শঙ্কর প্রসাদ দে
জুলাই ছাত্র বিক্ষোভ ও ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিস্ফোরণ একটি বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। ছাত্রদের অনুরোধে ড. ইউনূস রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের কোন বিধান বর্তমান সংবিধানে নেই। এরপরও সরকারটির মেয়াদ তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সরকার সামনে যতদিনই থাকুক, এটি একধরনের বৈধতা পেয়ে যাবে খন্দকার মোশতাক সরকারের মতোই। খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান করে খন্দকার মোশতাককে সেফ এক্সিট দিলে সরকারটি বৈধতা পেয়ে যায় এবং খন্দকার মোশতাকের কলম দিয়েই খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। অতীত প্রেক্ষাপট হলো নব্য স্বাধীন এ রাষ্ট্রে তখন পুঁজিবাদী বিকাশ সবে শুরু। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির ইলিমেন্টারি কনসেপ্ট হলো লুটপাট ছাড়া বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট ছাড়া তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে পুঁজিপতির সৃষ্টি সম্ভব নয়। পকিস্তান আমলের সমস্ত কলকারখানা, ব্যাংক, বিমা জাতীয়করণ হওয়ায় এবং সেগুলোতে লুটপাটের মাধ্যমে বছর-তিনেকের মধ্যে লুটপাটের ফলে উঠতি লুটেরাদের হাতে কিছু অর্থ এসে যায়। এখন এদের দরকার মিল কারখানার মালিক হওয়া। গ্রামীণ জনপদে ঠিকাদার, বড় ব্যবসায়ী, গাড়ির মালিক, চা-বাগানসহ বহু কিছুর মালিক হওয়া।
এ প্রশ্নে প্রথম বাধা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাকশাল বাস্তবায়িত হলে এদেশের বর্তমান ধনিক শ্রেণীর বর্তমান রূপ অবশ্যই বেশ কিছু সময়ের জন্য থমকে যেত। উঠতি ধনিক শ্রেণী রাজি ছিল বলেই মোশতাক বৈধতা পেয়েছিল। খালেদ মোশারফ ও জিয়াউর রহমান ছিলেন উছিলামাত্র। কার হাতে ক্ষমতা থাকবে এ নিয়ে ছিল দুই জেনারেল ও তাহেরের মধ্যে রশি টানাটানি। বর্তমানেও ধনিক শ্রেণী বছর-পাঁচেক আগে নিপতিত হওয়া সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বিমা কলকারখানা চা-বাগানসহ প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আত্মসাৎ সম্পন্ন করে একটি ছোট আকারের ধনিক শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটার চূড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পাদিত হয় জেনারেল এরশাদের হাত ধরে। এরপরের ইতিহাস এদেশে ধনিক শ্রেণীর সুবর্ণ সময়ের ইতিহাস। নব্বইয়ের দশক থেকে কৃষি, মৎস্য, সিমেন্ট, সিরামিক, টিম্বার, চা ও পোশাক শিল্পে শুরু হয় বিপ্লব। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমতে থাকে ব্যাংকে। এর সঙ্গে যোগ হয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ছোটমানের এসব ধনীরা নতুন ফন্দিতে নেমে পড়ল। শিল্পকারখানা, গার্মেন্টস, হ্যাচারি, শিপ ব্রেকিংসহ নতুন নতুন শিল্প প্রজেক্ট নিয়ে হাজির হলো ব্যাংকে, বেশির ভাগ জাল দলিল অথবা ওভার ভ্যালুড করে ঋণের নামে নিয়ে গেল হাজার হাজার কোটি টাকা। ব্যতিক্রমী সৎ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আছেন এবং এদের কারণে এখনো ব্যাংক, আমদানি, রপ্তানি ও গার্মেন্টসসহ শিল্পকারখানা টিকে আছে। খেলাপিঋণগুলো ব্যাংক কর্মকর্তা ও অসাধু ঋণগ্রহীতাদের এক চমৎকার অসাধু ঋণ প্রক্রিয়ার অবধারিত ফসল।
এবার এরা নতুন চেহারায়, নতুন রূপে আবির্ভূত হলো। এর শুরু মূলত ২০০১ সালের ৪ দলীয় জোট সরকার ও ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ জমানায়। দলে দলে যোগ দিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগে। জীবনভর রাজনীতি করে উঠে আসা নেতাকর্মীদের সাইডলাইনে বসিয়ে রেখে সংসদে ঢুকে গেল এসব ঋণখেলাপিরা। দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দখল করল এসব ঋণখেলাপিরা। আওয়ামী লীগ আমলে দেখা গেল হাতেগোনা কয়েকজনের খেলাপির ঋণ দাঁড়াল লক্ষ-কোটি টাকা। এবার এরা দখল করা শুরু করল ব্যাংক। অভিযোগ হলো এস আলমের কাছ থেকে ঋণ উদ্ধারের পরিবর্তে তুলে দেয়া হয়েছে ৮টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদে বসানো হয়েছে নতুন নতুন মুখ। একপর্যায়ে দেখা গেল ব্যাংকমালিকদের মধ্যে কামড়াকামড়ি সব বেসরকারি ব্যাংকেই ছড়িয়ে পড়ল। অর্থনীতির ভাষায় এর নাম পুঁজিবাদী বা ধনবাদী সংকট। ৫ আগস্ট ছাত্রদের গণবিস্ফোরণের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না ঘটলেও অন্য কোন কারণে অন্য কোন তারিখে পতন ছিল অবধারিত। কারণ ব্যাংক মালিক, শিল্পমালিক, আমদানি-রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীরা পরস্পর বাজার, ব্যাংক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে পরস্পরের মাঝে ঝগড়া, বিত-া বা দলাদলিতে এমন সংকটের সৃষ্টি করল যে আওয়ামী লীগ সরকার এগোতে পারছিল না। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী চেহারা নিয়ে প্রকাশ্যে এল। প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া সে চলেই না। ইহার নাম বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার সংকট। এ ধরনের সংকটজনক অবস্থায় সামনে আসে কার্ল মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রসঙ্গ, অথবা কেইনসীয় ফর্মুলায় ধনতান্ত্রিক সংকট উত্তরণ। লেনিন বলেছিলেন রুশ ধনিক শ্রেণী নিজেদের মধ্যে যে সংকট সৃষ্টি করেছে তার সুযোগ নিয়ে বিপ্লবের এটাই উপযুক্ত সময়। সেনাবাহিনীকে সামনে নিয়ে লেনিন ৭ নভেম্বর ১৯১৭ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যের সঙ্গে সংঘটিত করে ইতিহাস বদলে দিলেন। বাংলাদেশে জুলাই ’২৪ এর বিক্ষোভ যদি লেনিনের মতো কোন নেতার আহ্বানো হতো এবং যদি সমাজ পরিবর্তনের ডাক দেয়া হতো তবে তা বিপ্লবী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গোটা পৃথিবীতে ওরকম কোন মার্ক্সবাদী বিপ্লবী পার্টি ও বিপ্লবী নেতার অস্তিত্ব আজ আর নেই।
আরব বসন্তে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শাসক পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্র বা সরকার বা শোষণ কাঠামোর কোনটাই পরিবর্তন হয়নি। তিউনিসিয়ার বু-আজিজির আত্মত্যাগ ষোলআনাই বৃথা গেছে। ছেলেদের রক্ত নব্বইয়ের মতো বৃথা যাওয়ার লক্ষণ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে ত্রিমাত্রিক সংকট সবসীমা অতিক্রম করেছে। দুর্নীতি, ব্যাংকিং নৈরাজ্য ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করে রাষ্ট্রকে অচলাবস্থায় নিক্ষেপ করেছিল। ব্যাংক মানে গরিব, নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের টাকায় বড় লোকদের পোদ্দারি। একপর্যায়ে তথাকথিত ব্যাংকমালিকরা মারামারি হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। এস আলমকে ৮-১০ ব্যাংক তুলে দেয়া কোন যুক্তিতে সমর্থনযোগ্য ছিল না। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল ব্যক্তি খাতের ওপর শেখ হাসিনা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। দুর্নীতির ব্যাপারে শুধু এটুকু বলা যায় সরকার দলীয় নেতা, আমলা, পুলিশ ও ঠিকাদার ব্যবসায়ীরা দুর্নীতির উল্লাসে মত্ত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছিল শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ লীগের আতি-পাতি গর্জে ওঠা লীগের নামে। এত হাইব্রিড আতি-পাতি নেতা বা লীগকে নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতা আওয়ামী লীগের ছিল না। এই লুটপাট হলো ক্ষমতাসীন ধনিক শ্রেণীর পারস্পরিক ঝগড়া বা অভ্যন্তরীণ সংকট। এর বাইরে আওয়ামী ধনিক শ্রেণীর সঙ্গে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতি ধনিকদের দ্বন্দ্ব তো ছিলই। বর্তমানে ৫২টি ব্যাংক।
শত শত গার্মেন্টস, শিপ ব্রেকিং, সিমেন্ট, স্টিলসহ হরেক রকমের শিল্পকারখানার মালিক হয়েছে আওয়ামী বড়লোকরা। ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি বাকিদের। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামীবিরোধী বড় লোকরা অসহিষ্ণু ও অস্থির হয়ে পড়েছিল। কোটা আন্দোলনকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন অতঃপর এক দফা আন্দোলনে পরিণত করার মূল কুশীলব আওয়ামীবিরোধী ধনিক শ্রেণী। ছাত্রদের পেছনে শক্তি জুগিয়েছে দুর্নীতি বিরোধিতা, ব্যাংকিং নৈরাজ্যবিরোধী ও আওয়ামী স্বেচ্ছাচারিতা বিরোধী ধনিক শ্রেণী। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সমাজ, সরকার ও অর্থব্যবস্থা অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়। বিদ্যমান শোষণভিত্তিক শাসন টিকিয়ে রাখতে হলে অন্তবর্তী শাসন নামক ব্যবস্থা জারি করে ধনিক শ্রেণী সংকট আপাত; উত্তরণে সক্ষম হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকেও কাছে ভবিষ্যতে বিদায় করে দেয়া হবে। গদি দখল করবে হয় বিএনপির বুর্জোয়া বা আওয়ামী বুর্জোয়ারা। কোটা আন্দোলন ও ৫ আগস্ট-পরবর্তী পর্বে নিহত আহত ছাত্র-জনতা শিশু ও পুলিশের রক্তদান দীর্ঘমেয়াদে বৃথাই গেছে। এসবের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হলো বড় দলগুলোই বলতে শুরু করেছে সংস্কার হোক বা না হোক সবার আগে চাই নির্বাচন এবং সিংহাসন। কেইনসের ফর্মুলা অনুযায়ী সরকারি অধিগ্রহণ বা অর্থায়ন ছাড়া দেউলিয়া ১০ ব্যাংককে বাঁচানো যাবে না। অর্থ উপদেষ্টার মতে, বাজার কাজ করছে না ও বিশৃঙ্খল বলে মূল্যস্ফীতি চরমে। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া বেসরকারি শিল্প খাত ও বাজার ব্যবস্থা ভারসাম্যে আনা অসম্ভব। দেখা যাক অর্থনীতির বিশ^নন্দিত অধ্যাপক প্রফেসর ইউনূস বুর্র্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার এই সংকট কীভাবে সামাল দেন।
[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ; অর্থশাস্ত্রের সাবেক প্রভাষক]
শঙ্কর প্রসাদ দে
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
জুলাই ছাত্র বিক্ষোভ ও ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিস্ফোরণ একটি বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। ছাত্রদের অনুরোধে ড. ইউনূস রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের কোন বিধান বর্তমান সংবিধানে নেই। এরপরও সরকারটির মেয়াদ তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সরকার সামনে যতদিনই থাকুক, এটি একধরনের বৈধতা পেয়ে যাবে খন্দকার মোশতাক সরকারের মতোই। খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান করে খন্দকার মোশতাককে সেফ এক্সিট দিলে সরকারটি বৈধতা পেয়ে যায় এবং খন্দকার মোশতাকের কলম দিয়েই খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। অতীত প্রেক্ষাপট হলো নব্য স্বাধীন এ রাষ্ট্রে তখন পুঁজিবাদী বিকাশ সবে শুরু। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির ইলিমেন্টারি কনসেপ্ট হলো লুটপাট ছাড়া বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট ছাড়া তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে পুঁজিপতির সৃষ্টি সম্ভব নয়। পকিস্তান আমলের সমস্ত কলকারখানা, ব্যাংক, বিমা জাতীয়করণ হওয়ায় এবং সেগুলোতে লুটপাটের মাধ্যমে বছর-তিনেকের মধ্যে লুটপাটের ফলে উঠতি লুটেরাদের হাতে কিছু অর্থ এসে যায়। এখন এদের দরকার মিল কারখানার মালিক হওয়া। গ্রামীণ জনপদে ঠিকাদার, বড় ব্যবসায়ী, গাড়ির মালিক, চা-বাগানসহ বহু কিছুর মালিক হওয়া।
এ প্রশ্নে প্রথম বাধা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাকশাল বাস্তবায়িত হলে এদেশের বর্তমান ধনিক শ্রেণীর বর্তমান রূপ অবশ্যই বেশ কিছু সময়ের জন্য থমকে যেত। উঠতি ধনিক শ্রেণী রাজি ছিল বলেই মোশতাক বৈধতা পেয়েছিল। খালেদ মোশারফ ও জিয়াউর রহমান ছিলেন উছিলামাত্র। কার হাতে ক্ষমতা থাকবে এ নিয়ে ছিল দুই জেনারেল ও তাহেরের মধ্যে রশি টানাটানি। বর্তমানেও ধনিক শ্রেণী বছর-পাঁচেক আগে নিপতিত হওয়া সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বিমা কলকারখানা চা-বাগানসহ প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আত্মসাৎ সম্পন্ন করে একটি ছোট আকারের ধনিক শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটার চূড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পাদিত হয় জেনারেল এরশাদের হাত ধরে। এরপরের ইতিহাস এদেশে ধনিক শ্রেণীর সুবর্ণ সময়ের ইতিহাস। নব্বইয়ের দশক থেকে কৃষি, মৎস্য, সিমেন্ট, সিরামিক, টিম্বার, চা ও পোশাক শিল্পে শুরু হয় বিপ্লব। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমতে থাকে ব্যাংকে। এর সঙ্গে যোগ হয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ছোটমানের এসব ধনীরা নতুন ফন্দিতে নেমে পড়ল। শিল্পকারখানা, গার্মেন্টস, হ্যাচারি, শিপ ব্রেকিংসহ নতুন নতুন শিল্প প্রজেক্ট নিয়ে হাজির হলো ব্যাংকে, বেশির ভাগ জাল দলিল অথবা ওভার ভ্যালুড করে ঋণের নামে নিয়ে গেল হাজার হাজার কোটি টাকা। ব্যতিক্রমী সৎ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আছেন এবং এদের কারণে এখনো ব্যাংক, আমদানি, রপ্তানি ও গার্মেন্টসসহ শিল্পকারখানা টিকে আছে। খেলাপিঋণগুলো ব্যাংক কর্মকর্তা ও অসাধু ঋণগ্রহীতাদের এক চমৎকার অসাধু ঋণ প্রক্রিয়ার অবধারিত ফসল।
এবার এরা নতুন চেহারায়, নতুন রূপে আবির্ভূত হলো। এর শুরু মূলত ২০০১ সালের ৪ দলীয় জোট সরকার ও ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ জমানায়। দলে দলে যোগ দিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগে। জীবনভর রাজনীতি করে উঠে আসা নেতাকর্মীদের সাইডলাইনে বসিয়ে রেখে সংসদে ঢুকে গেল এসব ঋণখেলাপিরা। দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দখল করল এসব ঋণখেলাপিরা। আওয়ামী লীগ আমলে দেখা গেল হাতেগোনা কয়েকজনের খেলাপির ঋণ দাঁড়াল লক্ষ-কোটি টাকা। এবার এরা দখল করা শুরু করল ব্যাংক। অভিযোগ হলো এস আলমের কাছ থেকে ঋণ উদ্ধারের পরিবর্তে তুলে দেয়া হয়েছে ৮টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদে বসানো হয়েছে নতুন নতুন মুখ। একপর্যায়ে দেখা গেল ব্যাংকমালিকদের মধ্যে কামড়াকামড়ি সব বেসরকারি ব্যাংকেই ছড়িয়ে পড়ল। অর্থনীতির ভাষায় এর নাম পুঁজিবাদী বা ধনবাদী সংকট। ৫ আগস্ট ছাত্রদের গণবিস্ফোরণের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না ঘটলেও অন্য কোন কারণে অন্য কোন তারিখে পতন ছিল অবধারিত। কারণ ব্যাংক মালিক, শিল্পমালিক, আমদানি-রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীরা পরস্পর বাজার, ব্যাংক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে পরস্পরের মাঝে ঝগড়া, বিত-া বা দলাদলিতে এমন সংকটের সৃষ্টি করল যে আওয়ামী লীগ সরকার এগোতে পারছিল না। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী চেহারা নিয়ে প্রকাশ্যে এল। প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া সে চলেই না। ইহার নাম বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার সংকট। এ ধরনের সংকটজনক অবস্থায় সামনে আসে কার্ল মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রসঙ্গ, অথবা কেইনসীয় ফর্মুলায় ধনতান্ত্রিক সংকট উত্তরণ। লেনিন বলেছিলেন রুশ ধনিক শ্রেণী নিজেদের মধ্যে যে সংকট সৃষ্টি করেছে তার সুযোগ নিয়ে বিপ্লবের এটাই উপযুক্ত সময়। সেনাবাহিনীকে সামনে নিয়ে লেনিন ৭ নভেম্বর ১৯১৭ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যের সঙ্গে সংঘটিত করে ইতিহাস বদলে দিলেন। বাংলাদেশে জুলাই ’২৪ এর বিক্ষোভ যদি লেনিনের মতো কোন নেতার আহ্বানো হতো এবং যদি সমাজ পরিবর্তনের ডাক দেয়া হতো তবে তা বিপ্লবী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গোটা পৃথিবীতে ওরকম কোন মার্ক্সবাদী বিপ্লবী পার্টি ও বিপ্লবী নেতার অস্তিত্ব আজ আর নেই।
আরব বসন্তে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শাসক পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্র বা সরকার বা শোষণ কাঠামোর কোনটাই পরিবর্তন হয়নি। তিউনিসিয়ার বু-আজিজির আত্মত্যাগ ষোলআনাই বৃথা গেছে। ছেলেদের রক্ত নব্বইয়ের মতো বৃথা যাওয়ার লক্ষণ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে ত্রিমাত্রিক সংকট সবসীমা অতিক্রম করেছে। দুর্নীতি, ব্যাংকিং নৈরাজ্য ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করে রাষ্ট্রকে অচলাবস্থায় নিক্ষেপ করেছিল। ব্যাংক মানে গরিব, নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের টাকায় বড় লোকদের পোদ্দারি। একপর্যায়ে তথাকথিত ব্যাংকমালিকরা মারামারি হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। এস আলমকে ৮-১০ ব্যাংক তুলে দেয়া কোন যুক্তিতে সমর্থনযোগ্য ছিল না। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল ব্যক্তি খাতের ওপর শেখ হাসিনা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। দুর্নীতির ব্যাপারে শুধু এটুকু বলা যায় সরকার দলীয় নেতা, আমলা, পুলিশ ও ঠিকাদার ব্যবসায়ীরা দুর্নীতির উল্লাসে মত্ত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছিল শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ লীগের আতি-পাতি গর্জে ওঠা লীগের নামে। এত হাইব্রিড আতি-পাতি নেতা বা লীগকে নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতা আওয়ামী লীগের ছিল না। এই লুটপাট হলো ক্ষমতাসীন ধনিক শ্রেণীর পারস্পরিক ঝগড়া বা অভ্যন্তরীণ সংকট। এর বাইরে আওয়ামী ধনিক শ্রেণীর সঙ্গে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতি ধনিকদের দ্বন্দ্ব তো ছিলই। বর্তমানে ৫২টি ব্যাংক।
শত শত গার্মেন্টস, শিপ ব্রেকিং, সিমেন্ট, স্টিলসহ হরেক রকমের শিল্পকারখানার মালিক হয়েছে আওয়ামী বড়লোকরা। ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি বাকিদের। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামীবিরোধী বড় লোকরা অসহিষ্ণু ও অস্থির হয়ে পড়েছিল। কোটা আন্দোলনকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন অতঃপর এক দফা আন্দোলনে পরিণত করার মূল কুশীলব আওয়ামীবিরোধী ধনিক শ্রেণী। ছাত্রদের পেছনে শক্তি জুগিয়েছে দুর্নীতি বিরোধিতা, ব্যাংকিং নৈরাজ্যবিরোধী ও আওয়ামী স্বেচ্ছাচারিতা বিরোধী ধনিক শ্রেণী। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সমাজ, সরকার ও অর্থব্যবস্থা অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়। বিদ্যমান শোষণভিত্তিক শাসন টিকিয়ে রাখতে হলে অন্তবর্তী শাসন নামক ব্যবস্থা জারি করে ধনিক শ্রেণী সংকট আপাত; উত্তরণে সক্ষম হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকেও কাছে ভবিষ্যতে বিদায় করে দেয়া হবে। গদি দখল করবে হয় বিএনপির বুর্জোয়া বা আওয়ামী বুর্জোয়ারা। কোটা আন্দোলন ও ৫ আগস্ট-পরবর্তী পর্বে নিহত আহত ছাত্র-জনতা শিশু ও পুলিশের রক্তদান দীর্ঘমেয়াদে বৃথাই গেছে। এসবের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হলো বড় দলগুলোই বলতে শুরু করেছে সংস্কার হোক বা না হোক সবার আগে চাই নির্বাচন এবং সিংহাসন। কেইনসের ফর্মুলা অনুযায়ী সরকারি অধিগ্রহণ বা অর্থায়ন ছাড়া দেউলিয়া ১০ ব্যাংককে বাঁচানো যাবে না। অর্থ উপদেষ্টার মতে, বাজার কাজ করছে না ও বিশৃঙ্খল বলে মূল্যস্ফীতি চরমে। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া বেসরকারি শিল্প খাত ও বাজার ব্যবস্থা ভারসাম্যে আনা অসম্ভব। দেখা যাক অর্থনীতির বিশ^নন্দিত অধ্যাপক প্রফেসর ইউনূস বুর্র্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার এই সংকট কীভাবে সামাল দেন।
[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ; অর্থশাস্ত্রের সাবেক প্রভাষক]