alt

উপ-সম্পাদকীয়

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

মিজানুর রহমান

: রোববার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ক্যাডার পদ্ধতি দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর সূত্রপাত ঘটে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই, যখন দেশের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৭ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাদের মধ্যে বিসিএস ক্যাডারের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ পদ্ধতির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার এবং অন্যান্য ক্যাডারগুলোর মধ্যে দায়িত্ব ও সুবিধার বণ্টনে। প্রশাসন ক্যাডারের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং অন্যান্য ক্যাডারগুলোর প্রতি বৈষম্য আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোকে দুর্বল করে তুলছে। এটি শুধু কর্মকর্তাদের হতাশা বাড়ায় না, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই প্রেক্ষিতে বিসিএস কাঠামোর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের বিসিএস কাঠামো মূলত ২৬টি ক্যাডারে বিভক্ত। এর মধ্যে সাধারণ ক্যাডার ১৩টি ও টেকনিক্যাল ক্যাডার ১৩টি। সাধারণ ক্যাডার ১৩ টি হলেও একমাত্র প্রশাসন ক্যাডার অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় বেশি ক্ষমতা এবং সুবিধা ভোগ করে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সাধারণ ও টেকনিক্যাল ক্যাডারের প্রায় সকল মন্ত্রণালয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করেন। প্রশ্ন হলোÑ তারা কিভাবে এত দ্রুত বিভিন্ন ক্ষেত্রের দক্ষতা অর্জন করেন? বাস্তবতা হলো, তারা বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ছাড়াই এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।

উদাহরণস্বরূপ- একজন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা কখনও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, কখনও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে, আবার কখনও কৃষি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। টেকনিক্যাল ক্যাডারে নিয়োগ দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের, তারা নিজ নিজ বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন। অথচ তাদেরকে বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয় চলে প্রশাসন ক্যাডারের মাধ্যমে। এর ফলে, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে।

বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞের অভাব আমাদের প্রশাসন কাঠামোকে দুর্বল করে তুলছে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোর দিকে তাকানো যেতে পারে। তাদের প্রশাসন কাঠামোতে ‘ন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস রিফর্ম’ নামে একটি মডেল রয়েছে, যা প্রশাসনিক দক্ষতা উন্নত করতে এবং ক্যাডারগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ভারতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করেন। এটি তাদের প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে তুলেছে। একইভাবে জাপানের প্রশাসন কাঠামোতে পেশাভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণস্বরূপ- জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষাবিদদের নিয়োগ দেওয়া হয়, যা তাদের নীতি-নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে তোলে। অথচ আমাদের দেশে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অভাবে প্রশাসন কাঠামো অনেক সময় অকার্যকর হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় অন্যান্য ক্যাডারগুলোর কর্মকর্তারা তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। প্রমোশন, বদলি, প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে আর্থিক বাজেট বণ্টন পর্যন্ত সবকিছুতেই প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এটি অন্যান্য ক্যাডারগুলোর কর্মকর্তাদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক কাঠামোর দক্ষতাকে হ্রাস করছে।

উদাহরণস্বরূপ- গবেষণা এবং বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে যে শিক্ষা ক্যাডার বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের পেশাগত কাজে সরাসরি অবদান রাখলেও তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয় না। একটি সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে যে এ ধরনের কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ মনে করেন, প্রশাসনিক কাঠামোর বৈষম্যের কারণে তাদের পেশাগত উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে, এসব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একই বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে পদোন্নতির বৈষম্য একটি গুরুতর সমস্যা। কেউ চার বছরে উচ্চ পদে উন্নীত হয়, আর কেউ আট-দশ বছরেও একই পদে আটকে থাকে। কেউ শূন্য পদ না থাকলেও পদোন্নতি পাচ্ছে আর কেউ শূন্য পদের অভাবে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জনের পরেও প্রশাসন ক্যাডারের অযথা সময় ক্ষেপণের কারণে পদোন্নতি পায় না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এই বৈষম্যের ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে এবং তাদের কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধানে প্রমোশন ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ করতে হবে। প্রমোশন যেন দক্ষতা এবং কাজের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

উদাহরণস্বরূপ- ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়সীমা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। ‘ইন্ডিয়া অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুসরণ করে, যা অন্যান্য ক্যাডারের জন্য উদাহরণ হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রশাসন ক্যাডার অধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তারা দ্রুত পদোন্নতি পাচ্ছেন, অন্য ক্যাডারের প্রশিক্ষণের সুযোগ নিজেরা ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন, পরিবহন সুবিধা, ড্রাইভার ও গাড়ি মেইটেন্যান্স সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা এক বছরে যা পান একই বিসিএসের অন্য ক্যাডারের কোন কর্মকর্তা তা দশ বছরেও পান না। অন্যদিকে, অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছেন। অনেক ক্যাডারের গাড়ির প্রয়োজন হলেও তারা গাড়ি কিনতে পারে না, নিজস্ব ফান্ডের টাকা খরচ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি গাড়ি কিনতে চাইলেও সে অনুমতি মিলে না। অথচ বিগত কয়েকটি নির্বাচনের পূর্বে প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও প্রশাসন ক্যাডারেরে বড় কর্তাদের তুষ্ট করার জন্য সরকারের পক্ষ হতে গাড়ি বিলাস উপহার দেয়া হয় দীর্ঘদিন কিভাবে অনির্বাচিতভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় তার রোডম্যাপ করার বিনিময়ে।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন বিভিন্ন সরকার প্রশাসন ক্যাডারকে অধিক সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা প্রদান করে। এর উত্তর জনগণের নিকট বর্তমানে অত্যান্ত পরিষ্কার, তা হলো এই ক্যাডারের মাধ্যমেই নির্বাচিত সরকাররা গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। তারা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেয়ে জনবিরোধী পলিসি প্রণয়নে অধিক মনযোগী হয়ে উঠে। কিভাবে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় তার মাস্টারপ্ল্যান করা এই ক্যাডারের একটি অন্যতম গোপন দায়িত্ব। এর বিনিময়ে তারা ভোগ করেন সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা।

বিসিএস কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন সম্ভব। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে পেশাভিত্তিক ক্যাডারের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ নিশ্চিত করা একটি সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধান্ত হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ- ভারতের ‘ন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস রিফর্ম’ মডেল থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে, যেখানে বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নিয়োগের মাধ্যমে নীতি-নির্ধারণ এবং বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। একইভাবে, সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশাসনিক কাঠামোতেও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে সাফল্য এসেছে।

বর্তমান সরকারের কাছে সময়ের দাবি এই যে, প্রমোশন, বদলি এবং অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা আনার জন্য স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। একজন কর্মকর্তার প্রমোশন যেন তার দক্ষতা এবং কাজের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। একইসঙ্গে প্রশিক্ষণ, আর্থিক সুবিধা এবং কর্মক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করলে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কমে আসবে। এছাড়াও একটি কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রশাসন ক্যাডার এবং অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।

এর জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করে তাদের ন্যায্য পাওনা মূল্যায়ন করবে। এই ধরনের কমিশন ইতোমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো দেশগুলোতে সফলভাবে কাজ করছে। বিসিএস কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও কার্যকর, দক্ষ এবং গণমুখী করা সম্ভব। এটি করতে পারলে দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের জন্য আরও কার্যকর সেবা নিশ্চিত হবে। আশা করি, বর্তমান সরকার এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

[লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, গাইবান্ধা সরকারি কলেজ]

আদিবাসীদের প্রাণের স্পন্দন

ছবি

ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক

কৃতিত্ব অস্বীকারের অপসংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ : স্যালাইনে ফাঙ্গাস, অসহায় মানুষ

ছবি

আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অঙ্গীকার : বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য

এইচএমপিভি ভাইরাস : প্রয়োজন জনসচেতনতা

কেন দ্যাখাও মিথ্যে স্বপ্ন

অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও সড়ক দুর্ঘটনা

অপরিকল্পিত ভ্যাট ও কর বৃদ্ধি

ছবি

‘বেগমপাড়া’ হইতে খোলা চিঠি

সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানবে কে

মকর সংক্রান্তি : বাঙালির উৎসব ও ঐতিহ্যের ধারক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : অপসংস্কৃতি ও নৈতিক প্রশ্ন

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কূটতর্ক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

রজিনাদের বেঁচে থাকার লড়াই

মানব পাচার প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

সংবিধান সংশোধন : আমাদের বলার আছে

চিন্তা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা

গ্রাম উন্নয়নে যুব সমাজের ভূমিকা

‘দেশজ নাট্যশৈলী’র কেন্দ্রীয় নাট্যআঙ্গিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ও কিছু প্রশ্ন

রাখাইন পরিস্থিতি : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির বড় পরীক্ষা

রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব

রম্যগদ্য : নিশুতিরাতের আগন্তুক

গুরু রবিদাস জির কথা

গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের জন্য অশনিসংকেত

নতুন বছরের প্রত্যাশা

নৈতিকতা, শিক্ষা ও উন্নয়ন: আমাদের মুক্তির পথ

কোথায় নাই কোটা?

ছবি

ও আমার স্বপ্ন ঝরা আকুল করা জন্মভূমি

ব্রেন রট: বর্তমান সময়ের এক মারাত্মক ব্যাধি

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক দেশের গবেষণা

নির্মোহ ইতিহাস চর্চা ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়াসে শিক্ষা

জলবায়ুর পরিবর্তন ও দেশের ভবিষ্যৎ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

মিজানুর রহমান

রোববার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ক্যাডার পদ্ধতি দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর সূত্রপাত ঘটে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই, যখন দেশের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৭ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাদের মধ্যে বিসিএস ক্যাডারের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ পদ্ধতির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার এবং অন্যান্য ক্যাডারগুলোর মধ্যে দায়িত্ব ও সুবিধার বণ্টনে। প্রশাসন ক্যাডারের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং অন্যান্য ক্যাডারগুলোর প্রতি বৈষম্য আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোকে দুর্বল করে তুলছে। এটি শুধু কর্মকর্তাদের হতাশা বাড়ায় না, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই প্রেক্ষিতে বিসিএস কাঠামোর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের বিসিএস কাঠামো মূলত ২৬টি ক্যাডারে বিভক্ত। এর মধ্যে সাধারণ ক্যাডার ১৩টি ও টেকনিক্যাল ক্যাডার ১৩টি। সাধারণ ক্যাডার ১৩ টি হলেও একমাত্র প্রশাসন ক্যাডার অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় বেশি ক্ষমতা এবং সুবিধা ভোগ করে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সাধারণ ও টেকনিক্যাল ক্যাডারের প্রায় সকল মন্ত্রণালয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করেন। প্রশ্ন হলোÑ তারা কিভাবে এত দ্রুত বিভিন্ন ক্ষেত্রের দক্ষতা অর্জন করেন? বাস্তবতা হলো, তারা বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ছাড়াই এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।

উদাহরণস্বরূপ- একজন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা কখনও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, কখনও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে, আবার কখনও কৃষি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। টেকনিক্যাল ক্যাডারে নিয়োগ দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের, তারা নিজ নিজ বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন। অথচ তাদেরকে বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয় চলে প্রশাসন ক্যাডারের মাধ্যমে। এর ফলে, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে।

বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞের অভাব আমাদের প্রশাসন কাঠামোকে দুর্বল করে তুলছে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোর দিকে তাকানো যেতে পারে। তাদের প্রশাসন কাঠামোতে ‘ন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস রিফর্ম’ নামে একটি মডেল রয়েছে, যা প্রশাসনিক দক্ষতা উন্নত করতে এবং ক্যাডারগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ভারতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করেন। এটি তাদের প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে তুলেছে। একইভাবে জাপানের প্রশাসন কাঠামোতে পেশাভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণস্বরূপ- জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষাবিদদের নিয়োগ দেওয়া হয়, যা তাদের নীতি-নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে তোলে। অথচ আমাদের দেশে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অভাবে প্রশাসন কাঠামো অনেক সময় অকার্যকর হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় অন্যান্য ক্যাডারগুলোর কর্মকর্তারা তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। প্রমোশন, বদলি, প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে আর্থিক বাজেট বণ্টন পর্যন্ত সবকিছুতেই প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এটি অন্যান্য ক্যাডারগুলোর কর্মকর্তাদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক কাঠামোর দক্ষতাকে হ্রাস করছে।

উদাহরণস্বরূপ- গবেষণা এবং বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে যে শিক্ষা ক্যাডার বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের পেশাগত কাজে সরাসরি অবদান রাখলেও তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয় না। একটি সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে যে এ ধরনের কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ মনে করেন, প্রশাসনিক কাঠামোর বৈষম্যের কারণে তাদের পেশাগত উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে, এসব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একই বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে পদোন্নতির বৈষম্য একটি গুরুতর সমস্যা। কেউ চার বছরে উচ্চ পদে উন্নীত হয়, আর কেউ আট-দশ বছরেও একই পদে আটকে থাকে। কেউ শূন্য পদ না থাকলেও পদোন্নতি পাচ্ছে আর কেউ শূন্য পদের অভাবে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জনের পরেও প্রশাসন ক্যাডারের অযথা সময় ক্ষেপণের কারণে পদোন্নতি পায় না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এই বৈষম্যের ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে এবং তাদের কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধানে প্রমোশন ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ করতে হবে। প্রমোশন যেন দক্ষতা এবং কাজের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

উদাহরণস্বরূপ- ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়সীমা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। ‘ইন্ডিয়া অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুসরণ করে, যা অন্যান্য ক্যাডারের জন্য উদাহরণ হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রশাসন ক্যাডার অধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তারা দ্রুত পদোন্নতি পাচ্ছেন, অন্য ক্যাডারের প্রশিক্ষণের সুযোগ নিজেরা ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন, পরিবহন সুবিধা, ড্রাইভার ও গাড়ি মেইটেন্যান্স সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা এক বছরে যা পান একই বিসিএসের অন্য ক্যাডারের কোন কর্মকর্তা তা দশ বছরেও পান না। অন্যদিকে, অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছেন। অনেক ক্যাডারের গাড়ির প্রয়োজন হলেও তারা গাড়ি কিনতে পারে না, নিজস্ব ফান্ডের টাকা খরচ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি গাড়ি কিনতে চাইলেও সে অনুমতি মিলে না। অথচ বিগত কয়েকটি নির্বাচনের পূর্বে প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও প্রশাসন ক্যাডারেরে বড় কর্তাদের তুষ্ট করার জন্য সরকারের পক্ষ হতে গাড়ি বিলাস উপহার দেয়া হয় দীর্ঘদিন কিভাবে অনির্বাচিতভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় তার রোডম্যাপ করার বিনিময়ে।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন বিভিন্ন সরকার প্রশাসন ক্যাডারকে অধিক সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা প্রদান করে। এর উত্তর জনগণের নিকট বর্তমানে অত্যান্ত পরিষ্কার, তা হলো এই ক্যাডারের মাধ্যমেই নির্বাচিত সরকাররা গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। তারা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেয়ে জনবিরোধী পলিসি প্রণয়নে অধিক মনযোগী হয়ে উঠে। কিভাবে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় তার মাস্টারপ্ল্যান করা এই ক্যাডারের একটি অন্যতম গোপন দায়িত্ব। এর বিনিময়ে তারা ভোগ করেন সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা।

বিসিএস কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন সম্ভব। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে পেশাভিত্তিক ক্যাডারের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ নিশ্চিত করা একটি সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধান্ত হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ- ভারতের ‘ন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস রিফর্ম’ মডেল থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে, যেখানে বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নিয়োগের মাধ্যমে নীতি-নির্ধারণ এবং বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। একইভাবে, সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশাসনিক কাঠামোতেও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে সাফল্য এসেছে।

বর্তমান সরকারের কাছে সময়ের দাবি এই যে, প্রমোশন, বদলি এবং অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা আনার জন্য স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। একজন কর্মকর্তার প্রমোশন যেন তার দক্ষতা এবং কাজের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। একইসঙ্গে প্রশিক্ষণ, আর্থিক সুবিধা এবং কর্মক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করলে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কমে আসবে। এছাড়াও একটি কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রশাসন ক্যাডার এবং অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।

এর জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করে তাদের ন্যায্য পাওনা মূল্যায়ন করবে। এই ধরনের কমিশন ইতোমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো দেশগুলোতে সফলভাবে কাজ করছে। বিসিএস কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও কার্যকর, দক্ষ এবং গণমুখী করা সম্ভব। এটি করতে পারলে দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের জন্য আরও কার্যকর সেবা নিশ্চিত হবে। আশা করি, বর্তমান সরকার এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

[লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, গাইবান্ধা সরকারি কলেজ]

back to top