alt

উপ-সম্পাদকীয়

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

: বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

বিশ্বজুড়ে ১৭৩টি শহরের বাসযোগ্যতা সূচকে প্রকাশ করে আসছে লন্ডন ভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। প্রতিবেদনটি ২০১৫ সাল থেকে পাঁচটি মানদ-ে এই জীবন মানের মূল্যায়ন করে আসছে, যেমন স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সে মোট ১০০ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে যে শহর যত বেশি পয়েন্ট পায়, তালিকায় সেটির অবস্থান তত উপরে থাকে। ২০২৪ সালের বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা শেষদিক থেকে ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে, যা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। অপরদিকে, বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় এবার নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা (৯৮.৪) এরপরেই রয়েছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেন হেগেন (৯৮) এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ (৯৭.১)। বসবাসযোগ্য ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকার চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে ৫টি শহর। এগুলো হচ্ছেÑ সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক (৩০.৭), লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি (৪০.১), আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স (৪২), নাইজেরিয়ার লাগোস (৪২.২) ও পাকিস্তানের করাচি (৪২.৭)। তালিকায় ২০২১ সাল থেকে অব্যাহত ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন হামলায় বিধ্বস্ত ইউক্রেনের রাজধানী শহর কিয়েভ (৪৪.৫) বাংলাদেশের ঢাকার তুলনায় তিন ধাপ ওপরে আছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত দেশটির এই রাজধানী বাসযোগ্য শহরের তালিকায় এই বছর ১৬৫তম অবস্থানে রয়েছে।

২০২৪ সালের বাসযোগ্যতার সূচকে দেখা গেছে, বিশ্বে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। আগের বছর ১৬৬তম অবস্থানে থাকলেও এবার ১৬৮ নম্বরে নেমে এসেছে। উক্ত সূচকে ঢাকা স্থিতিশীলতায় ৫০, স্বাস্থ্যসেবায় ৪১.৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৪০.৫, শিক্ষায় ৬৬.৭ এবং অবকাঠামোতে ২৬.৮ পয়েন্ট পেয়েছে।

বাসযোগ্যতার সূচকে বিগত বেশ কয়েক বছরের সমীক্ষা পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই, এই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ঢাকার দুই ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণে রয়েছে নাগরিকদের শিক্ষার পরিবেশ ও গুণগত মানের পতন। অর্থাৎ ২০২৩ সালে যেখানে শিক্ষা খাতে আমাদের নম্বর ছিল ৭৫ তা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬.৭-এ। অন্য মানদ-গুলোতে আমাদের অবস্থান একই থাকলেও শুধু শিক্ষা খাতে মানদ-ের অবনতির কারণে মূলত এই বছর আমরা দুই ধাপ পিছিয়ে গেছি। শিক্ষা খাতে আমাদের এই অবনতির পেছনে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আমরা চিহ্নিত করতে পারি, বিগত কয়েক দশকে ঢাকায় ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নটর ডেম কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের মতো মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর হতে দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসম্মত চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের মতো নতুন মানসম্মত সরকারি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব অনুভব করছি। যদিও অসংখ্য বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, তবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়া যেমন ব্যয়বহুল একই সঙ্গে পড়ার মানও আশানুরূপ নয়।

পর্যাপ্ত চিকিৎসা শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবারও ঘাটতি রয়েছে, যার কারণে আমরা এই সূচকে এখনও স্বাস্থ্যসেবায় পঞ্চাশও অতিক্রম করতে পারিনি। এই খাতে আমাদের স্কোর এখনো ৪১.৭, যা গত বছরও একই ছিল এবং পূর্ববর্তী বছরে আরো নিম্ন (২৯.২) ছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মহামারীর সময় আমরা আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় ঘাটতি প্রতিনিয়তই বুঝতে পারি। ঢাকায় এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য অপর্যাপ্ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা এবং ব্যয়বহুল বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা উভয়ে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে পিছিয়ে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ঢাকা শহরের স্থিতিশীলতা গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্সে সব সময় একটি চ্যালেঞ্জিং দিক হয়ে থাকে। ক্রাইম রেট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সন্ত্রাসবাদের হুমকি এই স্থিতিশীলতার মানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। ঢাকায় অপরাধের হার তুলনামূলকভাবে বেশি, যা স্থিতিশীলতার স্কোরকে কমিয়ে দেয়। হরতাল, বিক্ষোভ, শ্রমিকদের আন্দোলন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঢাকার স্থিতিশীলতার মানকে প্রভাবিত করে। এসব ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলে ঢাকার স্থিতিশীলতা গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্সে উন্নত হতে পারে।

সংস্কৃতি ও পরিবেশ খাতেও বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। বিগত তিন বছর ধরেই আমরা এই খাতে একই নম্বর (৪০.৫) পেয়ে আসছি। ঢাকা এখন সবচেয়ে জনবহুল শহরের মধ্যে একটি। শহরটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, দ্রুত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই শহরকে দুর্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার মানুষের বাস। ম্যাক্রোট্রেন্ডসের মেট্রো এরিয়া র‍্যাঙ্কিং-২০২৩ অনুযায়ী, ঢাকা পৃথিবীর চতুর্থ ঘনবসতিপূর্ণ শহর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকায় বন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে ঢাকার নিচু এলাকাগুলো জলাবদ্ধতায় ভোগে। ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী এই চারটি নদী থাকার পরও বেপরোয়া নদী দখল, অপ-পরিকল্পনা ও অব্যবস্থাপনার ফলে এমন অসম্ভব দুর্যোগের কবলে নিপতিত আমাদের রাজধানী। জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি প্রভাব হলো ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ২০২৪ সালের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় উত্তরা সেক্টর-১৩ এলাকায় এবং সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় নয়াপল্টনে।তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী তারচেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। ঢাকায় তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণ। ‘ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট-২০২৩’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ আর নগর হিসেবে বিশ্বে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ঢাকা। ক্যাপস (সেন্টার ফর অ্যাটমস্ফিয়ারিক পলুশন স্টাডিস)-এর গবেষণা থেকে পাওয়া যায় যে, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৯.৫ শতাংশ, গৃহস্থালি বা রান্নার চুলার কাজের থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।

বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৪৩। এর মধ্যে অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ ১০০-তে পেয়েছে ২৬.৮। ২০১৯ সালেও বাংলাদেশ অবকাঠামো খাতে ২৬.৮ পেয়েছিল। অন্যান্য সূচকে কিছুটা কমবেশি হলেও অবকাঠামো সূচকে ধারাবাহিকভাবে একই নম্বর পাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকদের মতে, সূচকের একই অবস্থানে থাকাও অবনতির সামিল। অথচ বসবাস যোগ্যতার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের করাচি অবকাঠামো সূচকে পেয়েছে ৫১.৮ পয়েন্ট। ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহি দুর্বল। ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে। আগামী সময়েও বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অগ্রগতির সম্ভাবনা কম। ঢাকায় নাগরিক সুবিধা ও জনঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার অবাসযোগ্যতা ও অস্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কর্মকা- সারাদেশের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বিশদ অঞ্চলেই পরিকল্পনা ও অন্যান্য আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। ঢাকায় যেসব অবকাঠামো গড়া হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পনার মানদ-ে যথেষ্ট না।

বাসযোগ্য শহরে গণপরিবহন অপরিহার্য। গত এক দশকে ঢাকায় যানবাহন বেড়েছে ৩০০ শতাংশ। কিন্তু সড়ক নেটওয়ার্ক বাড়েনি। সরকার অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব দিলেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। সরকার বাসমালিকদের কাছে জিম্মি। বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার সড়কে পিক-টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি হচ্ছে ৪.৮ কিলোমিটার, যা একজন সাধারণ মানুষের হাঁটার গতির (৫ কি.মি.) চেয়েও কম। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ২০ ভাগের এক ভাগ। এই শহরকে বাঁচাতে হলে উন্নতমানের গণপরিবহন চালু করতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মেগা প্রকল্পে আগ্রহ বেশি। ফলে ঢাকায় টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। ঢাকায় সেবা দেয়ার সঙ্গে যেসব সংস্থা জড়িত, তাদের দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা কেন পিছিয়ে যাচ্ছি, সেটার জবাব তারা দেয় না। অবকাঠামো খাতে চরমভাবে খারাপ করছে বাংলাদেশ। শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, বাসগুলো যাত্রীর জন্য মারামারি করে এটাকে গণপরিবহন বলা যায় না। যে পরিস্থিতি তাতে ভবিষ্যতেও বাসযোগ্যতায় খুব বেশি উন্নতি হবে না।

ঢাকার বাসযোগ্যতায় পিছিয়ে থাকার পেছনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষসহ (ওয়াসা) প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রকট সমন্বয়হীনতা অনেকাংশে দায়ী। তাছাড়া নগর সংস্থায় দুর্নীতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দুর্বল এবং নিজেদের নাগরিক অধিকারের জন্য যে শহরে আন্দোলন করতে হয়, সেখানে বাসযোগ্যতা কম থাকবেই। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শহরকে বাইপাস করে যাওয়ার কথা, সেটি শহরকে ধ্বংস করতে করতে যাচ্ছে। শাহবাগ শিশুপার্ক বছরের পর বছর বন্ধ। সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাসযোগ্যতায় কিছুটা উন্নতি সম্ভব।

বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় এবার নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। ১০০-তে দেশটির স্কোর ৯৮.৪। ঢাকার অবস্থান রাতারাতি ভিয়েনার মতো করা সম্ভব হবে না। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ঢাকামুখী অভিগমনের হার কমানো এবং বাসযোগ্যতায় ঢাকার অবস্থান নিচের দিকে থাকার কারণ নির্ধারণ করে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও টেকসই উন্নয়ন কর্মকা-ের মাধ্যমে সূচকে উন্নতি করা সম্ভব।

ঢাকার বাসযোগ্যতা সূচক উন্নয়নের জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে; যেমন- সড়ক অবকাঠামো উন্নত করা এবং কার্যকর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা, শিল্প কারখানা এবং যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সবুজায়ন বৃদ্ধি করা, নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান উন্নত করা এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমানো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

ঢাকার বাসযোগ্যতা সূচক উন্নয়নের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ, নাগরিকদের সচেতনতা এবং পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকা একটি বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভেবিলিটি র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকার অবস্থান উন্নয়নের জন্যই নয় বরং নিজেদের জন্যই ঢাকাকে একটি বসবাসযোগ্য সুন্দর শহরে পরিণত করতে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ]

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ও করণীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

রম্যগদ্য : ‘চোর চাই, চোর...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

বিশ্বজুড়ে ১৭৩টি শহরের বাসযোগ্যতা সূচকে প্রকাশ করে আসছে লন্ডন ভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। প্রতিবেদনটি ২০১৫ সাল থেকে পাঁচটি মানদ-ে এই জীবন মানের মূল্যায়ন করে আসছে, যেমন স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সে মোট ১০০ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে যে শহর যত বেশি পয়েন্ট পায়, তালিকায় সেটির অবস্থান তত উপরে থাকে। ২০২৪ সালের বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা শেষদিক থেকে ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে, যা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। অপরদিকে, বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় এবার নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা (৯৮.৪) এরপরেই রয়েছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেন হেগেন (৯৮) এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ (৯৭.১)। বসবাসযোগ্য ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকার চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে ৫টি শহর। এগুলো হচ্ছেÑ সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক (৩০.৭), লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি (৪০.১), আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স (৪২), নাইজেরিয়ার লাগোস (৪২.২) ও পাকিস্তানের করাচি (৪২.৭)। তালিকায় ২০২১ সাল থেকে অব্যাহত ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন হামলায় বিধ্বস্ত ইউক্রেনের রাজধানী শহর কিয়েভ (৪৪.৫) বাংলাদেশের ঢাকার তুলনায় তিন ধাপ ওপরে আছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত দেশটির এই রাজধানী বাসযোগ্য শহরের তালিকায় এই বছর ১৬৫তম অবস্থানে রয়েছে।

২০২৪ সালের বাসযোগ্যতার সূচকে দেখা গেছে, বিশ্বে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। আগের বছর ১৬৬তম অবস্থানে থাকলেও এবার ১৬৮ নম্বরে নেমে এসেছে। উক্ত সূচকে ঢাকা স্থিতিশীলতায় ৫০, স্বাস্থ্যসেবায় ৪১.৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৪০.৫, শিক্ষায় ৬৬.৭ এবং অবকাঠামোতে ২৬.৮ পয়েন্ট পেয়েছে।

বাসযোগ্যতার সূচকে বিগত বেশ কয়েক বছরের সমীক্ষা পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই, এই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ঢাকার দুই ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণে রয়েছে নাগরিকদের শিক্ষার পরিবেশ ও গুণগত মানের পতন। অর্থাৎ ২০২৩ সালে যেখানে শিক্ষা খাতে আমাদের নম্বর ছিল ৭৫ তা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬.৭-এ। অন্য মানদ-গুলোতে আমাদের অবস্থান একই থাকলেও শুধু শিক্ষা খাতে মানদ-ের অবনতির কারণে মূলত এই বছর আমরা দুই ধাপ পিছিয়ে গেছি। শিক্ষা খাতে আমাদের এই অবনতির পেছনে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আমরা চিহ্নিত করতে পারি, বিগত কয়েক দশকে ঢাকায় ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নটর ডেম কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের মতো মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর হতে দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসম্মত চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের মতো নতুন মানসম্মত সরকারি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব অনুভব করছি। যদিও অসংখ্য বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, তবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়া যেমন ব্যয়বহুল একই সঙ্গে পড়ার মানও আশানুরূপ নয়।

পর্যাপ্ত চিকিৎসা শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবারও ঘাটতি রয়েছে, যার কারণে আমরা এই সূচকে এখনও স্বাস্থ্যসেবায় পঞ্চাশও অতিক্রম করতে পারিনি। এই খাতে আমাদের স্কোর এখনো ৪১.৭, যা গত বছরও একই ছিল এবং পূর্ববর্তী বছরে আরো নিম্ন (২৯.২) ছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মহামারীর সময় আমরা আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় ঘাটতি প্রতিনিয়তই বুঝতে পারি। ঢাকায় এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য অপর্যাপ্ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা এবং ব্যয়বহুল বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা উভয়ে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে পিছিয়ে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ঢাকা শহরের স্থিতিশীলতা গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্সে সব সময় একটি চ্যালেঞ্জিং দিক হয়ে থাকে। ক্রাইম রেট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সন্ত্রাসবাদের হুমকি এই স্থিতিশীলতার মানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। ঢাকায় অপরাধের হার তুলনামূলকভাবে বেশি, যা স্থিতিশীলতার স্কোরকে কমিয়ে দেয়। হরতাল, বিক্ষোভ, শ্রমিকদের আন্দোলন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঢাকার স্থিতিশীলতার মানকে প্রভাবিত করে। এসব ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলে ঢাকার স্থিতিশীলতা গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্সে উন্নত হতে পারে।

সংস্কৃতি ও পরিবেশ খাতেও বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। বিগত তিন বছর ধরেই আমরা এই খাতে একই নম্বর (৪০.৫) পেয়ে আসছি। ঢাকা এখন সবচেয়ে জনবহুল শহরের মধ্যে একটি। শহরটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, দ্রুত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই শহরকে দুর্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার মানুষের বাস। ম্যাক্রোট্রেন্ডসের মেট্রো এরিয়া র‍্যাঙ্কিং-২০২৩ অনুযায়ী, ঢাকা পৃথিবীর চতুর্থ ঘনবসতিপূর্ণ শহর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকায় বন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে ঢাকার নিচু এলাকাগুলো জলাবদ্ধতায় ভোগে। ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী এই চারটি নদী থাকার পরও বেপরোয়া নদী দখল, অপ-পরিকল্পনা ও অব্যবস্থাপনার ফলে এমন অসম্ভব দুর্যোগের কবলে নিপতিত আমাদের রাজধানী। জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি প্রভাব হলো ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ২০২৪ সালের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় উত্তরা সেক্টর-১৩ এলাকায় এবং সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় নয়াপল্টনে।তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী তারচেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। ঢাকায় তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণ। ‘ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট-২০২৩’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ আর নগর হিসেবে বিশ্বে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ঢাকা। ক্যাপস (সেন্টার ফর অ্যাটমস্ফিয়ারিক পলুশন স্টাডিস)-এর গবেষণা থেকে পাওয়া যায় যে, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৯.৫ শতাংশ, গৃহস্থালি বা রান্নার চুলার কাজের থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।

বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৪৩। এর মধ্যে অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ ১০০-তে পেয়েছে ২৬.৮। ২০১৯ সালেও বাংলাদেশ অবকাঠামো খাতে ২৬.৮ পেয়েছিল। অন্যান্য সূচকে কিছুটা কমবেশি হলেও অবকাঠামো সূচকে ধারাবাহিকভাবে একই নম্বর পাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকদের মতে, সূচকের একই অবস্থানে থাকাও অবনতির সামিল। অথচ বসবাস যোগ্যতার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের করাচি অবকাঠামো সূচকে পেয়েছে ৫১.৮ পয়েন্ট। ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহি দুর্বল। ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে। আগামী সময়েও বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অগ্রগতির সম্ভাবনা কম। ঢাকায় নাগরিক সুবিধা ও জনঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার অবাসযোগ্যতা ও অস্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কর্মকা- সারাদেশের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বিশদ অঞ্চলেই পরিকল্পনা ও অন্যান্য আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। ঢাকায় যেসব অবকাঠামো গড়া হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পনার মানদ-ে যথেষ্ট না।

বাসযোগ্য শহরে গণপরিবহন অপরিহার্য। গত এক দশকে ঢাকায় যানবাহন বেড়েছে ৩০০ শতাংশ। কিন্তু সড়ক নেটওয়ার্ক বাড়েনি। সরকার অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব দিলেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। সরকার বাসমালিকদের কাছে জিম্মি। বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার সড়কে পিক-টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি হচ্ছে ৪.৮ কিলোমিটার, যা একজন সাধারণ মানুষের হাঁটার গতির (৫ কি.মি.) চেয়েও কম। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ২০ ভাগের এক ভাগ। এই শহরকে বাঁচাতে হলে উন্নতমানের গণপরিবহন চালু করতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মেগা প্রকল্পে আগ্রহ বেশি। ফলে ঢাকায় টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। ঢাকায় সেবা দেয়ার সঙ্গে যেসব সংস্থা জড়িত, তাদের দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা কেন পিছিয়ে যাচ্ছি, সেটার জবাব তারা দেয় না। অবকাঠামো খাতে চরমভাবে খারাপ করছে বাংলাদেশ। শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, বাসগুলো যাত্রীর জন্য মারামারি করে এটাকে গণপরিবহন বলা যায় না। যে পরিস্থিতি তাতে ভবিষ্যতেও বাসযোগ্যতায় খুব বেশি উন্নতি হবে না।

ঢাকার বাসযোগ্যতায় পিছিয়ে থাকার পেছনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষসহ (ওয়াসা) প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রকট সমন্বয়হীনতা অনেকাংশে দায়ী। তাছাড়া নগর সংস্থায় দুর্নীতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দুর্বল এবং নিজেদের নাগরিক অধিকারের জন্য যে শহরে আন্দোলন করতে হয়, সেখানে বাসযোগ্যতা কম থাকবেই। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শহরকে বাইপাস করে যাওয়ার কথা, সেটি শহরকে ধ্বংস করতে করতে যাচ্ছে। শাহবাগ শিশুপার্ক বছরের পর বছর বন্ধ। সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাসযোগ্যতায় কিছুটা উন্নতি সম্ভব।

বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় এবার নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। ১০০-তে দেশটির স্কোর ৯৮.৪। ঢাকার অবস্থান রাতারাতি ভিয়েনার মতো করা সম্ভব হবে না। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ঢাকামুখী অভিগমনের হার কমানো এবং বাসযোগ্যতায় ঢাকার অবস্থান নিচের দিকে থাকার কারণ নির্ধারণ করে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও টেকসই উন্নয়ন কর্মকা-ের মাধ্যমে সূচকে উন্নতি করা সম্ভব।

ঢাকার বাসযোগ্যতা সূচক উন্নয়নের জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে; যেমন- সড়ক অবকাঠামো উন্নত করা এবং কার্যকর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা, শিল্প কারখানা এবং যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সবুজায়ন বৃদ্ধি করা, নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান উন্নত করা এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমানো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

ঢাকার বাসযোগ্যতা সূচক উন্নয়নের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ, নাগরিকদের সচেতনতা এবং পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকা একটি বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভেবিলিটি র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকার অবস্থান উন্নয়নের জন্যই নয় বরং নিজেদের জন্যই ঢাকাকে একটি বসবাসযোগ্য সুন্দর শহরে পরিণত করতে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ]

back to top