মতিউর রহমান
আধুনিক প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশ আমাদের জীবনকে অনেক সহজ ও গতিশীল করেছে; তবে এর ব্যবহার যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়, বিশেষ করে শিশুদের জীবনে, তখন তা নতুন সংকটের জন্ম দেয়। শৈশব হলো জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যখন শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের ভিত তৈরি হয়। এই সময়ে খেলাধুলা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ শিশুর সামগ্রিক বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বর্তমান যুগে শিশুদের হাতে হাতে স্মার্টফোন, ট্যাব ও অন্যান্য গ্যাজেট সহজলভ্য হওয়ায় তারা ক্রমশ ইলেকট্রনিক পর্দার জগতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান স্ক্রিন টাইম খেলার মাঠের খোলা আকাশ ও বন্ধুদের সঙ্গ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে, যা শৈশবের স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করছে।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা শিশুদের স্ক্রিন টাইমের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। অভিভাবকরা অনেক সময় শিশুদের শান্ত রাখার জন্য বা নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য তাদের হাতে স্মার্ট ডিভাইস তুলে দেন। স্মার্টফোনে বা ট্যাবে থাকা বিভিন্ন গেমস, কার্টুন ও অ্যাপস শিশুদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হয়। এগুলোর উজ্জ্বল রং, দ্রুত পরিবর্তনশীল দৃশ্য এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া শিশুদের মুগ্ধ করে রাখে। অনেক ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা ও এর জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস ব্যবহারও স্ক্রিন টাইম বাড়াতে ভূমিকা রাখে, যদিও এর অতিরিক্ত ও অযাচিত ব্যবহার শিশুদের ক্ষতির কারণ হয়। শহুরে জীবনে খেলার মাঠের স্বল্পতা, অ্যাপার্টমেন্ট জীবনযাপন এবং অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবও শিশুদের ঘরের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করার সুযোগ সীমিত করে দেয়। এর ফলে বিনোদনের সহজলভ্য উৎস হিসেবে স্ক্রিনই তাদের প্রধান সঙ্গী হয়ে ওঠে।
ঐতিহ্যগতভাবে খেলার মাঠ শিশুদের শারীরিক কার্যকলাপ, সামাজিকীকরণ এবং কল্পনাশক্তির বিকাশে কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দৌড়ানো, ঝাঁপানো, লুকোচুরি খেলা, বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে খেলাধুলা করাÑ এসবের মাধ্যমে শিশুরা শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করত, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব শিখত, নিজেদের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে শিখত এবং নতুন নতুন খেলার উদ্ভাবন করে কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটাত। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো তাদের মানসিক শান্তি দিত। কিন্তু স্ক্রিন টাইম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা খেলার মাঠবিমুখ হয়ে পড়ছে। তারা ঘরে বসেই ভার্চুয়াল জগতে নিজেদের আবদ্ধ করে রাখছে, যেখানে শারীরিক শ্রমের কোনো স্থান নেই এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সীমিত শুধু ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুদের মধ্যে।
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটানা বসে বা শুয়ে গ্যাজেট ব্যবহারের ফলে তাদের শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বাড়ে, যা শৈশবেই স্থূলতার ঝুঁকি তৈরি করে। দীর্ঘক্ষণ পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়, চোখে শুষ্কতা বা চুলকানির মতো সমস্যা দেখা দেয়। ঘুমের স্বাভাবিক চক্র ব্যাহত হয়, কারণ স্ক্রিনের নীল আলো মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণে বাধা দেয়, যা ঘুমের জন্য জরুরি। এছাড়া, ভুল ভঙ্গিতে বসার কারণে ঘাড়, পিঠ ও কোমরে ব্যথা হতে পারে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক গঠনেও এটি বাধা সৃষ্টি করতে পারে। শারীরিক খেলার অভাবে শিশুদের মাংসপেশি ও হাড়ের গঠন দুর্বল হতে পারে এবং তাদের সামগ্রিক শারীরিক সক্ষমতা কমে যায়।
শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি স্ক্রিন টাইম শিশুদের মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। অতিরিক্ত গেমিং বা ভিডিও দেখার ফলে শিশুদের মনোযোগের সময়কাল কমে যায়, তারা অল্পতেই বিরক্ত বা খিটখিটে হয়ে ওঠে। ভার্চুয়াল জগতের তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টি তাদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অসহিষ্ণু করে তোলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অনলাইন গেমসের মাধ্যমে তারা এক ধরনের ভার্চুয়াল সামাজিকতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও, বাস্তবে বন্ধু তৈরি করা, মুখের ভাব বা শারীরিক ভাষা বোঝা এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনে তারা পিছিয়ে পড়ে। এর ফলে তারা একাকীত্ব ও বিষণœতায় ভুগতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রিন ব্যবহার শিশুদের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তির বিকাশেও বাধা দেয়, কারণ তারা প্রস্তুত করা কন্টেন্ট দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজেরা কিছু চিন্তা বা তৈরি করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় তারা অনলাইনে অনুপযুক্ত বা ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর সংস্পর্শে আসে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
খেলার মাঠ হারানোর কুফল কেবল শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি শিশুদের সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াকেও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। খেলার মাঠে শিশুরা সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করে, ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে একসঙ্গে খেলা করে, নিয়মকানুন শেখে, নেতৃত্ব দেয়া ও মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলে। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাদের মধ্যে সহযোগিতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং দলীয় মনোভাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গুণাবলি বিকাশে সাহায্য করে। কিন্তু স্ক্রিনে আটকে থাকা শিশুরা এই মূল্যবান সামাজিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে না, যা তাদের ভবিষ্যতের সামাজিক জীবনে সমস্যা তৈরি করতে পারে। বাস্তব জগতের সমস্যা সমাধান এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতাও তাদের কমে যায়।
শিশুদের শৈশবকে প্রযুক্তির ফাঁদ থেকে মুক্ত করে খেলার মাঠে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সচেতন হতে হবে এবং শিশুদের স্ক্রিন ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। তাদের বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে, যেমন বই পড়া, আর্ট বা ক্রাফটিংয়ের মতো সৃজনশীল কাজে যুক্ত করা বা ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শিশুদের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করার জন্য উৎসাহিত করা এবং তাদের জন্য সময় বের করে তাদের খেলার মাঠে নিয়ে যাওয়া। অভিভাবক হিসেবে নিজেরাও প্রযুক্তির স্বাস্থ্যকর ব্যবহার করে শিশুদের সামনে উদাহরণ স্থাপন করা জরুরি। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসনও খেলার মাঠের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহারকে পুরোপুরি বন্ধ না করে এর ইতিবাচক দিকগুলো (শিক্ষামূলক অ্যাপস ইত্যাদি) কাজে লাগিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন শেখানো যেতে পারে।
স্ক্রিন টাইম আধুনিক শৈশবের এক কঠিন বাস্তবতা যা নীরবে শিশুদের খেলার মাঠ কেড়ে নিচ্ছে এবং তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটি শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। খেলার মাঠ কেবল খেলার জায়গা নয়, এটি শিশুর সার্বিক বিকাশের এক উন্মুক্ত পাঠশালা। সুস্থ ও সুন্দর শৈশবের জন্য প্রযুক্তি ও খেলার মাঠের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য আনা আজ সময়ের দাবি। শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্থ প্রজন্ম নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং খেলার মাঠের হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে হবে। শিশুদের হাতে গ্যাজেট নয়, তাদের হাতে খেলার বল তুলে দিয়ে মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়াই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
আধুনিক প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশ আমাদের জীবনকে অনেক সহজ ও গতিশীল করেছে; তবে এর ব্যবহার যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়, বিশেষ করে শিশুদের জীবনে, তখন তা নতুন সংকটের জন্ম দেয়। শৈশব হলো জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যখন শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের ভিত তৈরি হয়। এই সময়ে খেলাধুলা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ শিশুর সামগ্রিক বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বর্তমান যুগে শিশুদের হাতে হাতে স্মার্টফোন, ট্যাব ও অন্যান্য গ্যাজেট সহজলভ্য হওয়ায় তারা ক্রমশ ইলেকট্রনিক পর্দার জগতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান স্ক্রিন টাইম খেলার মাঠের খোলা আকাশ ও বন্ধুদের সঙ্গ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে, যা শৈশবের স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করছে।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা শিশুদের স্ক্রিন টাইমের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। অভিভাবকরা অনেক সময় শিশুদের শান্ত রাখার জন্য বা নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য তাদের হাতে স্মার্ট ডিভাইস তুলে দেন। স্মার্টফোনে বা ট্যাবে থাকা বিভিন্ন গেমস, কার্টুন ও অ্যাপস শিশুদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হয়। এগুলোর উজ্জ্বল রং, দ্রুত পরিবর্তনশীল দৃশ্য এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া শিশুদের মুগ্ধ করে রাখে। অনেক ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা ও এর জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস ব্যবহারও স্ক্রিন টাইম বাড়াতে ভূমিকা রাখে, যদিও এর অতিরিক্ত ও অযাচিত ব্যবহার শিশুদের ক্ষতির কারণ হয়। শহুরে জীবনে খেলার মাঠের স্বল্পতা, অ্যাপার্টমেন্ট জীবনযাপন এবং অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবও শিশুদের ঘরের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করার সুযোগ সীমিত করে দেয়। এর ফলে বিনোদনের সহজলভ্য উৎস হিসেবে স্ক্রিনই তাদের প্রধান সঙ্গী হয়ে ওঠে।
ঐতিহ্যগতভাবে খেলার মাঠ শিশুদের শারীরিক কার্যকলাপ, সামাজিকীকরণ এবং কল্পনাশক্তির বিকাশে কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দৌড়ানো, ঝাঁপানো, লুকোচুরি খেলা, বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে খেলাধুলা করাÑ এসবের মাধ্যমে শিশুরা শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করত, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব শিখত, নিজেদের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে শিখত এবং নতুন নতুন খেলার উদ্ভাবন করে কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটাত। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো তাদের মানসিক শান্তি দিত। কিন্তু স্ক্রিন টাইম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা খেলার মাঠবিমুখ হয়ে পড়ছে। তারা ঘরে বসেই ভার্চুয়াল জগতে নিজেদের আবদ্ধ করে রাখছে, যেখানে শারীরিক শ্রমের কোনো স্থান নেই এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সীমিত শুধু ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুদের মধ্যে।
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটানা বসে বা শুয়ে গ্যাজেট ব্যবহারের ফলে তাদের শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বাড়ে, যা শৈশবেই স্থূলতার ঝুঁকি তৈরি করে। দীর্ঘক্ষণ পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়, চোখে শুষ্কতা বা চুলকানির মতো সমস্যা দেখা দেয়। ঘুমের স্বাভাবিক চক্র ব্যাহত হয়, কারণ স্ক্রিনের নীল আলো মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণে বাধা দেয়, যা ঘুমের জন্য জরুরি। এছাড়া, ভুল ভঙ্গিতে বসার কারণে ঘাড়, পিঠ ও কোমরে ব্যথা হতে পারে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক গঠনেও এটি বাধা সৃষ্টি করতে পারে। শারীরিক খেলার অভাবে শিশুদের মাংসপেশি ও হাড়ের গঠন দুর্বল হতে পারে এবং তাদের সামগ্রিক শারীরিক সক্ষমতা কমে যায়।
শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি স্ক্রিন টাইম শিশুদের মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। অতিরিক্ত গেমিং বা ভিডিও দেখার ফলে শিশুদের মনোযোগের সময়কাল কমে যায়, তারা অল্পতেই বিরক্ত বা খিটখিটে হয়ে ওঠে। ভার্চুয়াল জগতের তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টি তাদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অসহিষ্ণু করে তোলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অনলাইন গেমসের মাধ্যমে তারা এক ধরনের ভার্চুয়াল সামাজিকতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও, বাস্তবে বন্ধু তৈরি করা, মুখের ভাব বা শারীরিক ভাষা বোঝা এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনে তারা পিছিয়ে পড়ে। এর ফলে তারা একাকীত্ব ও বিষণœতায় ভুগতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রিন ব্যবহার শিশুদের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তির বিকাশেও বাধা দেয়, কারণ তারা প্রস্তুত করা কন্টেন্ট দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজেরা কিছু চিন্তা বা তৈরি করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় তারা অনলাইনে অনুপযুক্ত বা ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর সংস্পর্শে আসে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
খেলার মাঠ হারানোর কুফল কেবল শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি শিশুদের সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াকেও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। খেলার মাঠে শিশুরা সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করে, ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে একসঙ্গে খেলা করে, নিয়মকানুন শেখে, নেতৃত্ব দেয়া ও মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলে। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাদের মধ্যে সহযোগিতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং দলীয় মনোভাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গুণাবলি বিকাশে সাহায্য করে। কিন্তু স্ক্রিনে আটকে থাকা শিশুরা এই মূল্যবান সামাজিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে না, যা তাদের ভবিষ্যতের সামাজিক জীবনে সমস্যা তৈরি করতে পারে। বাস্তব জগতের সমস্যা সমাধান এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতাও তাদের কমে যায়।
শিশুদের শৈশবকে প্রযুক্তির ফাঁদ থেকে মুক্ত করে খেলার মাঠে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সচেতন হতে হবে এবং শিশুদের স্ক্রিন ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। তাদের বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে, যেমন বই পড়া, আর্ট বা ক্রাফটিংয়ের মতো সৃজনশীল কাজে যুক্ত করা বা ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শিশুদের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করার জন্য উৎসাহিত করা এবং তাদের জন্য সময় বের করে তাদের খেলার মাঠে নিয়ে যাওয়া। অভিভাবক হিসেবে নিজেরাও প্রযুক্তির স্বাস্থ্যকর ব্যবহার করে শিশুদের সামনে উদাহরণ স্থাপন করা জরুরি। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসনও খেলার মাঠের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহারকে পুরোপুরি বন্ধ না করে এর ইতিবাচক দিকগুলো (শিক্ষামূলক অ্যাপস ইত্যাদি) কাজে লাগিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন শেখানো যেতে পারে।
স্ক্রিন টাইম আধুনিক শৈশবের এক কঠিন বাস্তবতা যা নীরবে শিশুদের খেলার মাঠ কেড়ে নিচ্ছে এবং তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটি শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। খেলার মাঠ কেবল খেলার জায়গা নয়, এটি শিশুর সার্বিক বিকাশের এক উন্মুক্ত পাঠশালা। সুস্থ ও সুন্দর শৈশবের জন্য প্রযুক্তি ও খেলার মাঠের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য আনা আজ সময়ের দাবি। শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্থ প্রজন্ম নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং খেলার মাঠের হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে হবে। শিশুদের হাতে গ্যাজেট নয়, তাদের হাতে খেলার বল তুলে দিয়ে মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়াই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]