alt

উপ-সম্পাদকীয়

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক দেশের গবেষণা

মাহমুদুল হাসান মিল্টন

: সোমবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২৫

গবেষণা হলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু, যা একটি জাতির উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান বিশ্বে গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞান দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ বাংলাদেশ কি গবেষণার ক্ষেত্রে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দেখতে হবে দেশের গবেষণার বর্তমান অবস্থা, এর সীমাবদ্ধতা, এবং সম্ভাবনার দিক।

বাংলাদেশের গবেষণার ইতিহাস দীর্ঘ হলেও, এর উন্নয়ন এখনো কিছু বাধার সম্মুখীন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকলেও, গবেষণার মান এবং পরিধি আন্তর্জাতিকমানের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। গবেষণায় অর্থায়নের অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির সংকট, দক্ষ গবেষক তৈরির সীমাবদ্ধতা, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব এসব সমস্যার পেছনে কাজ করছে। বাংলাদেশ তার মোট জিডিপির মাত্র ০.৩ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করে। যেখানে উন্নত দেশগুলো, যেমনÑ দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল এবং জাপান তাদের জিডিপির ৩-৪ শতাংশ গবেষণায় বিনিয়োগ করে। এ ধরনের আর্থিক সীমাবদ্ধতা গবেষণার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে।

এদিকে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে গবেষণার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অৎঃরভরপরধষ ওহঃবষষরমবহপব), ব্লকচেইন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং ন্যানোটেকনোলজির মতো অগ্রগামী প্রযুক্তিগুলো গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার এখনও সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কৃষি, স্বাস্থ্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে ফসলের রোগ নির্ধারণ, স্বল্প খরচে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। কিন্তু এই সব সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার সঠিক দিকনির্দেশনা এবং গবেষণার প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন।

গবেষণার মান উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণামূলক পাঠক্রমের অভাব এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। অনেক শিক্ষার্থী গবেষণার প্রতি আগ্রহী হলেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। গবেষণার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ কর্মশালা, গবেষণার জন্য অনুদান, এবং গবেষকদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে নবীন গবেষকদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব প্রদান করলে শিক্ষার্থীরা গবেষণাকে পেশা হিসেবে নিতে অনুপ্রাণিত হবে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বড় হাতিয়ার। উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ গবেষণা, ফান্ডিং এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের গবেষণাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। যেমন, প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের গবেষণা কার্যক্রমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতা করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা উচিত। এছাড়া, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে যাতে তারা গবেষণায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

তবে গবেষণার উন্নয়নের পথে নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেমনÑ গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব এবং প্রতিভাবান গবেষকদের দেশান্তর। অনেক প্রতিভাবান গবেষক দেশে উপযুক্ত সুযোগের অভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেরও উদ্যোগ প্রয়োজন। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং দক্ষ গবেষক তৈরির জন্য গবেষণাভিত্তিক পাঠক্রম প্রবর্তন জরুরি।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গবেষণার মাধ্যমে প্রচুর সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণা করে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন, স্বাস্থ্য খাতে জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে রোগ নিরাময় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আইসিডিডিআরবি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। এছাড়া বাংলাদেশের গবেষকদের তৈরি বায়োডিজেল এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগ গবেষণার প্রতি নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে সাহায্য করবে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি। যেমন, নদীভাঙন রোধ, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব মোকাবিলা, এবং উষ্ণায়নের কারণে কৃষিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা নিরসনে কার্যকর প্রযুক্তি উদ্ভাবন প্রয়োজন। গবেষণার মাধ্যমেই এসব সমস্যার টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব।

গবেষণার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বাস্থ্য খাতে এর ব্যবহার। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে মহামারী প্রতিরোধ, টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা এবং রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গবেষণা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, করোনা মহামারীর সময় গবেষণার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং টিকা উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও গবেষণার ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শিক্ষাক্রম উন্নয়নে গবেষণার অবদান অতুলনীয়। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি পেলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়বে। যেমন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাগার উন্নত করে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার সুযোগ দেয়া যেতে পারে।

যুগোপযোগী গবেষণার জন্য শুধু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি নয়, বরং সঠিক নীতি এবং গবেষণার প্রতি জাতীয় অঙ্গীকারও অপরিহার্য। গবেষণার উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু তার অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান নয়, বরং বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে গবেষণার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।

গবেষণার এই যাত্রা সহজ নয়, তবে এটি অনিবার্য। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য গবেষণার ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সরকারের পাশাপাশি দেশের শিক্ষাবিদ, গবেষক, এবং শিল্প খাতের প্রতিনিধিদের একত্রে কাজ করতে হবে। গবেষণার উন্নয়নে জাতীয় অগ্রাধিকার প্রদান এবং আন্তর্জাতিক মান অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি। তাই, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক বাংলাদেশের গবেষণাÑ এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

কোথায় নাই কোটা?

ছবি

ও আমার স্বপ্ন ঝরা আকুল করা জন্মভূমি

ব্রেন রট: বর্তমান সময়ের এক মারাত্মক ব্যাধি

নির্মোহ ইতিহাস চর্চা ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়াসে শিক্ষা

জলবায়ুর পরিবর্তন ও দেশের ভবিষ্যৎ

প্রসঙ্গ : থিয়েটার ফর থেরাপির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পাঠ

শ্বেতপত্রে নতুন কী আছে?

ছবি

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও জুনো ভাইয়ের স্মৃতি

পরিবেশ সুরক্ষায় সার্কুলার ইকোনমি

বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন

ভাড়া ‘নির্ধারণ’ কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করবে কে?

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য কেমন ছিল ২০২৪ সাল?

স্বৈরাচারের শেষ নেই...

ছবি

স্মরণ : বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী

দোষারোপের রাজনীতি আর কত

জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার বিকাশে চাই বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা

যৌন নিপীড়ন প্রসঙ্গে

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা সফল হবে?

নতুন বছরের প্রত্যাশা

ছবি

মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে জেগে উঠি নতুন বছরে

দোষারোপের রাজনীতি আর কত

প্রশাসনিক সংকট ও ভবিষ্যতের করণীয়

ছবি

বিপ্লবী রাজনীতির কাণ্ডারি : কমরেড মণি সিংহ

স্বাস্ব্য সংস্কার : কী কী বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি

জনশিক্ষা, গণশিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষা : রাষ্ট্রসংস্কারের মৌলিক ভিত্তি

জাহাজ ভাঙা শিল্প ও পরিবেশ বিপর্যয়

ছিন্নমূল মানুষের ‘শীত-জীবন’

বিভাজিত তাবলিগ জামাতের দ্বন্দ্ব

কোন পথে দেশ?

অহেতুক মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কি লাভ হচ্ছে?

রম্যগদ্য : ‘অন্ডুল নাস্তি...’

অনিরাপদ সড়ক, সমাধান কোথায়?

চাই দৃশ্যমান পরিবর্তন

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশ নিয়ে ভাবনা

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন

ধনিক শ্রেণীর চলমান সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক দেশের গবেষণা

মাহমুদুল হাসান মিল্টন

সোমবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২৫

গবেষণা হলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু, যা একটি জাতির উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান বিশ্বে গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞান দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ বাংলাদেশ কি গবেষণার ক্ষেত্রে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দেখতে হবে দেশের গবেষণার বর্তমান অবস্থা, এর সীমাবদ্ধতা, এবং সম্ভাবনার দিক।

বাংলাদেশের গবেষণার ইতিহাস দীর্ঘ হলেও, এর উন্নয়ন এখনো কিছু বাধার সম্মুখীন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকলেও, গবেষণার মান এবং পরিধি আন্তর্জাতিকমানের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। গবেষণায় অর্থায়নের অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির সংকট, দক্ষ গবেষক তৈরির সীমাবদ্ধতা, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব এসব সমস্যার পেছনে কাজ করছে। বাংলাদেশ তার মোট জিডিপির মাত্র ০.৩ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করে। যেখানে উন্নত দেশগুলো, যেমনÑ দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল এবং জাপান তাদের জিডিপির ৩-৪ শতাংশ গবেষণায় বিনিয়োগ করে। এ ধরনের আর্থিক সীমাবদ্ধতা গবেষণার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে।

এদিকে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে গবেষণার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অৎঃরভরপরধষ ওহঃবষষরমবহপব), ব্লকচেইন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং ন্যানোটেকনোলজির মতো অগ্রগামী প্রযুক্তিগুলো গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার এখনও সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কৃষি, স্বাস্থ্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে ফসলের রোগ নির্ধারণ, স্বল্প খরচে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। কিন্তু এই সব সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার সঠিক দিকনির্দেশনা এবং গবেষণার প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন।

গবেষণার মান উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণামূলক পাঠক্রমের অভাব এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। অনেক শিক্ষার্থী গবেষণার প্রতি আগ্রহী হলেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। গবেষণার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ কর্মশালা, গবেষণার জন্য অনুদান, এবং গবেষকদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে নবীন গবেষকদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব প্রদান করলে শিক্ষার্থীরা গবেষণাকে পেশা হিসেবে নিতে অনুপ্রাণিত হবে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বড় হাতিয়ার। উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ গবেষণা, ফান্ডিং এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের গবেষণাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। যেমন, প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের গবেষণা কার্যক্রমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতা করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা উচিত। এছাড়া, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে যাতে তারা গবেষণায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

তবে গবেষণার উন্নয়নের পথে নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেমনÑ গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব এবং প্রতিভাবান গবেষকদের দেশান্তর। অনেক প্রতিভাবান গবেষক দেশে উপযুক্ত সুযোগের অভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেরও উদ্যোগ প্রয়োজন। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং দক্ষ গবেষক তৈরির জন্য গবেষণাভিত্তিক পাঠক্রম প্রবর্তন জরুরি।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গবেষণার মাধ্যমে প্রচুর সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণা করে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন, স্বাস্থ্য খাতে জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে রোগ নিরাময় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আইসিডিডিআরবি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। এছাড়া বাংলাদেশের গবেষকদের তৈরি বায়োডিজেল এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগ গবেষণার প্রতি নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে সাহায্য করবে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি। যেমন, নদীভাঙন রোধ, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব মোকাবিলা, এবং উষ্ণায়নের কারণে কৃষিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা নিরসনে কার্যকর প্রযুক্তি উদ্ভাবন প্রয়োজন। গবেষণার মাধ্যমেই এসব সমস্যার টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব।

গবেষণার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বাস্থ্য খাতে এর ব্যবহার। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে মহামারী প্রতিরোধ, টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা এবং রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গবেষণা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, করোনা মহামারীর সময় গবেষণার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং টিকা উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও গবেষণার ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শিক্ষাক্রম উন্নয়নে গবেষণার অবদান অতুলনীয়। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি পেলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়বে। যেমন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাগার উন্নত করে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার সুযোগ দেয়া যেতে পারে।

যুগোপযোগী গবেষণার জন্য শুধু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি নয়, বরং সঠিক নীতি এবং গবেষণার প্রতি জাতীয় অঙ্গীকারও অপরিহার্য। গবেষণার উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু তার অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান নয়, বরং বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে গবেষণার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।

গবেষণার এই যাত্রা সহজ নয়, তবে এটি অনিবার্য। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য গবেষণার ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সরকারের পাশাপাশি দেশের শিক্ষাবিদ, গবেষক, এবং শিল্প খাতের প্রতিনিধিদের একত্রে কাজ করতে হবে। গবেষণার উন্নয়নে জাতীয় অগ্রাধিকার প্রদান এবং আন্তর্জাতিক মান অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি। তাই, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক বাংলাদেশের গবেষণাÑ এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top