সুমাইয়া আকতার
নদী আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই পরিচিত। জালের মতো বিস্তৃত থাকা অসংখ্য নদী প্রবাহিত মিষ্টি পানিই পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র, ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে মানুষের জীবনধারণের মূল উৎস হয়ে আছে। পৃথিবীতে এমন দেশ খুব কমই আছে, যেখানে বাংলাদেশের মতো নদ-নদী রয়েছে। জলপথ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের উন্মেষ ঘটে।
ইউরোপীয়রা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সমগ্র দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে এক সময়কার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি রূপ নেয় যান্ত্রিক অর্থনীতিতেÑ যা থেকে শিল্প বিপ্লবের মহাবিস্ফোরণ ঘটে। ইউরোপ থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আধুনিক কলকারখানা আর প্রযুক্তির ব্যবহার। তবুও ফুরিয়ে যায়নি জল, জলপথ, নদ-নদী, আর কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্ব। কিন্তু নদীর পানির অবাধ চলাচলের অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে। পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান জরুরি।
বাংলাদেশে নদী দখল একটি গুরুতর সমস্যা, যা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। বিভিন্ন স্থানে নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে, যা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। দেশের প্রতিটি নদীই অরক্ষিত। নদীর দুই পাশে নির্মিত ভবন, ইটভাটা ও শিল্পকারখানার কারণে নদীগুলো প্রবাহ হারিয়েছে, পানি দূষিত হয়েছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই নদীগুলো তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়েছে।
স্রোতহীন নদী ভরাট করে দখল করার মহোৎসবে মেতে উঠেছে ভূমিদস্যুরা। নদ-নদী হলো অফুরন্ত পানির উৎস। কখনো কখনো নদী উপচে বন্যায় আমাদের ভেসে যেতে হয়। কারণ, নদ-নদীগুলো আর আগের মতো স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হয় না। প্রয়োজনীয় পানিও ধারণ করতে পারে না। পলি পড়ে নাব্য হারিয়ে মৃত অবস্থায় উপনীত। বহু নদ-নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, জীবনযাপন, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নগর, হাটবাজার, যাতায়াত, বসতি, ভাষার বৈচিত্র সবই গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে কেন্দ্র করে।
কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মেরুদ- হয়ে আছে নদ-নদী। এছাড়া আমাদের প্রধান চারটি নদ-নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ ৫৪টি ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে শুধু গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি রয়েছে। বাকি ৫৩টি নিয়ে কোন চুক্তি নেই। সবগুলো নদ-নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চাবি-কাঠি ভারতের হাতে। অনেকে অভিযোগ করেন, প্রতিবেশী দেশটি ইচ্ছামতো তার অংশে বাঁধ, স্রোয়েন নির্মাণ ও আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। তারা প্রয়োজনে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, আবার বন্যায় পানি ছেড়ে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক নিয়মে অভিন্ন নদ-নদীর পানি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমানুপাতিক হারে পাওয়ার বিধান থাকলেও ভারত তা মানছে কিনা সেই প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের সবকটি নদ-নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। একসময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। পদ্মার এই করুণ দশার কারণে এর সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৮৫টি শাখা নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ফারাক্কার উজানে ভারতের অংশে পদ্মার পানি থৈ থৈ করছে। ভারত ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর ব্যারাজ এবং উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় ৪০০ পয়েন্ট দিয়ে পদ্মার পানি সরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে, যে তিস্তাকে কেন্দ্র করে দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প গড়ে উঠেছে, সেই তিস্তার উপর দিয়ে এখন মানুষ হেঁটে চলাচল করতে পারে। এর ফলে তিস্তা সেচপ্রকল্প টিকে থাকবে কিনা, এ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, তিস্তার বাংলাদেশ অংশের পানি সংরক্ষণের জন্য ভারতের প্রস্তাবের বিষয়ে আমি লজ্জিত। ভারতের টেকনিক্যাল কমিটি বাংলাদেশে এসে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলবে মর্মে বলা হচ্ছে। কিন্তু, বাংলাদেশে এ ধরনের পানি সংরক্ষণের সুযোগ নেই, এর ফলে বরং পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা আরো বিপর্যয়কর হবে। তিনি আরো বলেন, ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা যত বাড়বে, রাজনৈতিক দরকষাকষিতে বাংলাদেশের অবস্থান ততো দুর্বল হবে।
আমাদের বুঝতে হবে নদীর চরিত্রগুলো। সব নদীর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কিন্তু আবার এক রকম নয়। কোনো নদী বেশি পলি ধারণ করে, আবার কোনোটা কম। কেউ আবার বেশি খরস্রোতা, কেউ আবার সারা বছরই সমান তালে চলে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলি ধারণ করে পদ্মা, যমুনা ও তিস্তা। এককথায় বলতে দেশের বড় নদীগুলো সবারই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো পলি ধারণ করা।
তাই নদীর বৈশিষ্ট্যকে সমুন্নত রেখে তাকে ব্যবহারোপযোগী করতে হবে। এজন্য নদীশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল পরিমাণ পলি ধারণ করার কারণে তার পাড় ভাঙে। তাই আমাদের নদীশাসনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত নদীর পাড় সংরক্ষণ করা, পাড় বাঁধা। সেই পাড় বাঁধাটাও আবার তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী করতে হবে। যে দিকটা বেশি ভাঙছে সে দিকটাকে বেশি শক্ত, মজবুত করতে হবে। পর্যটন খাতেরও বিশাল অংশ নদী। যার মাধ্যমে নদী-পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। পণ্য পরিবহনের জন্য নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাশাপাশি নদীর মাধ্যমে মৎস্য সম্পদকে যথাযোগ্য ব্যবহার, সরবরাহে ইলিশ, চিংড়িসহ মিঠাপানির মাছ উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের একটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে। মাছের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার মাধ্যমে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই না; জীবন বাঁচাতে, পরিবেশকে রক্ষা করতে, উর্বরতা বৃদ্ধিতে, উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে, বর্ধনশীল উষ্ণতাকে প্রশমিত করতে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য যদি রক্ষা করতে নদী সংরক্ষণের বিকল্প নেই।
দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবিলম্বে খুব কম খরচে নদীশাসন, নদী ভাঙন প্রতিরোধ এবং নিরাপদভাবে সারা বছর নৌ-চলাচলের সুবিধার্থে নৌপরিবহন, পানিসম্পদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বুয়েট, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিআইডব্লিউটিয়ের নৌপথ সংরক্ষণ এবং পরিচালন বিভাগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যৌথ সভা করে স্বল্প ব্যয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বান্ডালিং কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণ, মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে নদীগুলোকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি পানির নায্য হিস্যার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ]
সুমাইয়া আকতার
শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
নদী আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই পরিচিত। জালের মতো বিস্তৃত থাকা অসংখ্য নদী প্রবাহিত মিষ্টি পানিই পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র, ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে মানুষের জীবনধারণের মূল উৎস হয়ে আছে। পৃথিবীতে এমন দেশ খুব কমই আছে, যেখানে বাংলাদেশের মতো নদ-নদী রয়েছে। জলপথ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের উন্মেষ ঘটে।
ইউরোপীয়রা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সমগ্র দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে এক সময়কার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি রূপ নেয় যান্ত্রিক অর্থনীতিতেÑ যা থেকে শিল্প বিপ্লবের মহাবিস্ফোরণ ঘটে। ইউরোপ থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আধুনিক কলকারখানা আর প্রযুক্তির ব্যবহার। তবুও ফুরিয়ে যায়নি জল, জলপথ, নদ-নদী, আর কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্ব। কিন্তু নদীর পানির অবাধ চলাচলের অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে। পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান জরুরি।
বাংলাদেশে নদী দখল একটি গুরুতর সমস্যা, যা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। বিভিন্ন স্থানে নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে, যা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। দেশের প্রতিটি নদীই অরক্ষিত। নদীর দুই পাশে নির্মিত ভবন, ইটভাটা ও শিল্পকারখানার কারণে নদীগুলো প্রবাহ হারিয়েছে, পানি দূষিত হয়েছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই নদীগুলো তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়েছে।
স্রোতহীন নদী ভরাট করে দখল করার মহোৎসবে মেতে উঠেছে ভূমিদস্যুরা। নদ-নদী হলো অফুরন্ত পানির উৎস। কখনো কখনো নদী উপচে বন্যায় আমাদের ভেসে যেতে হয়। কারণ, নদ-নদীগুলো আর আগের মতো স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হয় না। প্রয়োজনীয় পানিও ধারণ করতে পারে না। পলি পড়ে নাব্য হারিয়ে মৃত অবস্থায় উপনীত। বহু নদ-নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, জীবনযাপন, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নগর, হাটবাজার, যাতায়াত, বসতি, ভাষার বৈচিত্র সবই গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে কেন্দ্র করে।
কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মেরুদ- হয়ে আছে নদ-নদী। এছাড়া আমাদের প্রধান চারটি নদ-নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ ৫৪টি ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে শুধু গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি রয়েছে। বাকি ৫৩টি নিয়ে কোন চুক্তি নেই। সবগুলো নদ-নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চাবি-কাঠি ভারতের হাতে। অনেকে অভিযোগ করেন, প্রতিবেশী দেশটি ইচ্ছামতো তার অংশে বাঁধ, স্রোয়েন নির্মাণ ও আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। তারা প্রয়োজনে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, আবার বন্যায় পানি ছেড়ে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক নিয়মে অভিন্ন নদ-নদীর পানি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমানুপাতিক হারে পাওয়ার বিধান থাকলেও ভারত তা মানছে কিনা সেই প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের সবকটি নদ-নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। একসময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। পদ্মার এই করুণ দশার কারণে এর সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৮৫টি শাখা নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ফারাক্কার উজানে ভারতের অংশে পদ্মার পানি থৈ থৈ করছে। ভারত ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর ব্যারাজ এবং উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় ৪০০ পয়েন্ট দিয়ে পদ্মার পানি সরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে, যে তিস্তাকে কেন্দ্র করে দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প গড়ে উঠেছে, সেই তিস্তার উপর দিয়ে এখন মানুষ হেঁটে চলাচল করতে পারে। এর ফলে তিস্তা সেচপ্রকল্প টিকে থাকবে কিনা, এ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, তিস্তার বাংলাদেশ অংশের পানি সংরক্ষণের জন্য ভারতের প্রস্তাবের বিষয়ে আমি লজ্জিত। ভারতের টেকনিক্যাল কমিটি বাংলাদেশে এসে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলবে মর্মে বলা হচ্ছে। কিন্তু, বাংলাদেশে এ ধরনের পানি সংরক্ষণের সুযোগ নেই, এর ফলে বরং পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা আরো বিপর্যয়কর হবে। তিনি আরো বলেন, ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা যত বাড়বে, রাজনৈতিক দরকষাকষিতে বাংলাদেশের অবস্থান ততো দুর্বল হবে।
আমাদের বুঝতে হবে নদীর চরিত্রগুলো। সব নদীর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কিন্তু আবার এক রকম নয়। কোনো নদী বেশি পলি ধারণ করে, আবার কোনোটা কম। কেউ আবার বেশি খরস্রোতা, কেউ আবার সারা বছরই সমান তালে চলে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলি ধারণ করে পদ্মা, যমুনা ও তিস্তা। এককথায় বলতে দেশের বড় নদীগুলো সবারই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো পলি ধারণ করা।
তাই নদীর বৈশিষ্ট্যকে সমুন্নত রেখে তাকে ব্যবহারোপযোগী করতে হবে। এজন্য নদীশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল পরিমাণ পলি ধারণ করার কারণে তার পাড় ভাঙে। তাই আমাদের নদীশাসনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত নদীর পাড় সংরক্ষণ করা, পাড় বাঁধা। সেই পাড় বাঁধাটাও আবার তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী করতে হবে। যে দিকটা বেশি ভাঙছে সে দিকটাকে বেশি শক্ত, মজবুত করতে হবে। পর্যটন খাতেরও বিশাল অংশ নদী। যার মাধ্যমে নদী-পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। পণ্য পরিবহনের জন্য নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাশাপাশি নদীর মাধ্যমে মৎস্য সম্পদকে যথাযোগ্য ব্যবহার, সরবরাহে ইলিশ, চিংড়িসহ মিঠাপানির মাছ উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের একটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে। মাছের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার মাধ্যমে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই না; জীবন বাঁচাতে, পরিবেশকে রক্ষা করতে, উর্বরতা বৃদ্ধিতে, উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে, বর্ধনশীল উষ্ণতাকে প্রশমিত করতে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য যদি রক্ষা করতে নদী সংরক্ষণের বিকল্প নেই।
দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবিলম্বে খুব কম খরচে নদীশাসন, নদী ভাঙন প্রতিরোধ এবং নিরাপদভাবে সারা বছর নৌ-চলাচলের সুবিধার্থে নৌপরিবহন, পানিসম্পদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বুয়েট, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিআইডব্লিউটিয়ের নৌপথ সংরক্ষণ এবং পরিচালন বিভাগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যৌথ সভা করে স্বল্প ব্যয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বান্ডালিং কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণ, মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে নদীগুলোকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি পানির নায্য হিস্যার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ]