মিথুশিলাক মুরমু
সাম্প্রতিকালে ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা না-করা নিয়ে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন ও আন্দোলন চলমান। ১২ জানুয়ারি ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ নামক সংগঠনটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এ স্মারকলিপি দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ শব্দ প্রত্যাহারের ঘোষণা না এলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। কারণ, তাদের দাবি আদিবাসী শব্দের ব্যবহার সংবিধানবিরোধী, বিতর্কিত ও রাষ্ট্রদ্রোহী পরিভাষা। ১২ জানুয়ারি রাতেই অনলাইন সংস্করণ থেকে নবম ও দশম শ্রেণীর বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পেছনের প্রচ্ছদে থাকা ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলা হয়।
১৫ জানুয়ারি ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ একইভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সামনে পাঠ্যপুস্তকে গ্রাফিতিটি পুনর্বহালের দাবিতে কর্মসূচি গ্রহণ করে। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ও একই দিনে, একই সময়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে। অবশেষে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা পরিকল্পিতভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে।
ইতঃপূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারেও ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ নামক সংগঠনটি রাজু ভাস্কর্য পাদদেশে প্রতিবাদ সভা করেছিল। শেখ হাসিনা সরকারের উৎখাত পরবর্তীকালে দেশের শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতি রাজধানী, বিভাগীয়, জেলা শহর নয়; প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর বাউন্ডারি দেয়ালগুলোতে দৃশ্যমান রয়েছে। অজস্র গ্রাফিতির মধ্যে যেটি দেশবাসীর নজর কেড়েছে, সেটি হলোÑ বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ শস্য শ্যামলা প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা সম্প্রীতির বৃক্ষের পাতায় লেখা ‘বৌদ্ধ, হিন্দু, আদিবাসী, মুসলিম, খ্রিস্টান’; পাশে লেখা রয়েছেÑ ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’।
দেশের নাগরিক হিসেবে একজনের পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে, পক্ষে-বিপক্ষে দাবি-দাওয়া উত্থাপিত হতে পারে; নিজস্ব অভিমত প্রকাশের অধিকারকে ক্ষুণœ করার অর্থ হচ্ছে পরাধীনতা, দাবিয়ে রাখা এবং চরম বৈষম্য। দেশের সরকার রয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা,
চিন্তাশীল ও দায়িত্ববান নাগরিকরা রয়েছেন; সিদ্ধান্ত তারা নেবেন কিন্তু আদিবাসীদের প্রাণের কথা উপস্থাপনে বাধা কিংবা প্রতিহত করা সভ্য আচরণ হতে পারে না। নিঃসন্দেহে আদিবাসীরা জনবল, অর্থবিত্ত ও শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী; সেখানে রাজধানীর মতো সচেতন স্থানে তাদের ওপর হামলা, রক্তাক্ত, শারীরিকভাবে অপদস্ত করা কখনোই শোভনীয় নয়।
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ পরিষ্কার হয়েছে যে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বিবদমান পরিস্থিতিতে দু’পক্ষকেই নিবৃত্ত করতে পারতেন কিন্তু তারা সে পথে অগ্রসর হননি। অথবা আদিবাসীদের কর্মসূচিকে সীমিত করে এরূপ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে পারত। এটি শুধু এখানে নয়, আদিবাসীদের বিষয়গুলোতে দেশের সর্বত্রই আদিবাসীরা নিপীড়নের শিকার; স্থানীয় থানা-পুলিশ প্রশাসন আদিবাসীদের নিরাপত্তার বিষয়ে ঔদাসীন্য প্রতীয়মান হয়ে থাকে। খোদ রাজধানীতে প্রাণের স্পন্দন আদিবাসী শব্দটি পাঠ্যপুস্তকে প্রতিস্থাপনে দাবি-দাওয়া শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের উপস্থিতিতে পেশিশক্তির যে দাপট দেখা গেল গণতান্ত্রিক দেশে এটি কখনোই কাম্য নয়। অভিযোগ উত্থিত হয়েছে, ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ প্রথমে হামলার লক্ষ্যে তেড়ে গিয়েছে। এটি যেমন বিশ^াসযোগ্য নয়, তেমনই আশ্চর্যজনক! আদিবাসী শিক্ষার্থীদের হাতে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড থাকলেও কোনো লাঠিসোঁটা ছিল না; মুহূর্তের মধ্যে পেশিশক্তির ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’র লোকজন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত করেছে।
পাঠ্যপুস্তকে বসবাসরত আদিবাসীদেরকে বারবার ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করে শিক্ষার্থীদের মানসপটে গ্রোথিত করার প্রবল প্রচেষ্টায় আমরা সংক্ষুব্ধ। যে সমস্ত জাতিগোষ্ঠী শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল থেকে নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করতে উদ্যোগী, তাদের প্রাণের স্পন্দন আদিবাসী শব্দটি বারংবার উপেক্ষিত হয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকের ১৯ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ বাঙালি ও আদিবাসী জনগণ অংশগ্রহণ করে।’ ২১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত রয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ এ অঞ্চলের বাঙালি এবং এ ভূখ-ে বসবাসকারী অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে নতুন যে দেশপ্রেমের জন্ম দেয়, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ শেষে জনগণ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে।’
মুক্তিযুদ্ধের আদিবাসীদের অসামান্য অবদানের এক লাইনের স্বীকৃতিও সরকারের সংকীর্ণ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আমরা মনে করি, প্রত্যেকটি ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে, রয়েছে ভয়েস ও চয়েসের অধিকার। মানবসত্তার স্বভাবজাত প্রত্যাশা প্রাপ্তির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে ছাত্র সমাজের এহেন বর্বরতা সত্যিই অতীতের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কালো তিলক হিসেবেই দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের পর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গল টেন্যান্সি এ্যাক্ট প্রণয়ন করে, এ্যাক্টের ৯৭ ধারায় প্রায় ২৭টি জাতিগোষ্ঠীর নাম স্থান পেয়েছে। দীর্ঘ বছর পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ পাকিস্তান সরকার আইনটিকে রিভিউ করে, সেখানেও ৯৭ ধারাকে অক্ষত রেখে সমসংখ্যক আদিবাসীদের অধিকার সমুন্নত রাখা হয়। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন পূর্ব পর্যন্ত আদিবাসীদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবেই অফিস-আদালতে, রাজনৈতিক আলোচনায়, জাতীয় সংসদে আইন প্রণেতাদের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্কালে যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দের প্রতীক হিসেবে যে গ্রাফিতিটি হৃদয়াসনে আসীন; সেখান থেকে তো আর বিলুপ্ত করা যাবে না।
[লেখক : কলামিস্ট ]
মিথুশিলাক মুরমু
রোববার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫
সাম্প্রতিকালে ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা না-করা নিয়ে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন ও আন্দোলন চলমান। ১২ জানুয়ারি ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ নামক সংগঠনটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এ স্মারকলিপি দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ শব্দ প্রত্যাহারের ঘোষণা না এলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। কারণ, তাদের দাবি আদিবাসী শব্দের ব্যবহার সংবিধানবিরোধী, বিতর্কিত ও রাষ্ট্রদ্রোহী পরিভাষা। ১২ জানুয়ারি রাতেই অনলাইন সংস্করণ থেকে নবম ও দশম শ্রেণীর বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পেছনের প্রচ্ছদে থাকা ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলা হয়।
১৫ জানুয়ারি ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ একইভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সামনে পাঠ্যপুস্তকে গ্রাফিতিটি পুনর্বহালের দাবিতে কর্মসূচি গ্রহণ করে। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ও একই দিনে, একই সময়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে। অবশেষে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা পরিকল্পিতভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে।
ইতঃপূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারেও ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ নামক সংগঠনটি রাজু ভাস্কর্য পাদদেশে প্রতিবাদ সভা করেছিল। শেখ হাসিনা সরকারের উৎখাত পরবর্তীকালে দেশের শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতি রাজধানী, বিভাগীয়, জেলা শহর নয়; প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর বাউন্ডারি দেয়ালগুলোতে দৃশ্যমান রয়েছে। অজস্র গ্রাফিতির মধ্যে যেটি দেশবাসীর নজর কেড়েছে, সেটি হলোÑ বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ শস্য শ্যামলা প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা সম্প্রীতির বৃক্ষের পাতায় লেখা ‘বৌদ্ধ, হিন্দু, আদিবাসী, মুসলিম, খ্রিস্টান’; পাশে লেখা রয়েছেÑ ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’।
দেশের নাগরিক হিসেবে একজনের পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে, পক্ষে-বিপক্ষে দাবি-দাওয়া উত্থাপিত হতে পারে; নিজস্ব অভিমত প্রকাশের অধিকারকে ক্ষুণœ করার অর্থ হচ্ছে পরাধীনতা, দাবিয়ে রাখা এবং চরম বৈষম্য। দেশের সরকার রয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা,
চিন্তাশীল ও দায়িত্ববান নাগরিকরা রয়েছেন; সিদ্ধান্ত তারা নেবেন কিন্তু আদিবাসীদের প্রাণের কথা উপস্থাপনে বাধা কিংবা প্রতিহত করা সভ্য আচরণ হতে পারে না। নিঃসন্দেহে আদিবাসীরা জনবল, অর্থবিত্ত ও শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী; সেখানে রাজধানীর মতো সচেতন স্থানে তাদের ওপর হামলা, রক্তাক্ত, শারীরিকভাবে অপদস্ত করা কখনোই শোভনীয় নয়।
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ পরিষ্কার হয়েছে যে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বিবদমান পরিস্থিতিতে দু’পক্ষকেই নিবৃত্ত করতে পারতেন কিন্তু তারা সে পথে অগ্রসর হননি। অথবা আদিবাসীদের কর্মসূচিকে সীমিত করে এরূপ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে পারত। এটি শুধু এখানে নয়, আদিবাসীদের বিষয়গুলোতে দেশের সর্বত্রই আদিবাসীরা নিপীড়নের শিকার; স্থানীয় থানা-পুলিশ প্রশাসন আদিবাসীদের নিরাপত্তার বিষয়ে ঔদাসীন্য প্রতীয়মান হয়ে থাকে। খোদ রাজধানীতে প্রাণের স্পন্দন আদিবাসী শব্দটি পাঠ্যপুস্তকে প্রতিস্থাপনে দাবি-দাওয়া শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের উপস্থিতিতে পেশিশক্তির যে দাপট দেখা গেল গণতান্ত্রিক দেশে এটি কখনোই কাম্য নয়। অভিযোগ উত্থিত হয়েছে, ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ প্রথমে হামলার লক্ষ্যে তেড়ে গিয়েছে। এটি যেমন বিশ^াসযোগ্য নয়, তেমনই আশ্চর্যজনক! আদিবাসী শিক্ষার্থীদের হাতে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড থাকলেও কোনো লাঠিসোঁটা ছিল না; মুহূর্তের মধ্যে পেশিশক্তির ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’র লোকজন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত করেছে।
পাঠ্যপুস্তকে বসবাসরত আদিবাসীদেরকে বারবার ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করে শিক্ষার্থীদের মানসপটে গ্রোথিত করার প্রবল প্রচেষ্টায় আমরা সংক্ষুব্ধ। যে সমস্ত জাতিগোষ্ঠী শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল থেকে নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করতে উদ্যোগী, তাদের প্রাণের স্পন্দন আদিবাসী শব্দটি বারংবার উপেক্ষিত হয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকের ১৯ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ বাঙালি ও আদিবাসী জনগণ অংশগ্রহণ করে।’ ২১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত রয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ এ অঞ্চলের বাঙালি এবং এ ভূখ-ে বসবাসকারী অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে নতুন যে দেশপ্রেমের জন্ম দেয়, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ শেষে জনগণ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে।’
মুক্তিযুদ্ধের আদিবাসীদের অসামান্য অবদানের এক লাইনের স্বীকৃতিও সরকারের সংকীর্ণ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আমরা মনে করি, প্রত্যেকটি ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে, রয়েছে ভয়েস ও চয়েসের অধিকার। মানবসত্তার স্বভাবজাত প্রত্যাশা প্রাপ্তির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে ছাত্র সমাজের এহেন বর্বরতা সত্যিই অতীতের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কালো তিলক হিসেবেই দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের পর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গল টেন্যান্সি এ্যাক্ট প্রণয়ন করে, এ্যাক্টের ৯৭ ধারায় প্রায় ২৭টি জাতিগোষ্ঠীর নাম স্থান পেয়েছে। দীর্ঘ বছর পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ পাকিস্তান সরকার আইনটিকে রিভিউ করে, সেখানেও ৯৭ ধারাকে অক্ষত রেখে সমসংখ্যক আদিবাসীদের অধিকার সমুন্নত রাখা হয়। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন পূর্ব পর্যন্ত আদিবাসীদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবেই অফিস-আদালতে, রাজনৈতিক আলোচনায়, জাতীয় সংসদে আইন প্রণেতাদের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্কালে যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দের প্রতীক হিসেবে যে গ্রাফিতিটি হৃদয়াসনে আসীন; সেখান থেকে তো আর বিলুপ্ত করা যাবে না।
[লেখক : কলামিস্ট ]