alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : শিক্ষা জাতীয়করণ

মাজহার মান্নান

: সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে কাজ করে যাচ্ছে। একটি রাষ্ট্রের সংস্কার খুব জটিল এবং সময়সাপেক্ষ একটি কাজ। সব নির্বাচিত সরকারই কমবেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো বেসরকারি শিক্ষকদের; কিন্তু সেটা অধরা থেকে গেছে। বেসরকারি শিক্ষকদের একটি বিরাট ভুমিকা থাকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে। পোলিং, সহকারী প্রিসাইডিং, প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে তারা ব্যাপক ভুমিকা রাখেন। এছাড়াও ভোটার তালিকা করা, জরিপ কাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজ তারা করে থাকেন; কিন্তু তাদের প্রত্যাশার জায়গাটি আজও অপূর্ণ থেকে গেছে। ফেসবুকে চোখ রাখলে দেশের কোন চাকুরিজীবীর হাহাকার চোখে না পড়লেও বেসরকারি শিক্ষকদের হাহাকার প্রচুর পরিমাণে চোখে পড়ে। ফেসবুকে তাদের আর্তনাদ ঝড় দেখে খুব খারাপ লাগে। আমি নিজেও একজন শিক্ষক। তাই তাদের দুঃখ বুঝতে পারি।

বেসরকারি শিক্ষকদের আবার কয়েকটি ধরন রয়েছে। একটি অংশ এমপিওভুক্ত, একটি অংশ নন-এমপিওভুক্ত। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমস্যাগুলোই আগে তুলে ধরতে চাই।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন খুবই কম। কেননা তারা মূলত বেসিকটা পেয়ে থাকেন। বাড়িভাড়া যা পান সেটা উল্লেখ না করাই ভালো। কিছুটা মেডিকেল ভাতা পান। সব মিলিয়ে যা পান তার থেকে ১০ শতাংশ আবার কেটে রাখা হয় অবসর ও কল্যাণ তহবিলের জন্য। স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক ১২৫০০ বেসিক পেয়ে থাকেন। কী হয় এই টাকা দিয়ে? চারজনের একটি পরিবার কি চলা সম্ভব? মোটেও না। একজন প্রভাষক ২২০০০ টাকা বেসিক পান। তার পদমর্যাদা অনুযায়ী এই টাকা দিয়ে কি সমাজে টিকে থাকা সম্ভব?

বেসরকারি শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেড এবং পদোন্নতির জায়গাটি খুবই সংকুচিত। এ যেন সোনার হরিণ!

বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার পর তাদের অবসর ও কল্যাণের টাকা তুলতে গলদঘর্ম হতে হয়। বছরের পর বছর তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষারত অনেকে মারাও যায়। এ জটিলতার যেন শেষ নেই।

চাকুরিতে যোগদানের পর এমপিওভুক্ত হতে পারা আর হিমালয় জয় করা সমান কথা। ঘুষ দিয়েও দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত হতে।

বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা নেই। অন্তর্বর্তী সরকার এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্তদের বদলির আদেশ জারি করেছেন। তবে প্রজ্ঞাপন এখনো হয়নি। কতটুকু কি লাভ হবে তা পরে বুঝা যাবে।

বেসরকারি শিক্ষকরা ঈদ বোনাস পান তাদের বেসিবের ২৫ শতাংশ। যেটা খুবই কম। যার বেসিক ১২৫০০ টাকা তিনি ঈদ বোনাস পান ৩১২৫ টাকা। এই টাকা দিয়ে একটি সন্তানের পোশাকও কেনা যায় না।

বেসরকারি শিক্ষকরা মাসের ১-৫ তারিখের মধ্যে বেতন পান এমন নজির খুব কম। অনেক সময় মাসের শেষে গিয়ে বেতন হাতে পান। এটাতো হলো তাদের আর্থিক দীনতার চিত্র। তাদের আর যে কত কি সহ্য করতে হয় তা হিসাববিহীন। ম্যানেজিং কমিটির অযথা হস্তক্ষেপে তাদের চাকরি জীবন বিষাদময় হয়ে উঠে। তাদের গায়ে হাত পর্যন্ত তোলা হয়। পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল তৈরি করার জন্য তাদের ওপর থাকে অনৈতিক চাপ। নানা সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষক সমাজকে বছরের বেশিরভাগ সময় দেখা যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাবি আদায়ে ব্যস্ত থাকতে।

দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮০ শতাংশ শিক্ষা সম্পন্ন হয় বেসরকারি শিক্ষকদের দ্বারা। অথচ তারা পরতে পরতে অবহেলিত। দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারির সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এরা প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে একটি নির্দিষ্টি অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকে। এদের পেছনে আর কিছু টাকা ব্যয় করলে এদের জাতীয়করণ করা সম্ভব। আমি কোন অর্থনীতিবিদ নই। সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি দেশের যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে তার ১০ ভাগের এক ভাগ অর্থ দিয়ে এই শিক্ষকগুলোর জাতীয়করণ করা সম্ভব। সদিচ্ছাটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিগত সরকারসমূহ তাদের সুবিধামতো বেছে বেছে কিছু প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছে; কিন্তু তাতে মূল সমস্যা কমেনি বরং আরও প্রকট হয়েছে। আবার সেগুলো জাতীয়করণে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলেও খবর চাউর হয়েছে। দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় রেখে এলে সামগ্রিক সমন্যার সমাধান সম্ভব নয়।

শিক্ষা জাতীয়করণ নিয়ে শিক্ষক, বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একটি বড় অংশের দাবি হল শুধু তাদের পদটি জাতীয়করণ হোক। তারা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ চান না। শিক্ষকদের আরেকটি গ্রুপ চান প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হোক এবং প্রতিষ্ঠানের অর্জিত আয় সরকারি কোষাগারে চলে যাক। আরেকটি গ্রুপ চায় সমগ্র শিক্ষা জাতীয়করণ হোক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বহু শিক্ষক আছেন যারা এমপিওভুক্ত নন। তারা চান তাদেরটাও জাতীয়করণ হোক। এখানে একটি হিসাব আছে।

প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলে এমপিও নন-এমপিও সবাই সেটার আওতায় আসে। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জাতীয়করণ করলে টাকার চাপ অনেক কমে আসে। তাদের শুধু সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া আর পূর্ণ উৎসব ভাতা দিলেই হয়ে যায়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জাতীয়করন করাটা অনেক সহজ এবং অর্থ সাশ্রয়ী হবে। আর দেশের সমগ্র শিক্ষাকে যদি জাতীয়করণ করতে হয় তবে বড় বাজেটের প্রয়োজন হবে। নিখুঁত জরিপের প্রয়োজন হবে। দেশের শিক্ষার সত্যিকার সংস্কার চাইলে শিক্ষা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। সরকার এক্ষেত্রে শিক্ষা জাতীয়করণ একটি কমিশন গঠন করে দিতে পারে। যদি একান্তই জাতীয়করণ সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করে দিতে পারে সরকার।

দেশে একটি নির্বাচন করাই এ সরকারের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তাদের বহুমাত্রিক সংস্কার করার ইচ্ছা আছে। শিক্ষা খাতে ছোটখাটো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে; কিন্তু গতি খুব ধীর। একাদশ প্রথম বর্ষের ভর্তি প্রায় ৬ মাস হতে চললো; কিন্তু এখনো বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবই বাজারে আসেনি। মন্থরগতিতে কাজ করে শিক্ষার সংস্কার সম্ভব হবে না। শিক্ষা সংস্কার করতে পৃথক কমিশন লাগবে। জাদরেল শিক্ষাবিদ লাগবে। শিক্ষা জাতীয়করণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ে কোন কার্যকর সেমিনার বা গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কেন এই অবহেলা।

চাকরিজীবীদের সব শ্রেণী বেশ ভালো আছে; কিন্তু শিক্ষকদের এ বেহালদশা কেন? শিক্ষকদের অবহেলায় রেখে শিক্ষার কতটুকু উন্নয়ন সম্ভব? যাকে দিয়ে জাতি তৈরি হবে তার নিজেরই যদি ভগ্নদশা অবস্থা হয় তাহলে কিভাবে শিক্ষা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কতটুকু লাভ হচ্ছে তাতে? এসব না করে বরং ভালোমানের বেতন দিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রকৃত শিক্ষা আদায় করার সুযোগ আছে। কেন জাতীয়করণ হয় না? শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা কেমন তা নতুন করে লিখে কলেবর বাড়াতে চাই না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষকদের বেতন কাঠামো দেখলে সহজে অনুমান করা যায় কি দৈন্য অবস্থা আমাদের শিক্ষকদের। প্রতিবেশী ভারতে শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা নিজে চোখে দেখে এসেছি। ভারতের কয়েকটি বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা উচ্চ বেতন এবং মর্যাদা দুটোই পেয়ে থাকে। ভারতের চেয়ে আমাদের আর্থিক সঙ্গতি নেহাৎ কম নয়। তাহলে গলদ কোথায়? পাকিস্তান, শ্রীলংকায়ও শিক্ষকরা মানসম্মত বেতন ও সম্মান পেয়ে থাকেন। তাহলে আমরা কোথায় আটকে আছি। প্রায়ই শোনা যায় আমলাতান্ত্রিক জটিলার ফাঁদে আটকা পড়েছে জাতীয়করণসহ নানা সুবিধা; কিন্তু কেন? শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করার প্রতিশ্রুতি তো বড় রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে ছিল। কোথায় গেল সেই আশ্বাস? উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।

সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এবং অন্যান্য কী কী চ্যালেঞ্জসমূহ রয়েছে সেটার একটি গবেষণাভিত্তিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন। বেসরকারি পর্যায়ে এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জরিপ করা হলেও পূর্ণাঙ্গ জরিপ এখনো হয়নি। তবে খ-িত জরিপ এবং বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ থেকে যেটা অনুমান করা যায় সেটা হলো জাতীয়করণের জন্য অর্থের চেয়ে সদিচ্ছাটি বেশি প্রয়োজন। বেশিরভাগ শিক্ষক মনে করেন যে শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবি যখনই জড়ালো হয় তখন সেটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জালে আটকা পড়ে মুখথুবড়ে। তাদের এ ধারণা কতটুকু সঠিক তা যাচাই করার সুযোগ নেই। তবে এতটুকু আন্দাজ করা যায় যে, শিক্ষকরা কোন কিছুই সহজভাবে পায়নি। কঠোর আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাদের অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছে।

জাতীয়করণের দাবি নিয়ে শিক্ষকরা প্রেসক্লাবে প্রায়ই এসে থাকেন। সারা বছরই শিক্ষকদের কোন না কোন অংশ তাদের দাবি আদায়ে প্রেসক্লাবে অবস্থান করেন; কিন্তু কেন? শিক্ষকদের কেন বারবার তাদের দাবি আদায়ে প্রেসক্লাবে অবস্থান করতে হবে? আরও তো বহু চাকরিজীবী আছেন, তারা কয় দিন প্রেসক্লাবে তাদের দাবির পক্ষে অবস্থান করেন? এর থেকেই বুঝা যায় যে, শিক্ষকরা বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকেরা চরম বৈষম্যের শিকার। অবহেলার দাবানলে দগ্ধ এসব শিক্ষক আর কত দিন রাজপথে থাকবেন। যাদের বিদ্যালয়ে অবস্থান করে শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকার কথা তারা এখন রাজপথে তাদের দাবি আদায়ের জন্য। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের ক্লাশ থেকে।

রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নির্বাচনী ডামাডোল নিয়ে ব্যস্ত আছেন। দেশের সমস্যা সমাধানে তাদের আপাতত মাথা ব্যথা দেখি না; কিন্তু আমাদের মাথা ব্যথা আছে। এই সরকারের প্রতি শিক্ষকরা আস্থা রাখতে চান। শিক্ষকদের এই আস্থাকে সরকার ও রাষ্ট্র সম্মান জানাবে বলে আশা রাখি।

[লেখক : শিক্ষক]

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন

ধনিক শ্রেণীর চলমান সংকট

ছবি

বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য এবং আমাদের প্রান্তিক মানুষ

বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে ওষুধের ব্যবহার

শুভ বড়দিন

উগান্ডায় নতুন ভাইরাস ডিঙ্গা ডিঙ্গা

পরিবেশবান্ধব ঢাকা চাই

বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন

ছবি

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা : ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সৃষ্টির প্রথম ভ্রুণ

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভূমিকা

প্রগতিতে অগ্রগতি

পরিবারতন্ত্র ও পরিবারতত্ত্ব : উত্তরণের উপায়

উপেক্ষিত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা

সরিষার তেল গবেষণায় সাফল্য

সিরিয়ায় রাজনৈতিক পালাবদল : কার লাভ, কার ক্ষতি?

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : শিক্ষা জাতীয়করণ

মাজহার মান্নান

সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে কাজ করে যাচ্ছে। একটি রাষ্ট্রের সংস্কার খুব জটিল এবং সময়সাপেক্ষ একটি কাজ। সব নির্বাচিত সরকারই কমবেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো বেসরকারি শিক্ষকদের; কিন্তু সেটা অধরা থেকে গেছে। বেসরকারি শিক্ষকদের একটি বিরাট ভুমিকা থাকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে। পোলিং, সহকারী প্রিসাইডিং, প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে তারা ব্যাপক ভুমিকা রাখেন। এছাড়াও ভোটার তালিকা করা, জরিপ কাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজ তারা করে থাকেন; কিন্তু তাদের প্রত্যাশার জায়গাটি আজও অপূর্ণ থেকে গেছে। ফেসবুকে চোখ রাখলে দেশের কোন চাকুরিজীবীর হাহাকার চোখে না পড়লেও বেসরকারি শিক্ষকদের হাহাকার প্রচুর পরিমাণে চোখে পড়ে। ফেসবুকে তাদের আর্তনাদ ঝড় দেখে খুব খারাপ লাগে। আমি নিজেও একজন শিক্ষক। তাই তাদের দুঃখ বুঝতে পারি।

বেসরকারি শিক্ষকদের আবার কয়েকটি ধরন রয়েছে। একটি অংশ এমপিওভুক্ত, একটি অংশ নন-এমপিওভুক্ত। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমস্যাগুলোই আগে তুলে ধরতে চাই।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন খুবই কম। কেননা তারা মূলত বেসিকটা পেয়ে থাকেন। বাড়িভাড়া যা পান সেটা উল্লেখ না করাই ভালো। কিছুটা মেডিকেল ভাতা পান। সব মিলিয়ে যা পান তার থেকে ১০ শতাংশ আবার কেটে রাখা হয় অবসর ও কল্যাণ তহবিলের জন্য। স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক ১২৫০০ বেসিক পেয়ে থাকেন। কী হয় এই টাকা দিয়ে? চারজনের একটি পরিবার কি চলা সম্ভব? মোটেও না। একজন প্রভাষক ২২০০০ টাকা বেসিক পান। তার পদমর্যাদা অনুযায়ী এই টাকা দিয়ে কি সমাজে টিকে থাকা সম্ভব?

বেসরকারি শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেড এবং পদোন্নতির জায়গাটি খুবই সংকুচিত। এ যেন সোনার হরিণ!

বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার পর তাদের অবসর ও কল্যাণের টাকা তুলতে গলদঘর্ম হতে হয়। বছরের পর বছর তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষারত অনেকে মারাও যায়। এ জটিলতার যেন শেষ নেই।

চাকুরিতে যোগদানের পর এমপিওভুক্ত হতে পারা আর হিমালয় জয় করা সমান কথা। ঘুষ দিয়েও দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত হতে।

বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা নেই। অন্তর্বর্তী সরকার এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্তদের বদলির আদেশ জারি করেছেন। তবে প্রজ্ঞাপন এখনো হয়নি। কতটুকু কি লাভ হবে তা পরে বুঝা যাবে।

বেসরকারি শিক্ষকরা ঈদ বোনাস পান তাদের বেসিবের ২৫ শতাংশ। যেটা খুবই কম। যার বেসিক ১২৫০০ টাকা তিনি ঈদ বোনাস পান ৩১২৫ টাকা। এই টাকা দিয়ে একটি সন্তানের পোশাকও কেনা যায় না।

বেসরকারি শিক্ষকরা মাসের ১-৫ তারিখের মধ্যে বেতন পান এমন নজির খুব কম। অনেক সময় মাসের শেষে গিয়ে বেতন হাতে পান। এটাতো হলো তাদের আর্থিক দীনতার চিত্র। তাদের আর যে কত কি সহ্য করতে হয় তা হিসাববিহীন। ম্যানেজিং কমিটির অযথা হস্তক্ষেপে তাদের চাকরি জীবন বিষাদময় হয়ে উঠে। তাদের গায়ে হাত পর্যন্ত তোলা হয়। পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল তৈরি করার জন্য তাদের ওপর থাকে অনৈতিক চাপ। নানা সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষক সমাজকে বছরের বেশিরভাগ সময় দেখা যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাবি আদায়ে ব্যস্ত থাকতে।

দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮০ শতাংশ শিক্ষা সম্পন্ন হয় বেসরকারি শিক্ষকদের দ্বারা। অথচ তারা পরতে পরতে অবহেলিত। দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারির সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এরা প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে একটি নির্দিষ্টি অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকে। এদের পেছনে আর কিছু টাকা ব্যয় করলে এদের জাতীয়করণ করা সম্ভব। আমি কোন অর্থনীতিবিদ নই। সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি দেশের যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে তার ১০ ভাগের এক ভাগ অর্থ দিয়ে এই শিক্ষকগুলোর জাতীয়করণ করা সম্ভব। সদিচ্ছাটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিগত সরকারসমূহ তাদের সুবিধামতো বেছে বেছে কিছু প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছে; কিন্তু তাতে মূল সমস্যা কমেনি বরং আরও প্রকট হয়েছে। আবার সেগুলো জাতীয়করণে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলেও খবর চাউর হয়েছে। দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় রেখে এলে সামগ্রিক সমন্যার সমাধান সম্ভব নয়।

শিক্ষা জাতীয়করণ নিয়ে শিক্ষক, বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একটি বড় অংশের দাবি হল শুধু তাদের পদটি জাতীয়করণ হোক। তারা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ চান না। শিক্ষকদের আরেকটি গ্রুপ চান প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হোক এবং প্রতিষ্ঠানের অর্জিত আয় সরকারি কোষাগারে চলে যাক। আরেকটি গ্রুপ চায় সমগ্র শিক্ষা জাতীয়করণ হোক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বহু শিক্ষক আছেন যারা এমপিওভুক্ত নন। তারা চান তাদেরটাও জাতীয়করণ হোক। এখানে একটি হিসাব আছে।

প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলে এমপিও নন-এমপিও সবাই সেটার আওতায় আসে। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জাতীয়করণ করলে টাকার চাপ অনেক কমে আসে। তাদের শুধু সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া আর পূর্ণ উৎসব ভাতা দিলেই হয়ে যায়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জাতীয়করন করাটা অনেক সহজ এবং অর্থ সাশ্রয়ী হবে। আর দেশের সমগ্র শিক্ষাকে যদি জাতীয়করণ করতে হয় তবে বড় বাজেটের প্রয়োজন হবে। নিখুঁত জরিপের প্রয়োজন হবে। দেশের শিক্ষার সত্যিকার সংস্কার চাইলে শিক্ষা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। সরকার এক্ষেত্রে শিক্ষা জাতীয়করণ একটি কমিশন গঠন করে দিতে পারে। যদি একান্তই জাতীয়করণ সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করে দিতে পারে সরকার।

দেশে একটি নির্বাচন করাই এ সরকারের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তাদের বহুমাত্রিক সংস্কার করার ইচ্ছা আছে। শিক্ষা খাতে ছোটখাটো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে; কিন্তু গতি খুব ধীর। একাদশ প্রথম বর্ষের ভর্তি প্রায় ৬ মাস হতে চললো; কিন্তু এখনো বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবই বাজারে আসেনি। মন্থরগতিতে কাজ করে শিক্ষার সংস্কার সম্ভব হবে না। শিক্ষা সংস্কার করতে পৃথক কমিশন লাগবে। জাদরেল শিক্ষাবিদ লাগবে। শিক্ষা জাতীয়করণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ে কোন কার্যকর সেমিনার বা গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কেন এই অবহেলা।

চাকরিজীবীদের সব শ্রেণী বেশ ভালো আছে; কিন্তু শিক্ষকদের এ বেহালদশা কেন? শিক্ষকদের অবহেলায় রেখে শিক্ষার কতটুকু উন্নয়ন সম্ভব? যাকে দিয়ে জাতি তৈরি হবে তার নিজেরই যদি ভগ্নদশা অবস্থা হয় তাহলে কিভাবে শিক্ষা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কতটুকু লাভ হচ্ছে তাতে? এসব না করে বরং ভালোমানের বেতন দিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রকৃত শিক্ষা আদায় করার সুযোগ আছে। কেন জাতীয়করণ হয় না? শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা কেমন তা নতুন করে লিখে কলেবর বাড়াতে চাই না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষকদের বেতন কাঠামো দেখলে সহজে অনুমান করা যায় কি দৈন্য অবস্থা আমাদের শিক্ষকদের। প্রতিবেশী ভারতে শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা নিজে চোখে দেখে এসেছি। ভারতের কয়েকটি বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা উচ্চ বেতন এবং মর্যাদা দুটোই পেয়ে থাকে। ভারতের চেয়ে আমাদের আর্থিক সঙ্গতি নেহাৎ কম নয়। তাহলে গলদ কোথায়? পাকিস্তান, শ্রীলংকায়ও শিক্ষকরা মানসম্মত বেতন ও সম্মান পেয়ে থাকেন। তাহলে আমরা কোথায় আটকে আছি। প্রায়ই শোনা যায় আমলাতান্ত্রিক জটিলার ফাঁদে আটকা পড়েছে জাতীয়করণসহ নানা সুবিধা; কিন্তু কেন? শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করার প্রতিশ্রুতি তো বড় রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে ছিল। কোথায় গেল সেই আশ্বাস? উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।

সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এবং অন্যান্য কী কী চ্যালেঞ্জসমূহ রয়েছে সেটার একটি গবেষণাভিত্তিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন। বেসরকারি পর্যায়ে এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জরিপ করা হলেও পূর্ণাঙ্গ জরিপ এখনো হয়নি। তবে খ-িত জরিপ এবং বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ থেকে যেটা অনুমান করা যায় সেটা হলো জাতীয়করণের জন্য অর্থের চেয়ে সদিচ্ছাটি বেশি প্রয়োজন। বেশিরভাগ শিক্ষক মনে করেন যে শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবি যখনই জড়ালো হয় তখন সেটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জালে আটকা পড়ে মুখথুবড়ে। তাদের এ ধারণা কতটুকু সঠিক তা যাচাই করার সুযোগ নেই। তবে এতটুকু আন্দাজ করা যায় যে, শিক্ষকরা কোন কিছুই সহজভাবে পায়নি। কঠোর আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাদের অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছে।

জাতীয়করণের দাবি নিয়ে শিক্ষকরা প্রেসক্লাবে প্রায়ই এসে থাকেন। সারা বছরই শিক্ষকদের কোন না কোন অংশ তাদের দাবি আদায়ে প্রেসক্লাবে অবস্থান করেন; কিন্তু কেন? শিক্ষকদের কেন বারবার তাদের দাবি আদায়ে প্রেসক্লাবে অবস্থান করতে হবে? আরও তো বহু চাকরিজীবী আছেন, তারা কয় দিন প্রেসক্লাবে তাদের দাবির পক্ষে অবস্থান করেন? এর থেকেই বুঝা যায় যে, শিক্ষকরা বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকেরা চরম বৈষম্যের শিকার। অবহেলার দাবানলে দগ্ধ এসব শিক্ষক আর কত দিন রাজপথে থাকবেন। যাদের বিদ্যালয়ে অবস্থান করে শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকার কথা তারা এখন রাজপথে তাদের দাবি আদায়ের জন্য। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের ক্লাশ থেকে।

রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নির্বাচনী ডামাডোল নিয়ে ব্যস্ত আছেন। দেশের সমস্যা সমাধানে তাদের আপাতত মাথা ব্যথা দেখি না; কিন্তু আমাদের মাথা ব্যথা আছে। এই সরকারের প্রতি শিক্ষকরা আস্থা রাখতে চান। শিক্ষকদের এই আস্থাকে সরকার ও রাষ্ট্র সম্মান জানাবে বলে আশা রাখি।

[লেখক : শিক্ষক]

back to top