alt

উপ-সম্পাদকীয়

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

মাহরুফ চৌধুরী

: মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ঔপনিবেশিক শাসনামলের উত্তরাধিকার বহন করেই যাত্রা শুরু করেছিল। যদিও ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত মানের অভাব এখনও দৃষ্টিগোচর।

গত দুই দশকে দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু উচ্চশিক্ষার গুণগতমানের তেমন উন্নতি ঘটেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-উত্তর গণআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে উচ্চশিক্ষার মান আরও সমৃদ্ধ ও যুগোপযোগী করে শিক্ষার্থীদেরকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যে প্রস্তত করা এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেÑ আমাদের উচ্চশিক্ষা আসলে কেমন হওয়া উচিত? সঙ্গত কারণেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নকে ঘিরে সুধিমহলে বিভিন্ন আলোচনা, সমালোচনা, এবং বিতর্ক চলমান। জাতির সম্মুখে উচ্চশিক্ষাকে জীবনমুখী যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা ও বাধা রয়েছে এবং দেশের সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সেসব সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন। দেশের উচ্চশিক্ষার উচ্চমান নিশ্চিত করতে আরও গভীর আলোচনা-পর্যালোচনা এবং একটি সম্মিলিত উদ্যোগের দাবি রাখে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং গবেষণা, উদ্ভাবন এবং সামগ্রিকভাবে জাতির উন্নয়নে অবদান রাখার প্রধান বাহন হয়ে উঠবে। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় একটি উন্নত, উদ্ভাবনী এবং প্রতিযোগিতামূলক জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে এবং অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে শিক্ষার্থীদের জন্য জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গঠনতন্ত্র, মৌলিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে আধুনিক মানদ- নির্ধারণ ও সেগুলোকে প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, দক্ষতার উন্নয়ন ও বিকাশ, এবং সেই জ্ঞান ও দক্ষতাকে সমাজে প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করা। এ লক্ষ্য অর্জনে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়; বরং নতুন জ্ঞান তৈরি এবং নিত্যনতুন উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে আরো জীবনমুখী করার পাশাপাশি গবেষণার ওপর আরও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য হওয়া উচিত ক্যাম্পাসে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি গবেষণা, উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার জন্য শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত আর্থিক ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এবং প্রশাসন থেকে উৎসাহ ও স্বীকৃতি দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা থাকবে। এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু দেশেই নয়, বিশ্ব পরিম-লেও নিজেদের মর্যাদাপূর্ণ স্থান দখল করতে পারবে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন সমাজ ও রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা ও বাণিজ্যিক খাতের সঙ্গে সংযোগ সাধন করে শিক্ষাকে জীবনমুখী কর্মকান্ডের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে কর্মমুখী ও বাস্তব জীবনের চাহিদার সঙ্গে সংযুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতির যুগে এমন উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে সফলতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উন্নত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং উৎপাদনমুখী শিল্পখাতের মধ্যে যে ধরনের কার্যকর সহযোগিতা দেখা যায়, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ শুধু জ্ঞান বিতরণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে শিল্প ও অর্থনৈতিক খাতের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখা। শিল্প খাতের সঙ্গে এই সমন্বয় নিশ্চিত করা গেলে, শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ, উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী এবং শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতায় নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করে যথাযথ স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।

উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যৌথ ডিগ্রি প্রোগ্রাম, শিক্ষার্থী বিনিময় প্রোগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে। এ উদ্যোগগুলো শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক জ্ঞান, যোগাযোগ দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক সচেতন বৃদ্ধি করবে এবং তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলবে। এর পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন, শিক্ষক বিনিময় কার্যক্রম এবং তাদের গবেষণায় বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। এসব উদ্যোগ উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণে সহায়ক হবে এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বমানের উচ্চতায় নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উচ্চশিক্ষাকে কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও যুগোপযোগী করতে আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি শিক্ষাপরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষার বিস্তারে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষার্থীদের দক্ষতাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা সম্ভব নয়। এটি শুধু শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন নয়, বরং শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতেও সহায়তা করবে। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা শুধু শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতাই বৃদ্ধি করবে না, বরং এটি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা উচ্চশিক্ষার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত। একাডেমিক শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে মানসিক সুস্থতা, নৈতিক মূল্যবোধ, এবং মানবিক গুণাবলির চর্চা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যতœশীল না হলে তাদের পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা বিকশিত করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে নৈতিকতার অভাব শিক্ষার্থীদের আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা পরবর্তীতে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নানা সমস্যার সৃষ্টি করবে। বর্তমান ধনতান্ত্রিক যান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় নৈতিক স্খলন ও মানসিক বৈকল্য খুবই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই উচ্চশিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ তাদের সামগ্রিক উপযোগিতা ও দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে আধুনিক অবকাঠামো এবং সমৃদ্ধ ক্যাম্পাস জীবনের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও ব্যক্তিগত বিকাশের জন্য মানসম্পন্ন অবকাঠামো নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শারীরিক অবকাঠামোর মান শুধু শিক্ষার গুণগতমান উন্নত করতেই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বস্তি ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

বলা হয়ে থাকে, উত্তরাধিকার ও পরিবেশই নিশ্চিত করে একজন মানুষ পরিণত বয়সে কেমন হবে। তাই একুশ শতকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের এমন একটি পরিবেশ প্রয়োজন যেখানে তারা জ্ঞানার্জন, গবেষণা এবং সুস্থ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পাবে। উন্নত অবকাঠামো ও সমৃদ্ধ ক্যাম্পাস জীবন কেবল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নত করবে না, বরং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সহযোগিতা, সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা, সহাবস্থান, পরমতসহিষ্ণুতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলিও বিকাশে সহায়তা করবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে একটি প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় শিক্ষা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা ও আগ্রহ আরও বাড়াবে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও জ্ঞান পরিমাপের জন্য কার্যকর ও যুগোপযোগী মূল্যায়ন পদ্ধতি অপরিহার্য। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাস্তরে প্রচলিত শিখন মূল্যায়নের গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক নয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুখস্থবিদ্যার প্রবণতা বাড়ছে এবং তারা প্রকৃত সমস্যা সমাধানে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারছে না। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। সৃজনশীল ও সমন্বিত মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং বাস্তবজীবনের প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব। বিশেষ করে সমস্যানির্ভর ও প্রকল্পভিত্তিক শিখন মূল্যায়নের মাধ্যমে একদিকে শিক্ষার মানও উন্নত হবে এবং অপরদিকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা বিশ্বমানে পৌঁছবে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন হলে শিক্ষার্থীরা কেবল দেশীয় চাকরির বাজারেই নয়, বরং বৈশ্বিক চাকরির বাজারেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক প্রয়োজনে নানা গবেষণা ও উদ্ভাবনমুখী কর্মকা- পরিচালনা করতে হবে। এসব কর্মকা- শুধু জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রেই সহায়ক হবে না, বরং দেশে শিল্প, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক খাতের উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আর সেজন্য গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ, গবেষণা ল্যাবরেটরি স্থাপন, শিল্পকারখানার সঙ্গে যৌথ গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতা কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন।

শিক্ষকদের গবেষণায় উৎসাহিত করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে দেশব্যাপী বিজ্ঞান মেলা ও গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনের জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে।একদিকে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। যেমন ইন্টার্নশিপ, প্রশিক্ষণ, এবং যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জগতের কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, যা তাদের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে রাখবে। অপরদিকে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইন শিক্ষা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্য বিজ্ঞান এবং অন্যান্য আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব। একইসঙ্গে শিক্ষকদেরও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষণ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত করতে হবে। শিক্ষাকে রাষ্ট্রসংস্কারের বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার ওপরও জোর দিতে হবে। দেশের জন্য সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নৈতিকতা, মানবাধিকার এবং সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

একুশ শতকের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদিকে যেমন জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে, অপরদিকে তেমনি দেশের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। শিক্ষার্থীদের মানবিক ও নৈতিক উৎকর্ষতা সাধনের পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক বিশ্ব বিদ্যার আলয়। আমরা সেই কাক্সিক্ষত আগামীর প্রত্যাশায় রইলাম।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

আদিবাসীদের প্রাণের স্পন্দন

ছবি

ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক

কৃতিত্ব অস্বীকারের অপসংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ : স্যালাইনে ফাঙ্গাস, অসহায় মানুষ

ছবি

আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অঙ্গীকার : বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য

এইচএমপিভি ভাইরাস : প্রয়োজন জনসচেতনতা

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

কেন দ্যাখাও মিথ্যে স্বপ্ন

অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও সড়ক দুর্ঘটনা

অপরিকল্পিত ভ্যাট ও কর বৃদ্ধি

ছবি

‘বেগমপাড়া’ হইতে খোলা চিঠি

সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানবে কে

মকর সংক্রান্তি : বাঙালির উৎসব ও ঐতিহ্যের ধারক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : অপসংস্কৃতি ও নৈতিক প্রশ্ন

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কূটতর্ক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

রজিনাদের বেঁচে থাকার লড়াই

মানব পাচার প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

সংবিধান সংশোধন : আমাদের বলার আছে

চিন্তা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা

গ্রাম উন্নয়নে যুব সমাজের ভূমিকা

‘দেশজ নাট্যশৈলী’র কেন্দ্রীয় নাট্যআঙ্গিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ও কিছু প্রশ্ন

রাখাইন পরিস্থিতি : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির বড় পরীক্ষা

রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব

রম্যগদ্য : নিশুতিরাতের আগন্তুক

গুরু রবিদাস জির কথা

গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের জন্য অশনিসংকেত

নতুন বছরের প্রত্যাশা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

মাহরুফ চৌধুরী

মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ঔপনিবেশিক শাসনামলের উত্তরাধিকার বহন করেই যাত্রা শুরু করেছিল। যদিও ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত মানের অভাব এখনও দৃষ্টিগোচর।

গত দুই দশকে দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু উচ্চশিক্ষার গুণগতমানের তেমন উন্নতি ঘটেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-উত্তর গণআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে উচ্চশিক্ষার মান আরও সমৃদ্ধ ও যুগোপযোগী করে শিক্ষার্থীদেরকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যে প্রস্তত করা এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেÑ আমাদের উচ্চশিক্ষা আসলে কেমন হওয়া উচিত? সঙ্গত কারণেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নকে ঘিরে সুধিমহলে বিভিন্ন আলোচনা, সমালোচনা, এবং বিতর্ক চলমান। জাতির সম্মুখে উচ্চশিক্ষাকে জীবনমুখী যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা ও বাধা রয়েছে এবং দেশের সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সেসব সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন। দেশের উচ্চশিক্ষার উচ্চমান নিশ্চিত করতে আরও গভীর আলোচনা-পর্যালোচনা এবং একটি সম্মিলিত উদ্যোগের দাবি রাখে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং গবেষণা, উদ্ভাবন এবং সামগ্রিকভাবে জাতির উন্নয়নে অবদান রাখার প্রধান বাহন হয়ে উঠবে। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় একটি উন্নত, উদ্ভাবনী এবং প্রতিযোগিতামূলক জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে এবং অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে শিক্ষার্থীদের জন্য জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গঠনতন্ত্র, মৌলিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে আধুনিক মানদ- নির্ধারণ ও সেগুলোকে প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, দক্ষতার উন্নয়ন ও বিকাশ, এবং সেই জ্ঞান ও দক্ষতাকে সমাজে প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করা। এ লক্ষ্য অর্জনে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়; বরং নতুন জ্ঞান তৈরি এবং নিত্যনতুন উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে আরো জীবনমুখী করার পাশাপাশি গবেষণার ওপর আরও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য হওয়া উচিত ক্যাম্পাসে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি গবেষণা, উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার জন্য শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত আর্থিক ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এবং প্রশাসন থেকে উৎসাহ ও স্বীকৃতি দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা থাকবে। এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু দেশেই নয়, বিশ্ব পরিম-লেও নিজেদের মর্যাদাপূর্ণ স্থান দখল করতে পারবে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন সমাজ ও রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা ও বাণিজ্যিক খাতের সঙ্গে সংযোগ সাধন করে শিক্ষাকে জীবনমুখী কর্মকান্ডের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে কর্মমুখী ও বাস্তব জীবনের চাহিদার সঙ্গে সংযুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতির যুগে এমন উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে সফলতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উন্নত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং উৎপাদনমুখী শিল্পখাতের মধ্যে যে ধরনের কার্যকর সহযোগিতা দেখা যায়, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ শুধু জ্ঞান বিতরণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে শিল্প ও অর্থনৈতিক খাতের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখা। শিল্প খাতের সঙ্গে এই সমন্বয় নিশ্চিত করা গেলে, শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ, উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী এবং শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতায় নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করে যথাযথ স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।

উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যৌথ ডিগ্রি প্রোগ্রাম, শিক্ষার্থী বিনিময় প্রোগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে। এ উদ্যোগগুলো শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক জ্ঞান, যোগাযোগ দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক সচেতন বৃদ্ধি করবে এবং তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলবে। এর পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন, শিক্ষক বিনিময় কার্যক্রম এবং তাদের গবেষণায় বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। এসব উদ্যোগ উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণে সহায়ক হবে এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বমানের উচ্চতায় নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উচ্চশিক্ষাকে কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও যুগোপযোগী করতে আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি শিক্ষাপরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষার বিস্তারে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষার্থীদের দক্ষতাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা সম্ভব নয়। এটি শুধু শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন নয়, বরং শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতেও সহায়তা করবে। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা শুধু শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতাই বৃদ্ধি করবে না, বরং এটি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা উচ্চশিক্ষার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত। একাডেমিক শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে মানসিক সুস্থতা, নৈতিক মূল্যবোধ, এবং মানবিক গুণাবলির চর্চা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যতœশীল না হলে তাদের পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা বিকশিত করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে নৈতিকতার অভাব শিক্ষার্থীদের আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা পরবর্তীতে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নানা সমস্যার সৃষ্টি করবে। বর্তমান ধনতান্ত্রিক যান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় নৈতিক স্খলন ও মানসিক বৈকল্য খুবই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই উচ্চশিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ তাদের সামগ্রিক উপযোগিতা ও দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে আধুনিক অবকাঠামো এবং সমৃদ্ধ ক্যাম্পাস জীবনের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও ব্যক্তিগত বিকাশের জন্য মানসম্পন্ন অবকাঠামো নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শারীরিক অবকাঠামোর মান শুধু শিক্ষার গুণগতমান উন্নত করতেই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বস্তি ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

বলা হয়ে থাকে, উত্তরাধিকার ও পরিবেশই নিশ্চিত করে একজন মানুষ পরিণত বয়সে কেমন হবে। তাই একুশ শতকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের এমন একটি পরিবেশ প্রয়োজন যেখানে তারা জ্ঞানার্জন, গবেষণা এবং সুস্থ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পাবে। উন্নত অবকাঠামো ও সমৃদ্ধ ক্যাম্পাস জীবন কেবল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নত করবে না, বরং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সহযোগিতা, সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা, সহাবস্থান, পরমতসহিষ্ণুতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলিও বিকাশে সহায়তা করবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে একটি প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় শিক্ষা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা ও আগ্রহ আরও বাড়াবে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও জ্ঞান পরিমাপের জন্য কার্যকর ও যুগোপযোগী মূল্যায়ন পদ্ধতি অপরিহার্য। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাস্তরে প্রচলিত শিখন মূল্যায়নের গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক নয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুখস্থবিদ্যার প্রবণতা বাড়ছে এবং তারা প্রকৃত সমস্যা সমাধানে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারছে না। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। সৃজনশীল ও সমন্বিত মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং বাস্তবজীবনের প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব। বিশেষ করে সমস্যানির্ভর ও প্রকল্পভিত্তিক শিখন মূল্যায়নের মাধ্যমে একদিকে শিক্ষার মানও উন্নত হবে এবং অপরদিকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা বিশ্বমানে পৌঁছবে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন হলে শিক্ষার্থীরা কেবল দেশীয় চাকরির বাজারেই নয়, বরং বৈশ্বিক চাকরির বাজারেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক প্রয়োজনে নানা গবেষণা ও উদ্ভাবনমুখী কর্মকা- পরিচালনা করতে হবে। এসব কর্মকা- শুধু জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রেই সহায়ক হবে না, বরং দেশে শিল্প, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক খাতের উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আর সেজন্য গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ, গবেষণা ল্যাবরেটরি স্থাপন, শিল্পকারখানার সঙ্গে যৌথ গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতা কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন।

শিক্ষকদের গবেষণায় উৎসাহিত করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে দেশব্যাপী বিজ্ঞান মেলা ও গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনের জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে।একদিকে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। যেমন ইন্টার্নশিপ, প্রশিক্ষণ, এবং যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জগতের কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, যা তাদের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে রাখবে। অপরদিকে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইন শিক্ষা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্য বিজ্ঞান এবং অন্যান্য আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব। একইসঙ্গে শিক্ষকদেরও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষণ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত করতে হবে। শিক্ষাকে রাষ্ট্রসংস্কারের বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার ওপরও জোর দিতে হবে। দেশের জন্য সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নৈতিকতা, মানবাধিকার এবং সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

একুশ শতকের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদিকে যেমন জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে, অপরদিকে তেমনি দেশের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। শিক্ষার্থীদের মানবিক ও নৈতিক উৎকর্ষতা সাধনের পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক বিশ্ব বিদ্যার আলয়। আমরা সেই কাক্সিক্ষত আগামীর প্রত্যাশায় রইলাম।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top