গৌতম রায়
গত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ডাক্তার অভিজিৎ তরফদার ‘মহাজাগতিক’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট, পর্যায়ক্রম ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের নেফ্রলজি বিভাগ। সেখানেই প্রসঙ্গক্রমে এসেছিল স্যালাইন ঘিরে নানা ধরনের বিষয়। ডেট ওভার হয়ে যাওয়া স্যালাইনে ছত্রাক এবং তা থেকে রোগীর শরীরের সংক্রমণ। রোগীর প্রাণ সংশয়Ñ এই সমস্ত বিষয়গুলি উঠে এসেছিল অভিজিৎ বাবুর সেই উপন্যাসে। উপন্যাসটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পরবর্তীকালে কলকাতার কোনও একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সেই উপন্যাস অবলম্বনে একটি দীর্ঘ টেলি সিরিয়াল নির্মাণ করেছিল এবং সেই টেলি সিরিয়ালটিও খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
গত কয়েক দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন ঘিরে যে সমস্ত কা-কারখানা ঘটে চলেছে, তা দেখে যেন মনে হচ্ছে, অভিজিৎ তরফদারের সেই উপন্যাসটি বাস্তবে একেবারে অভিনীত হয়ে চলেছে। খবরের কাগজের রিপোর্টে বেরিয়েছে,সমাজ মাধ্যমে আমরা দেখেছি, সেই ডেট ফুরিয়ে যাওয়া, ছত্রাক যুক্ত স্যালাইন ব্যবহারে একাধিক প্রসূতি এবং শিশু অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একজন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ দুজন মাকে মুখ রক্ষার্থে রাজ্য প্রশাসন গ্রীণ করিডোর তৈরি করে কলকাতার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। এখনো পর্যন্ত জানতে পারে যাচ্ছে যে, ছত্রাকযুক্ত স্যালাইন ব্যবহারে জেরে বেশ কিছু প্রসূতি এবং সদ্যোজাত শিশু মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা লড়ছে।
স্যালাইন ঘিরে এই যে কর্মকা- চলছে তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা, বিশেষ করে যুব বামপন্থিরা প্রাণপণ প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে এত বড় একটা কেলেঙ্কারিকে ঢাকবার জন্য যেভাবে কার্যত প্রতিযোগিতা চলছে, সেই ব্যবস্থার বিবরণে বোধ হয়, বাংলা শব্দমালার কোনও শব্দই আর পর্যাপ্ত নয়। সেই স্যালাইন তৈরি বা সময় ফুরিয়ে যাওয়া স্যালাইন সরবরাহ, সমস্ত কিছুকে ঘিরে ভয়াবহ বেনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সেই সমস্ত বেনিয়মের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংযোগ ঘিরে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। রাজ্যে যে রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের কেষ্ট-বিষ্টুদের সঙ্গে ওইসব কেলেঙ্কারি সঙ্গে যুক্ত লোকেদের সংযোগ ঘিরে নানা ধরনের অভিযোগ উঠছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটিকে ঘিরে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনও ভূমিকা গ্রহণ করা হয়নি।
রাজ্য সরকার, যাদের কর্মকা-ের সঙ্গে এই স্যালাইন কেলেঙ্কারির সংযোগ রয়েছে বলে বিরোধী বামপন্থিরা অভিযোগ করছেন, সেই রাজ্য সরকারেরই অধীনস্থ সিআইডির ওপর দেয়া হয়েছে গোটা কেলেঙ্কারি তদন্ত ভার বেশ কয়েক দিন চলে গেছে। এখনো পর্যন্ত তদন্তের প্রাথমিক গতিপ্রকৃতি কি, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছু জানতে পারছে না। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বশংবদ কিছু সংবাদপত্রকে প্রতিদিন প্রায় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। ফলে একটা দুটো সংবাদপত্র ব্যতীত পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সবকটি প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যাপারটিকে যতটা তরলভাবে দেখাতে পারা যায়, তার জন্য কার্যত প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে কার্যত সরকার ভাজনাকারী সংবাদমাধ্যমগুলোকে আর নিজেদের পকেটের পয়সা খরচা করে সংবাদপত্র পরিচালনা করতে হয় না। কারণ সরকারের প্রোপাগা-া করবার জন্য রাজ্য সরকার যে হারে বিজ্ঞাপন, তাদের পছন্দের সংবাদপত্রগুলোতে দেয়, সেই বিজ্ঞাপনের টাকা থেকেই এখন সরকার পছন্দ খবরের কাগজ গুলি, তাদের খবরে কাগজ চালানোর যাবতীয় খরচা তুলে ফেলতে পারে।
ছত্রাকযুক্ত নানা ধরনের স্যালাইন ব্যবহারের জেরে যে সমস্ত প্রসূতিরা এখন কলকাতার সব থেকে নামি সরকারি হাসপাতাল, এসএসকেএমে কার্যতম মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, তাদের শারীরিক অবস্থা ক্রমশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলা যায় মাল্টি অর্গান ফেলিওর, সেই দিকেই রোগীরা যাচ্ছে বলে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসকেরা অনুমান করছেন। এই অবস্থার ভেতরে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই স্যালাইন কেলেঙ্কারি ঘিরে এখনো পর্যন্ত কোনও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
কার্যত পশ্চিমবঙ্গে এখন যে কোনও কেলেঙ্কারি ব্যাপারটাই সিআইডি বনাম সিবিআই এর একটা চোর পুলিশের খেলায় পরিণত হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ শাসনকালে যে দুই একটা লোক দেখানো বিচার বিভাগীয় কমিশন তৈরি করা হয়েছিল বিগত বামফ্রন্ট সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করবার তাগিদে, সেই কমিশন গুলি বছরের পর বছর,সাধারণ নাগরিকদের করের টাকায় পরিচালিত হলেও, আজ পর্যন্ত কোনও রকম প্রতিবেদন পেশ করতে সক্ষম হয়নি। অতীতে কংগ্রেস আমলে বা বামফ্রন্ট আমলে কোনও বিচার বিভাগীয় কমিশনের এত দীর্ঘসূত্রিতা আমরা দেখিনি। বস্তুত এই সমস্ত বিচার বিভাগীয় কমিশনগুলিকেই ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থিদের প্রতি তার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার তাগিদেই তৈরি করেছিলেন। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ব্যক্তিগতভাবে হেনস্তা করবার জন্য সেই কমিশনে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পর্যন্ত করা হয়েছিল; কিন্তু মমতার যাবতীয় অভিযোগের বিন্দুমাত্র কোনও সারবর্তা না থাকায়, সরকারের যথেষ্ট প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো অবস্থাতেই, বুদ্ধদেব বাবুসহ বামফ্রন্ট সরকারের আমলের একজনও মন্ত্রী, বিধায়ক সাংসদের গায়ে সেই সমস্ত বিচার বিভাগীয় কমিশনগুলি একটি কালির ছিটে পর্যন্ত লাগাতে সক্ষম হয়নি।
কত ১৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দপ্তরটি খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। তাছাড়াও আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর মুখ্যমন্ত্রীর হাতে রয়েছে। এই ১৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা ঠিক কোন জায়গায় চলে গেছে, সেটা যাঁরা এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে পরিচিত হননি, তার বাইরের মানুষজন বুঝতে পারবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই পশ্চিমবঙ্গে একাধিক হাসপাতাল, যেগুলোতে কোনও পরিকাঠামো নেই, সেগুলিকে উনি রাজনৈতিক ফায়দা তোলবার অভিপ্রায়ে, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন। মজার কথা হলো- এই সমস্ত হাসপাতালগুলোতে ঝাঁ চকচকে বাড়ি হয়েছে। নীল সাদা রং হয়েছে। বাড়ি, সেই বাড়ি রং ইত্যাদির পিছনে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সংযুক্ত লোকজনদের পকেট ভারী হয়েছে। কিন্তু কখনও কোনো অবস্থাতেই স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বাড়ানোর দিকে কোনরকম লক্ষ্য নজর দেওয়া হয়নি।
সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের বেনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার পাশাপাশি ডাক্তার থেকে শুরু করে, নার্স থেকে শুরু করে, স্বাস্থ্য পরিসেবক থেকে শুরু করে, সাধারণ কর্মী, করণিকÑ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বল্গাহীন দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্তরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটিকে একেবারে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় মেশিন আছে তো কর্মী নেই। কর্মী আছে তো মেশিন নেই।
অযোগ্য কর্মী, অযোগ্য ডাক্তার বহু ক্ষেত্রে সরকারি পরিষেবার মধ্যে সংযুক্ত হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ। ফলে অতি সাধারণ গরিব মানুষও এখন খুব বেকায়দায় না পড়লে আর সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনো রকম সুযোগ নিতে চায় না।
অপরপক্ষে কয়েক বছর হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ্মান ভারত ব্যবস্থার সঙ্গে টক্কর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড চালু করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য সাথী কার্ড এর আওতাভুক্ত মানুষদের বিমার আওতায় আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে কখনো কোনো রকম আর্থিক মানদন্ড কার্ডধারী মানুষদের ক্ষেত্রে আরোপ করা হয়নি। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসক তৃণমূলের কাছের লোকেরাই এই কার্ডের সুযোগ পাচ্ছে। বিত্তবানেরা এই কার্ডের সুযোগ পাচ্ছে। সত্যিকারের গরিব মানুষ, গরিব মুসলমান, গরিব ক্রিশ্চিয়ান, আদিবাসী,তপশিলি জাতি-উপজাতিভুক্ত মানুষ, অন্যান্য দলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষ, তারা শাসকদলের আওতার মধ্যে না থাকলেই কোনও অবস্থাতেই এই কার্ড পাওয়ার অধিকারী হচ্ছে না।
সেই সঙ্গে এই কার্ড ঘিরে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ প্রাইভেট নার্সিংহোমগুলোতে চলছে একটা ভয়াবহ আর্থিক দুর্নীতি। প্রায় বেশিরভাগ শাসক ঘনিষ্ঠ প্রাইভেট নার্সিংহোম, হসপিটালগুলো এই কার্ডের ব্যবহার করে লাখ-লাখ, কোটি-কোটি টাকার সরকারি কোষাগার লুট করছে। সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পৌঁছলে, সেই সমস্ত হাসপাতাল বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্বন্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ফলে সাধারণ মানুষ গরিব মানুষ, যারা কোনো রকমভাবে সামাজিক শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত নয়, ক্ষতাবান নয় এইরকম মানুষ, তারা এক ভয়াবহ সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
আর সেই সংকটেরই ফলশ্রুতি হচ্ছে এই ধরনের স্যালাইন কেলেঙ্কারিসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি। আরজি কর হাসপাতালে যে কর্মরতা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে, সেই ঘটনার পেছনেও কিন্তু নানা ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির আভাস ঘিরে মানুষের মনে সন্দেহ রয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে স্বাস্থ্য দুর্নীতি একটা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন পূর্ণ সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে বিগত ১৪ বছর ধরে নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়াতে নানা ধরনের প্রথাগত সংকট তৈরি হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যস্ততা হেতু এবং একইসঙ্গে ভূমি সংস্কার, সংখ্যালঘু উন্নয়ন সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর তার হাতে থাকার দরুণ স্বাস্থ্য দপ্তরে তিনি কতখানি মনোযোগ অর্পণ করতে পারছেন, তা নিয়ে বহু ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা উঠে আসছে যে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাজনিত যে সমস্ত সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী সময় দিতে পারছেন না বলে, গোটা ব্যাপারটা কি প্রতিমন্ত্রীর ওপরেই সবটা সামলাবার দায়িত্ব পড়েছে? স্বাস্থ্য দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ আমলাদের মধ্যে শাসক নিয়ন্ত্রিত ডাক্তার বাবুদের কোটারি এবং সিন্ডিকেট রাজ আজকে এমন একটা অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে, যার জেরে শাসক তৃণমূলের মধ্যেই গৃহযুদ্ধের পরিবেশ ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে।
যে শান্তনু সেন পেশায় একজন চিকিৎসক, তাকে একটা সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিলেন, আরজি কর কা-ে তিনি কিছু বেসুরো কথা বলাতেÑ একদা তৃণমূলের সেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংক্রান্ত দোর্দ- প্রতাপ নেতাকে তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহূর্তে সাসপেন্ড করেছে।
শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ প্রত্যেকটি বিষয়, যেগুলো সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত, সেই জায়গাগুলো আজ পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা ভয়ংকর বললেও খুব কম বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এখন বেসরকারি হাতে। সরকারি স্কুলগুলোতে, কলেজগুলোতে সাধারণ মানুষের করের টাকায় মাস্টার মশাইদের মাইনে হচ্ছে। নানা ধরনের শিক্ষা সামগ্রী কেনা হচ্ছে। বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। সংস্কার হচ্ছে। রং হচ্ছে; কিন্তু ছাত্র প্রায় নেই বললেই চলে। সমস্ত ভিড়টা গিয়ে জড়ো হয়েছে বেসরকারি শিক্ষা মাধ্যমগুলোতে। সেটা স্কুলের ক্ষেত্রেই হোক, কিংবা কলেজের ক্ষেত্রেই হোক। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এই ক্ষেত্রগুলোতে যেভাবে বেসরকারিকরণের প্রতি রাজ্য সরকার সমস্ত ধরনের মনোনিবেশ এবং ছাড়পত্র অর্পণ করেছেন, তাতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা সমস্ত কিছুতেই এখন মেধার কোনো দাম নেই। দাম হচ্ছে একমাত্র যার পকেটে যত টাকা আছে সেই টাকার।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
রোববার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫
গত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ডাক্তার অভিজিৎ তরফদার ‘মহাজাগতিক’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট, পর্যায়ক্রম ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের নেফ্রলজি বিভাগ। সেখানেই প্রসঙ্গক্রমে এসেছিল স্যালাইন ঘিরে নানা ধরনের বিষয়। ডেট ওভার হয়ে যাওয়া স্যালাইনে ছত্রাক এবং তা থেকে রোগীর শরীরের সংক্রমণ। রোগীর প্রাণ সংশয়Ñ এই সমস্ত বিষয়গুলি উঠে এসেছিল অভিজিৎ বাবুর সেই উপন্যাসে। উপন্যাসটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পরবর্তীকালে কলকাতার কোনও একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সেই উপন্যাস অবলম্বনে একটি দীর্ঘ টেলি সিরিয়াল নির্মাণ করেছিল এবং সেই টেলি সিরিয়ালটিও খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
গত কয়েক দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন ঘিরে যে সমস্ত কা-কারখানা ঘটে চলেছে, তা দেখে যেন মনে হচ্ছে, অভিজিৎ তরফদারের সেই উপন্যাসটি বাস্তবে একেবারে অভিনীত হয়ে চলেছে। খবরের কাগজের রিপোর্টে বেরিয়েছে,সমাজ মাধ্যমে আমরা দেখেছি, সেই ডেট ফুরিয়ে যাওয়া, ছত্রাক যুক্ত স্যালাইন ব্যবহারে একাধিক প্রসূতি এবং শিশু অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একজন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ দুজন মাকে মুখ রক্ষার্থে রাজ্য প্রশাসন গ্রীণ করিডোর তৈরি করে কলকাতার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। এখনো পর্যন্ত জানতে পারে যাচ্ছে যে, ছত্রাকযুক্ত স্যালাইন ব্যবহারে জেরে বেশ কিছু প্রসূতি এবং সদ্যোজাত শিশু মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা লড়ছে।
স্যালাইন ঘিরে এই যে কর্মকা- চলছে তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা, বিশেষ করে যুব বামপন্থিরা প্রাণপণ প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে এত বড় একটা কেলেঙ্কারিকে ঢাকবার জন্য যেভাবে কার্যত প্রতিযোগিতা চলছে, সেই ব্যবস্থার বিবরণে বোধ হয়, বাংলা শব্দমালার কোনও শব্দই আর পর্যাপ্ত নয়। সেই স্যালাইন তৈরি বা সময় ফুরিয়ে যাওয়া স্যালাইন সরবরাহ, সমস্ত কিছুকে ঘিরে ভয়াবহ বেনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সেই সমস্ত বেনিয়মের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংযোগ ঘিরে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। রাজ্যে যে রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের কেষ্ট-বিষ্টুদের সঙ্গে ওইসব কেলেঙ্কারি সঙ্গে যুক্ত লোকেদের সংযোগ ঘিরে নানা ধরনের অভিযোগ উঠছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটিকে ঘিরে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনও ভূমিকা গ্রহণ করা হয়নি।
রাজ্য সরকার, যাদের কর্মকা-ের সঙ্গে এই স্যালাইন কেলেঙ্কারির সংযোগ রয়েছে বলে বিরোধী বামপন্থিরা অভিযোগ করছেন, সেই রাজ্য সরকারেরই অধীনস্থ সিআইডির ওপর দেয়া হয়েছে গোটা কেলেঙ্কারি তদন্ত ভার বেশ কয়েক দিন চলে গেছে। এখনো পর্যন্ত তদন্তের প্রাথমিক গতিপ্রকৃতি কি, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছু জানতে পারছে না। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বশংবদ কিছু সংবাদপত্রকে প্রতিদিন প্রায় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। ফলে একটা দুটো সংবাদপত্র ব্যতীত পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সবকটি প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যাপারটিকে যতটা তরলভাবে দেখাতে পারা যায়, তার জন্য কার্যত প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে কার্যত সরকার ভাজনাকারী সংবাদমাধ্যমগুলোকে আর নিজেদের পকেটের পয়সা খরচা করে সংবাদপত্র পরিচালনা করতে হয় না। কারণ সরকারের প্রোপাগা-া করবার জন্য রাজ্য সরকার যে হারে বিজ্ঞাপন, তাদের পছন্দের সংবাদপত্রগুলোতে দেয়, সেই বিজ্ঞাপনের টাকা থেকেই এখন সরকার পছন্দ খবরের কাগজ গুলি, তাদের খবরে কাগজ চালানোর যাবতীয় খরচা তুলে ফেলতে পারে।
ছত্রাকযুক্ত নানা ধরনের স্যালাইন ব্যবহারের জেরে যে সমস্ত প্রসূতিরা এখন কলকাতার সব থেকে নামি সরকারি হাসপাতাল, এসএসকেএমে কার্যতম মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, তাদের শারীরিক অবস্থা ক্রমশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলা যায় মাল্টি অর্গান ফেলিওর, সেই দিকেই রোগীরা যাচ্ছে বলে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসকেরা অনুমান করছেন। এই অবস্থার ভেতরে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই স্যালাইন কেলেঙ্কারি ঘিরে এখনো পর্যন্ত কোনও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
কার্যত পশ্চিমবঙ্গে এখন যে কোনও কেলেঙ্কারি ব্যাপারটাই সিআইডি বনাম সিবিআই এর একটা চোর পুলিশের খেলায় পরিণত হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ শাসনকালে যে দুই একটা লোক দেখানো বিচার বিভাগীয় কমিশন তৈরি করা হয়েছিল বিগত বামফ্রন্ট সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করবার তাগিদে, সেই কমিশন গুলি বছরের পর বছর,সাধারণ নাগরিকদের করের টাকায় পরিচালিত হলেও, আজ পর্যন্ত কোনও রকম প্রতিবেদন পেশ করতে সক্ষম হয়নি। অতীতে কংগ্রেস আমলে বা বামফ্রন্ট আমলে কোনও বিচার বিভাগীয় কমিশনের এত দীর্ঘসূত্রিতা আমরা দেখিনি। বস্তুত এই সমস্ত বিচার বিভাগীয় কমিশনগুলিকেই ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থিদের প্রতি তার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার তাগিদেই তৈরি করেছিলেন। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ব্যক্তিগতভাবে হেনস্তা করবার জন্য সেই কমিশনে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পর্যন্ত করা হয়েছিল; কিন্তু মমতার যাবতীয় অভিযোগের বিন্দুমাত্র কোনও সারবর্তা না থাকায়, সরকারের যথেষ্ট প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো অবস্থাতেই, বুদ্ধদেব বাবুসহ বামফ্রন্ট সরকারের আমলের একজনও মন্ত্রী, বিধায়ক সাংসদের গায়ে সেই সমস্ত বিচার বিভাগীয় কমিশনগুলি একটি কালির ছিটে পর্যন্ত লাগাতে সক্ষম হয়নি।
কত ১৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দপ্তরটি খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। তাছাড়াও আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর মুখ্যমন্ত্রীর হাতে রয়েছে। এই ১৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা ঠিক কোন জায়গায় চলে গেছে, সেটা যাঁরা এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে পরিচিত হননি, তার বাইরের মানুষজন বুঝতে পারবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই পশ্চিমবঙ্গে একাধিক হাসপাতাল, যেগুলোতে কোনও পরিকাঠামো নেই, সেগুলিকে উনি রাজনৈতিক ফায়দা তোলবার অভিপ্রায়ে, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন। মজার কথা হলো- এই সমস্ত হাসপাতালগুলোতে ঝাঁ চকচকে বাড়ি হয়েছে। নীল সাদা রং হয়েছে। বাড়ি, সেই বাড়ি রং ইত্যাদির পিছনে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সংযুক্ত লোকজনদের পকেট ভারী হয়েছে। কিন্তু কখনও কোনো অবস্থাতেই স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বাড়ানোর দিকে কোনরকম লক্ষ্য নজর দেওয়া হয়নি।
সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের বেনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার পাশাপাশি ডাক্তার থেকে শুরু করে, নার্স থেকে শুরু করে, স্বাস্থ্য পরিসেবক থেকে শুরু করে, সাধারণ কর্মী, করণিকÑ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বল্গাহীন দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্তরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটিকে একেবারে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় মেশিন আছে তো কর্মী নেই। কর্মী আছে তো মেশিন নেই।
অযোগ্য কর্মী, অযোগ্য ডাক্তার বহু ক্ষেত্রে সরকারি পরিষেবার মধ্যে সংযুক্ত হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ। ফলে অতি সাধারণ গরিব মানুষও এখন খুব বেকায়দায় না পড়লে আর সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনো রকম সুযোগ নিতে চায় না।
অপরপক্ষে কয়েক বছর হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ্মান ভারত ব্যবস্থার সঙ্গে টক্কর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড চালু করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য সাথী কার্ড এর আওতাভুক্ত মানুষদের বিমার আওতায় আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে কখনো কোনো রকম আর্থিক মানদন্ড কার্ডধারী মানুষদের ক্ষেত্রে আরোপ করা হয়নি। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসক তৃণমূলের কাছের লোকেরাই এই কার্ডের সুযোগ পাচ্ছে। বিত্তবানেরা এই কার্ডের সুযোগ পাচ্ছে। সত্যিকারের গরিব মানুষ, গরিব মুসলমান, গরিব ক্রিশ্চিয়ান, আদিবাসী,তপশিলি জাতি-উপজাতিভুক্ত মানুষ, অন্যান্য দলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষ, তারা শাসকদলের আওতার মধ্যে না থাকলেই কোনও অবস্থাতেই এই কার্ড পাওয়ার অধিকারী হচ্ছে না।
সেই সঙ্গে এই কার্ড ঘিরে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ প্রাইভেট নার্সিংহোমগুলোতে চলছে একটা ভয়াবহ আর্থিক দুর্নীতি। প্রায় বেশিরভাগ শাসক ঘনিষ্ঠ প্রাইভেট নার্সিংহোম, হসপিটালগুলো এই কার্ডের ব্যবহার করে লাখ-লাখ, কোটি-কোটি টাকার সরকারি কোষাগার লুট করছে। সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পৌঁছলে, সেই সমস্ত হাসপাতাল বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্বন্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ফলে সাধারণ মানুষ গরিব মানুষ, যারা কোনো রকমভাবে সামাজিক শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত নয়, ক্ষতাবান নয় এইরকম মানুষ, তারা এক ভয়াবহ সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
আর সেই সংকটেরই ফলশ্রুতি হচ্ছে এই ধরনের স্যালাইন কেলেঙ্কারিসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি। আরজি কর হাসপাতালে যে কর্মরতা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে, সেই ঘটনার পেছনেও কিন্তু নানা ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির আভাস ঘিরে মানুষের মনে সন্দেহ রয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে স্বাস্থ্য দুর্নীতি একটা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন পূর্ণ সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে বিগত ১৪ বছর ধরে নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়াতে নানা ধরনের প্রথাগত সংকট তৈরি হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যস্ততা হেতু এবং একইসঙ্গে ভূমি সংস্কার, সংখ্যালঘু উন্নয়ন সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর তার হাতে থাকার দরুণ স্বাস্থ্য দপ্তরে তিনি কতখানি মনোযোগ অর্পণ করতে পারছেন, তা নিয়ে বহু ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা উঠে আসছে যে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাজনিত যে সমস্ত সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী সময় দিতে পারছেন না বলে, গোটা ব্যাপারটা কি প্রতিমন্ত্রীর ওপরেই সবটা সামলাবার দায়িত্ব পড়েছে? স্বাস্থ্য দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ আমলাদের মধ্যে শাসক নিয়ন্ত্রিত ডাক্তার বাবুদের কোটারি এবং সিন্ডিকেট রাজ আজকে এমন একটা অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে, যার জেরে শাসক তৃণমূলের মধ্যেই গৃহযুদ্ধের পরিবেশ ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে।
যে শান্তনু সেন পেশায় একজন চিকিৎসক, তাকে একটা সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিলেন, আরজি কর কা-ে তিনি কিছু বেসুরো কথা বলাতেÑ একদা তৃণমূলের সেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংক্রান্ত দোর্দ- প্রতাপ নেতাকে তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহূর্তে সাসপেন্ড করেছে।
শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ প্রত্যেকটি বিষয়, যেগুলো সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত, সেই জায়গাগুলো আজ পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা ভয়ংকর বললেও খুব কম বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এখন বেসরকারি হাতে। সরকারি স্কুলগুলোতে, কলেজগুলোতে সাধারণ মানুষের করের টাকায় মাস্টার মশাইদের মাইনে হচ্ছে। নানা ধরনের শিক্ষা সামগ্রী কেনা হচ্ছে। বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। সংস্কার হচ্ছে। রং হচ্ছে; কিন্তু ছাত্র প্রায় নেই বললেই চলে। সমস্ত ভিড়টা গিয়ে জড়ো হয়েছে বেসরকারি শিক্ষা মাধ্যমগুলোতে। সেটা স্কুলের ক্ষেত্রেই হোক, কিংবা কলেজের ক্ষেত্রেই হোক। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এই ক্ষেত্রগুলোতে যেভাবে বেসরকারিকরণের প্রতি রাজ্য সরকার সমস্ত ধরনের মনোনিবেশ এবং ছাড়পত্র অর্পণ করেছেন, তাতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা সমস্ত কিছুতেই এখন মেধার কোনো দাম নেই। দাম হচ্ছে একমাত্র যার পকেটে যত টাকা আছে সেই টাকার।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]