহ একাধিক শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক, বিভিন্ন স্তরের তৃণমূলের নেতারা এখন জেলে রয়েছে। সরকারের একদা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেলে রয়েছে প্রায় বছরখানেক হতে চললো। সব পথকে আশ্চর্যের বিষয় একজন বিধায়ক দুর্নীতির দায়ে, আর্থিক তছরূপের কারনে প্রায় বছরখানেক জেলে থাকলেও তার বিধায়ক পদ নিয়ে বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করে চলেছেন। পার্থ যে অঞ্চলের বিধায়ক, সেখানকার নাগরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে বিধায়কের পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। সরকারি, বেসরকারি বহু পরিষেবার ক্ষেত্রেই বিধায়কের প্রশংসাপত্র অত্যন্ত জরুরি। বিরোধী সিপিআই (এম) এই নাগরিক পরিষেবার বিষয়টি ঘিরে যথেষ্ট আন্দোলন করছে। প্রতীকী গণভোটের ও আয়োজন তারা করেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আন্দোলন লগ্নে আমার জন্ম- বলে শীবাকীর্তন গাওয়া সরকার প্রধান, তার দীর্ঘ বারো বছরের শাসনকালে চিটফান্ড থেকে শুরু করে, বাম ছাত্র কর্মী সুদীপ্ত গুপ্তের পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, নবান্ন অভিযানে, পুলিশের মারে, বাম যুবকর্মী মইদুলের মৃত্যুসহ প্রতিটি বিষয়কে চরম উপেক্ষা করে চলেছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নির্বাচনী এলাকার নাগরিকদের বিধায়ক পরিষেবা না পাওয়া জনিত সমস্যা ঘিরে আজ পর্যন্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি। অথচ প্রগলভতায় ভারতীয় রাজনীতিতে মমতার সঙ্গে একমাত্র তুলনা করা চলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।
যে মমতা বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন কথায় কথায় সিবিআই তদন্ত দাবি করতেন, সেই মমতাই ক্ষমতায় আসবার পর থেকে সিবিআইয়ের নাম শুনলে কার্যত তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন সিআইডি এবং নিজের বশংবদ অফিসারদের নিয়ে তিনি যে ‘সিট’ তৈরি করে দেন, তার বাইরে আর অন্য কোনো রকমের তদন্তে তার আস্থা নেই। এটা বলার কোনো দরকার পড়ে না যে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন সিআইডি বা সিটের তদন্ত যে কি, তা সাধারণ মানুষ চিটফান্ড সারদার কোটি কোটি টাকা তার দলের কেষ্টবিষ্টুদের আত্মসাৎ ঘিরে যে তদন্ত, সেই সময়ে দেখেছে। এই সারদা চিট ফান্ড ঘিরে তিনি যেভাবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামল সেনকে যুক্ত করেছিলেন, সেই ক্ষেত্রে শ্যামল সেন যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেটি শ্যামল সেনের গৌরবময় অতীত তো দূরের কথা গোটা বিচারপতিদের সুনামের প্রতি আদৌ কোনো সুবিচার করেননি।
নিয়োগ দুর্নীতিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছের লোক এবং দলের একটা বড় অংশের ভূমিকা ঘিরে কলকাতা হাইকোর্টে একাধিক মামলা চলছে। সেইসব মামলাগুলো আটকাটে সাধারণ মানুষের করের টাকা দিয়েই কেবল হাইকোর্ট নয়, সুপ্রিম কোর্টেও মামলা চালাচ্ছে রাজ্য সরকার। ভারতের জাঁদরেল সব উকিল, যাদের একবার আদালতে দাঁড়াবার সাম্মানিকই বেশ কয়েক লক্ষ টাকা, তেমন উকিল নিয়োগ করে সাময়িক স্বস্তি রাজ্য সরকারের মিললেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে এখন মমতার দলের বিষোদগার সর্বজনবিদিত। অভিজিৎ বাবু কেবল তৃণমূলের লোকজনেদেরই নয়, খোদ মমতা এবং মমতা যাকে নিজের উত্তরসূরি বলে তুলে ধরতে চাইছেন, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাতের ঘুম কার্যত কেড়ে নিয়েছেন। অভিজিৎ বাবু আদালতে বসা মানেই এখন কার্যত খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেকের হার্টরেট বেড়ে যাওয়া। তাই অভিজিৎ বাবুকে ঠেকাতে মমতা তার বশংবদদের দিয়ে কত ধরনের যে কৌশলের পথ ধরছেন তার ইয়ত্তা নেই।
আনন্দবাজার গোষ্ঠীর একটি বৈদ্যুতিক চ্যানেলে অভিজিৎ বাবুর যে সাক্ষৎকার প্রচারিত হয়েছে, সেটি মমতা এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেককে কিছুটা স্বস্তি দিতে একটা বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কিনা- এটা এখন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষদের কাছে একটা বড় রকমের চর্চার বিষয়। যে বিষয়টি তার কাছেই বিচারাধীন, সেই বিষয়ে হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতিকে ক্যামেরার সামনে প্রশ্ন করবার নজির সাংবাদিকতার ইতিহাসে আছে কিনা তা গবেষকেরাই বলতে পারবেন; কিন্তু বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণের তীর যে মমতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেকের দিকে, তৃণমূলেরই যুব নেতা কুন্তল ঘোষের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পৌঁছেছিল, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। আর সে জন্যই কি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে আইনের চোখে, জনসমক্ষে অপদস্ত করতে আনন্দবাজারের বৈদ্যুতিক চ্যানেল ওই পথে হেঁটেছে?- এই প্রশ্নটা যে পশ্চিমবঙ্গে এখন মমতার বিরোধী শিবিরের কাছেই বড় হয়ে দেখ দিয়েছে তা নয়, খোদ মমতার দলেরই একটা বড় অংশ, যারা মমতাকে ক্ষমতায় আনতে একটা সময়ে বহু পরিশ্রম করেও এই অভিষেক কে নেতা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার পর প্রচন্ডভাবে ক্রমান্বয়ে অপমানিত হয়ে চলেছেন, প্রশ্নটা তাদের ভিতরেও জোরদারভাবে উঠতে শুরু করেছে।
তদন্তের প্রয়োজনে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিষেককে জেরা করা বিষয়ে ইতিবাচক মানসিকতার বিরুদ্ধে শাসক তৃণমূলের সর্বস্তরে যে প্রতিক্রিয়া, তাতে যেন সর্বজনবিদিত বাংলা প্রবাদ, ঠাকুরঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি- এটাই সাধারণ মানুষের ভিতরে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। অভিষেক যদি যথার্থই কোনোরকম আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত না হয়ে থাকেন, তাহলে বিচারক তদন্তের স্বার্থে অভিষেককে জেরার বিষয়টি তুলতেই কেন তৃণমূল আর তাদের বশংবদ সংবাদমাধ্যমখুলি এইভাবে ‘গেল গেল’ রব তুলবে? কাউকে জেরা করা মানেই তো আর তাকে ‘অপরাধী’ বলে ধরে নেওয়া নয়। মমতা ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগীয় কমিশনের সামনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পর্যন্ত হাজির করিয়েছিলেন। বুদ্ধবাবু তো একটা দিনের জন্যও তদন্ত কমিশনকে এড়িয়ে যাননি। মজার কথা হলো- মমতার বুদ্ধবাবুকে অপদস্ত করবার, হেনস্তা করবার চেষ্টাটা এতটাই কাঁচা দাগের ছিল যে, মমতার রাজনৈতিক বিদ্বেষ বুঝতে একটি ছোট শিশুর ও অসুবিধা হয়নি।
অভিষেকের বিরুদ্ধে বিচারপতি অভিজিৎ বাবু রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক আচরণ করছেন, এটা যদি মমতা-অভিষেক থেকে শুরু করে তৃণমূলের প্রায় সব স্তরেরই নেতাকর্মীরা মনে করে থাকেন, তবে সোজাসুজি জেরার মুখোমুখি হয়ে তদন্তের গতিপথকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে অভিষেকের ভয় কোথায়? মমতার সঙ্কোচ কোথায়? একজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসাতে চাইছেন একজন কর্মরত বিচারপতি, এটা যদি জেরার মুখোমুখি হয়ে অভিষেক প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে তো আখেরে রাজনৈতিকভাবে যে ডিবিডেন্টটা অভিষেক ঘরে তুলবেন, সেই মানের ডিবিডেন্ট তো শত চেষ্টা করেও তার আত্মীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেকের রাজনৈতিক অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারবেন না। তাহলে কেন এই দ্বিধা অভিষেকের? কেনই বা জেরা আটকাটে এই আদালত থেকে আরেক আদালতে ছোটাছুটি? কেনই বা আনন্দবাজারের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকা?
নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে সিপিআইয়ের (এম) আন্দোলন যে পর্যায়ে গিয়েছে তেমন আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে মমতা ক্ষমতায় আসবার পর ওই দল আগে কখনো দেখাতে সক্ষম হয়নি। চিটফান্ড ইস্যুতে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় শাসক তৃণমূলের একটা বড় অংশ জড়িয়ে থাকার অভিযোগের পরেও সিপিআই (এম) সেই সময়ে মমতার দলের ভয়াবহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সেভাবে দানা বাঁধতেই পারেনি; কিন্তু বর্তমান সময়ে এই নিয়োগ দুর্নীতিকে ঘিরে সিপিআইয়ের (এম) আন্দোলন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা যে আদালতকেও একটা দৃঢ় অবস্থানে পৌঁছতে অনেকখানি সাহায্য করেছে- সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
তৃণমূলের লোকদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যে হাজার হাজার অযোগ্য লোক চাকরি পেয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে- আদালতের নির্দেশে তারা চাকরিচ্যুত হয়েছে। নিজের দলের লোকেরা মোটা টাকা ঘুষ নিয়ে (বিরোধীদের অভিযোগ, সেই ঘুষের সিংহভাগ সরাসরি গিয়েছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে) যেসব হাজার হাজার অযোগ্য লোকেদের চাকরি পাইয়ে দিয়েছিল, তাদের আদালতের নির্দেশে চাকরিচ্যুত হওয়ার ঘটনাকে খোদ মমতা, সরকারি চাকুরেদের প্রাপ্য মহার্য ভাতার জন্য আন্দোলনের জের বলে আবারো একটা বড় রকমের বিভ্রান্তি তৈরি করতে চাইছেন। নিজের দলের লোকদের ঘুষ দিয়ে যেসব অযোগ্য লোকেরা চাকরি ম্যানেজ করেছিল, আদালতের নির্দেশে সেই সব অযোগ্যদের চাকরি চলে যাওয়ার ক্ষোভটা যাতে তার নিজের ওপরে না বর্তায় সেই রাজনৈতিক কৌশলেই ডিএ আন্দোলনকারীদের দিকে বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে একটা চরম রাজনৈতিক ছলনা করতে চাইছেন মমতা।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শুক্রবার, ১৯ মে ২০২৩
নিয়োগ দুর্নীতি তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসবার পর থেকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে, যা নিয়ে এখন প্রতিবাদে লেখা কোনো শব্দই বুঝি বা আর যথেষ্ট নয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন তৃণমূলের জামানাতে যে কোনো স্তরেই সরকারি চাকরি যারা পেয়েছেন, তাদের ভিতর একটা বড় অংশ আদালতের নির্দেশে চাকরি হারিয়েছেন বা হারাতে চলেছেন। আর একটা বড় অংশ এখন প্রবল অনিশ্চয়তার ভিতরে দিন কাটাচ্ছেন। প্রত্যেকেরই আশঙ্কা কবে বা যায় সরকারি চাকরি। পরিস্থিতি এখন পশ্চিমবঙ্গে এমনই দাঁড়িয়েছে যে, যারা নিজেদের যোগ্যতায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন, সেই সব মানুষদেরও এখন সাধারণের সন্দেহের দৃষ্টির এক কদর্যতার ভিতর দিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এমনই এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ভিতরে মমতা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষকে এনে ফেলেছেন।
নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে বামফ্রন্ট সরকার, তাদের শাসনকালের মধ্যবর্তী সময়ে স্কুল, কলেজে সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেন। তার আগে স্কুল, কলেজের পরিচালন সমিতির মাধ্যমে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল, সেই প্রক্রিয়া তে স্বচ্ছতার অভাবের বিষয়টি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার বা তাদের প্রধান পরিচালক সিপিআই (এম) সময়ের নিরিখে অনুভব করেছিল। সেই অনুভূতির জেরেই তারা সার্ভিস কমিশন তৈরি করে। প্রাথমিক শিক্ষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও সময়ের নিরিখে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করে বাস্তুঘুঘুদের বাসা ভেঙেছিল বামফ্রন্ট সরকারই।
বর্তমান সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসবার সঙ্গে সঙ্গেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য হয়, এসব সার্ভিস কমিশনগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে পেছনের দরজা দিয়ে চড়া দামে চাকরি প্রার্থীদের পাইয়ে দেওয়া যায় চাকরি। প্রাথমিকের কেরানি থেকে কার্যত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রত্যেকটি পদে চাকরির জন্যেই মূখ্য মন্ত্রীর অনুপ্রেরণাতে চলা তার দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা এখন বিভিন্ন ধরনের ‘রেট’ ঠিক করে দিয়েছে। সেই ‘রেট’ যেই-ই পূর্ণ করতে পারবে, তা সে সিপিআই (এম), বিজেপি, আরএসপি, তৃণমূল- কোনোটাই দেখবার দরকার নেই শাসক শিবিরের, সেই লোকটির চাকরি পাকা। এই গোটা পদ্ধতিটাই এখন সিবিআই, ইডির তদন্ত এবং হাইকোর্টের অত্যন্ত সদর্থচ ভূমিকাতে এখন প্রায় সবস্তরের নাগলিকই বুঝতে পারছেন।
মমতা ক্ষমতায় আসবার পর সরকারি স্তরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কটা চাকরি স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়েছে, সেটাই এখন দেখবার বিষয়। প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকরির ক্ষেত্রে মমতার শিক্ষামন্ত্রীসহ একাধিক শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক, বিভিন্ন স্তরের তৃণমূলের নেতারা এখন জেলে রয়েছে। সরকারের একদা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেলে রয়েছে প্রায় বছরখানেক হতে চললো। সব পথকে আশ্চর্যের বিষয় একজন বিধায়ক দুর্নীতির দায়ে, আর্থিক তছরূপের কারনে প্রায় বছরখানেক জেলে থাকলেও তার বিধায়ক পদ নিয়ে বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করে চলেছেন। পার্থ যে অঞ্চলের বিধায়ক, সেখানকার নাগরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে বিধায়কের পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। সরকারি, বেসরকারি বহু পরিষেবার ক্ষেত্রেই বিধায়কের প্রশংসাপত্র অত্যন্ত জরুরি। বিরোধী সিপিআই (এম) এই নাগরিক পরিষেবার বিষয়টি ঘিরে যথেষ্ট আন্দোলন করছে। প্রতীকী গণভোটের ও আয়োজন তারা করেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আন্দোলন লগ্নে আমার জন্ম- বলে শীবাকীর্তন গাওয়া সরকার প্রধান, তার দীর্ঘ বারো বছরের শাসনকালে চিটফান্ড থেকে শুরু করে, বাম ছাত্র কর্মী সুদীপ্ত গুপ্তের পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, নবান্ন অভিযানে, পুলিশের মারে, বাম যুবকর্মী মইদুলের মৃত্যুসহ প্রতিটি বিষয়কে চরম উপেক্ষা করে চলেছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নির্বাচনী এলাকার নাগরিকদের বিধায়ক পরিষেবা না পাওয়া জনিত সমস্যা ঘিরে আজ পর্যন্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি। অথচ প্রগলভতায় ভারতীয় রাজনীতিতে মমতার সঙ্গে একমাত্র তুলনা করা চলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।
যে মমতা বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন কথায় কথায় সিবিআই তদন্ত দাবি করতেন, সেই মমতাই ক্ষমতায় আসবার পর থেকে সিবিআইয়ের নাম শুনলে কার্যত তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন সিআইডি এবং নিজের বশংবদ অফিসারদের নিয়ে তিনি যে ‘সিট’ তৈরি করে দেন, তার বাইরে আর অন্য কোনো রকমের তদন্তে তার আস্থা নেই। এটা বলার কোনো দরকার পড়ে না যে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন সিআইডি বা সিটের তদন্ত যে কি, তা সাধারণ মানুষ চিটফান্ড সারদার কোটি কোটি টাকা তার দলের কেষ্টবিষ্টুদের আত্মসাৎ ঘিরে যে তদন্ত, সেই সময়ে দেখেছে। এই সারদা চিট ফান্ড ঘিরে তিনি যেভাবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামল সেনকে যুক্ত করেছিলেন, সেই ক্ষেত্রে শ্যামল সেন যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেটি শ্যামল সেনের গৌরবময় অতীত তো দূরের কথা গোটা বিচারপতিদের সুনামের প্রতি আদৌ কোনো সুবিচার করেননি।
নিয়োগ দুর্নীতিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছের লোক এবং দলের একটা বড় অংশের ভূমিকা ঘিরে কলকাতা হাইকোর্টে একাধিক মামলা চলছে। সেইসব মামলাগুলো আটকাটে সাধারণ মানুষের করের টাকা দিয়েই কেবল হাইকোর্ট নয়, সুপ্রিম কোর্টেও মামলা চালাচ্ছে রাজ্য সরকার। ভারতের জাঁদরেল সব উকিল, যাদের একবার আদালতে দাঁড়াবার সাম্মানিকই বেশ কয়েক লক্ষ টাকা, তেমন উকিল নিয়োগ করে সাময়িক স্বস্তি রাজ্য সরকারের মিললেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে এখন মমতার দলের বিষোদগার সর্বজনবিদিত। অভিজিৎ বাবু কেবল তৃণমূলের লোকজনেদেরই নয়, খোদ মমতা এবং মমতা যাকে নিজের উত্তরসূরি বলে তুলে ধরতে চাইছেন, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাতের ঘুম কার্যত কেড়ে নিয়েছেন। অভিজিৎ বাবু আদালতে বসা মানেই এখন কার্যত খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেকের হার্টরেট বেড়ে যাওয়া। তাই অভিজিৎ বাবুকে ঠেকাতে মমতা তার বশংবদদের দিয়ে কত ধরনের যে কৌশলের পথ ধরছেন তার ইয়ত্তা নেই।
আনন্দবাজার গোষ্ঠীর একটি বৈদ্যুতিক চ্যানেলে অভিজিৎ বাবুর যে সাক্ষৎকার প্রচারিত হয়েছে, সেটি মমতা এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেককে কিছুটা স্বস্তি দিতে একটা বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কিনা- এটা এখন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষদের কাছে একটা বড় রকমের চর্চার বিষয়। যে বিষয়টি তার কাছেই বিচারাধীন, সেই বিষয়ে হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতিকে ক্যামেরার সামনে প্রশ্ন করবার নজির সাংবাদিকতার ইতিহাসে আছে কিনা তা গবেষকেরাই বলতে পারবেন; কিন্তু বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণের তীর যে মমতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেকের দিকে, তৃণমূলেরই যুব নেতা কুন্তল ঘোষের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পৌঁছেছিল, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। আর সে জন্যই কি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে আইনের চোখে, জনসমক্ষে অপদস্ত করতে আনন্দবাজারের বৈদ্যুতিক চ্যানেল ওই পথে হেঁটেছে?- এই প্রশ্নটা যে পশ্চিমবঙ্গে এখন মমতার বিরোধী শিবিরের কাছেই বড় হয়ে দেখ দিয়েছে তা নয়, খোদ মমতার দলেরই একটা বড় অংশ, যারা মমতাকে ক্ষমতায় আনতে একটা সময়ে বহু পরিশ্রম করেও এই অভিষেক কে নেতা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার পর প্রচন্ডভাবে ক্রমান্বয়ে অপমানিত হয়ে চলেছেন, প্রশ্নটা তাদের ভিতরেও জোরদারভাবে উঠতে শুরু করেছে।
তদন্তের প্রয়োজনে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিষেককে জেরা করা বিষয়ে ইতিবাচক মানসিকতার বিরুদ্ধে শাসক তৃণমূলের সর্বস্তরে যে প্রতিক্রিয়া, তাতে যেন সর্বজনবিদিত বাংলা প্রবাদ, ঠাকুরঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি- এটাই সাধারণ মানুষের ভিতরে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। অভিষেক যদি যথার্থই কোনোরকম আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত না হয়ে থাকেন, তাহলে বিচারক তদন্তের স্বার্থে অভিষেককে জেরার বিষয়টি তুলতেই কেন তৃণমূল আর তাদের বশংবদ সংবাদমাধ্যমখুলি এইভাবে ‘গেল গেল’ রব তুলবে? কাউকে জেরা করা মানেই তো আর তাকে ‘অপরাধী’ বলে ধরে নেওয়া নয়। মমতা ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগীয় কমিশনের সামনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পর্যন্ত হাজির করিয়েছিলেন। বুদ্ধবাবু তো একটা দিনের জন্যও তদন্ত কমিশনকে এড়িয়ে যাননি। মজার কথা হলো- মমতার বুদ্ধবাবুকে অপদস্ত করবার, হেনস্তা করবার চেষ্টাটা এতটাই কাঁচা দাগের ছিল যে, মমতার রাজনৈতিক বিদ্বেষ বুঝতে একটি ছোট শিশুর ও অসুবিধা হয়নি।
অভিষেকের বিরুদ্ধে বিচারপতি অভিজিৎ বাবু রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক আচরণ করছেন, এটা যদি মমতা-অভিষেক থেকে শুরু করে তৃণমূলের প্রায় সব স্তরেরই নেতাকর্মীরা মনে করে থাকেন, তবে সোজাসুজি জেরার মুখোমুখি হয়ে তদন্তের গতিপথকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে অভিষেকের ভয় কোথায়? মমতার সঙ্কোচ কোথায়? একজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসাতে চাইছেন একজন কর্মরত বিচারপতি, এটা যদি জেরার মুখোমুখি হয়ে অভিষেক প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে তো আখেরে রাজনৈতিকভাবে যে ডিবিডেন্টটা অভিষেক ঘরে তুলবেন, সেই মানের ডিবিডেন্ট তো শত চেষ্টা করেও তার আত্মীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেকের রাজনৈতিক অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারবেন না। তাহলে কেন এই দ্বিধা অভিষেকের? কেনই বা জেরা আটকাটে এই আদালত থেকে আরেক আদালতে ছোটাছুটি? কেনই বা আনন্দবাজারের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকা?
নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে সিপিআইয়ের (এম) আন্দোলন যে পর্যায়ে গিয়েছে তেমন আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে মমতা ক্ষমতায় আসবার পর ওই দল আগে কখনো দেখাতে সক্ষম হয়নি। চিটফান্ড ইস্যুতে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় শাসক তৃণমূলের একটা বড় অংশ জড়িয়ে থাকার অভিযোগের পরেও সিপিআই (এম) সেই সময়ে মমতার দলের ভয়াবহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সেভাবে দানা বাঁধতেই পারেনি; কিন্তু বর্তমান সময়ে এই নিয়োগ দুর্নীতিকে ঘিরে সিপিআইয়ের (এম) আন্দোলন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা যে আদালতকেও একটা দৃঢ় অবস্থানে পৌঁছতে অনেকখানি সাহায্য করেছে- সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
তৃণমূলের লোকদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যে হাজার হাজার অযোগ্য লোক চাকরি পেয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে- আদালতের নির্দেশে তারা চাকরিচ্যুত হয়েছে। নিজের দলের লোকেরা মোটা টাকা ঘুষ নিয়ে (বিরোধীদের অভিযোগ, সেই ঘুষের সিংহভাগ সরাসরি গিয়েছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে) যেসব হাজার হাজার অযোগ্য লোকেদের চাকরি পাইয়ে দিয়েছিল, তাদের আদালতের নির্দেশে চাকরিচ্যুত হওয়ার ঘটনাকে খোদ মমতা, সরকারি চাকুরেদের প্রাপ্য মহার্য ভাতার জন্য আন্দোলনের জের বলে আবারো একটা বড় রকমের বিভ্রান্তি তৈরি করতে চাইছেন। নিজের দলের লোকদের ঘুষ দিয়ে যেসব অযোগ্য লোকেরা চাকরি ম্যানেজ করেছিল, আদালতের নির্দেশে সেই সব অযোগ্যদের চাকরি চলে যাওয়ার ক্ষোভটা যাতে তার নিজের ওপরে না বর্তায় সেই রাজনৈতিক কৌশলেই ডিএ আন্দোলনকারীদের দিকে বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে একটা চরম রাজনৈতিক ছলনা করতে চাইছেন মমতা।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]