alt

উপ-সম্পাদকীয়

সুন্দরবন : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জনপদের ভরসার স্থল

মিহির কুমার রায়

: মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫
image

সুন্দরবনে গত ২২ বছরে ২৪ বার আগুন লেগেছে

ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবনের বৃহৎ অংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। নোনা পরিবেশে বিস্তৃত এই ম্যানগ্রোভ বন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অখ- বনভূমি। প্রকৃতির ওপর আমাদের নির্ভরতা অপরিহার্য, আর সুন্দরবন অক্সিজেন ও কার্বনের এক বিশাল ভা-ার হিসেবে কাজ করে। অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের আদান-প্রদানের মাধ্যমে এটি স্থানীয় জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, আমরা এই বনকে কতটা রক্ষা করতে পেরেছি, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দেশে বনভূমি ২৫% থাকার কথা থাকলেও তা এখন ১০%-এর নিচে নেমে গেছে, যা একটি মহাবিপদের সংকেত। মধুপুরের গড়, ভাওয়ালের গড় এবং বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনÑ এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো এখন হুমকির মুখে। এটি রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নেয়ার সময়।

সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী একটি বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বনভূমি। বঙ্গোপসাগরের উত্তরে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রধান অংশ অবস্থিত। এর মোট আয়তনের প্রায় ৬২% বাংলাদেশের অংশে পড়েছে।

সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল। এখানে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, বানর, উভচর প্রাণীসহ বিভিন্ন বিরল ও বিপন্ন প্রজাতি। এই বনে ৩২২টির বেশি মাছ, প্রায় ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর বসবাস রয়েছে। এছাড়া, ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ এর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। জলজ, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই বন বিশ্বের অন্যতম লবণাক্ত ম্যানগ্রোভ বন। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত সুন্দরবনের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত সামুদ্রিক স্রোত এবং কাদা চরের সমন্বয়ে। এর প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

‘সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। সরকার বনজ রাজস্বের ৪১% এই বন থেকে আহরণ করে এবং উপকূলীয় এলাকার জ্বালানি কাঠের চাহিদা পূরণ করে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় গঠিত বদ্বীপ অঞ্চলে সুন্দরবনের উৎপত্তি। দিনে দুবার জোয়ার-ভাটায় এর নদী-খাল প্লাবিত হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভাটার স্থায়িত্ব বেড়েছে এবং পলি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে, ফলে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ভারতের ফারাক্কা বাঁধসহ নদীর আন্তঃসংযোগমূলক প্রকল্পগুলো এই নাব্য সংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এটি ভবিষ্যতে আগুনের ঘটনা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

বনের চারপাশে মানুষের বসতি থাকায় বন উজাড়, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, কাঠ, কাঁকড়া, ঝিনুকের অতি আহরণ এবং নৌ পরিবহনের ত্রুটির কারণে সুন্দরবন বিপন্নতার দিকে এগোচ্ছে। জাহাজডুবি, তেল, ফার্নেস ওয়েল, কয়লা, সারসহ রাসায়নিক দ্রব্যে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, যা জলজ প্রাণীদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে। পলি জমে নদীর অববাহিকা ভরাট হলে মানুষ সেখানে বসতি ও স্থাপনা গড়ে তুলছে।

সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি প্রাকৃতিক ঢাল। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সামুদ্রিক ঝড়ে এর ঘন বৃক্ষরাজি বাফার জোন হিসেবে কাজ করে, যা জনবসতি, চাষাবাদ ও অবকাঠামোকে বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। সিডর, আইলা ও আম্পানের মতো দুর্যোগে সুন্দরবন না থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি হতো। মধু, কাঠ, গোলপাতা, মাছ ও কাঁকড়ার মতো সম্পদ লাখো মানুষের জীবিকার উৎস। পর্যটন খাতেও এর বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে অর্থনীতিতে অবদান রাখে।

তবে, সুন্দরবন আজ নানা হুমকির মুখে। অবৈধ কাঠ কাটা, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিরল প্রাণীর শিকার ও পাচার, শিল্প বর্জ্য ও তেল নিঃসরণে জলজ পরিবেশের দূষণ এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো উন্নয়ন প্রকল্প এর জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের ফুসফুসখ্যাত এই বিশ্ব ঐতিহ্যে গত ২২ বছরে ২৪ বার আগুন লেগেছে। চারটি রেঞ্জের মধ্যে শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে না বা লাগানো হয় নাÑ এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বন বিভাগের হিসাবে, এই দুই রেঞ্জে ২৩ বার আগুনে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমি পুড়েছে। সর্বশেষ আগুনের ক্ষতি এখনো নির্ধারিত হয়নি। প্রতিবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সুপারিশগুলো ফাইলবন্দি থেকে যায়। প্রস্তাবিত সমাধানের মধ্যে রয়েছে নদী-খাল খনন, প্রতি দুই কিলোমিটারে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, কাঁটাতার বা নাইলনের বেড়া দেয়া। সেফ দ্য ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, “লোকালয়-সংলগ্ন নদী-খাল খনন, কাঁটাতারের বেড়া, বন অপরাধীদের দমন ও অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা জরুরি।”

সুন্দরবন-সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা বনের ওপর চাপ কমাতে পারে। এতে বন উজাড় ও অসৎ ব্যবসায়ীদের রোধ সম্ভব। বন বিভাগকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে ড্রোন ও স্যাটেলাইট মনিটরিং চালু করা যেতে পারে। অবৈধ কাঠ আহরণ, শিকার ও পাচার বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। শিল্প ও অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশগত মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ইউনেস্কোর সহযোগিতায় টেকসই সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি প্রয়োজন। আমাদের দায়িত্ব এই অমূল্য সম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা, যাতে সুন্দরবন চিরকাল আমাদের রক্ষাকবচ হয়ে থাকে।

[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

কখন বসন্ত গেল, এবার হল না গান

সেই কালরাত

মাটির যথার্থ পরিচর্যা : জীবনের ভিত রক্ষার আহ্বান

আমাদের বন, আমাদের পানি : প্রকৃতির সংকট ও আমাদের করণীয়

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই

রামনবমী ঘিরে সাম্প্রদায়িক কৌশল

ঈদে মিলবে না নতুন নোট

প্রসঙ্গ : পুরুষ ধর্ষণ

শাহবাগ শাপলা বিভাজন : দায় যাদের তাদেরই করতে হবে নিরসন

বিশ্ব বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস

নতুন রাজনৈতিক দল কি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে?

ছবি

ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ছাভা’ : ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ

রম্যগদ্য : বোধ যখন ক্রোধ

গাছে পেরেক ঠোকা

মানুষ ও বন্য হাতি

আলুর চাষ, বীজ উৎপাদন ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

অখণ্ড বাংলা তত্ত্ব : বাইনারিজম থেকে মুক্তির পথ

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত মত প্রকাশের গুরুত্ব

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স প্রবাহ

ভারতব্যাপী সংঘ : বিজেপির নয়া কৌশল

আর্থিক খাত নিয়ে অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য

ভূমিকম্পের আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

মনে কী দ্বিধা রেখে নতুন প্রত্যাশায় নতুন দল!

ছবি

উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুর্নীতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন

আদালতের ভেতরে ভিডিও ধারণের আইনি দিক

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সুন্দরবন : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জনপদের ভরসার স্থল

মিহির কুমার রায়

image

সুন্দরবনে গত ২২ বছরে ২৪ বার আগুন লেগেছে

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫

ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবনের বৃহৎ অংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। নোনা পরিবেশে বিস্তৃত এই ম্যানগ্রোভ বন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অখ- বনভূমি। প্রকৃতির ওপর আমাদের নির্ভরতা অপরিহার্য, আর সুন্দরবন অক্সিজেন ও কার্বনের এক বিশাল ভা-ার হিসেবে কাজ করে। অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের আদান-প্রদানের মাধ্যমে এটি স্থানীয় জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, আমরা এই বনকে কতটা রক্ষা করতে পেরেছি, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দেশে বনভূমি ২৫% থাকার কথা থাকলেও তা এখন ১০%-এর নিচে নেমে গেছে, যা একটি মহাবিপদের সংকেত। মধুপুরের গড়, ভাওয়ালের গড় এবং বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনÑ এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো এখন হুমকির মুখে। এটি রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নেয়ার সময়।

সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী একটি বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বনভূমি। বঙ্গোপসাগরের উত্তরে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রধান অংশ অবস্থিত। এর মোট আয়তনের প্রায় ৬২% বাংলাদেশের অংশে পড়েছে।

সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল। এখানে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, বানর, উভচর প্রাণীসহ বিভিন্ন বিরল ও বিপন্ন প্রজাতি। এই বনে ৩২২টির বেশি মাছ, প্রায় ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর বসবাস রয়েছে। এছাড়া, ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ এর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। জলজ, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই বন বিশ্বের অন্যতম লবণাক্ত ম্যানগ্রোভ বন। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত সুন্দরবনের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত সামুদ্রিক স্রোত এবং কাদা চরের সমন্বয়ে। এর প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

‘সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। সরকার বনজ রাজস্বের ৪১% এই বন থেকে আহরণ করে এবং উপকূলীয় এলাকার জ্বালানি কাঠের চাহিদা পূরণ করে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় গঠিত বদ্বীপ অঞ্চলে সুন্দরবনের উৎপত্তি। দিনে দুবার জোয়ার-ভাটায় এর নদী-খাল প্লাবিত হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভাটার স্থায়িত্ব বেড়েছে এবং পলি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে, ফলে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ভারতের ফারাক্কা বাঁধসহ নদীর আন্তঃসংযোগমূলক প্রকল্পগুলো এই নাব্য সংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এটি ভবিষ্যতে আগুনের ঘটনা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

বনের চারপাশে মানুষের বসতি থাকায় বন উজাড়, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, কাঠ, কাঁকড়া, ঝিনুকের অতি আহরণ এবং নৌ পরিবহনের ত্রুটির কারণে সুন্দরবন বিপন্নতার দিকে এগোচ্ছে। জাহাজডুবি, তেল, ফার্নেস ওয়েল, কয়লা, সারসহ রাসায়নিক দ্রব্যে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, যা জলজ প্রাণীদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে। পলি জমে নদীর অববাহিকা ভরাট হলে মানুষ সেখানে বসতি ও স্থাপনা গড়ে তুলছে।

সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি প্রাকৃতিক ঢাল। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সামুদ্রিক ঝড়ে এর ঘন বৃক্ষরাজি বাফার জোন হিসেবে কাজ করে, যা জনবসতি, চাষাবাদ ও অবকাঠামোকে বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। সিডর, আইলা ও আম্পানের মতো দুর্যোগে সুন্দরবন না থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি হতো। মধু, কাঠ, গোলপাতা, মাছ ও কাঁকড়ার মতো সম্পদ লাখো মানুষের জীবিকার উৎস। পর্যটন খাতেও এর বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে অর্থনীতিতে অবদান রাখে।

তবে, সুন্দরবন আজ নানা হুমকির মুখে। অবৈধ কাঠ কাটা, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিরল প্রাণীর শিকার ও পাচার, শিল্প বর্জ্য ও তেল নিঃসরণে জলজ পরিবেশের দূষণ এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো উন্নয়ন প্রকল্প এর জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের ফুসফুসখ্যাত এই বিশ্ব ঐতিহ্যে গত ২২ বছরে ২৪ বার আগুন লেগেছে। চারটি রেঞ্জের মধ্যে শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে না বা লাগানো হয় নাÑ এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বন বিভাগের হিসাবে, এই দুই রেঞ্জে ২৩ বার আগুনে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমি পুড়েছে। সর্বশেষ আগুনের ক্ষতি এখনো নির্ধারিত হয়নি। প্রতিবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সুপারিশগুলো ফাইলবন্দি থেকে যায়। প্রস্তাবিত সমাধানের মধ্যে রয়েছে নদী-খাল খনন, প্রতি দুই কিলোমিটারে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, কাঁটাতার বা নাইলনের বেড়া দেয়া। সেফ দ্য ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, “লোকালয়-সংলগ্ন নদী-খাল খনন, কাঁটাতারের বেড়া, বন অপরাধীদের দমন ও অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা জরুরি।”

সুন্দরবন-সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা বনের ওপর চাপ কমাতে পারে। এতে বন উজাড় ও অসৎ ব্যবসায়ীদের রোধ সম্ভব। বন বিভাগকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে ড্রোন ও স্যাটেলাইট মনিটরিং চালু করা যেতে পারে। অবৈধ কাঠ আহরণ, শিকার ও পাচার বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। শিল্প ও অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশগত মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ইউনেস্কোর সহযোগিতায় টেকসই সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি প্রয়োজন। আমাদের দায়িত্ব এই অমূল্য সম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা, যাতে সুন্দরবন চিরকাল আমাদের রক্ষাকবচ হয়ে থাকে।

[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

back to top