এম এ হোসাইন
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অপ্রচলিত এবং প্রায়শই চমকদার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বেশ পরিচিত। তার সর্বশেষ চটকদার ধারণাটি হলোÑ গাজা দখল করে সেখানকার ফিলিস্তিনি জনগণকে চিরস্থায়ীভাবে অন্যত্র স্থানান্তর করে ওই অঞ্চলটির উন্নয়ন সাধন করা। যদিও এটি একটি রসাত্মক উপন্যাসের মতো শোনায়, তবে এর অবাস্তবতা সত্ত্বেও, এই প্রস্তাবটি ট্রাম্পের মানসিকতা, সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি এবং ব্যবসা ও ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক সংঘাত দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অনেক কিছু প্রকাশ করে।
প্রথমেই অনেকে ট্রাম্পের গাজা ‘দখল’ করার ধারণাটি হাস্যকর মনে করে উড়িয়ে দেন। এই অঞ্চলটি গভীর ঐতিহাসিক সংঘাত, একটি গুরুতর মানবিক সংকট এবং জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতায় আক্রান্ত, যা দশকের পর দশক ধরে সমাধান এড়িয়ে চলেছে। তবুও ট্রাম্পের জন্য সবকিছু সম্ভব, এবং গাজা তার চূড়ান্ত ডিলমেকার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনের একটি সুযোগ হতে পারে। তার দৃষ্টিতে এটি একটি নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জনের জন্য আরও একধাপ এগিয়ে নিতে পারে।
ট্রাম্পের এই কাল্পনিক পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করে, আমরা তার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ‘ব্যবসা-প্রথম’ মানসিকতা প্রয়োগের বিস্তৃত প্রভাবগুলো উন্মোচন করতে পারি। গাজা কি সত্যিই একটি ‘ট্রাম্প-ব্র্যান্ডেড’ সাফল্যের গল্পে পরিণত হতে পারে? নাকি এই ধারণাটি ট্রাম্পের ভূ-রাজনীতি, মানবাধিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়গুলোর প্রতি মৌলিক ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে প্রতিফলিত করে?
ব্যবসা, মিডিয়া বা রাজনীতিতে ডিল করার জন্য ট্রাম্প সবসময় নিজেকে একজন সফল ডিলমেকার হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন। আলোচনা এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে জটিল পরিস্থিতি ‘ঠিক’ করার তার ক্ষমতার বিশ্বাস তার বৈদেশিক নীতি চিন্তার অনেকটাই নির্ধারণ করে। তার প্রথম মেয়াদে প্রসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় এটি আরও স্পষ্ট ছিল।
কিন্তু গাজা আটলান্টিক সিটির একটি ধুঁকে ধুঁকে চলা ক্যাসিনো নয়Ñ এটি একটি ঘনবসতিপূর্ণ যুদ্ধাঞ্চল যার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে প্রতিরোধ ও নিপীড়নের। ট্রাম্পের ধারণার মৌলিক ত্রুটি হলো যে তিনি আন্তর্জাতিক সংঘাতগুলোকে ব্যবসায়িক সমস্যা হিসেবে দেখেন, যা কূটনীতি ও ন্যায়বিচারের পরিবর্তে লেনদেনের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য বলে মনে করেন।
ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার সম্ভাবনাটি গাজায় তার আগ্রহের পেছনে একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শান্তি চুক্তিতে তার ভূমিকার জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি চেয়েছেন, বিশেষত ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে চুক্তি করার তার প্রচেষ্টা। তার মতে, গাজার সংকট ‘সমাধান’ করার মতো একটি চরম পদক্ষেপ তাকে একটি ঐতিহাসিক শান্তি স্থাপনকারীর মর্যাদায় উন্নীত করতে পারে, নৈতিক ও আইনি প্রভাব সত্ত্বেও।
যদি ট্রাম্প গাজা ‘দখল’ করেন, তবে এটি কেমন দেখাবে? তার ট্র্যাক রেকর্ডটি একটি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে যা বিলাসবহুল উন্নয়ন, চকচকে ব্র্যান্ডিং এবং অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পূর্ণ।
একটি ট্রাম্প টাওয়ার গাজার কল্পনা করুন, ধ্বংসাবশেষের মধ্যে উঠে আসা একটি চকচকে সোনালি আকাশচুম্বী ভবন। এর পাশে থাকতে পারে একটি গাজা ইন্টারন্যাশনাল গল্ফ রিসোর্ট, একটি বিলাসবহুল গন্তব্য, যা ‘বাণিজ্যের মাধ্যমে শান্তি’ প্রতিশ্রুতি দেয়। ট্রাম্প গাজাকে একটি ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল’ হিসেবে পরিণত করার কল্পনা করতে পারেন, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা, ক্যাসিনো এবং শপিংমল স্থাপনের জন্য আকর্ষণ করতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনা হিসেবে তার বিশ্বাস অঞ্চলটিকে ‘বাণিজ্যিকীকরণের’ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিতে পারে।
ট্রাম্পের স্বভাবশৈলীতে, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সম্ভবত একটি বড় সীমান্ত প্রাচীর জড়িত থাকবে, যা অনুমান করা যায় কাতার বা সৌদি আরবের মতো উপসাগরীয় দেশগুলো দ্বারা অর্থায়িত হবে। তিনি এটিকে নিরাপত্তা উদ্বেগের ‘সমাধান’ হিসেবে চিহ্নিত করবেন, এবং গভীর রাজনৈতিক জটিলতা এড়িয়ে চলবেন। ট্রাম্পের প্রস্তাবের সবচেয়ে বিতর্কিত দিকটি হলো গাজার জনসংখ্যাকে জর্ডান বা মিশরে স্থানান্তর করার ধারণা। এটি জাতিগত নিধন হিসেবে বিবেচিত হবে, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবে এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ সৃষ্টি করবে।
ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে গাজার বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামটি কেবল অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিষয় নয়Ñ এটি সার্বভৌমত্ব, স্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ বলপূর্বক দখল থেকে মুক্তির বিষয়। যে কোন পরিমাণ বিলাসবহুল উন্নয়ন রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিতদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারে না। যদিও ইসরায়েলি সরকারের কোন কোন অংশ গাজায় ফিলিস্তিনিদের দাবি দূর করার উপায় হিসেবে ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে, কিন্তু অন্যরা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ব্যাপক স্থানান্তরের জন্য লজিস্টিক অপর্যাপ্ততার বাস্তবতাকেও স্বীকার করে।
জর্ডান ও মিশর ইতোমধ্যেই গাজার জনসংখ্যা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। তাদের সরকারগুলো বুঝতে পেরেছে যে এমন একটি পদক্ষেপ তাদের নিজস্ব দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করবে এবং ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। ইরাক যুদ্ধের পর, বেশিরভাগ আমেরিকান মধ্যপ্রাচ্যে আরও সামরিক উপস্থিতির ব্যাপারে বেশ সতর্ক। গাজার জনসংখ্যাকে জোরপূর্বক তাদের মাতৃভূমি থেকে সরানোর ধারণাটি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ধারণার পাশাপাশি অন্যান্য বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক শক্তিগুলোও গাজার পেছনে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের পাশাপাশি অন্য পরাশক্তিগুলো যেমন রাশিয়া, চীন ও ভারত, সবাই গাজার ভবিষ্যৎ গঠনে বিনিয়োগ করেছে। সুতরাং, গাজায় মানবিক কারণে চেয়ে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক লাভের জন্যই সবাই বেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
গাজায় মার্কিন আগ্রহের সবচেয়ে উপেক্ষিত কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো এর অফশোর প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত। ইসরায়েল তার লেভিয়াথান এবং তামার গ্যাস ক্ষেত্রগুলি উন্মোচন করছে, যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলো রাশিয়ার জ্বালানি শক্তির ওপর নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছে। গাজার নিজস্ব গ্যাস ক্ষেত্রগুলো যা সম্প্রতি ইউরোপীয় ও ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোকে খননের অধিকার দেয়া হয়েছে। ফলে এটি ধারণা করা হয় গাজায় বিশাল মূল্যবান প্রাকৃতিক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মজুত রয়েছে। একটি স্থিতিশীল, জনশূন্য গাজা- গ্যাস উত্তোলনকে সহজ করতে পারে এবং অবকাঠামোর নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে পারে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনাটি বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য পুনর্বিন্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি গাজার সমস্যা ‘সমাধান’ হয় (জোরপূর্বক হলেও), এটি ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে গভীর কূটনৈতিক সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে। কাতার-তুরস্ক পাইপলাইন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে, যা অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা হ্রাস থেকে উপকৃত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মিলে রাশিয়াকে বৈশ্বিক গ্যাস বাজার থেকে উৎখাত করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। গাজার এই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই লক্ষ্য আরও এগিয়ে নিতে পারে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায়, যদি আমেরিকা ও ইসরায়েলের নেতৃত্বে গাজায় একটি বিশাল পুনর্গঠন প্রচেষ্টা সম্ভব হয় তবে এটি তাদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক হবে। যদি ট্রাম্প একটি ‘নতুন গাজা’ এর জন্য সমর্থন সুরক্ষিত করতে পারেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাণ কোম্পানি, প্রতিরক্ষা ঠিকাদার এবং অবকাঠামো ফার্মগুলোর অভাবনীয় লাভ হবে।
যদিও ট্রাম্পের গাজা ‘দখল’ করার ধারণাটি বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম তবুও তার বক্তব্যকে অবহেলা করা ঠিক নয়। বেন গভিরের মতো ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা ইতোমধ্যেই গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে সরানোর ধারণাটি গ্রহণ করেছেন। ট্রাম্পের মন্তব্যগুলো এই ব্যক্তিদের আরও আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে পারে।
ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি হলে আলোচিত শান্তি চুক্তির যে কোনও সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দেবে। এটি ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করবে এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে।
হামাসসহ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো সম্ভবত এমন একটি পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সহিংসতা বাড়াবে। ইতোমধ্যেই শরণার্থী জনসংখ্যার বোঝা বহনকারী জর্ডান ও মিশর ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। ফলে, ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনিদের আরও জোরপূর্বক স্থানচ্যুতির দিকে যে কোনও পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। এর পাশাপাশি, রাশিয়া বা চীনের আঞ্চলিক উচ্চাকাক্সক্ষার সমালোচনা করার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাও হ্রাস করবে।
ট্রাম্পের গাজা প্রস্তাবটি একটি উদ্ভট মনে হলেও, এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা তুলে ধরে। বিশ্বের পরাশক্তিধর জাতির রাষ্ট্রপতি জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকটগুলোকে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং ঐতিহাসিক সংগ্রামের বিষয় হিসেবে বিবেচনা না করে ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক আইন এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের গভীরভাবে প্রোথিত আদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতির বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। যদিও তিনি ব্র্যান্ডিং এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাস করতে পারেন তবে গাজার সংকটের জন্য কূটনীতি, মানবিক সমাধান এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রয়োজন। ট্রাম্প টাওয়ার কিংবা জোরপূর্বক স্থানান্তর পরিকল্পনা এক্ষেত্রে সফলতা বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।
এর মূলে, এই অবাস্তব প্রস্তাবটি ‘ব্যবসামনস্ক’ নেতা এবং বাস্তব বিশ্বের সংগ্রামরত বাস্তুচ্যুত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাই প্রতিফলিত করে এবং যদি ইতিহাস আমাদের একটি পাঠ শিখিয়ে থাকে, তবে তা হলো যে আপনি একটি হোটেল চেইন দিয়ে দখল, যুদ্ধ এবং জাতিগত সংঘাত সমাধান করতে পারবেন না।
[লেখক: রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অপ্রচলিত এবং প্রায়শই চমকদার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বেশ পরিচিত। তার সর্বশেষ চটকদার ধারণাটি হলোÑ গাজা দখল করে সেখানকার ফিলিস্তিনি জনগণকে চিরস্থায়ীভাবে অন্যত্র স্থানান্তর করে ওই অঞ্চলটির উন্নয়ন সাধন করা। যদিও এটি একটি রসাত্মক উপন্যাসের মতো শোনায়, তবে এর অবাস্তবতা সত্ত্বেও, এই প্রস্তাবটি ট্রাম্পের মানসিকতা, সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি এবং ব্যবসা ও ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক সংঘাত দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অনেক কিছু প্রকাশ করে।
প্রথমেই অনেকে ট্রাম্পের গাজা ‘দখল’ করার ধারণাটি হাস্যকর মনে করে উড়িয়ে দেন। এই অঞ্চলটি গভীর ঐতিহাসিক সংঘাত, একটি গুরুতর মানবিক সংকট এবং জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতায় আক্রান্ত, যা দশকের পর দশক ধরে সমাধান এড়িয়ে চলেছে। তবুও ট্রাম্পের জন্য সবকিছু সম্ভব, এবং গাজা তার চূড়ান্ত ডিলমেকার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনের একটি সুযোগ হতে পারে। তার দৃষ্টিতে এটি একটি নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জনের জন্য আরও একধাপ এগিয়ে নিতে পারে।
ট্রাম্পের এই কাল্পনিক পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করে, আমরা তার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ‘ব্যবসা-প্রথম’ মানসিকতা প্রয়োগের বিস্তৃত প্রভাবগুলো উন্মোচন করতে পারি। গাজা কি সত্যিই একটি ‘ট্রাম্প-ব্র্যান্ডেড’ সাফল্যের গল্পে পরিণত হতে পারে? নাকি এই ধারণাটি ট্রাম্পের ভূ-রাজনীতি, মানবাধিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়গুলোর প্রতি মৌলিক ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে প্রতিফলিত করে?
ব্যবসা, মিডিয়া বা রাজনীতিতে ডিল করার জন্য ট্রাম্প সবসময় নিজেকে একজন সফল ডিলমেকার হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন। আলোচনা এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে জটিল পরিস্থিতি ‘ঠিক’ করার তার ক্ষমতার বিশ্বাস তার বৈদেশিক নীতি চিন্তার অনেকটাই নির্ধারণ করে। তার প্রথম মেয়াদে প্রসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় এটি আরও স্পষ্ট ছিল।
কিন্তু গাজা আটলান্টিক সিটির একটি ধুঁকে ধুঁকে চলা ক্যাসিনো নয়Ñ এটি একটি ঘনবসতিপূর্ণ যুদ্ধাঞ্চল যার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে প্রতিরোধ ও নিপীড়নের। ট্রাম্পের ধারণার মৌলিক ত্রুটি হলো যে তিনি আন্তর্জাতিক সংঘাতগুলোকে ব্যবসায়িক সমস্যা হিসেবে দেখেন, যা কূটনীতি ও ন্যায়বিচারের পরিবর্তে লেনদেনের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য বলে মনে করেন।
ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার সম্ভাবনাটি গাজায় তার আগ্রহের পেছনে একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শান্তি চুক্তিতে তার ভূমিকার জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি চেয়েছেন, বিশেষত ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে চুক্তি করার তার প্রচেষ্টা। তার মতে, গাজার সংকট ‘সমাধান’ করার মতো একটি চরম পদক্ষেপ তাকে একটি ঐতিহাসিক শান্তি স্থাপনকারীর মর্যাদায় উন্নীত করতে পারে, নৈতিক ও আইনি প্রভাব সত্ত্বেও।
যদি ট্রাম্প গাজা ‘দখল’ করেন, তবে এটি কেমন দেখাবে? তার ট্র্যাক রেকর্ডটি একটি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে যা বিলাসবহুল উন্নয়ন, চকচকে ব্র্যান্ডিং এবং অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পূর্ণ।
একটি ট্রাম্প টাওয়ার গাজার কল্পনা করুন, ধ্বংসাবশেষের মধ্যে উঠে আসা একটি চকচকে সোনালি আকাশচুম্বী ভবন। এর পাশে থাকতে পারে একটি গাজা ইন্টারন্যাশনাল গল্ফ রিসোর্ট, একটি বিলাসবহুল গন্তব্য, যা ‘বাণিজ্যের মাধ্যমে শান্তি’ প্রতিশ্রুতি দেয়। ট্রাম্প গাজাকে একটি ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল’ হিসেবে পরিণত করার কল্পনা করতে পারেন, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা, ক্যাসিনো এবং শপিংমল স্থাপনের জন্য আকর্ষণ করতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনা হিসেবে তার বিশ্বাস অঞ্চলটিকে ‘বাণিজ্যিকীকরণের’ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিতে পারে।
ট্রাম্পের স্বভাবশৈলীতে, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সম্ভবত একটি বড় সীমান্ত প্রাচীর জড়িত থাকবে, যা অনুমান করা যায় কাতার বা সৌদি আরবের মতো উপসাগরীয় দেশগুলো দ্বারা অর্থায়িত হবে। তিনি এটিকে নিরাপত্তা উদ্বেগের ‘সমাধান’ হিসেবে চিহ্নিত করবেন, এবং গভীর রাজনৈতিক জটিলতা এড়িয়ে চলবেন। ট্রাম্পের প্রস্তাবের সবচেয়ে বিতর্কিত দিকটি হলো গাজার জনসংখ্যাকে জর্ডান বা মিশরে স্থানান্তর করার ধারণা। এটি জাতিগত নিধন হিসেবে বিবেচিত হবে, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবে এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ সৃষ্টি করবে।
ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে গাজার বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামটি কেবল অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিষয় নয়Ñ এটি সার্বভৌমত্ব, স্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ বলপূর্বক দখল থেকে মুক্তির বিষয়। যে কোন পরিমাণ বিলাসবহুল উন্নয়ন রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিতদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারে না। যদিও ইসরায়েলি সরকারের কোন কোন অংশ গাজায় ফিলিস্তিনিদের দাবি দূর করার উপায় হিসেবে ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে, কিন্তু অন্যরা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ব্যাপক স্থানান্তরের জন্য লজিস্টিক অপর্যাপ্ততার বাস্তবতাকেও স্বীকার করে।
জর্ডান ও মিশর ইতোমধ্যেই গাজার জনসংখ্যা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। তাদের সরকারগুলো বুঝতে পেরেছে যে এমন একটি পদক্ষেপ তাদের নিজস্ব দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করবে এবং ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। ইরাক যুদ্ধের পর, বেশিরভাগ আমেরিকান মধ্যপ্রাচ্যে আরও সামরিক উপস্থিতির ব্যাপারে বেশ সতর্ক। গাজার জনসংখ্যাকে জোরপূর্বক তাদের মাতৃভূমি থেকে সরানোর ধারণাটি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ধারণার পাশাপাশি অন্যান্য বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক শক্তিগুলোও গাজার পেছনে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের পাশাপাশি অন্য পরাশক্তিগুলো যেমন রাশিয়া, চীন ও ভারত, সবাই গাজার ভবিষ্যৎ গঠনে বিনিয়োগ করেছে। সুতরাং, গাজায় মানবিক কারণে চেয়ে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক লাভের জন্যই সবাই বেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
গাজায় মার্কিন আগ্রহের সবচেয়ে উপেক্ষিত কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো এর অফশোর প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত। ইসরায়েল তার লেভিয়াথান এবং তামার গ্যাস ক্ষেত্রগুলি উন্মোচন করছে, যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলো রাশিয়ার জ্বালানি শক্তির ওপর নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছে। গাজার নিজস্ব গ্যাস ক্ষেত্রগুলো যা সম্প্রতি ইউরোপীয় ও ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোকে খননের অধিকার দেয়া হয়েছে। ফলে এটি ধারণা করা হয় গাজায় বিশাল মূল্যবান প্রাকৃতিক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মজুত রয়েছে। একটি স্থিতিশীল, জনশূন্য গাজা- গ্যাস উত্তোলনকে সহজ করতে পারে এবং অবকাঠামোর নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে পারে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনাটি বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য পুনর্বিন্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি গাজার সমস্যা ‘সমাধান’ হয় (জোরপূর্বক হলেও), এটি ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে গভীর কূটনৈতিক সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে। কাতার-তুরস্ক পাইপলাইন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে, যা অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা হ্রাস থেকে উপকৃত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মিলে রাশিয়াকে বৈশ্বিক গ্যাস বাজার থেকে উৎখাত করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। গাজার এই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই লক্ষ্য আরও এগিয়ে নিতে পারে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায়, যদি আমেরিকা ও ইসরায়েলের নেতৃত্বে গাজায় একটি বিশাল পুনর্গঠন প্রচেষ্টা সম্ভব হয় তবে এটি তাদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক হবে। যদি ট্রাম্প একটি ‘নতুন গাজা’ এর জন্য সমর্থন সুরক্ষিত করতে পারেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাণ কোম্পানি, প্রতিরক্ষা ঠিকাদার এবং অবকাঠামো ফার্মগুলোর অভাবনীয় লাভ হবে।
যদিও ট্রাম্পের গাজা ‘দখল’ করার ধারণাটি বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম তবুও তার বক্তব্যকে অবহেলা করা ঠিক নয়। বেন গভিরের মতো ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা ইতোমধ্যেই গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে সরানোর ধারণাটি গ্রহণ করেছেন। ট্রাম্পের মন্তব্যগুলো এই ব্যক্তিদের আরও আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে পারে।
ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি হলে আলোচিত শান্তি চুক্তির যে কোনও সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দেবে। এটি ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করবে এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে।
হামাসসহ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো সম্ভবত এমন একটি পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সহিংসতা বাড়াবে। ইতোমধ্যেই শরণার্থী জনসংখ্যার বোঝা বহনকারী জর্ডান ও মিশর ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। ফলে, ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনিদের আরও জোরপূর্বক স্থানচ্যুতির দিকে যে কোনও পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। এর পাশাপাশি, রাশিয়া বা চীনের আঞ্চলিক উচ্চাকাক্সক্ষার সমালোচনা করার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাও হ্রাস করবে।
ট্রাম্পের গাজা প্রস্তাবটি একটি উদ্ভট মনে হলেও, এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা তুলে ধরে। বিশ্বের পরাশক্তিধর জাতির রাষ্ট্রপতি জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকটগুলোকে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং ঐতিহাসিক সংগ্রামের বিষয় হিসেবে বিবেচনা না করে ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক আইন এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের গভীরভাবে প্রোথিত আদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতির বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। যদিও তিনি ব্র্যান্ডিং এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাস করতে পারেন তবে গাজার সংকটের জন্য কূটনীতি, মানবিক সমাধান এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রয়োজন। ট্রাম্প টাওয়ার কিংবা জোরপূর্বক স্থানান্তর পরিকল্পনা এক্ষেত্রে সফলতা বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।
এর মূলে, এই অবাস্তব প্রস্তাবটি ‘ব্যবসামনস্ক’ নেতা এবং বাস্তব বিশ্বের সংগ্রামরত বাস্তুচ্যুত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাই প্রতিফলিত করে এবং যদি ইতিহাস আমাদের একটি পাঠ শিখিয়ে থাকে, তবে তা হলো যে আপনি একটি হোটেল চেইন দিয়ে দখল, যুদ্ধ এবং জাতিগত সংঘাত সমাধান করতে পারবেন না।
[লেখক: রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]