আনোয়ারুল হক
ষড়ঋতুর এই দেশে আর ষড়ঋতু নেই। পঞ্জিকা অনুযায়ী এখনও বসন্ত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই বসন্তেই রুদ্র, রুক্ষ গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা প্রকৃতি টের পেয়ে গেছে। বসন্তেও বসন্তের আমেজ প্রকৃতিতে নেই বললেই চলে। অন্যদিকে গত বছরের সজল বর্ষাকালেই নেমে এসেছিল বসন্ত। দেশের ছাত্র-তরুণরা সুফিয়া কামালের ভাষায় যখন গেয়ে উঠল ‘আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ (স্বৈরাচার) শেষ করি’ -- সেই বাসন্তী আমেজও আর মানুষের মনোজগতে নেই।
কিন্তু এটা তো সত্য আমাদের চোখের সামনে লাখো ছাত্র-তরুণ গুলি বোমার সামনে দাঁড়িয়ে মিছিলের সাথীকে হারানোর পরেও গানে গানে অবিস্মরণীয় এক সংগ্রাম গড়ে তোলে। দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের রং, কার্টুনে আঁকা বিদ্রোহ, কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’, মিউজিক পরিণত হয়ে গেল ম্যাজিকে। দেয়ালে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল আসছে হাসিনার বিদায় বাহন। কিন্তু ক্ষমতার মোহ তাদের অন্ধ করে দিয়েছিল। চোখের ওপর পর্দা টেনে, নির্দয় ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠে তারা রক্তের হোলি খেলায় নেমে পড়ে। আর নিজেদের জন্য দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অসম্মানজনক বিদায়ের পরিণতিকে ডেকে আনেন।
বিজয়ী গণঅভ্যুত্থান বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ এমন এক গণপরিসর সৃষ্টি করে যে, মানুষ আশায় বুক বাঁধে এখন থেকে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। সবাই মৌলিক মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠিত হবে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে, জাতি ও ধর্মগত সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের পথে দেশ অগ্রসর হবে।
এই যে স্বপ্ন আমাদের অতি সাধারণ তরুণরা দেখেছিল তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যে নতুন বন্দোবস্তের কথা শুনে সেদিন আমরা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেখানে যদি অসহিষ্ণুতা ও অসহনশীলতা, ক্রোধ ও প্রতিহিংসাই প্রতিদিন দেখতে হয় তবে তাকে নতুন বন্দোবস্ত বলা কঠিন। জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল কি ভুল হাতে চলে গেল? দেশে কি কার্যত কোনো সরকার আছে!
প্রধান উপদেষ্টা বলছেন এক কথা আর তার প্রতিবাদ জানিয়ে ভিন্ন কথা বলছেন তার তরুণ উপদেষ্টারা। তরুণ উপদেষ্টারা নতুন দলের রাজনীতির সঙ্গেও আছেন। আবার উপদেষ্টা পরিষদেও আছেন। তারা গাছেরটাও খাবেন আবার তলারটাও খাবেন। এটাই কি ‘নতুন স্বাধীনতা’? সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় তারা প্রধান উপদেষ্টাকে নিঃসঙ্গ বানিয়ে বা প্রধান উপদেষ্টাও উপদেষ্টাদের এ ধরনের স্বাধীনতা দিয়ে দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
মনে রাখা প্রয়োজন জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ছিল মূলত মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনার বহিঃপ্রকাশ। আর সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাতারে একজোট হয়ে দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ ছিল, তারা মনে করেছিলেন এই আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক দলের খবরদারি বা স্বার্থান্বেষী ইন্ধন নেই। সেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাই একটি নতুন রাজনৈতিক দলের ডাকে একইভাবে সাড়া দেবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই; বরং নতুন দলের কর্তাদের হাঁকডাক, জেদ, দম্ভ, ক্রোধ, প্রতিহিংসার মধ্যে মানুষ পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখতে পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে বন্দী হয়ে পড়ছে জুলাই অভ্যুত্থানগাথা। তারা সংস্কারের পরিবর্তে নতুন করে বৃহৎ আকারে বিভাজন তৈরি করে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের সব আকাক্সক্ষা পূরণ না হলেও দেশকে অস্থিতিশীলতার হাত থেকে রক্ষার স্বার্থে অতিদ্রুত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর জরুরি হয়ে পড়েছে। অহেতুক বিলম্ব দেশকে নতুন করে আবার এক অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিতে পারে। আবার নির্বাচন নিয়ে পর্দার অন্তরালে আসন ভাগাভাগির ‘পুরনো সেই দিনের কথা...’ নামক খেলা চললে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
সব মিলিয়ে বসন্তের শেষ প্রহরে মনে হচ্ছে,
‘কখন যে বসন্ত গেল, এবার হল না গান ... / কখন যে ফুল ফোটা হয়ে গেল অবসান’
সামনে ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। ওই দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল মুক্তির সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। আজকের প্রেক্ষাপটে তাকে মনে হচ্ছে ‘বর্ণময় রঙিন বিষাদ, বিষণœ সুন্দর’। তারপরেও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর দিকে ‘মানে না নয়ন কেন ফিরে ফিরে চায় .....’
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]
আনোয়ারুল হক
মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫
ষড়ঋতুর এই দেশে আর ষড়ঋতু নেই। পঞ্জিকা অনুযায়ী এখনও বসন্ত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই বসন্তেই রুদ্র, রুক্ষ গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা প্রকৃতি টের পেয়ে গেছে। বসন্তেও বসন্তের আমেজ প্রকৃতিতে নেই বললেই চলে। অন্যদিকে গত বছরের সজল বর্ষাকালেই নেমে এসেছিল বসন্ত। দেশের ছাত্র-তরুণরা সুফিয়া কামালের ভাষায় যখন গেয়ে উঠল ‘আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ (স্বৈরাচার) শেষ করি’ -- সেই বাসন্তী আমেজও আর মানুষের মনোজগতে নেই।
কিন্তু এটা তো সত্য আমাদের চোখের সামনে লাখো ছাত্র-তরুণ গুলি বোমার সামনে দাঁড়িয়ে মিছিলের সাথীকে হারানোর পরেও গানে গানে অবিস্মরণীয় এক সংগ্রাম গড়ে তোলে। দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের রং, কার্টুনে আঁকা বিদ্রোহ, কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’, মিউজিক পরিণত হয়ে গেল ম্যাজিকে। দেয়ালে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল আসছে হাসিনার বিদায় বাহন। কিন্তু ক্ষমতার মোহ তাদের অন্ধ করে দিয়েছিল। চোখের ওপর পর্দা টেনে, নির্দয় ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠে তারা রক্তের হোলি খেলায় নেমে পড়ে। আর নিজেদের জন্য দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অসম্মানজনক বিদায়ের পরিণতিকে ডেকে আনেন।
বিজয়ী গণঅভ্যুত্থান বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ এমন এক গণপরিসর সৃষ্টি করে যে, মানুষ আশায় বুক বাঁধে এখন থেকে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। সবাই মৌলিক মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠিত হবে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে, জাতি ও ধর্মগত সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের পথে দেশ অগ্রসর হবে।
এই যে স্বপ্ন আমাদের অতি সাধারণ তরুণরা দেখেছিল তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যে নতুন বন্দোবস্তের কথা শুনে সেদিন আমরা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেখানে যদি অসহিষ্ণুতা ও অসহনশীলতা, ক্রোধ ও প্রতিহিংসাই প্রতিদিন দেখতে হয় তবে তাকে নতুন বন্দোবস্ত বলা কঠিন। জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল কি ভুল হাতে চলে গেল? দেশে কি কার্যত কোনো সরকার আছে!
প্রধান উপদেষ্টা বলছেন এক কথা আর তার প্রতিবাদ জানিয়ে ভিন্ন কথা বলছেন তার তরুণ উপদেষ্টারা। তরুণ উপদেষ্টারা নতুন দলের রাজনীতির সঙ্গেও আছেন। আবার উপদেষ্টা পরিষদেও আছেন। তারা গাছেরটাও খাবেন আবার তলারটাও খাবেন। এটাই কি ‘নতুন স্বাধীনতা’? সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় তারা প্রধান উপদেষ্টাকে নিঃসঙ্গ বানিয়ে বা প্রধান উপদেষ্টাও উপদেষ্টাদের এ ধরনের স্বাধীনতা দিয়ে দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
মনে রাখা প্রয়োজন জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ছিল মূলত মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনার বহিঃপ্রকাশ। আর সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাতারে একজোট হয়ে দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ ছিল, তারা মনে করেছিলেন এই আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক দলের খবরদারি বা স্বার্থান্বেষী ইন্ধন নেই। সেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাই একটি নতুন রাজনৈতিক দলের ডাকে একইভাবে সাড়া দেবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই; বরং নতুন দলের কর্তাদের হাঁকডাক, জেদ, দম্ভ, ক্রোধ, প্রতিহিংসার মধ্যে মানুষ পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখতে পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে বন্দী হয়ে পড়ছে জুলাই অভ্যুত্থানগাথা। তারা সংস্কারের পরিবর্তে নতুন করে বৃহৎ আকারে বিভাজন তৈরি করে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের সব আকাক্সক্ষা পূরণ না হলেও দেশকে অস্থিতিশীলতার হাত থেকে রক্ষার স্বার্থে অতিদ্রুত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর জরুরি হয়ে পড়েছে। অহেতুক বিলম্ব দেশকে নতুন করে আবার এক অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিতে পারে। আবার নির্বাচন নিয়ে পর্দার অন্তরালে আসন ভাগাভাগির ‘পুরনো সেই দিনের কথা...’ নামক খেলা চললে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
সব মিলিয়ে বসন্তের শেষ প্রহরে মনে হচ্ছে,
‘কখন যে বসন্ত গেল, এবার হল না গান ... / কখন যে ফুল ফোটা হয়ে গেল অবসান’
সামনে ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। ওই দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল মুক্তির সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। আজকের প্রেক্ষাপটে তাকে মনে হচ্ছে ‘বর্ণময় রঙিন বিষাদ, বিষণœ সুন্দর’। তারপরেও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর দিকে ‘মানে না নয়ন কেন ফিরে ফিরে চায় .....’
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]