alt

উপ-সম্পাদকীয়

অন্ধকার সত্য, শেষ সত্য নয়!

আনোয়ারুল হক

: সোমবার, ১৯ মে ২০২৫
image

আগের একটি লেখা থেকে দু’লাইন উদ্ধৃত করছি। ‘জুলাই জাগরণে আমাদের ছাত্র-তরুণরা গুলি-বোমার সামনে দাঁড়িয়ে মিছিলের সাথীকে হারানোর পরেও গানে গানে অবিস্মরণীয় এক সংগ্রাম গড়ে তোলে। দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের রং, কার্টুনে আঁকা বিদ্রোহ, কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা বা এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। মিউজিক পরিণত হয়ে গেল ম্যাজিকে!’ অভ্যুত্থান বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে হলো এক নতুন ভোরের সূচনা।

কিন্তু ভোরটা সকাল হতে না হতেই দেয়ালে দেয়ালে আঁকা স্বপ্নগুলো ফিকে হতে শুরু করল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, সংখ্যালঘু নিধন, নারী ধর্ষণসহ সব অপরাধের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশের কাঁধে ভর করে অনেকটা গাজীর বেশে হাজির হলো। কণ্ঠে জাতীয় সংগীত, হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে ছাত্র-তরুণদের যে অভ্যুত্থান করেছেÑসেই জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা বদলে ফেলার দাবি উত্থাপন করার দুঃসাহস দেখাল। প্রয়োজনীয় সংশোধন বা সংস্কার নয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের মূল নীতিসমূহ পরিবর্তন করার মতো দাবিও ওই গোষ্ঠী উত্থাপন করল। মুছে ফেলতে লাগল একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ সবের মৃদু প্রতিবাদ করলেও ভাবখানা এমনটা যে, ‘আমার বলার কিছু ছিল না, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম...।’ সরকারের এ ধরনের ভূমিকা এবং দক্ষিণ বঙ্গের এক নবনিযুক্ত সিপাহসালারের নিয়মিত বিভাজনের উসকানিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই এখন আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। রাজনীতির কেন্দ্রে বসানোর চেষ্টা হচ্ছে বিভাজনের ভয়ংকর ব্যাধিকে। আর তাই তো দিনের আকাশ এখন মেঘে অন্ধকার।

অবশ্য এ পটভূমিতে এবারের ছাত্র গণআন্দোলনের ‘অন্যতম রূপকার’ খ্যাত উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নতুন রাজনৈতিক দল সম্পর্কে একধরনের হতাশা প্রকাশ করে ফেইসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন ‘রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক কমিটিই ছিল দীর্ঘমেয়াদে অভ্যুত্থানের ফোর্স হিসেবে টেকসই’। আমরাও দেখতে পাচ্ছি নানা মত, পথের তরুণরা মিলে যে জাতীয় নাগরিক পার্টি গড়ে তুললেন তা যাত্রার শুরু থেকেই হোঁচট খাচ্ছে। প্রথমত এখন পর্যন্ত তাদের ঘোষিত কোন কর্মসূচি নেই। একেক নেতা একেক সুরে তাদের কথিত রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। মূল নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে উত্তর বাংলা বা দক্ষিণ বাংলার সিপাহ সালাররা কর্মসূচি ঘোষণা করে দিচ্ছেন এবং নেতৃত্বকে বাধ্য হয়ে তার স্বীকৃতি দিয়ে ওই সব কর্মসূচিতে শামিল হতে হচ্ছে। দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির জমায়েত ক্ষমতা ও সংগঠন শক্তি এখনো সীমিত। তাই অনেক ক্ষেত্রেই জমায়েতের জন্য তারা নির্ভর করেন মৌলবাদী নানা শক্তি ও গোষ্ঠীর ওপর। ফলে কখনো কখনো এসব শক্তির সঙ্গে মিলে যে রাজনৈতিক মেরূকরণ গড়ে ওঠে তা তাদের ঘোষিত মধ্যমপন্থার রাজনীতির সঙ্গে যায় না।

ছাত্র সমন্বয়কদের সমর্থনপুষ্ট ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে বলে আসছিলেন রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনা ও শাহবাগে যে সমাবেশ হলো সেই সমাবেশের ডাক দিলেন ছাত্র সমন্বয়কদেরই গড়া ও উপদেষ্টাদের সমর্থিত নতুন দলের দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক। সেই ডাকে প্রথমে সমবেত হলো জামায়াত, হেফাজত ও ছাত্রশিবির। কৌশলগত কোনো কারণে না অনেকটাই বাধ্য হয়ে নাগরিক পার্টির মূল নেতৃত্ব অনেক পরে সেখানে একটি মিছিল নিয়ে শামিল হন। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রথম থেকেই দাবি ছিল বিচারিক প্রক্রিয়ায় জুলাই হত্যাকা-ের কুশীলবদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং গনতন্ত্রে উত্তোরনের স্বার্থে মব সৃষ্টির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। তাই স্বভাবতই ঐ সমাবেশে বিশেষত জমায়েত নিষিদ্ধ স্থানে হাজির হওয়ার আমন্ত্রণে বিএনপি সাড়া দেয়নি। সমাবেশের ছবি দেখলেই বুঝা যায় উগ্র দক্ষিণপন্থার ওই সমাবেশে সাধারণ ছাত্র তরুণরাও খুব একটা শামিল হয় নি। জামায়াত হেফাজত শিবির প্রাধান্যের ঐ সমাবেশে যখন কিছু সংখ্যক তরুণ জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করে তখন জামায়াত শিবির বাধা দেয় এবং সেøাগান তোলে ‘গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই।’

বিভাজনের এক শক্তিকে বিদায় করার পর আজ আরো হিংস্র এবং উন্মত্ত চেহারা নিয়ে যে নতুন বিভাজনের শক্তি আবির্ভূত হয়েছে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর ছিলো এবং সেই সরকারে দলের ৪ জন মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করায় গনহত্যাসহ পাক বাহিনীর সকল ফ্যাসিস্টিক অপরাধের দায়ও তাদের ওপর বর্তায়। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অনুশোচনা না করে তারা বরং বলে থাকেন ১৯৭১ সালে দূরদর্শিতার জায়গা থেকে জামাত পাকিস্তানের সাথে ছিল। ১৯৭১ সালে জামায়াত আমির গোলাম আযম বলেছিলেন, ‘কোন ভালো মুসলমান তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।’ জুলাই অভ্যুত্থানের পরে তাদেরই পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সে সময়ের সব ইসলামী রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ইসলামের সঙ্গে। সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।’

আজ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যতই স্ট্যাটাস দেন- ’৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। পাকিস্তান এ দেশে গণহত্যা চলিয়েছে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। এসব স্ট্যাটাসে কাজ হবে না। কারণ মুখে যাই বলুক, ওদের কাছে হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগ নয় আসল ফ্যাসিস্ট হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বয়ান দিলে- ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে ন্যায্যতা দিলে ওরা দুই দিন পরে আপনাকেও ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর হিসেবে আখ্যায়িত করবে। নিজেরা সরাসরি বলতে না পারলে ওদের ‘ইনকিলাব’ মঞ্চ দিয়ে বলাবে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ওদের আইনের আওতায় আনুন। আর বিরত করুন নাগরিক পার্টির সেই অংশটিকে যাদের সমর্থন ও সহযোগিতায় এই দুঃসাহস তারা দেখাতে পারছে। নাগরিক পার্টির কিছু নেতাকে সাথে নিয়েই তো ওরা বগুড়ায় জাতীয় সংগীত গাওয়ার অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে, উদীচী কার্যালয়ে হামলা করেছে।

মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের নমনীয়তা বা কখনো কখনো নিরব সমর্থন পরিস্থিতিকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, বিক্ষোভকারী ছাত্রদের সাথে আলোচনা করতে গিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা যিনি ক’দিন আগেই এই ছাত্রদের নিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নানাভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাকে নাজেহাল শুধু নয় বোতল আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে। আরো অবাক হতে হয় এ ঘটনার সমালোচনা করে হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে। তিনি লেখেনÑ ‘সমালোচনা গণতান্ত্রিক অধিকার কিন্তু শারীরিক লাঞ্ছনা বর্বরতা...’। জনাব আবদুল্লাহ আপনি কি আপনার ও আপনার অনুসারীদের পুরোনো স্ট্যাটাসগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন কতবার বিভিন্ন ইস্যুতে এই বর্বরতা সৃষ্টির জন্য আপনারা উস্কানি দিয়েছেন? আপনাদের কাছ থেকেই তো ছাত্ররা এ সব শিখছে। পথে ঘাটে যাকে তাকে আওয়ামী দোষর আখ্যা দিয়ে হামলা করা, মারপিট করা, লাঞ্ছিত করা এমনকি যারা আইনের আওতায় চলে গেছে তাদের উপর আদালত চত্বরে বারংবার হামলা করার কোনো প্রতিবাদ কি আপনারা করেছেন? এভাবে কি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে? এসবই তো মুখে ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদবিরোধী আওয়াজ আর অন্তরে ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী প্রবণতার নমুনা। বহুত্ববাদ বিরোধী এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির শক্তি সরকারের ভেতরে বাইরে সব জায়গায়ই ক্রিয়াশীল। সকল ক্ষেত্রে আওয়ামী ভূত না খুঁজে নিজেদের আশপাশেও একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

জনাব মাহফুজ আলম যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বা দায় ও দরদের সমাজের কথা বলেন তার সাথে আবার মিলে না আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণে তার অবস্থান। রাজনৈতিক দল সমূহের সাথে আলোচনায় না যেয়ে যে পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত করা হলো তা গণতন্ত্রে উত্তোরণের পথে খুব একটা যুক্তিযুক্ত পথ হিসেবে দেখছেন না দেশ বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই যে, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিচার হতে হবে। প্রতিটি হত্যার জন্য আইনানুগ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। আবার এটাও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন একনায়কতন্ত্রে ও কতৃত্ববাদী শাসনে কুশীলবদের সংখ্যা থাকে সীমিত। তাই হড়ে গড়ে আসামি করা হলে মামলা কিন্তু দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যেমনটা গণতন্ত্রে উত্তোরণপন্থাকে দূর্বল করে ফেলা হল প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম ও নিবন্ধন স্থগিত করে। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম খুব একটা প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় কি ছিলো? জুলাই হত্যাকা-ের ফলে আওয়ামী লীগ নৈতিকভাবে পরাজিত। তারা নিজেরাই তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। মাঝে-মধ্যে অস্বাভাবিক কার্যক্রম-জনসমর্থনহীন ২/৪টি ঝটিকা মিছিলের খবর বা ২/৪ বার তাদের নেত্রীর পুরোনো কাসুন্দি মার্কা বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে; যা জনমনে কোনো আবেদন সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়নি। স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে চাইলে তারা বহু আগেই এত মৃত্যু এত রক্তপাতের ঘটনায় তাদের অনুশোচনা প্রকাশ করতো। আর অস্বাভাবিক কার্যক্রম তো আইনি বেআইনি সকল অবস্থায়ই চালানো যায়।

তবে যত বড় অপরাধই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব করে থাকুক বাংলাদেশের ইতিহাসের গভীরে শিকড় প্রোথিত আছে ৭৫ বছরের পুরোনো এই দলটির। তাই রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে আওয়ামী লীগকে সহজে মুছে ফেলা যাবে না। এর বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীসহ সমাজে রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে। আওয়ামী লীগের যে মূল রাজনীতি যার চর্চা বহুকাল যাবত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব করছেন না, সেই রাজনীতির কিন্তু আমাদের সমাজে ভিত্তি আছে। ভিত্তি আছে বলেই শেখ মুজিব বাংলার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তাকে হত্যা করা এবং তার অবর্তমানে যে নেতৃত্ব দলের মধ্যেকার মোশতাক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম সফল করেছিলেন সেই তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বকে হত্যা করার পরেও সেই দল উঠে দাঁড়িয়েছে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দুই দফা শাসক দল হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বর্ণ-অধ্যায়ে আওয়ামী লীগের যেমন অনন্য অবস্থান আছে, আবার গত এক যুগে মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের দলটাকে শেখ হাসিনা এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে দীর্ঘ সময় এ দলকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, স্থবির এবং লজ্জাজনকভাবে ভারতে আশ্রয়পুষ্ট দলের বদনাম নিয়ে অনিশ্চয়তার গিরিখাতে ধুঁকতে হবে।

গণআন্দোলনের কাছে পরাভূত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে তাকে ‘মজলুম’ বানানো হলো। মজলুমের প্রতি কিন্তু মানুষের সহানুভূতি তৈরি হয়; বরং রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে, জুলাই হত্যাকান্ডের কুশীলবদের দ্রুত বিচারের কাঠগড়ায় তুলে এবং যথাযথ ব্যালটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দিলে নিশ্চিতভাবে করুণ পরাজয় হতো তাদের কর্তৃত্ববাদ, স্বেচ্ছাচার, পরিবারতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী পন্থায় দেশ শাসনের নীতি। সফল হতো গণতন্ত্রে উত্তোরণ, সফল হতো এবারের অভ্যুত্থানের ছাত্র তরুণদের আকাংখা। নির্বাচনে বিজয়ী শক্তি কিছুটা হলেও শিক্ষা নিতো স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও ভোটে কি করুণ পরিণতি হয়। সে পথে না যেয়ে অনিশ্চিয়তা ও অস্থিতিশীলতাকেই জিইয়ে রাখা হলো।

একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো গণতন্ত্রে উত্তোরণে সবচেয়ে উপযুক্ত পন্থা অংশগ্রহণমূলক একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তদারক করা। সে লক্ষ্যে নির্বাচনের জন্য একটি স্পষ্ট সময়সূচি নির্ধারণ ও তার মধ্যেই প্রয়োজনীয় নির্বাচনী সংস্কার সম্পন্ন করা; যার মধ্য নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা। দলের অভ্যন্তরে স্বৈরতন্ত্র স্বেচ্ছাচারিতা না থাকলে সরকারেও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে। নির্বাচন ছাড়া অসংখ্য এজেন্ডা নিয়ে তো অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ করার সুযোগ সীমিত। সংবিধান সে ক্ষমতা সমর্থন বা অনুমোদন করে না। নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বিলম্বের পরিনতি হবে অস্থিরতা ও অস্থিশীলতার শক্তিকে ঘোঁট পাকানোর সুযোগ করে দেওয়া। ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বাপ্নিক মানুষ। তার স্বপ্নগুলো লিপিবদ্ধ ও প্রকাশ করে এবং জনপ্রতিনিধিদের বিবেচনার জন্য রেখে দ্রত ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করলে অস্থিতিশীলতার শক্তি পরাভূত হবে।

বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি-গোষ্ঠী যত উল্লম্ফন করুক এ দেশের মাটি যেমন নরম, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষও উদার ও মানবিক। কট্টরপন্থায় তারা বিশ্বাসী নয়। তাইতো দেখবেন কট্টরপন্থি মৌলবাদীদের সত্তরের দশকে যতটুকু জনসমর্থন ছিলো, আশি-নব্বই দশকে বা আজকেও সেটুকুই আছে। তাদের পেয়ারা পাকিস্তানেই তারা কখনো ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে পারেনি। একমাত্র ব্যাতিক্রম ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর উমেদারি করার শর্তে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভায় ৪টি মন্ত্রী পদ লাভ আর মিলিটারি শাসক জিয়াউল হকের উমেদারি করে কেবিনেটে স্থান করে নেওয়া। পাকিস্তানের জমিন জামায়াতের জন্য অপেক্ষাকৃত উর্বর হলেও বিগত ২০২৪ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে জামায়াত ইসলামী সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করে এবং বাংলাদেশ অপেক্ষা জামায়াতের ক্ষমতা বেশি হলেও সারাদেশে তাদের দাড়িপাল্লা পেয়েছে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ভোট। অর্থাৎ প্রদত্ত ভোটের ২.৩%। বাংলাদেশের মধ্য ডানপন্থি কোনো শক্তির সহায়তা না পেলে এখানেও জামায়াত এরকম ভোটই পাবে; কিন্তু ভাব দেখাচ্ছে ক্ষমতায় গেল বলে!

উগ্র মৌলবাদ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কখনো পাখনা মেলে ধরে, কখনো গুটিয়ে রাখে। আজ হয়তোবা পরিস্থিতির সুযোগে তারা পূর্ণ পাখনা মেলে ধরায় কারো কারো কাছে মনে হচ্ছেÑ এ কোন সকাল, রাতের থেকেও অন্ধকার! হ্যাঁ, অন্ধকার তো বটেই! কিন্তু এটাও মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্ধকার সত্য, তবে শেষ সত্য নয়!

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

সিউল : স্বর্গ নেমেছে ধরায়

নাচোল বিদ্রোহ ও ইলা মিত্র সংগ্রহশালা : সাঁওতাল স্মৃতি কেন উপেক্ষিত?

বিয়েতে মিতব্যয়িতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাহবা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের ভয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অন্ধকার সত্য, শেষ সত্য নয়!

আনোয়ারুল হক

image

সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

আগের একটি লেখা থেকে দু’লাইন উদ্ধৃত করছি। ‘জুলাই জাগরণে আমাদের ছাত্র-তরুণরা গুলি-বোমার সামনে দাঁড়িয়ে মিছিলের সাথীকে হারানোর পরেও গানে গানে অবিস্মরণীয় এক সংগ্রাম গড়ে তোলে। দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের রং, কার্টুনে আঁকা বিদ্রোহ, কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা বা এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। মিউজিক পরিণত হয়ে গেল ম্যাজিকে!’ অভ্যুত্থান বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে হলো এক নতুন ভোরের সূচনা।

কিন্তু ভোরটা সকাল হতে না হতেই দেয়ালে দেয়ালে আঁকা স্বপ্নগুলো ফিকে হতে শুরু করল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, সংখ্যালঘু নিধন, নারী ধর্ষণসহ সব অপরাধের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশের কাঁধে ভর করে অনেকটা গাজীর বেশে হাজির হলো। কণ্ঠে জাতীয় সংগীত, হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে ছাত্র-তরুণদের যে অভ্যুত্থান করেছেÑসেই জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা বদলে ফেলার দাবি উত্থাপন করার দুঃসাহস দেখাল। প্রয়োজনীয় সংশোধন বা সংস্কার নয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের মূল নীতিসমূহ পরিবর্তন করার মতো দাবিও ওই গোষ্ঠী উত্থাপন করল। মুছে ফেলতে লাগল একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ সবের মৃদু প্রতিবাদ করলেও ভাবখানা এমনটা যে, ‘আমার বলার কিছু ছিল না, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম...।’ সরকারের এ ধরনের ভূমিকা এবং দক্ষিণ বঙ্গের এক নবনিযুক্ত সিপাহসালারের নিয়মিত বিভাজনের উসকানিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই এখন আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। রাজনীতির কেন্দ্রে বসানোর চেষ্টা হচ্ছে বিভাজনের ভয়ংকর ব্যাধিকে। আর তাই তো দিনের আকাশ এখন মেঘে অন্ধকার।

অবশ্য এ পটভূমিতে এবারের ছাত্র গণআন্দোলনের ‘অন্যতম রূপকার’ খ্যাত উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নতুন রাজনৈতিক দল সম্পর্কে একধরনের হতাশা প্রকাশ করে ফেইসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন ‘রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক কমিটিই ছিল দীর্ঘমেয়াদে অভ্যুত্থানের ফোর্স হিসেবে টেকসই’। আমরাও দেখতে পাচ্ছি নানা মত, পথের তরুণরা মিলে যে জাতীয় নাগরিক পার্টি গড়ে তুললেন তা যাত্রার শুরু থেকেই হোঁচট খাচ্ছে। প্রথমত এখন পর্যন্ত তাদের ঘোষিত কোন কর্মসূচি নেই। একেক নেতা একেক সুরে তাদের কথিত রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। মূল নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে উত্তর বাংলা বা দক্ষিণ বাংলার সিপাহ সালাররা কর্মসূচি ঘোষণা করে দিচ্ছেন এবং নেতৃত্বকে বাধ্য হয়ে তার স্বীকৃতি দিয়ে ওই সব কর্মসূচিতে শামিল হতে হচ্ছে। দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির জমায়েত ক্ষমতা ও সংগঠন শক্তি এখনো সীমিত। তাই অনেক ক্ষেত্রেই জমায়েতের জন্য তারা নির্ভর করেন মৌলবাদী নানা শক্তি ও গোষ্ঠীর ওপর। ফলে কখনো কখনো এসব শক্তির সঙ্গে মিলে যে রাজনৈতিক মেরূকরণ গড়ে ওঠে তা তাদের ঘোষিত মধ্যমপন্থার রাজনীতির সঙ্গে যায় না।

ছাত্র সমন্বয়কদের সমর্থনপুষ্ট ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে বলে আসছিলেন রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনা ও শাহবাগে যে সমাবেশ হলো সেই সমাবেশের ডাক দিলেন ছাত্র সমন্বয়কদেরই গড়া ও উপদেষ্টাদের সমর্থিত নতুন দলের দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক। সেই ডাকে প্রথমে সমবেত হলো জামায়াত, হেফাজত ও ছাত্রশিবির। কৌশলগত কোনো কারণে না অনেকটাই বাধ্য হয়ে নাগরিক পার্টির মূল নেতৃত্ব অনেক পরে সেখানে একটি মিছিল নিয়ে শামিল হন। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রথম থেকেই দাবি ছিল বিচারিক প্রক্রিয়ায় জুলাই হত্যাকা-ের কুশীলবদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং গনতন্ত্রে উত্তোরনের স্বার্থে মব সৃষ্টির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। তাই স্বভাবতই ঐ সমাবেশে বিশেষত জমায়েত নিষিদ্ধ স্থানে হাজির হওয়ার আমন্ত্রণে বিএনপি সাড়া দেয়নি। সমাবেশের ছবি দেখলেই বুঝা যায় উগ্র দক্ষিণপন্থার ওই সমাবেশে সাধারণ ছাত্র তরুণরাও খুব একটা শামিল হয় নি। জামায়াত হেফাজত শিবির প্রাধান্যের ঐ সমাবেশে যখন কিছু সংখ্যক তরুণ জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করে তখন জামায়াত শিবির বাধা দেয় এবং সেøাগান তোলে ‘গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই।’

বিভাজনের এক শক্তিকে বিদায় করার পর আজ আরো হিংস্র এবং উন্মত্ত চেহারা নিয়ে যে নতুন বিভাজনের শক্তি আবির্ভূত হয়েছে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর ছিলো এবং সেই সরকারে দলের ৪ জন মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করায় গনহত্যাসহ পাক বাহিনীর সকল ফ্যাসিস্টিক অপরাধের দায়ও তাদের ওপর বর্তায়। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অনুশোচনা না করে তারা বরং বলে থাকেন ১৯৭১ সালে দূরদর্শিতার জায়গা থেকে জামাত পাকিস্তানের সাথে ছিল। ১৯৭১ সালে জামায়াত আমির গোলাম আযম বলেছিলেন, ‘কোন ভালো মুসলমান তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।’ জুলাই অভ্যুত্থানের পরে তাদেরই পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সে সময়ের সব ইসলামী রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ইসলামের সঙ্গে। সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।’

আজ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যতই স্ট্যাটাস দেন- ’৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। পাকিস্তান এ দেশে গণহত্যা চলিয়েছে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। এসব স্ট্যাটাসে কাজ হবে না। কারণ মুখে যাই বলুক, ওদের কাছে হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগ নয় আসল ফ্যাসিস্ট হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বয়ান দিলে- ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে ন্যায্যতা দিলে ওরা দুই দিন পরে আপনাকেও ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর হিসেবে আখ্যায়িত করবে। নিজেরা সরাসরি বলতে না পারলে ওদের ‘ইনকিলাব’ মঞ্চ দিয়ে বলাবে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ওদের আইনের আওতায় আনুন। আর বিরত করুন নাগরিক পার্টির সেই অংশটিকে যাদের সমর্থন ও সহযোগিতায় এই দুঃসাহস তারা দেখাতে পারছে। নাগরিক পার্টির কিছু নেতাকে সাথে নিয়েই তো ওরা বগুড়ায় জাতীয় সংগীত গাওয়ার অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে, উদীচী কার্যালয়ে হামলা করেছে।

মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের নমনীয়তা বা কখনো কখনো নিরব সমর্থন পরিস্থিতিকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, বিক্ষোভকারী ছাত্রদের সাথে আলোচনা করতে গিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা যিনি ক’দিন আগেই এই ছাত্রদের নিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নানাভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাকে নাজেহাল শুধু নয় বোতল আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে। আরো অবাক হতে হয় এ ঘটনার সমালোচনা করে হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে। তিনি লেখেনÑ ‘সমালোচনা গণতান্ত্রিক অধিকার কিন্তু শারীরিক লাঞ্ছনা বর্বরতা...’। জনাব আবদুল্লাহ আপনি কি আপনার ও আপনার অনুসারীদের পুরোনো স্ট্যাটাসগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন কতবার বিভিন্ন ইস্যুতে এই বর্বরতা সৃষ্টির জন্য আপনারা উস্কানি দিয়েছেন? আপনাদের কাছ থেকেই তো ছাত্ররা এ সব শিখছে। পথে ঘাটে যাকে তাকে আওয়ামী দোষর আখ্যা দিয়ে হামলা করা, মারপিট করা, লাঞ্ছিত করা এমনকি যারা আইনের আওতায় চলে গেছে তাদের উপর আদালত চত্বরে বারংবার হামলা করার কোনো প্রতিবাদ কি আপনারা করেছেন? এভাবে কি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে? এসবই তো মুখে ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদবিরোধী আওয়াজ আর অন্তরে ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী প্রবণতার নমুনা। বহুত্ববাদ বিরোধী এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির শক্তি সরকারের ভেতরে বাইরে সব জায়গায়ই ক্রিয়াশীল। সকল ক্ষেত্রে আওয়ামী ভূত না খুঁজে নিজেদের আশপাশেও একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

জনাব মাহফুজ আলম যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বা দায় ও দরদের সমাজের কথা বলেন তার সাথে আবার মিলে না আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণে তার অবস্থান। রাজনৈতিক দল সমূহের সাথে আলোচনায় না যেয়ে যে পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত করা হলো তা গণতন্ত্রে উত্তোরণের পথে খুব একটা যুক্তিযুক্ত পথ হিসেবে দেখছেন না দেশ বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই যে, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিচার হতে হবে। প্রতিটি হত্যার জন্য আইনানুগ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। আবার এটাও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন একনায়কতন্ত্রে ও কতৃত্ববাদী শাসনে কুশীলবদের সংখ্যা থাকে সীমিত। তাই হড়ে গড়ে আসামি করা হলে মামলা কিন্তু দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যেমনটা গণতন্ত্রে উত্তোরণপন্থাকে দূর্বল করে ফেলা হল প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম ও নিবন্ধন স্থগিত করে। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম খুব একটা প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় কি ছিলো? জুলাই হত্যাকা-ের ফলে আওয়ামী লীগ নৈতিকভাবে পরাজিত। তারা নিজেরাই তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। মাঝে-মধ্যে অস্বাভাবিক কার্যক্রম-জনসমর্থনহীন ২/৪টি ঝটিকা মিছিলের খবর বা ২/৪ বার তাদের নেত্রীর পুরোনো কাসুন্দি মার্কা বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে; যা জনমনে কোনো আবেদন সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়নি। স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে চাইলে তারা বহু আগেই এত মৃত্যু এত রক্তপাতের ঘটনায় তাদের অনুশোচনা প্রকাশ করতো। আর অস্বাভাবিক কার্যক্রম তো আইনি বেআইনি সকল অবস্থায়ই চালানো যায়।

তবে যত বড় অপরাধই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব করে থাকুক বাংলাদেশের ইতিহাসের গভীরে শিকড় প্রোথিত আছে ৭৫ বছরের পুরোনো এই দলটির। তাই রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে আওয়ামী লীগকে সহজে মুছে ফেলা যাবে না। এর বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীসহ সমাজে রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে। আওয়ামী লীগের যে মূল রাজনীতি যার চর্চা বহুকাল যাবত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব করছেন না, সেই রাজনীতির কিন্তু আমাদের সমাজে ভিত্তি আছে। ভিত্তি আছে বলেই শেখ মুজিব বাংলার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তাকে হত্যা করা এবং তার অবর্তমানে যে নেতৃত্ব দলের মধ্যেকার মোশতাক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম সফল করেছিলেন সেই তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বকে হত্যা করার পরেও সেই দল উঠে দাঁড়িয়েছে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দুই দফা শাসক দল হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বর্ণ-অধ্যায়ে আওয়ামী লীগের যেমন অনন্য অবস্থান আছে, আবার গত এক যুগে মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের দলটাকে শেখ হাসিনা এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে দীর্ঘ সময় এ দলকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, স্থবির এবং লজ্জাজনকভাবে ভারতে আশ্রয়পুষ্ট দলের বদনাম নিয়ে অনিশ্চয়তার গিরিখাতে ধুঁকতে হবে।

গণআন্দোলনের কাছে পরাভূত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে তাকে ‘মজলুম’ বানানো হলো। মজলুমের প্রতি কিন্তু মানুষের সহানুভূতি তৈরি হয়; বরং রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে, জুলাই হত্যাকান্ডের কুশীলবদের দ্রুত বিচারের কাঠগড়ায় তুলে এবং যথাযথ ব্যালটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দিলে নিশ্চিতভাবে করুণ পরাজয় হতো তাদের কর্তৃত্ববাদ, স্বেচ্ছাচার, পরিবারতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী পন্থায় দেশ শাসনের নীতি। সফল হতো গণতন্ত্রে উত্তোরণ, সফল হতো এবারের অভ্যুত্থানের ছাত্র তরুণদের আকাংখা। নির্বাচনে বিজয়ী শক্তি কিছুটা হলেও শিক্ষা নিতো স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও ভোটে কি করুণ পরিণতি হয়। সে পথে না যেয়ে অনিশ্চিয়তা ও অস্থিতিশীলতাকেই জিইয়ে রাখা হলো।

একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো গণতন্ত্রে উত্তোরণে সবচেয়ে উপযুক্ত পন্থা অংশগ্রহণমূলক একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তদারক করা। সে লক্ষ্যে নির্বাচনের জন্য একটি স্পষ্ট সময়সূচি নির্ধারণ ও তার মধ্যেই প্রয়োজনীয় নির্বাচনী সংস্কার সম্পন্ন করা; যার মধ্য নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা। দলের অভ্যন্তরে স্বৈরতন্ত্র স্বেচ্ছাচারিতা না থাকলে সরকারেও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে। নির্বাচন ছাড়া অসংখ্য এজেন্ডা নিয়ে তো অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ করার সুযোগ সীমিত। সংবিধান সে ক্ষমতা সমর্থন বা অনুমোদন করে না। নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বিলম্বের পরিনতি হবে অস্থিরতা ও অস্থিশীলতার শক্তিকে ঘোঁট পাকানোর সুযোগ করে দেওয়া। ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বাপ্নিক মানুষ। তার স্বপ্নগুলো লিপিবদ্ধ ও প্রকাশ করে এবং জনপ্রতিনিধিদের বিবেচনার জন্য রেখে দ্রত ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করলে অস্থিতিশীলতার শক্তি পরাভূত হবে।

বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি-গোষ্ঠী যত উল্লম্ফন করুক এ দেশের মাটি যেমন নরম, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষও উদার ও মানবিক। কট্টরপন্থায় তারা বিশ্বাসী নয়। তাইতো দেখবেন কট্টরপন্থি মৌলবাদীদের সত্তরের দশকে যতটুকু জনসমর্থন ছিলো, আশি-নব্বই দশকে বা আজকেও সেটুকুই আছে। তাদের পেয়ারা পাকিস্তানেই তারা কখনো ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে পারেনি। একমাত্র ব্যাতিক্রম ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর উমেদারি করার শর্তে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভায় ৪টি মন্ত্রী পদ লাভ আর মিলিটারি শাসক জিয়াউল হকের উমেদারি করে কেবিনেটে স্থান করে নেওয়া। পাকিস্তানের জমিন জামায়াতের জন্য অপেক্ষাকৃত উর্বর হলেও বিগত ২০২৪ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে জামায়াত ইসলামী সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করে এবং বাংলাদেশ অপেক্ষা জামায়াতের ক্ষমতা বেশি হলেও সারাদেশে তাদের দাড়িপাল্লা পেয়েছে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ভোট। অর্থাৎ প্রদত্ত ভোটের ২.৩%। বাংলাদেশের মধ্য ডানপন্থি কোনো শক্তির সহায়তা না পেলে এখানেও জামায়াত এরকম ভোটই পাবে; কিন্তু ভাব দেখাচ্ছে ক্ষমতায় গেল বলে!

উগ্র মৌলবাদ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কখনো পাখনা মেলে ধরে, কখনো গুটিয়ে রাখে। আজ হয়তোবা পরিস্থিতির সুযোগে তারা পূর্ণ পাখনা মেলে ধরায় কারো কারো কাছে মনে হচ্ছেÑ এ কোন সকাল, রাতের থেকেও অন্ধকার! হ্যাঁ, অন্ধকার তো বটেই! কিন্তু এটাও মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্ধকার সত্য, তবে শেষ সত্য নয়!

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

back to top