এম এ হোসাইন
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দেখানো মানচিত্র প্রকাশ করেছেন। তারই বিস্ফোরক মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
গত ৭ জানুয়ারি শেয়ার করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এ পোস্টগুলো সারা বিশ্বব্যাপী কানাডার সার্বভৌমত্ব, কূটনীতি ও জাতীয় পরিচয় নিয়ে তুমুল কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন তিনি বারবার দাবি করছেন যে কানাডিয়ানরা যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হলে উপকৃত হবে; যা কানাডিয়ান রাজনৈতিক নেতারা তাৎক্ষণিক এবং দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ট্রাম্পের প্রথম পোস্টে একটি উজ্জ্বল ছবি দেখানো হয়, যেখানে উত্তর আমেরিকাকে একীভূত হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে এবং কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানচিত্রে রাষ্ট্রীয় সীমান্তের অনুপস্থিতি দেখানো হয়েছে এবং পুরো অঞ্চলের ওপর ‘যুক্তরাষ্ট্র’ শব্দটি সুস্পষ্টভাবে লেখা ছিল। এর পরের পোস্টে উভয় অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার রঙে রাঙানো মানচিত্র দেখানো হয় এবং তার ক্যাপশন ছিল ‘ওহ কানাডা’।
ট্রাম্পের এই পোস্টগুলো এমন এক সময় এসেছে যখন কানাডিয়ান রাজনৈতিক নেতারা ট্রাম্পের বক্তব্যকে তীব্রভাবে প্রত্যাখান করেছেন। ট্রাম্পের যে বক্তব্য ‘যদি কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত হয় তাহলে কানাডিয়ান নাগরিকদের উপকার হবে’Ñ তা কানাডিয়ান রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিতে সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসাবে দেখছেন। তাছাড়া এ ধরনের মন্তব্য রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
একই দিনে একটি প্রেস কনফারেন্সে ট্রাম্প তার অবস্থান আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন এবং অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের হুমকি দেন। তিনি কানাডার পণ্যের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপের কথা বলেন যদি অটোয়া তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে। ট্রাম্প বলেন, ‘আপনি সেই কৃত্রিমভাবে তৈরি লাইনটি মুছে ফেলুন এবং দেখুন এটি কেমন লাগে। এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও অনেক ভালো হবে।’
ট্রাম্পের এ ধরনের বক্তব্য যা দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক যুক্তি দিয়ে তার বিতর্কিত অবস্থানকে সমর্থন করার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সীমান্ত বিলোপের বিষয়ে তার মন্তব্য তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম অরক্ষিত সীমান্ত থাকা দুই জাতির মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি করেছে।
কানাডার নেতারা দ্রুত ট্রাম্পের বক্তব্যের নিন্দা করেন। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (পূর্বে টুইটার) প্ল্যাটফর্মে কানাডার সার্বভৌমত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘কানাডা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হবে না, তা বরফের গোলার নরক থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনার চেয়েও কম।’
পিয়ের পোলিয়েভ, বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির নেতা, ট্রুডোর মতামতের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে ঘোষণা করেন, ‘কানাডা কখনো ৫১তম রাজ্য হবে না।’ উভয় নেতা কানাডার পরিচয় এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরে নাগরিকদের কানাডার সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের যে কোনো ধারণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
ট্রাম্পের প্রস্তাব নিন্দা করার পাশাপাশি কানাডিয়ান রাজনীতিবিদরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্বও জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। ট্রুডো তার মেয়াদকালে জনপ্রিয়তায় ওঠানামার মুখোমুখি হয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এবং লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে তার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, যা কানাডার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কানাডাকে আমেরিকার সঙ্গে সংযুক্তির ধারণা নতুন নয়। ১৯শ শতকে কিছু আমেরিকান গোষ্ঠী ‘ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি’ মতবাদকে সমর্থন করেছিল, যা উত্তর আমেরিকা মহাদেশজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখ- প্রসারের লক্ষ্য ছিল। তবে এ আকাক্সক্ষাগুলো কখনো উল্লেখযোগ্য সমর্থন পায়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সম্পর্ক আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে স্থিতিশীল এবং পারস্পরিক উপকারী অংশীদারিত্বে পরিণত হয়েছে।
এই দুই দেশ অর্থনৈতিকভাবে গভীরভাবে জড়িত। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে একটি, যার বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৭০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ইউনাইটেড স্টেটস-মেক্সিকো-কানাডা অ্যাগ্রিমেন্টের (ইউএসএমসিএ) মতো চুক্তি এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে আরও মজবুত করেছে। তবে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো এ সহযোগিতামূলক ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করছে।
ট্রাম্পের পোস্ট দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তার সমর্থকরা এটিকে সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রশংসা করেন। ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে এই ধারণার জন্ম দেয় যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এবং সম্পদকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে সমালোচকরা পোস্টগুলোকে বেপরোয়া, সাম্রাজ্যবাদী এবং কানাডার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সংবেদনশীলতাহীন বলে অভিহিত করেন।
কানাডায় ক্ষোভ ছিল স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #ঐধহফংঙভভঈধহধফধ এবং #ঞৎঁসঢ়ইধপশঙভভ-এর মতো হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করেছিল, যেখানে অনেক নাগরিক তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং জাতীয় গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মতামত দিয়েছেন। অনেক কানাডীয়ের কাছে ট্রাম্পের প্রস্তাব তাদের সার্বভৌমত্বকে অবজ্ঞা করার পাশাপাশি কয়েক দশকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিকে ক্ষুণœ করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন।
ট্রাম্পের মন্তব্য ইউএস-কানাডা সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে এই দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ কূটনীতির মাধ্যমে সামলানো হয়েছে, কিন্তু ট্রাম্পের আগ্রাসী বক্তৃতা এই ভারসাম্য নষ্ট করার ঝুঁকি তৈরি করছে। তার শুল্ক আরোপের হুমকি উভয় দেশের শিল্পক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য প্রবাহ ব্যাহত করতে পারে।
তাছাড়া এ প্রস্তাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করার প্রতিশ্রুতির ওপর বৃহত্তর প্রশ্ন তোলে। যদি এমন বক্তব্য নীতিতে রূপান্তরিত হয়, তবে এটি অন্যান্য দেশগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে।
কিছু বিশ্লেষক ট্রাম্পের বিতর্কিত মানচিত্রগুলোকে একটি কৌশলগত রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, যা তার সমর্থকদের উদ্দীপিত করতে এবং দেশীয় চ্যালেঞ্জ থেকে দৃষ্টি সরাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একটি উসকানিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, ট্রাম্প একটি ‘স্থিতবস্তাকে’ চ্যালেঞ্জ করার প্রতিকৃতিকে শক্তিশালী করার প্রয়াস বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে অন্যরা এটিকে একটি বেপরোয়া জুয়া হিসেবে দেখছেন, যার গুরুতর কূটনৈতিক প্রভাব হতে পারে। কানাডার মতো ঘনিষ্ঠ মিত্রকে বিচ্ছিন্ন করা এবং কয়েক দশকের সহযোগিতাকে বিপন্ন করার ঝুঁকি, এ ধরনের বক্তব্য থেকে আসা স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লাভের চেয়ে অনেক বেশি।
কানাডা যখন তার নির্বাচনী মৌসুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের নেতৃত্বে পরিবর্তন হচ্ছে, তখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে। কানাডার নেতারা ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে একত্রিত থেকেছেন এবং এই বিতর্ককে নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতি সমবেত করতে ব্যবহার করেছেন।
বর্তমান বিতর্ক হয়তো ম্লান হয়ে যাবে, তবে এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব ও স্বাধীনতার সূক্ষ্ম ভারসাম্যের একটি কঠিন স্মারক হিসেবে কাজ করছে। উভয় দেশকে অবশ্যই এ সুযোগটি গ্রহণ করে পারস্পরিক সম্মান ও গঠনমূলক সংলাপের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করতে হবে।
ট্রাম্পের উসকানিমূলক মানচিত্র ও বিবৃতি যেকোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, কূটনীতি এবং জাতীয় পরিচয়ের বিষয়গুলোকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। তার পোস্টগুলো যেমন ব্যাপক নিন্দার ঝড় তুলেছে, তেমনি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্বও তুলে ধরেছে।
বর্তমানে কানাডা তার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে, যেখানে তাদের নেতারা এবং নাগরিকরা যেকোনো সংযুক্তির ধারণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এ বিতর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্কের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলবে নাকি এটি ক্ষণস্থায়ী একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ইতিহাসে ম্লান হয়ে যাবে, তা সময়ই বলবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিতÑ এই বিতর্ক সীমান্ত, মৈত্রী এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের দীর্ঘস্থায়ী গুরুত্ব নিয়ে আলোচনাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
রোববার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দেখানো মানচিত্র প্রকাশ করেছেন। তারই বিস্ফোরক মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
গত ৭ জানুয়ারি শেয়ার করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এ পোস্টগুলো সারা বিশ্বব্যাপী কানাডার সার্বভৌমত্ব, কূটনীতি ও জাতীয় পরিচয় নিয়ে তুমুল কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন তিনি বারবার দাবি করছেন যে কানাডিয়ানরা যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হলে উপকৃত হবে; যা কানাডিয়ান রাজনৈতিক নেতারা তাৎক্ষণিক এবং দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ট্রাম্পের প্রথম পোস্টে একটি উজ্জ্বল ছবি দেখানো হয়, যেখানে উত্তর আমেরিকাকে একীভূত হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে এবং কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানচিত্রে রাষ্ট্রীয় সীমান্তের অনুপস্থিতি দেখানো হয়েছে এবং পুরো অঞ্চলের ওপর ‘যুক্তরাষ্ট্র’ শব্দটি সুস্পষ্টভাবে লেখা ছিল। এর পরের পোস্টে উভয় অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার রঙে রাঙানো মানচিত্র দেখানো হয় এবং তার ক্যাপশন ছিল ‘ওহ কানাডা’।
ট্রাম্পের এই পোস্টগুলো এমন এক সময় এসেছে যখন কানাডিয়ান রাজনৈতিক নেতারা ট্রাম্পের বক্তব্যকে তীব্রভাবে প্রত্যাখান করেছেন। ট্রাম্পের যে বক্তব্য ‘যদি কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত হয় তাহলে কানাডিয়ান নাগরিকদের উপকার হবে’Ñ তা কানাডিয়ান রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিতে সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসাবে দেখছেন। তাছাড়া এ ধরনের মন্তব্য রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
একই দিনে একটি প্রেস কনফারেন্সে ট্রাম্প তার অবস্থান আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন এবং অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের হুমকি দেন। তিনি কানাডার পণ্যের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপের কথা বলেন যদি অটোয়া তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে। ট্রাম্প বলেন, ‘আপনি সেই কৃত্রিমভাবে তৈরি লাইনটি মুছে ফেলুন এবং দেখুন এটি কেমন লাগে। এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও অনেক ভালো হবে।’
ট্রাম্পের এ ধরনের বক্তব্য যা দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক যুক্তি দিয়ে তার বিতর্কিত অবস্থানকে সমর্থন করার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সীমান্ত বিলোপের বিষয়ে তার মন্তব্য তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম অরক্ষিত সীমান্ত থাকা দুই জাতির মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি করেছে।
কানাডার নেতারা দ্রুত ট্রাম্পের বক্তব্যের নিন্দা করেন। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (পূর্বে টুইটার) প্ল্যাটফর্মে কানাডার সার্বভৌমত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘কানাডা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হবে না, তা বরফের গোলার নরক থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনার চেয়েও কম।’
পিয়ের পোলিয়েভ, বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির নেতা, ট্রুডোর মতামতের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে ঘোষণা করেন, ‘কানাডা কখনো ৫১তম রাজ্য হবে না।’ উভয় নেতা কানাডার পরিচয় এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরে নাগরিকদের কানাডার সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের যে কোনো ধারণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
ট্রাম্পের প্রস্তাব নিন্দা করার পাশাপাশি কানাডিয়ান রাজনীতিবিদরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্বও জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। ট্রুডো তার মেয়াদকালে জনপ্রিয়তায় ওঠানামার মুখোমুখি হয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এবং লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে তার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, যা কানাডার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কানাডাকে আমেরিকার সঙ্গে সংযুক্তির ধারণা নতুন নয়। ১৯শ শতকে কিছু আমেরিকান গোষ্ঠী ‘ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি’ মতবাদকে সমর্থন করেছিল, যা উত্তর আমেরিকা মহাদেশজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখ- প্রসারের লক্ষ্য ছিল। তবে এ আকাক্সক্ষাগুলো কখনো উল্লেখযোগ্য সমর্থন পায়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সম্পর্ক আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে স্থিতিশীল এবং পারস্পরিক উপকারী অংশীদারিত্বে পরিণত হয়েছে।
এই দুই দেশ অর্থনৈতিকভাবে গভীরভাবে জড়িত। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে একটি, যার বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৭০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ইউনাইটেড স্টেটস-মেক্সিকো-কানাডা অ্যাগ্রিমেন্টের (ইউএসএমসিএ) মতো চুক্তি এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে আরও মজবুত করেছে। তবে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো এ সহযোগিতামূলক ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করছে।
ট্রাম্পের পোস্ট দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তার সমর্থকরা এটিকে সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রশংসা করেন। ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে এই ধারণার জন্ম দেয় যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এবং সম্পদকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে সমালোচকরা পোস্টগুলোকে বেপরোয়া, সাম্রাজ্যবাদী এবং কানাডার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সংবেদনশীলতাহীন বলে অভিহিত করেন।
কানাডায় ক্ষোভ ছিল স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #ঐধহফংঙভভঈধহধফধ এবং #ঞৎঁসঢ়ইধপশঙভভ-এর মতো হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করেছিল, যেখানে অনেক নাগরিক তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং জাতীয় গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মতামত দিয়েছেন। অনেক কানাডীয়ের কাছে ট্রাম্পের প্রস্তাব তাদের সার্বভৌমত্বকে অবজ্ঞা করার পাশাপাশি কয়েক দশকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিকে ক্ষুণœ করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন।
ট্রাম্পের মন্তব্য ইউএস-কানাডা সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে এই দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ কূটনীতির মাধ্যমে সামলানো হয়েছে, কিন্তু ট্রাম্পের আগ্রাসী বক্তৃতা এই ভারসাম্য নষ্ট করার ঝুঁকি তৈরি করছে। তার শুল্ক আরোপের হুমকি উভয় দেশের শিল্পক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য প্রবাহ ব্যাহত করতে পারে।
তাছাড়া এ প্রস্তাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করার প্রতিশ্রুতির ওপর বৃহত্তর প্রশ্ন তোলে। যদি এমন বক্তব্য নীতিতে রূপান্তরিত হয়, তবে এটি অন্যান্য দেশগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে।
কিছু বিশ্লেষক ট্রাম্পের বিতর্কিত মানচিত্রগুলোকে একটি কৌশলগত রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, যা তার সমর্থকদের উদ্দীপিত করতে এবং দেশীয় চ্যালেঞ্জ থেকে দৃষ্টি সরাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একটি উসকানিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, ট্রাম্প একটি ‘স্থিতবস্তাকে’ চ্যালেঞ্জ করার প্রতিকৃতিকে শক্তিশালী করার প্রয়াস বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে অন্যরা এটিকে একটি বেপরোয়া জুয়া হিসেবে দেখছেন, যার গুরুতর কূটনৈতিক প্রভাব হতে পারে। কানাডার মতো ঘনিষ্ঠ মিত্রকে বিচ্ছিন্ন করা এবং কয়েক দশকের সহযোগিতাকে বিপন্ন করার ঝুঁকি, এ ধরনের বক্তব্য থেকে আসা স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লাভের চেয়ে অনেক বেশি।
কানাডা যখন তার নির্বাচনী মৌসুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের নেতৃত্বে পরিবর্তন হচ্ছে, তখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে। কানাডার নেতারা ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে একত্রিত থেকেছেন এবং এই বিতর্ককে নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতি সমবেত করতে ব্যবহার করেছেন।
বর্তমান বিতর্ক হয়তো ম্লান হয়ে যাবে, তবে এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব ও স্বাধীনতার সূক্ষ্ম ভারসাম্যের একটি কঠিন স্মারক হিসেবে কাজ করছে। উভয় দেশকে অবশ্যই এ সুযোগটি গ্রহণ করে পারস্পরিক সম্মান ও গঠনমূলক সংলাপের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করতে হবে।
ট্রাম্পের উসকানিমূলক মানচিত্র ও বিবৃতি যেকোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, কূটনীতি এবং জাতীয় পরিচয়ের বিষয়গুলোকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। তার পোস্টগুলো যেমন ব্যাপক নিন্দার ঝড় তুলেছে, তেমনি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্বও তুলে ধরেছে।
বর্তমানে কানাডা তার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে, যেখানে তাদের নেতারা এবং নাগরিকরা যেকোনো সংযুক্তির ধারণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এ বিতর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্কের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলবে নাকি এটি ক্ষণস্থায়ী একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ইতিহাসে ম্লান হয়ে যাবে, তা সময়ই বলবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিতÑ এই বিতর্ক সীমান্ত, মৈত্রী এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের দীর্ঘস্থায়ী গুরুত্ব নিয়ে আলোচনাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]