alt

উপ-সম্পাদকীয়

লালনের গান ও ধর্মীয় অনুভূতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২৫ মে ২০২৪

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ফেইসবুকে লালন সাঁইয়ের একটি গানের দুটি চরণ লিখে পোস্ট করার ঘটনায় কিছু মুসলিমের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, আঘাত লাগার অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে করিৎকর্মা পুলিশ তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে। ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’- এই গানটি শোনেনি এমন কোন বাঙালি আছে বলে মনে হয় না। এই গানেরই দুটি চরণ হচ্ছে, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী লোকের কি হয় বিধান।’

এই দুটি চরণের মর্ম কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘সুন্নতে খাতনা দিলে যদি হয় মুসলমান, তাহলে নারী জাতির কি হয় বিধান’। মুচলেকা দিয়ে আদালত থেকে ছাড়া পেলেও তার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ না হলে তার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পুলিশ মোতায়েন করা হতো না। পুলিশ মোতায়েন করায় পোস্টদাতার জীবন ও সম্পদ ঝুঁকিমুক্ত, না ঝুঁকিযুক্ত তা পরে জানা যাবে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি জনরোষে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

পাকিস্তানে একবার কারো বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অভিযোগ উঠলে সেই ব্যক্তি জেলখানা ও বাইরে কোথাও নিরাপদ থাকে না। পাকিস্তানের ধর্মান্ধরা বিচারের অপেক্ষা করে না, বিচারের আগেই অভিযুক্তকে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলে এবং এমন ঘটনা পাকিস্তানে অহরহ ঘটছে। জেলখানায় সাধারণ লোকের অনুপ্রবেশের সুযোগ না থাকায় জেলখানার পুলিশ প্রহরীই অভিযুক্তকে হত্যা করে ফেলে। জেলখানায় কোনভাবে বেঁচে গেলেও কেউ জামিন নিয়ে বাইরে আসে না, বাইরে এলে কী হবে তা সবাই জানে। এমনকি বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও উন্মত্ত জনতা বহু অভিযুক্তকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সরকার এমন উন্মত্ত জনতা থেকে বেকসুর খালাস পাওয়া ব্যক্তিকে বাঁচাতে অনেক সময় ছলচাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে, জেলখানা থেকে সরাসরি বিমানে তুলে দিয়ে ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়। এতে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায় ইসলামপন্থী দলগুলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছে এই মর্মে দাবি তুলেছিল যে, আদালতে বেকসুর খালাস পাওয়া কোন ব্যক্তিকে ভিন দেশে পাঠানো যাবে না।

মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে কথা বলে মালালা ইউসুফ জাঁই গুলি খেল। ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারের পক্ষে কথা বলায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসিরকে হত্যা করেছে তারই দেহরক্ষী মালিক মুমতাজ হুসাইন কাদরি। এই কাদরির গলায় মালা দেয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষের লম্বা মিছিলও হয়েছে।

পাকিস্তানি ভূত বাংলাদেশের ওপর ভর করেছে, এখন আমরা পাকিস্তানের চেয়েও বেশি স্পর্শকাতর, সামান্যতেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। অনুভূতিতে আঘাত লাগলে আমরাও এখন আর মুখে মুখে প্রতিবাদ করি না, লিখে প্রতিকার চাই না, প্রতিঘাত করার জন্য সবাই হয়ে যাই এক এক জন ‘মালিক মুমতাজ হুসাইন কাদরি’।

রাজনৈতিক ফায়দা লোটার লক্ষ্যে ধর্মীয় অনুভূতির পারদ ওঠানামা করানো হয় বলে ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোর বদনাম রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে ধর্মের অতিরিক্ত ব্যবহারে বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের ইমেজ ভালো নয়। একসময় বাংলাদেশের কেউ পাকিস্তান যেত না, কারণ পাসপোর্টে পাকিস্তানের ভিসা থাকলে ইউরোপ, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের ভিসা পাওয়া যেত না, পাকিস্তান গেলেই ভাবত জঙ্গি কানেকশন রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থাও অচিরে তেমন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখনো বাংলাদেশের কারো নামের সঙ্গে ‘মুহাম্মদ’, ‘আহমদ’, ‘ইসলাম’ থাকলে ভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দশবার চেহারা পর্যবেক্ষণ করে থাকে।

লালন ফকিরের ধর্ম নিয়ে কম টানাটানি হয়নি, এখনো হচ্ছে। তাকে কেউ বলে মুসলমান, আবার কেউ বলে হিন্দু। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী লালন ফকিরকে মুসলমান অভিধায় অভিষিক্ত করে আনন্দ লাভ করছেন। লালন কিন্তু কখনো নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান রূপে পরিচয় দেননি। তিনি হচ্ছেন জাত-বর্ণ-ধর্ম বহির্ভূত মানবতা বন্দনার বাউল।

কাজী নজরুল ইসলামকেও মাঝে মাঝে মুসলমান কবি-লেখক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়; তার রচিত শ্যামা সংগীতের কথা তখন অনুচ্চারিত থাকে। কিন্তু মুসলমানরাই তাকে ‘কাফের’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল, আর ‘কাফের’ উপাধি ঘোচাতেই তাকে রচনা করতে হয়েছিল অজস্র ইসলামিক গান ও কবিতা। তারপরও ১৯২৬ সালে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনে ঢাকা বিভাগ থেকে প্রার্থী হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম জামানত হারিয়েছিলেন। কে না জানে, কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মান্তর না করেই হিন্দু মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে আমৃত্যু সংসার করেছেন। লালন ফকির ও নজরুল মানবধর্মকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন।

লালন ফকিরকে মুসলমান বানানো যায়নি বলেই ইদানীং তার আধ্যাত্মিক গানগুলোর মধ্যে যৌনতার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। লালনের যে গানের খৎনার কথা লিখে একজন হিন্দু অভিযুক্ত হয়েছেন সেই গানের কথা কিন্তু ঠিক নয়, কারণ মেয়েদেরও খৎনা হয়। পুরুষের যেমন সবার খৎনা হয় না, মেয়েদেরও তেমনি সবার খৎনা হয় না। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানদের নবী ইব্রাহীম (আ.) ৮০ বছর বয়সে তার নিজের হাতেই নিজের খৎনা করেন। ইসলাম ধর্মের আগেও বেশির ভাগ পৌত্তলিক পুরুষের এবং কিছু কিছু মেয়ের খৎনা করা হতো; অন্যদিকে ইহুদী পুরুষদের খৎনা ধর্মীয় কারণেই হতো।

জন্মের অষ্টম দিনে প্রত্যেক ইহুদি ছেলের খৎনা হতো বিধায় যিশুরও খৎনা হয়েছিল; কিন্তু তার অনুসারীরা পরে খৎনা পরিত্যাগ করেছে। মুসলমানদের খৎনা হয় ধর্মীয় নির্দেশে এবং সেই নির্দেশ এসেছে হাদিস থেকে। কোরআনে খৎনার কথা নেই, থাকার কথাও নয়; কারণ কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রেষ্ঠতম-সুন্দর আকৃতিতে’। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন নিখুঁতভাবে, কোন ক্রুটি নেই, ক্রুটি না থাকায় শরীরের কোথাও অপ্রয়োজনীয় অংশও থাকার কথা নয়।

কিন্তু হাদিস বলছে, খৎনা ‘পুরুষদের জন্য আইন এবং মহিলাদের জন্য সম্মান রক্ষা।’ মহিলাদের খৎনা নিয়ে ইমাম এবং আলেমদের মধ্যে রয়েছে মতভেদ। শাফিঈ ও হাম্বলি আইনবিদদের মতে মুসলিম পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য খৎনা বাধ্যতামূলক। হানাফি মাজহাবের মেয়েরা বেঁচে গেছে, তাদের জন্য খৎনা বাধ্যতামূলক নয়। আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ২৯টি দেশে মেয়েদের খৎনা করা হলেও এদের মধ্যে ২৪টি দেশেই মেয়েদের খৎনা নিষিদ্ধ। ধর্মে থাকা সত্ত্বেও কেন মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে মেয়েদের খৎনা নিষিদ্ধ তা বোধগম্য নয়। তবে কয়েকটি মুসলিম দেশে মেয়েদের খৎনা হয় ব্যাপকভাবে; ৯০ শতাংশ মিশরীয় নারী খৎনার শিকার। সিয়েরা লিওনেও দেদারছে মেয়েদের খৎনা হচ্ছে। মেয়েদের খৎনা হচ্ছে সুদান, সোমালিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশীয়া, ইথিওপিয়ায়।

অত্যন্ত অমানবিক এই প্রথাটি সভ্য পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হলেও অনেক দেশে এটি ধর্মীয় চর্”া হিসেবে পালন করা হয়। জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে প্রতি ২০ জন মেয়ে শিশু বা নারীর মধ্যে ১ জনের খৎনা করা হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে নাকি এই সময়ে বিশ কোটি নারীর খৎনা রয়েছে অর্থাৎ যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। ধর্মের নিক্তিতে বিচার করলে লালনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঠিক তদরূপ কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত পড়ে বা শুনেও যে কারোরই মনে হতে পারে যে তিনি একজন কালি অন্তপ্রাণ হিন্দু। অখ- মানবসমাজ গঙে তোলার মহান ব্রত নিয়ে তারা দুইজন অসংখ্য গান লিখেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা উভয়ে ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি ভেদাভেদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু প্রচার করেছেন। তার গানের ভক্ত অগণিত মানুষ।

লালন ফকিরের যে গানের দুটি চরণ পোস্ট করে সঞ্জয় রক্ষিত গ্রেপ্তার হয়েছেন সেই গানটি রেডিও, টিভি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অজস্রবার শুনেছি, কিন্তু কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে ইতোপূর্বে শোনা যায়নি। শতাধিক বছরের সুপ্ত অনুভূতির জাগরণ হয়েছে শুধু একজন হিন্দুর লেখায় চরণ দুটি ওঠে আসায়। সমাজের কিছু লোকের ধর্মে মন না থাকলেও ধর্মানুভূতি তীব্র; এদের সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘যাহারা গু-া, ভ- তারাই ধর্মের আবরণে স্বার্থের লোভে ক্ষেপাইয়া তোলে অজ্ঞান জনগণে!’ এরা রাষ্ট্রের প্রশ্রয় পায় বলেই জাতির জন্য তা চরম দুর্ভাগ্য।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি]

সড়কে কিশোর মোটরবাইকার : নিয়ন্ত্রণ জরুরি

মব জাস্টিস আইনের শাসনের পরিপন্থি

ছবি

গভীর সংকট আর বড় সম্ভাবনা পাশাপাশি হাঁটছে

জ্ঞানদায়িনী মা সরস্বতী দেবী

‘সংখ্যাস্বল্প’ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কেন প্রয়োজন?

সব ক্ষেত্রে বাংলাকে প্রাধান্য দিন

গুজব : মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

অন্তর্বর্তী সরকার: নাগরিকদের প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?

পাঠ্যবই সংকটে থমকে গেছে শিক্ষার চাকা

আরজি কর : শাসক রোষে ভিকটিমের পরিবার

চাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

শুল্ক বনাম উদ্ভাবন যুদ্ধ

রম্যগদ্য : “ডক্টর.জ্বী-ভাগো...”

বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ছবি

যোগেন ম-লের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

লালনের গান ও ধর্মীয় অনুভূতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ২৫ মে ২০২৪

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ফেইসবুকে লালন সাঁইয়ের একটি গানের দুটি চরণ লিখে পোস্ট করার ঘটনায় কিছু মুসলিমের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, আঘাত লাগার অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে করিৎকর্মা পুলিশ তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে। ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’- এই গানটি শোনেনি এমন কোন বাঙালি আছে বলে মনে হয় না। এই গানেরই দুটি চরণ হচ্ছে, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী লোকের কি হয় বিধান।’

এই দুটি চরণের মর্ম কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘সুন্নতে খাতনা দিলে যদি হয় মুসলমান, তাহলে নারী জাতির কি হয় বিধান’। মুচলেকা দিয়ে আদালত থেকে ছাড়া পেলেও তার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ না হলে তার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পুলিশ মোতায়েন করা হতো না। পুলিশ মোতায়েন করায় পোস্টদাতার জীবন ও সম্পদ ঝুঁকিমুক্ত, না ঝুঁকিযুক্ত তা পরে জানা যাবে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি জনরোষে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

পাকিস্তানে একবার কারো বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অভিযোগ উঠলে সেই ব্যক্তি জেলখানা ও বাইরে কোথাও নিরাপদ থাকে না। পাকিস্তানের ধর্মান্ধরা বিচারের অপেক্ষা করে না, বিচারের আগেই অভিযুক্তকে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলে এবং এমন ঘটনা পাকিস্তানে অহরহ ঘটছে। জেলখানায় সাধারণ লোকের অনুপ্রবেশের সুযোগ না থাকায় জেলখানার পুলিশ প্রহরীই অভিযুক্তকে হত্যা করে ফেলে। জেলখানায় কোনভাবে বেঁচে গেলেও কেউ জামিন নিয়ে বাইরে আসে না, বাইরে এলে কী হবে তা সবাই জানে। এমনকি বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও উন্মত্ত জনতা বহু অভিযুক্তকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সরকার এমন উন্মত্ত জনতা থেকে বেকসুর খালাস পাওয়া ব্যক্তিকে বাঁচাতে অনেক সময় ছলচাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে, জেলখানা থেকে সরাসরি বিমানে তুলে দিয়ে ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়। এতে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায় ইসলামপন্থী দলগুলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছে এই মর্মে দাবি তুলেছিল যে, আদালতে বেকসুর খালাস পাওয়া কোন ব্যক্তিকে ভিন দেশে পাঠানো যাবে না।

মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে কথা বলে মালালা ইউসুফ জাঁই গুলি খেল। ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারের পক্ষে কথা বলায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসিরকে হত্যা করেছে তারই দেহরক্ষী মালিক মুমতাজ হুসাইন কাদরি। এই কাদরির গলায় মালা দেয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষের লম্বা মিছিলও হয়েছে।

পাকিস্তানি ভূত বাংলাদেশের ওপর ভর করেছে, এখন আমরা পাকিস্তানের চেয়েও বেশি স্পর্শকাতর, সামান্যতেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। অনুভূতিতে আঘাত লাগলে আমরাও এখন আর মুখে মুখে প্রতিবাদ করি না, লিখে প্রতিকার চাই না, প্রতিঘাত করার জন্য সবাই হয়ে যাই এক এক জন ‘মালিক মুমতাজ হুসাইন কাদরি’।

রাজনৈতিক ফায়দা লোটার লক্ষ্যে ধর্মীয় অনুভূতির পারদ ওঠানামা করানো হয় বলে ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোর বদনাম রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে ধর্মের অতিরিক্ত ব্যবহারে বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের ইমেজ ভালো নয়। একসময় বাংলাদেশের কেউ পাকিস্তান যেত না, কারণ পাসপোর্টে পাকিস্তানের ভিসা থাকলে ইউরোপ, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের ভিসা পাওয়া যেত না, পাকিস্তান গেলেই ভাবত জঙ্গি কানেকশন রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থাও অচিরে তেমন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখনো বাংলাদেশের কারো নামের সঙ্গে ‘মুহাম্মদ’, ‘আহমদ’, ‘ইসলাম’ থাকলে ভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দশবার চেহারা পর্যবেক্ষণ করে থাকে।

লালন ফকিরের ধর্ম নিয়ে কম টানাটানি হয়নি, এখনো হচ্ছে। তাকে কেউ বলে মুসলমান, আবার কেউ বলে হিন্দু। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী লালন ফকিরকে মুসলমান অভিধায় অভিষিক্ত করে আনন্দ লাভ করছেন। লালন কিন্তু কখনো নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান রূপে পরিচয় দেননি। তিনি হচ্ছেন জাত-বর্ণ-ধর্ম বহির্ভূত মানবতা বন্দনার বাউল।

কাজী নজরুল ইসলামকেও মাঝে মাঝে মুসলমান কবি-লেখক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়; তার রচিত শ্যামা সংগীতের কথা তখন অনুচ্চারিত থাকে। কিন্তু মুসলমানরাই তাকে ‘কাফের’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল, আর ‘কাফের’ উপাধি ঘোচাতেই তাকে রচনা করতে হয়েছিল অজস্র ইসলামিক গান ও কবিতা। তারপরও ১৯২৬ সালে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনে ঢাকা বিভাগ থেকে প্রার্থী হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম জামানত হারিয়েছিলেন। কে না জানে, কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মান্তর না করেই হিন্দু মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে আমৃত্যু সংসার করেছেন। লালন ফকির ও নজরুল মানবধর্মকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন।

লালন ফকিরকে মুসলমান বানানো যায়নি বলেই ইদানীং তার আধ্যাত্মিক গানগুলোর মধ্যে যৌনতার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। লালনের যে গানের খৎনার কথা লিখে একজন হিন্দু অভিযুক্ত হয়েছেন সেই গানের কথা কিন্তু ঠিক নয়, কারণ মেয়েদেরও খৎনা হয়। পুরুষের যেমন সবার খৎনা হয় না, মেয়েদেরও তেমনি সবার খৎনা হয় না। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানদের নবী ইব্রাহীম (আ.) ৮০ বছর বয়সে তার নিজের হাতেই নিজের খৎনা করেন। ইসলাম ধর্মের আগেও বেশির ভাগ পৌত্তলিক পুরুষের এবং কিছু কিছু মেয়ের খৎনা করা হতো; অন্যদিকে ইহুদী পুরুষদের খৎনা ধর্মীয় কারণেই হতো।

জন্মের অষ্টম দিনে প্রত্যেক ইহুদি ছেলের খৎনা হতো বিধায় যিশুরও খৎনা হয়েছিল; কিন্তু তার অনুসারীরা পরে খৎনা পরিত্যাগ করেছে। মুসলমানদের খৎনা হয় ধর্মীয় নির্দেশে এবং সেই নির্দেশ এসেছে হাদিস থেকে। কোরআনে খৎনার কথা নেই, থাকার কথাও নয়; কারণ কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রেষ্ঠতম-সুন্দর আকৃতিতে’। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন নিখুঁতভাবে, কোন ক্রুটি নেই, ক্রুটি না থাকায় শরীরের কোথাও অপ্রয়োজনীয় অংশও থাকার কথা নয়।

কিন্তু হাদিস বলছে, খৎনা ‘পুরুষদের জন্য আইন এবং মহিলাদের জন্য সম্মান রক্ষা।’ মহিলাদের খৎনা নিয়ে ইমাম এবং আলেমদের মধ্যে রয়েছে মতভেদ। শাফিঈ ও হাম্বলি আইনবিদদের মতে মুসলিম পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য খৎনা বাধ্যতামূলক। হানাফি মাজহাবের মেয়েরা বেঁচে গেছে, তাদের জন্য খৎনা বাধ্যতামূলক নয়। আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ২৯টি দেশে মেয়েদের খৎনা করা হলেও এদের মধ্যে ২৪টি দেশেই মেয়েদের খৎনা নিষিদ্ধ। ধর্মে থাকা সত্ত্বেও কেন মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে মেয়েদের খৎনা নিষিদ্ধ তা বোধগম্য নয়। তবে কয়েকটি মুসলিম দেশে মেয়েদের খৎনা হয় ব্যাপকভাবে; ৯০ শতাংশ মিশরীয় নারী খৎনার শিকার। সিয়েরা লিওনেও দেদারছে মেয়েদের খৎনা হচ্ছে। মেয়েদের খৎনা হচ্ছে সুদান, সোমালিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশীয়া, ইথিওপিয়ায়।

অত্যন্ত অমানবিক এই প্রথাটি সভ্য পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হলেও অনেক দেশে এটি ধর্মীয় চর্”া হিসেবে পালন করা হয়। জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে প্রতি ২০ জন মেয়ে শিশু বা নারীর মধ্যে ১ জনের খৎনা করা হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে নাকি এই সময়ে বিশ কোটি নারীর খৎনা রয়েছে অর্থাৎ যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। ধর্মের নিক্তিতে বিচার করলে লালনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঠিক তদরূপ কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত পড়ে বা শুনেও যে কারোরই মনে হতে পারে যে তিনি একজন কালি অন্তপ্রাণ হিন্দু। অখ- মানবসমাজ গঙে তোলার মহান ব্রত নিয়ে তারা দুইজন অসংখ্য গান লিখেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা উভয়ে ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি ভেদাভেদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু প্রচার করেছেন। তার গানের ভক্ত অগণিত মানুষ।

লালন ফকিরের যে গানের দুটি চরণ পোস্ট করে সঞ্জয় রক্ষিত গ্রেপ্তার হয়েছেন সেই গানটি রেডিও, টিভি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অজস্রবার শুনেছি, কিন্তু কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে ইতোপূর্বে শোনা যায়নি। শতাধিক বছরের সুপ্ত অনুভূতির জাগরণ হয়েছে শুধু একজন হিন্দুর লেখায় চরণ দুটি ওঠে আসায়। সমাজের কিছু লোকের ধর্মে মন না থাকলেও ধর্মানুভূতি তীব্র; এদের সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘যাহারা গু-া, ভ- তারাই ধর্মের আবরণে স্বার্থের লোভে ক্ষেপাইয়া তোলে অজ্ঞান জনগণে!’ এরা রাষ্ট্রের প্রশ্রয় পায় বলেই জাতির জন্য তা চরম দুর্ভাগ্য।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি]

back to top