মিথুশিলাক মুরমু
গত ১১ জানুয়ারি আমনুরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে ঐতিহাসিক নাচোল বিদ্রোহের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব কমরেড ইলা মিত্রের সংগ্রহশালা পরিদর্শনের উদ্দেশে রওনা হই। আমনুরা থেকে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার দূরে, আমনুরা রেলওয়ে জংশন থেকে নেজামপুর হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। একপর্যায়ে ইটের সলিং রাস্তা শেষে কাঁচা এঁটেল মাটির পথে পৌঁছাইÑসেই মাটির পথ ধরেই পৌঁছানো যায় সংগ্রহশালায়।
গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে একটি খোলা জায়গায় স্থাপিত হয়েছে দ্বিতল ভবনের সংগ্রহশালা এবং একটি ছাউনি ঘর। এই সংগ্রহশালাটি ২০২৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিব খাঁন, উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রায় ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সংগ্রহশালাটি চোখে দেখার প্রবল আগ্রহ নিয়ে হাজির হয়েছিলাম সফরসঙ্গী গাইডার প্রদীপ হেমব্রমসহ।
ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিটি কক্ষ মনোযোগ সহকারে পরিদর্শন করি। চোখে পড়ে ইলা মিত্রের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ঐতিহাসিক ছবিসহ ফ্রেম, সহযোদ্ধা আদিবাসী সাঁওতালদের তীর-ধনুক এবং ইলা মিত্রকে নিয়ে লেখা কিছু বই। তবে একটি বিষয় অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও বেদনাদায়ক ছিলÑইলা মিত্র ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর গভীর সম্পর্কের কোনো নির্দিষ্ট নিদর্শন এখানে ছিল না।
দ্বিতল ভবনের পাশের এক কক্ষবিশিষ্ট ছাউনির ঘরে কেবল কয়েকটি তীর ও ধনুক রাখা ছিল। উৎসাহী হয়ে তত্ত্বাবধায়ককে জিজ্ঞেস করি, আদিবাসীদের অন্যান্য স্মারক কোথায়? উত্তরে জানান, কর্তৃপক্ষ যা দিয়েছেন, তা-ই প্রদর্শনের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি বলেন, একসময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থানার চ-ীপুর, কেন্দুয়া, কুসবাডাঙ্গা, রাওতাড়া, ধরমপুর ও ঘাসুড়া ছিল সাঁওতাল ও অন্যান্য আদিবাসীদের বসতি। এখন অনেক গ্রামেই তারা আর নেই। কেউ কেউ আছে, কেউ কেউ বিতাড়িত হয়েছে। নাচোল বিদ্রোহের পর আদিবাসীদের ওপর যে নিষ্ঠুরতা চলেছে, তার কোনো স্বীকৃতি এই সংগ্রহশালায় নেই।
প্রবেশপথে জেলা পরিষদের সৌজন্যে একটি প্রস্তর ফলকে কমরেড ইলা মিত্রের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। সেখানে কেবল একটি লাইনে বলা হয়েছে, ‘১৯৫০ সালের ৭ই জানুয়ারি আদিবাসী সাঁওতাল ও বর্গাচাষিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে।’ অথচ নাচোল উপজেলার সরকারি ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল সাঁওতালরা এবং ইলা মিত্র সাঁওতালদের সঙ্গে বসবাস করেছেন, তাদের ভাষা শিখেছেন, তাদের চেতনা জাগাতে ভাঙা ভাঙা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলেছেন। সেই সাঁওতালদের ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘রাণী মা’।
শেখ রফিক সম্পাদিত ‘ইলা মিত্রের জবানবন্দি’ গ্রন্থের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘তেভাগা আন্দোলনের লড়াকু বিপ্লবী ইলা মিত্র সাঁওতালদের একান্ত আপনজন। তিনি তাদেরকে জমিদার ও মহাজনের শোষণ থেকে মুক্ত করতে লড়াই করেছেন।’ সেলিনা হোসেন লিখেছেন, “ছুটির দিনে গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করতেন ইলা মিত্র। ধান জোতদারদের না দিয়ে কৃষক সমিতির উঠোনে নিয়ে আসতেন। সন্তান জন্মের পরও তিনি তেভাগা আন্দোলনের প্রয়োজনেই মাঠে ছিলেন, কাজ করেছেন সাঁওতালদের সঙ্গেÑতাই তিনি হয়ে ওঠেন সবার ‘রাণী মা’।”
১৯৪৯ সালে তার নেতৃত্বে হাজারো ভূমিহীন কৃষক সংগঠিত হয়। জোতদার-মহাজনদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। চ-ীপুরে পুলিশ এলে, গ্রামবাসীরা তাদের ঘেরাও করে এবং উত্তেজনার একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা ও পাঁচ কনস্টেবল নিহত হন। এরপর ৭ জানুয়ারি পুলিশ প্রতিরোধ শুরু করে। সাঁওতাল নারী সেজে পালানোর চেষ্টা করেন ইলা মিত্র, কিন্তু রহনপুর রেলস্টেশনে ধরা পড়েন। এরপর তাকে, রমেন্দ্র মিত্র ও মাতলা মাঝিকে প্রধান আসামি করে ‘নাচোল হত্যা মামলা’ দায়ের করা হয়। শতাধিক সাঁওতাল কৃষককেও আসামি করা হয়।
সংগ্রহশালায় কিছু ঐতিহাসিক ছবি, সংবাদ প্রতিবেদন থাকলেও আদিবাসীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে নেই কোনো আলাদা উপস্থাপনা, স্মারক বা নিদর্শন। শুধু কিছু তীর-ধনুক ছাড়া পুরো সংগ্রহশালায় তাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
এমনকি যারা এই সংগ্রহশালাটি নির্মাণ করেছেন, তারা যেন ভুলে গেছেন যে ইলা মিত্রের সংগ্রাম শুধু তার একার ছিল না। এটি ছিল একটি জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। অথচ সাঁওতালদের ভূমিকাকে সযতেœ মুছে ফেলা হয়েছে। এই অবহেলা, এই অস্বীকারÑইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের অনুরোধ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন যেন দ্রুত এই সংগ্রহশালায় সাঁওতালসহ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত সংগ্রামী উপকরণ সংরক্ষণ করে এবং তাদের স্মৃতিফলক স্থাপন করে ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। ইতিহাসের সত্যকে মুছে ফেললে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ইতিহাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
জাতির কৃতজ্ঞতা তখনই অর্থবহ হয়, যখন সে ইতিহাসের প্রতি সৎ ও সম্পূর্ণ থাকে।
[লেখক : কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
সোমবার, ১৯ মে ২০২৫
গত ১১ জানুয়ারি আমনুরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে ঐতিহাসিক নাচোল বিদ্রোহের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব কমরেড ইলা মিত্রের সংগ্রহশালা পরিদর্শনের উদ্দেশে রওনা হই। আমনুরা থেকে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার দূরে, আমনুরা রেলওয়ে জংশন থেকে নেজামপুর হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। একপর্যায়ে ইটের সলিং রাস্তা শেষে কাঁচা এঁটেল মাটির পথে পৌঁছাইÑসেই মাটির পথ ধরেই পৌঁছানো যায় সংগ্রহশালায়।
গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে একটি খোলা জায়গায় স্থাপিত হয়েছে দ্বিতল ভবনের সংগ্রহশালা এবং একটি ছাউনি ঘর। এই সংগ্রহশালাটি ২০২৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিব খাঁন, উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রায় ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সংগ্রহশালাটি চোখে দেখার প্রবল আগ্রহ নিয়ে হাজির হয়েছিলাম সফরসঙ্গী গাইডার প্রদীপ হেমব্রমসহ।
ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিটি কক্ষ মনোযোগ সহকারে পরিদর্শন করি। চোখে পড়ে ইলা মিত্রের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ঐতিহাসিক ছবিসহ ফ্রেম, সহযোদ্ধা আদিবাসী সাঁওতালদের তীর-ধনুক এবং ইলা মিত্রকে নিয়ে লেখা কিছু বই। তবে একটি বিষয় অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও বেদনাদায়ক ছিলÑইলা মিত্র ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর গভীর সম্পর্কের কোনো নির্দিষ্ট নিদর্শন এখানে ছিল না।
দ্বিতল ভবনের পাশের এক কক্ষবিশিষ্ট ছাউনির ঘরে কেবল কয়েকটি তীর ও ধনুক রাখা ছিল। উৎসাহী হয়ে তত্ত্বাবধায়ককে জিজ্ঞেস করি, আদিবাসীদের অন্যান্য স্মারক কোথায়? উত্তরে জানান, কর্তৃপক্ষ যা দিয়েছেন, তা-ই প্রদর্শনের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি বলেন, একসময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থানার চ-ীপুর, কেন্দুয়া, কুসবাডাঙ্গা, রাওতাড়া, ধরমপুর ও ঘাসুড়া ছিল সাঁওতাল ও অন্যান্য আদিবাসীদের বসতি। এখন অনেক গ্রামেই তারা আর নেই। কেউ কেউ আছে, কেউ কেউ বিতাড়িত হয়েছে। নাচোল বিদ্রোহের পর আদিবাসীদের ওপর যে নিষ্ঠুরতা চলেছে, তার কোনো স্বীকৃতি এই সংগ্রহশালায় নেই।
প্রবেশপথে জেলা পরিষদের সৌজন্যে একটি প্রস্তর ফলকে কমরেড ইলা মিত্রের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। সেখানে কেবল একটি লাইনে বলা হয়েছে, ‘১৯৫০ সালের ৭ই জানুয়ারি আদিবাসী সাঁওতাল ও বর্গাচাষিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে।’ অথচ নাচোল উপজেলার সরকারি ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল সাঁওতালরা এবং ইলা মিত্র সাঁওতালদের সঙ্গে বসবাস করেছেন, তাদের ভাষা শিখেছেন, তাদের চেতনা জাগাতে ভাঙা ভাঙা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলেছেন। সেই সাঁওতালদের ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘রাণী মা’।
শেখ রফিক সম্পাদিত ‘ইলা মিত্রের জবানবন্দি’ গ্রন্থের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘তেভাগা আন্দোলনের লড়াকু বিপ্লবী ইলা মিত্র সাঁওতালদের একান্ত আপনজন। তিনি তাদেরকে জমিদার ও মহাজনের শোষণ থেকে মুক্ত করতে লড়াই করেছেন।’ সেলিনা হোসেন লিখেছেন, “ছুটির দিনে গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করতেন ইলা মিত্র। ধান জোতদারদের না দিয়ে কৃষক সমিতির উঠোনে নিয়ে আসতেন। সন্তান জন্মের পরও তিনি তেভাগা আন্দোলনের প্রয়োজনেই মাঠে ছিলেন, কাজ করেছেন সাঁওতালদের সঙ্গেÑতাই তিনি হয়ে ওঠেন সবার ‘রাণী মা’।”
১৯৪৯ সালে তার নেতৃত্বে হাজারো ভূমিহীন কৃষক সংগঠিত হয়। জোতদার-মহাজনদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। চ-ীপুরে পুলিশ এলে, গ্রামবাসীরা তাদের ঘেরাও করে এবং উত্তেজনার একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা ও পাঁচ কনস্টেবল নিহত হন। এরপর ৭ জানুয়ারি পুলিশ প্রতিরোধ শুরু করে। সাঁওতাল নারী সেজে পালানোর চেষ্টা করেন ইলা মিত্র, কিন্তু রহনপুর রেলস্টেশনে ধরা পড়েন। এরপর তাকে, রমেন্দ্র মিত্র ও মাতলা মাঝিকে প্রধান আসামি করে ‘নাচোল হত্যা মামলা’ দায়ের করা হয়। শতাধিক সাঁওতাল কৃষককেও আসামি করা হয়।
সংগ্রহশালায় কিছু ঐতিহাসিক ছবি, সংবাদ প্রতিবেদন থাকলেও আদিবাসীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে নেই কোনো আলাদা উপস্থাপনা, স্মারক বা নিদর্শন। শুধু কিছু তীর-ধনুক ছাড়া পুরো সংগ্রহশালায় তাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
এমনকি যারা এই সংগ্রহশালাটি নির্মাণ করেছেন, তারা যেন ভুলে গেছেন যে ইলা মিত্রের সংগ্রাম শুধু তার একার ছিল না। এটি ছিল একটি জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। অথচ সাঁওতালদের ভূমিকাকে সযতেœ মুছে ফেলা হয়েছে। এই অবহেলা, এই অস্বীকারÑইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের অনুরোধ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন যেন দ্রুত এই সংগ্রহশালায় সাঁওতালসহ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত সংগ্রামী উপকরণ সংরক্ষণ করে এবং তাদের স্মৃতিফলক স্থাপন করে ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। ইতিহাসের সত্যকে মুছে ফেললে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ইতিহাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
জাতির কৃতজ্ঞতা তখনই অর্থবহ হয়, যখন সে ইতিহাসের প্রতি সৎ ও সম্পূর্ণ থাকে।
[লেখক : কলামিস্ট]