রহমান মৃধা
মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি বর্তমানে একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনসহ বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর কৌশলগত সম্পর্ক এবং উপস্থিতি গভীরভাবে যুক্ত। বাংলাদেশ যে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, তার কূটনৈতিক নীতি কীভাবে এই পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং কীভাবে রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতার বা কনফেডারেশনের প্রশ্নে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র কৌশলকে সামঞ্জস্য করতে পারে, তা নিয়ে একটি সুষম বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি বিশেষভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, তবে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতার ইস্যু বাংলাদেশের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ উত্থাপন করে:
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন: রোহিঙ্গারা, যারা বাংলাদেশের সীমানায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর একটি সুষ্ঠু এবং মানবিক উপায় বের করা।
ভারতের প্রভাব: ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশে প্রায়শই একটি আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে, বিশেষত রাখাইন পরিস্থিতি ঘিরে। ভারতের অবস্থান মিয়ানমারে রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এই দিক থেকে যে উদ্যোগ নিতে পারে তা হলো মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে একটি ত্রিপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা, যেখানে বাংলাদেশ রাখাইনের স্বাধীনতা কিংবা কনফেডারেশনের শর্তগুলো বিবেচনা করবে এবং সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি সমাধান করবে। এর জন্য চীন এবং ভারতকে সহায়ক ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
রাখাইনের স্বাধীনতার প্রশ্নটি বাংলাদেশকে খুবই সচেতন করে তুলছে, কারণ এই অঞ্চলের স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগণের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। তাই বাংলাদেশ যখন রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে, তখন তাকে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের অধিকার রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে।
চীন, যে মিয়ানমারের বড়তম আন্তর্জাতিক সহযোগী এবং বিনিয়োগকারী, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীনকেও বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাখাইন স্টেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের শর্তে যদি রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার ফিরে পায়, তবে তারা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের অধিকার বলতে বোঝানো হচ্ছে:
নাগরিকত্ব প্রদান: মিয়ানমারে তাদের পূর্ণ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি।
বাসস্থান ও সম্পত্তির অধিকার: তাদের পূর্বের ভূমি ও বাড়িঘর ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা।
নিরাপত্তা: রাখাইনে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব।
এই শর্তগুলো পূরণ হলে রোহিঙ্গারা তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হতে পারে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই অধিকারগুলো বাস্তবায়নে রাখাইনের নেতৃত্বকে রাজি করানোর লক্ষ্য রাখতে পারে। বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে এবং আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। বিশেষভাবে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতনের পর, রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের পরিস্থিতি যদি স্থিতিশীল হয়, তাহলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি এবং নিরাপত্তা কৌশলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পরিণত করেছে, যা আগামীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বড় পরীক্ষা হতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতনের ইঙ্গিত এবং রাখাইনে আঞ্চলিক শক্তির পালাবদল, বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি তার পররাষ্ট্র নীতি এবং নিরাপত্তা কৌশলকে দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে পারে, তবে শুধু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনই সম্ভব হবে না, বরং রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের প্রশ্নেও বাংলাদেশে অবস্থান পরিষ্কার হবে।
[লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]
রহমান মৃধা
শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫
মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি বর্তমানে একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনসহ বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর কৌশলগত সম্পর্ক এবং উপস্থিতি গভীরভাবে যুক্ত। বাংলাদেশ যে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, তার কূটনৈতিক নীতি কীভাবে এই পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং কীভাবে রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতার বা কনফেডারেশনের প্রশ্নে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র কৌশলকে সামঞ্জস্য করতে পারে, তা নিয়ে একটি সুষম বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি বিশেষভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, তবে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতার ইস্যু বাংলাদেশের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ উত্থাপন করে:
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন: রোহিঙ্গারা, যারা বাংলাদেশের সীমানায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর একটি সুষ্ঠু এবং মানবিক উপায় বের করা।
ভারতের প্রভাব: ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশে প্রায়শই একটি আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে, বিশেষত রাখাইন পরিস্থিতি ঘিরে। ভারতের অবস্থান মিয়ানমারে রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এই দিক থেকে যে উদ্যোগ নিতে পারে তা হলো মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে একটি ত্রিপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা, যেখানে বাংলাদেশ রাখাইনের স্বাধীনতা কিংবা কনফেডারেশনের শর্তগুলো বিবেচনা করবে এবং সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি সমাধান করবে। এর জন্য চীন এবং ভারতকে সহায়ক ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
রাখাইনের স্বাধীনতার প্রশ্নটি বাংলাদেশকে খুবই সচেতন করে তুলছে, কারণ এই অঞ্চলের স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগণের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। তাই বাংলাদেশ যখন রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে, তখন তাকে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের অধিকার রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে।
চীন, যে মিয়ানমারের বড়তম আন্তর্জাতিক সহযোগী এবং বিনিয়োগকারী, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীনকেও বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাখাইন স্টেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের শর্তে যদি রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার ফিরে পায়, তবে তারা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের অধিকার বলতে বোঝানো হচ্ছে:
নাগরিকত্ব প্রদান: মিয়ানমারে তাদের পূর্ণ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি।
বাসস্থান ও সম্পত্তির অধিকার: তাদের পূর্বের ভূমি ও বাড়িঘর ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা।
নিরাপত্তা: রাখাইনে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব।
এই শর্তগুলো পূরণ হলে রোহিঙ্গারা তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হতে পারে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই অধিকারগুলো বাস্তবায়নে রাখাইনের নেতৃত্বকে রাজি করানোর লক্ষ্য রাখতে পারে। বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে এবং আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। বিশেষভাবে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতনের পর, রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের পরিস্থিতি যদি স্থিতিশীল হয়, তাহলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি এবং নিরাপত্তা কৌশলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পরিণত করেছে, যা আগামীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বড় পরীক্ষা হতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতনের ইঙ্গিত এবং রাখাইনে আঞ্চলিক শক্তির পালাবদল, বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি তার পররাষ্ট্র নীতি এবং নিরাপত্তা কৌশলকে দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে পারে, তবে শুধু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনই সম্ভব হবে না, বরং রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের প্রশ্নেও বাংলাদেশে অবস্থান পরিষ্কার হবে।
[লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]