রেজাউল করিম খোকন
সামাজিক দায়বদ্ধতা বা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) হলো এমন একটি ব্যবসায়িক নীতি, যা সমাজের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনকে ব্যবসার অংশ করে। কোনো ব্যবসা শুধু নৈতিক ও আইনগতভাবে পরিচালিত হলেই তার সমস্ত দায়িত্ব শেষ হয় না। যে সমাজে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সেই সমাজের প্রতি তার কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। বর্তমানে বিশ্বের বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআরের অংশ হিসেবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়নে অংশ নিচ্ছে। এই কার্যক্রমে তারা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশের কিছু অংশ বরাদ্দ রাখে।
সিএসআর ধারণাটি ১৯৬০-১৯৭০ এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়। ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ‘স্টেকহোল্ডার’ শব্দটি প্রচলন করে, যারা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়। সমর্থকদের মতে, সিএসআর দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বাড়ায়। তবে সমালোচকরা মনে করেন, সিএসআর-এ অতিরিক্ত মনোযোগ প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যক্রম থেকে বিচ্যুত করে এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। ২০০০ সালে ম্যাকউইলিয়াম ও সেইগেলের গবেষণায় দেখা যায়, সিএসআর-এ ব্যয় প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে প্রভাবিত করে। তারা মনে করেন, এই অর্থ গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে সমাজ বেশি উপকৃত হতো।
কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা সমাজ, মানুষ ও পরিবেশের ওপর প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের প্রভাবের জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে। এর জন্য প্রতিষ্ঠানকে মুনাফার কিছু অংশ সমাজের উন্নয়নে ব্যয় করতে হয়, তবে এটি অন্যান্য লক্ষ্যকে অবহেলা করে নয়। একজন দক্ষ ম্যানেজারের চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনৈতিক, আইনি ও সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। সিএসআর-এ নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান কম লাভজনক হবে, এমন ধারণা সঠিক নয়। বরং, এটি সমাজ ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্যই লাভজনক।
বাংলাদেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআর-এর আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ খাতে উল্লেখযোগ্য ব্যয় করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় শিক্ষায় সর্বোচ্চ ৩০%, স্বাস্থ্যে ৩০%, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে ২০% এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ২০% ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো সিএসআর-এ ৩০৬.৭৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা আগের ছয় মাসের তুলনায় ০.৭৮% কম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ৪৬.৯১%, স্বাস্থ্যে ২৫.১৬%, শিক্ষায় ১৭.৫৫% এবং জলবায়ু ও পরিবেশে ৩.৬৩% ব্যয় হয়েছে। তবে ছয়টি ব্যাংকÑ বেসিক ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকÑ লোকসানের কারণে সিএসআর-এ কোনো ব্যয় করেনি।
২০২২ সালে সিএসআর ব্যয় ছিল ১,১৪৩ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে কমে ৯২৪ কোটি এবং ২০২৪ সালে আরও কমে ৬১৫.৯৬ কোটি টাকায় নেমেছে, যা আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ব্যাংক খাতের উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট ও মুনাফা হ্রাস এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৮ সালে প্রথম সিএসআর নীতিমালা জারি করে এবং অপব্যবহার রোধে তথ্যভান্ডার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন নীতিমালায় জলবায়ু পরিবর্তন ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
শুধু কর্পোরেট নয়, ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতাও গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের এগিয়ে নেয়া। বিত্তবানদের উচিত অসহায়দের কল্যাণে এগিয়ে আসা। সামাজিক বৈষম্য দূর না হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যবশত, আধুনিক সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়ছে, যা সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ক্ষুণœ করছে। সুনাগরিক হতে হলে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সমাজের কল্যাণে কাজ করতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা মানুষের সহজাত দায়িত্বশীলতা, যা সভ্যতার অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। এই সংকটকালে সবার উচিত অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
রোববার, ০৪ মে ২০২৫
সামাজিক দায়বদ্ধতা বা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) হলো এমন একটি ব্যবসায়িক নীতি, যা সমাজের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনকে ব্যবসার অংশ করে। কোনো ব্যবসা শুধু নৈতিক ও আইনগতভাবে পরিচালিত হলেই তার সমস্ত দায়িত্ব শেষ হয় না। যে সমাজে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সেই সমাজের প্রতি তার কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। বর্তমানে বিশ্বের বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআরের অংশ হিসেবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়নে অংশ নিচ্ছে। এই কার্যক্রমে তারা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশের কিছু অংশ বরাদ্দ রাখে।
সিএসআর ধারণাটি ১৯৬০-১৯৭০ এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়। ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ‘স্টেকহোল্ডার’ শব্দটি প্রচলন করে, যারা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়। সমর্থকদের মতে, সিএসআর দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বাড়ায়। তবে সমালোচকরা মনে করেন, সিএসআর-এ অতিরিক্ত মনোযোগ প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যক্রম থেকে বিচ্যুত করে এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। ২০০০ সালে ম্যাকউইলিয়াম ও সেইগেলের গবেষণায় দেখা যায়, সিএসআর-এ ব্যয় প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে প্রভাবিত করে। তারা মনে করেন, এই অর্থ গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে সমাজ বেশি উপকৃত হতো।
কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা সমাজ, মানুষ ও পরিবেশের ওপর প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের প্রভাবের জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে। এর জন্য প্রতিষ্ঠানকে মুনাফার কিছু অংশ সমাজের উন্নয়নে ব্যয় করতে হয়, তবে এটি অন্যান্য লক্ষ্যকে অবহেলা করে নয়। একজন দক্ষ ম্যানেজারের চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনৈতিক, আইনি ও সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। সিএসআর-এ নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান কম লাভজনক হবে, এমন ধারণা সঠিক নয়। বরং, এটি সমাজ ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্যই লাভজনক।
বাংলাদেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআর-এর আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ খাতে উল্লেখযোগ্য ব্যয় করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় শিক্ষায় সর্বোচ্চ ৩০%, স্বাস্থ্যে ৩০%, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে ২০% এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ২০% ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো সিএসআর-এ ৩০৬.৭৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা আগের ছয় মাসের তুলনায় ০.৭৮% কম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ৪৬.৯১%, স্বাস্থ্যে ২৫.১৬%, শিক্ষায় ১৭.৫৫% এবং জলবায়ু ও পরিবেশে ৩.৬৩% ব্যয় হয়েছে। তবে ছয়টি ব্যাংকÑ বেসিক ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকÑ লোকসানের কারণে সিএসআর-এ কোনো ব্যয় করেনি।
২০২২ সালে সিএসআর ব্যয় ছিল ১,১৪৩ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে কমে ৯২৪ কোটি এবং ২০২৪ সালে আরও কমে ৬১৫.৯৬ কোটি টাকায় নেমেছে, যা আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ব্যাংক খাতের উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট ও মুনাফা হ্রাস এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৮ সালে প্রথম সিএসআর নীতিমালা জারি করে এবং অপব্যবহার রোধে তথ্যভান্ডার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন নীতিমালায় জলবায়ু পরিবর্তন ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
শুধু কর্পোরেট নয়, ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতাও গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের এগিয়ে নেয়া। বিত্তবানদের উচিত অসহায়দের কল্যাণে এগিয়ে আসা। সামাজিক বৈষম্য দূর না হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যবশত, আধুনিক সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়ছে, যা সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ক্ষুণœ করছে। সুনাগরিক হতে হলে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সমাজের কল্যাণে কাজ করতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা মানুষের সহজাত দায়িত্বশীলতা, যা সভ্যতার অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। এই সংকটকালে সবার উচিত অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]