রন্টি চৌধুরী
বিশ্বজুড়ে উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) একটি বিশাল ভূমিকা রাখে। ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির সময়ে কংগ্রেস অনুমোদিত ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টের মাধ্যমে এই সংস্থাটি গঠিত হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক সাহায্য সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম, যার বার্ষিক বাজেট প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের মোট বৈদেশিক সাহায্যের অর্ধেকেরও বেশি ইউএসএআইডির মাধ্যমে দেয়া হয়। ইউক্রেন, সাব-সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে এটি বড় ধরনের সহায়তা প্রদান করে। ইউএসএআইডি খাদ্য সহায়তা, দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অবকাঠামো নির্মাণ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিকাশসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করে। এটি পোলিও নির্মুল, ইবোলা প্রতিরোধ, এইচআইভি মোকাবিলা এবং সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংকটের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে ইউএসএআইডির উপস্থিতি দীর্ঘদিনের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই সংস্থাটি স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করে আসছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ইউএসএআইডি প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করেছে। এর মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলার শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। দেশে বিভিন্ন সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ইউএসএআইডি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও কাজ করছে।
এহেন একটি প্রতিষ্ঠানকে আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার কট্টর সমর্থন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক বন্ধ করে দিতে চাচ্ছেন। ডনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই বৈদেশিক সাহায্যের সমালোচক। তিনি মনে করেন, আমেরিকার করদাতাদের অর্থ বিদেশে ব্যয় না করে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে খরচ করা উচিত। এ বছর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্টের মসনদে বসেই, তিনি ৯০ দিনের জন্য সমস্ত আন্তর্জাতিক সাহায্য কার্যক্রম স্থগিত করেন। ইলন মাস্ককে ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি নামের একটি বাজেট কাটছাঁট দপ্তের প্রধান বানিয়ে দেন ট্রাম্প। ইলন মাস্কের প্রতিনিধি দল ইউএসএআইডির আর্থিক নথিপত্র পর্যালোচনা করতে গেলে সংস্থার নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের গোপনীয় তথ্য দেখাতে অস্বীকৃতি জানান, যেহেতু ইউএসএআইডির মতো একটি স্বাধীন এজেন্সির গোপন নথি মাস্কের দপ্তর আইনত দেখতে পারে না। কিন্তু এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যে দুজন শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এ কাজে বাধা দিয়েছিলেন তাদের সরিয়ে দেয়া হয় এবং মাস্ক ঘোষণা দেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউএসএআইডি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে রাজি হয়েছেন। এ ঘটনাটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতার জগতে এক বিশাল আলোড়ন তোলে। ইউএসএআইডি বন্ধের সিদ্ধান্ত শুধু উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলবে না, বরং এটি আমেরিকার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমিয়ে দেবে।
ইতোমধ্যে সোমবারে ইউএসএআইডির মেইন অফিসে কাউকে আসতে দেয়া হয় নি। সবাই শঙ্কিত। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ যে একজন অনির্বাচিত ব্যাক্তি মাস্কের ইচ্ছায় ইউএসএআইডি এর মতো প্রতিষ্ঠানের দশ হাজার কর্মীর এমন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি সত্যি ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিতে পারবেন? যদিও হোয়াইট হাউস ইউএসএআইডির কার্যক্রমে প্রভাব রাখতে পারে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এককভাবে এটি বন্ধ করতে পারবেন না। ইউএসএআইডি ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্ট অব ১৯৬১ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এটি বন্ধ করতে হলে কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রেসিডেন্টই এককভাবে এটি বিলুপ্ত করতে পারবেন না। এর ফলে ট্রাম্প প্রশাসন যদি এটি বন্ধ করতে চায়, তাহলে এটি দীর্ঘ আইনি ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে পরিণত হবে। ইউএসএআইডি বন্ধ করার জন্য কংগ্রেসের উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে, যা এই মুহূর্তে খুবই কঠিন। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে কেবল উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হবে না, বরং এটি আমেরিকার বৈদেশিক নীতিতে ব্যাপক ধাক্কা দেবে। বৈশ্বিক মানবিক সহায়তার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং ইউএসএআইডি এর অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এটি বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্বের অবস্থান দুর্বল হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর তাদের প্রভাব আরও বিস্তৃত করতে পারবে। ইতোমধ্যে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে বৈশ্বিক অবকাঠামো বিনিয়োগে অগ্রসর হচ্ছে, যা ইউএসএআইডি বন্ধ হলে আরও ত্বরান্বিত হবে। চীন এবং রাশিয়া উভয়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব শর্ত আরোপ করে, যা প্রায়শই পশ্চিমা দেশগুলোর শর্তের চেয়ে ভিন্ন হয়।
বাংলাদেশেও এর প্রভাব নেতিবাচক হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিতে ইউএসএআইডির বিনিয়োগ হ্রাস পেলে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তার একটি বড় অংশ ইউএসএআইডির মাধ্যমে আসে। এটি বন্ধ হলে শরণার্থীদের স্বাস্থ্য ও খাদ্য সহায়তা বিপর্যস্ত হতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির একটি বড় অংশ ইউএসএআইডির অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং এর ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হবে।
আমেরিকার বৈদেশিক সহায়তার সবচেয়ে বড় প্রতীক ইউএসএআইডি। এটি শুধু অর্থ সহায়তা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতিফলন। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে, আমেরিকার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে দেশটি দুর্বল হয়ে পড়বে। ইউএসএআইডি শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করে না, বরং এটি আমেরিকার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে আমেরিকার মিত্র দেশগুলোর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে, যা আমেরিকার বৈদেশিক নীতিকে দুর্বল করে দেবে।
ইতোমধ্যে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে অনেক উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ করছে। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রের এই দেশগুলোর ওপর প্রভাব কমে যাবে। ফলে বৈশ্বিক নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি কমবে। চীন এবং রাশিয়া উভয়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বৈদেশিক সাহায্যকে ব্যবহার করে। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। ইউএসএআইডির মতো সংস্থাগুলোর টিকে থাকা আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার না বানিয়ে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করাই হবে সঠিক পদক্ষেপ। ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে দুর্বল করতে পারে। ইউএসএআইডি বন্ধ করার পরিবর্তে, এর কার্যক্রমকে আরও কার্যকর এবং স্বচ্ছ করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে, ইউএসএআইডির মতো সংস্থাগুলোর শক্তিশালী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। ইউএসএআইডিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য, এর বাজেট বৃদ্ধি করা এবং এর কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করার জন্য নতুন কৌশল তৈরি করা উচিত।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পলিসিওয়াচ বাংলাদেশ]
রন্টি চৌধুরী
সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বিশ্বজুড়ে উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) একটি বিশাল ভূমিকা রাখে। ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির সময়ে কংগ্রেস অনুমোদিত ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টের মাধ্যমে এই সংস্থাটি গঠিত হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক সাহায্য সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম, যার বার্ষিক বাজেট প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের মোট বৈদেশিক সাহায্যের অর্ধেকেরও বেশি ইউএসএআইডির মাধ্যমে দেয়া হয়। ইউক্রেন, সাব-সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে এটি বড় ধরনের সহায়তা প্রদান করে। ইউএসএআইডি খাদ্য সহায়তা, দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অবকাঠামো নির্মাণ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিকাশসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করে। এটি পোলিও নির্মুল, ইবোলা প্রতিরোধ, এইচআইভি মোকাবিলা এবং সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংকটের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে ইউএসএআইডির উপস্থিতি দীর্ঘদিনের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই সংস্থাটি স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করে আসছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ইউএসএআইডি প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করেছে। এর মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলার শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। দেশে বিভিন্ন সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ইউএসএআইডি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও কাজ করছে।
এহেন একটি প্রতিষ্ঠানকে আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার কট্টর সমর্থন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক বন্ধ করে দিতে চাচ্ছেন। ডনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই বৈদেশিক সাহায্যের সমালোচক। তিনি মনে করেন, আমেরিকার করদাতাদের অর্থ বিদেশে ব্যয় না করে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে খরচ করা উচিত। এ বছর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্টের মসনদে বসেই, তিনি ৯০ দিনের জন্য সমস্ত আন্তর্জাতিক সাহায্য কার্যক্রম স্থগিত করেন। ইলন মাস্ককে ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি নামের একটি বাজেট কাটছাঁট দপ্তের প্রধান বানিয়ে দেন ট্রাম্প। ইলন মাস্কের প্রতিনিধি দল ইউএসএআইডির আর্থিক নথিপত্র পর্যালোচনা করতে গেলে সংস্থার নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের গোপনীয় তথ্য দেখাতে অস্বীকৃতি জানান, যেহেতু ইউএসএআইডির মতো একটি স্বাধীন এজেন্সির গোপন নথি মাস্কের দপ্তর আইনত দেখতে পারে না। কিন্তু এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যে দুজন শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এ কাজে বাধা দিয়েছিলেন তাদের সরিয়ে দেয়া হয় এবং মাস্ক ঘোষণা দেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউএসএআইডি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে রাজি হয়েছেন। এ ঘটনাটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতার জগতে এক বিশাল আলোড়ন তোলে। ইউএসএআইডি বন্ধের সিদ্ধান্ত শুধু উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলবে না, বরং এটি আমেরিকার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমিয়ে দেবে।
ইতোমধ্যে সোমবারে ইউএসএআইডির মেইন অফিসে কাউকে আসতে দেয়া হয় নি। সবাই শঙ্কিত। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ যে একজন অনির্বাচিত ব্যাক্তি মাস্কের ইচ্ছায় ইউএসএআইডি এর মতো প্রতিষ্ঠানের দশ হাজার কর্মীর এমন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি সত্যি ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিতে পারবেন? যদিও হোয়াইট হাউস ইউএসএআইডির কার্যক্রমে প্রভাব রাখতে পারে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এককভাবে এটি বন্ধ করতে পারবেন না। ইউএসএআইডি ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্ট অব ১৯৬১ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এটি বন্ধ করতে হলে কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রেসিডেন্টই এককভাবে এটি বিলুপ্ত করতে পারবেন না। এর ফলে ট্রাম্প প্রশাসন যদি এটি বন্ধ করতে চায়, তাহলে এটি দীর্ঘ আইনি ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে পরিণত হবে। ইউএসএআইডি বন্ধ করার জন্য কংগ্রেসের উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে, যা এই মুহূর্তে খুবই কঠিন। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে কেবল উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হবে না, বরং এটি আমেরিকার বৈদেশিক নীতিতে ব্যাপক ধাক্কা দেবে। বৈশ্বিক মানবিক সহায়তার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং ইউএসএআইডি এর অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এটি বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্বের অবস্থান দুর্বল হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর তাদের প্রভাব আরও বিস্তৃত করতে পারবে। ইতোমধ্যে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে বৈশ্বিক অবকাঠামো বিনিয়োগে অগ্রসর হচ্ছে, যা ইউএসএআইডি বন্ধ হলে আরও ত্বরান্বিত হবে। চীন এবং রাশিয়া উভয়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব শর্ত আরোপ করে, যা প্রায়শই পশ্চিমা দেশগুলোর শর্তের চেয়ে ভিন্ন হয়।
বাংলাদেশেও এর প্রভাব নেতিবাচক হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিতে ইউএসএআইডির বিনিয়োগ হ্রাস পেলে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তার একটি বড় অংশ ইউএসএআইডির মাধ্যমে আসে। এটি বন্ধ হলে শরণার্থীদের স্বাস্থ্য ও খাদ্য সহায়তা বিপর্যস্ত হতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির একটি বড় অংশ ইউএসএআইডির অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং এর ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হবে।
আমেরিকার বৈদেশিক সহায়তার সবচেয়ে বড় প্রতীক ইউএসএআইডি। এটি শুধু অর্থ সহায়তা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতিফলন। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে, আমেরিকার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে দেশটি দুর্বল হয়ে পড়বে। ইউএসএআইডি শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করে না, বরং এটি আমেরিকার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে আমেরিকার মিত্র দেশগুলোর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে, যা আমেরিকার বৈদেশিক নীতিকে দুর্বল করে দেবে।
ইতোমধ্যে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে অনেক উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ করছে। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রের এই দেশগুলোর ওপর প্রভাব কমে যাবে। ফলে বৈশ্বিক নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি কমবে। চীন এবং রাশিয়া উভয়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বৈদেশিক সাহায্যকে ব্যবহার করে। ইউএসএআইডি বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। ইউএসএআইডির মতো সংস্থাগুলোর টিকে থাকা আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার না বানিয়ে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করাই হবে সঠিক পদক্ষেপ। ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে দুর্বল করতে পারে। ইউএসএআইডি বন্ধ করার পরিবর্তে, এর কার্যক্রমকে আরও কার্যকর এবং স্বচ্ছ করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে, ইউএসএআইডির মতো সংস্থাগুলোর শক্তিশালী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। ইউএসএআইডিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য, এর বাজেট বৃদ্ধি করা এবং এর কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করার জন্য নতুন কৌশল তৈরি করা উচিত।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পলিসিওয়াচ বাংলাদেশ]