শঙ্কর প্রসাদ দে
থাই এয়ারওয়েজের বিশাল বোয়িং ইনসিওন বিমানবন্দরে নামার মুহূর্তে জানালা দিয়ে কোরীয় উপদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে শুরু হলো মুগ্ধতা, বিস্ময় ও সুখানুভূতির পালা। জুনের ১ম সপ্তাহ বসন্ত বলে কথা। শুনেছিলাম বিমানবন্দরটি পৃথিবী সেরা। প্লেন ল্যান্ডিং, ইমিগ্রেশন ও শহরের দিকে ধাবমান বাসে উঠে বুঝলাম কথাটি সর্বাংশে সত্য। অনেক ছোট নদীর উপর ডজন খানেক সেতুপথ অতিক্রম করে মিনিট বিশেকের ব্যবধানে সিউল শহরমুখী সর্পিল রাজপথ। দু’পাশে ঘরবাড়ি, তারকাখচিত হোটেল, মোটেল, শপিংমল, আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টগুলোর চেয়ে সুন্দর হলো প্রবেশাঙ্গন।
রাজপথগুলোর দুধারে গোলাপসহ বাহারি ফুলবৃক্ষ। মাঝখানে ডিভাইডার সাজানো হয়েছে মাটিভর্তি বাস্কেটে শুধু ফুল, ফুটন্ত ফুল আর ফুলবৃক্ষ। পৃথিবীর সব দেশেই ফুটপাত আছে। অথচ সিউলের ফুটপাত দিয়ে সাইকেল চালানোর জন্য রাবার কার্পেট বিছানো আছে। কোন ডাস্টবিন নেই। কোন ধুলাবালি নেই। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া এদেশে কেউ হর্ন বাজান না। জেব্রাক্রসিংয়ে যতক্ষণ মানুষ থাকবে ততক্ষণ গাড়ির চাকা ঘুরে না। সিগন্যাল নেই এমন গলি বা ছোট রাস্তাগুলোতে এটিই নিয়ম এটিই আইন। সন্ধ্যায় দলবেঁধে সবাই বেরোলাম শহর দেখতে।
কোরিয়া ভাগ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সমাপ্তিতে। দু’হাজার বছর ধরে পাহাড়ি এই জনপদ ছিল, মূলত জাপানি উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ করেছিল আমেরিকান নৌবাহিনীর হাতে। সেই থেকে আজকের দক্ষিণ কোরিয়া দখলে নিল আমেরিকা। প্রতিষ্ঠিত হলো আজকের দক্ষিণ কোরিয়া। অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর বিস্ময় মাত্র ১ লাখ বর্গকিলোমিটারের ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষের কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ৪৫ হাজার মার্কিন ডলার। ভাবা যায়? এই অর্জন ঘটেছে মাত্র অর্ধশতকে।
১৯৪৫ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত কোরিয়া সংকটের সমাপ্তি হয় ১৯৫৩ সালে উত্তর কোরিয়ার আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপটে। একদিন সবাই মিলে ছুটলাম নামিয়ারা দ্বীপ দেখতে। পৃথিবীর অন্যসব শহরের মতো সিউলের বেড়ে উঠা হাং নদীকে ঘিরে। এই হাং নদীকে ডান পাশে রেখে ট্রেন এগিয়ে চলল নগর পেরিয়ে গ্রামীণ জনপদে। একটিও গাছ কাটা হলো না। একটিও পাহাড় বা টিলা কাটা হলো না। সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রায় দু’শো কিলোমিটার পথ পেছনে ফেললো মাত্র দু’ঘণ্টায়। পাহাড়গুলো দিব্যি মিতালীতে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলায়। বৃক্ষরাজি ব্যস্ত আছে খোশগল্প আর মৃদু কোলাহলে। গ্রামে মানে ২০-২৫ তলা দালান। সব আধুনিক সুবিধা নিয়ে দালানগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
পাহাড়ের ঢালুতে যৎসামান্য ধান, গম, ভুট্টো আর সবজি ক্ষেত। নিজের ফসলে ৩ মাসের খোরাকও হয় না। বুঝলাম, একসময় কেন কোরিয়ানরা কুকুর, শূকর, সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড় খেতেন। এখনো এসব কোরিয়ানদের জনপ্রিয় খাবার। ধান হয় বলেই পাঞ্জাব আর বাংলার মানুষ ভাত খায়। নইলে আফগানদের মতো আমাদের রুটি খেতে হতো।
প্রযুক্তিতে এরা এখন বিশ^সেরা, অর্ধেক মানুষ খ্রিস্টান হলেও, এক-চতুর্থাংশ বুডিস্ট হলেও, ধর্ম খুব বেশি চর্চিত নয়। এক-চতুর্থাংশ মানুষতো কোন ধর্মই মানে না। বাঙাল কথায় নাস্তিক। অথচ এরা মিথ্যে বলতে জানে না। গত দশকে একমাত্র নারী প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন হাই, বয়ফ্রেন্ড অন্যায়ভাবে সরকারি ফাইল দেখতে দিয়েছিলেন। নৈতিকতার প্রশ্নে তাৎক্ষণিক ভাবে শেষ পর্যন্ত অপসারিত হলে বিশে^র নজরে আসে। অন্যায়ভাবে সামরিক শাসন জারি করায় প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টকে বরখাস্ত করেন। শুধু তাইই নয়। প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল সামরিক আইন জারির জন্য মাফ চেয়েও শাস্তি থেকে রক্ষা পাননি।
বলা হয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতিতে দক্ষিণ কোরিয়া আজকের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক কিছু শেখার আছে। আবার ইনসিওন থেকে টোকিওগামী বিমান আকাশে উড়তেই ভাবলাম মাত্র ৫০ বছরে প্রকৃতিকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না করে, শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ধারণ করে একটি দেশ শহর থেকে গ্রাম অবধি এমন করে সাজাতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ^াস করা কষ্টকর। আনমনে ভাবছিলাম, একটি রাজধানী শহরকেও যে ফুলের বাগানে সজ্জিত করা যায়, বসন্তের সিউল না দেখলে বিশ^াস করা মুশকিল। এ যেন স্বর্গ নেমেছে ধরায়।
[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ ]
শঙ্কর প্রসাদ দে
সোমবার, ১৯ মে ২০২৫
থাই এয়ারওয়েজের বিশাল বোয়িং ইনসিওন বিমানবন্দরে নামার মুহূর্তে জানালা দিয়ে কোরীয় উপদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে শুরু হলো মুগ্ধতা, বিস্ময় ও সুখানুভূতির পালা। জুনের ১ম সপ্তাহ বসন্ত বলে কথা। শুনেছিলাম বিমানবন্দরটি পৃথিবী সেরা। প্লেন ল্যান্ডিং, ইমিগ্রেশন ও শহরের দিকে ধাবমান বাসে উঠে বুঝলাম কথাটি সর্বাংশে সত্য। অনেক ছোট নদীর উপর ডজন খানেক সেতুপথ অতিক্রম করে মিনিট বিশেকের ব্যবধানে সিউল শহরমুখী সর্পিল রাজপথ। দু’পাশে ঘরবাড়ি, তারকাখচিত হোটেল, মোটেল, শপিংমল, আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টগুলোর চেয়ে সুন্দর হলো প্রবেশাঙ্গন।
রাজপথগুলোর দুধারে গোলাপসহ বাহারি ফুলবৃক্ষ। মাঝখানে ডিভাইডার সাজানো হয়েছে মাটিভর্তি বাস্কেটে শুধু ফুল, ফুটন্ত ফুল আর ফুলবৃক্ষ। পৃথিবীর সব দেশেই ফুটপাত আছে। অথচ সিউলের ফুটপাত দিয়ে সাইকেল চালানোর জন্য রাবার কার্পেট বিছানো আছে। কোন ডাস্টবিন নেই। কোন ধুলাবালি নেই। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া এদেশে কেউ হর্ন বাজান না। জেব্রাক্রসিংয়ে যতক্ষণ মানুষ থাকবে ততক্ষণ গাড়ির চাকা ঘুরে না। সিগন্যাল নেই এমন গলি বা ছোট রাস্তাগুলোতে এটিই নিয়ম এটিই আইন। সন্ধ্যায় দলবেঁধে সবাই বেরোলাম শহর দেখতে।
কোরিয়া ভাগ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সমাপ্তিতে। দু’হাজার বছর ধরে পাহাড়ি এই জনপদ ছিল, মূলত জাপানি উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ করেছিল আমেরিকান নৌবাহিনীর হাতে। সেই থেকে আজকের দক্ষিণ কোরিয়া দখলে নিল আমেরিকা। প্রতিষ্ঠিত হলো আজকের দক্ষিণ কোরিয়া। অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর বিস্ময় মাত্র ১ লাখ বর্গকিলোমিটারের ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষের কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ৪৫ হাজার মার্কিন ডলার। ভাবা যায়? এই অর্জন ঘটেছে মাত্র অর্ধশতকে।
১৯৪৫ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত কোরিয়া সংকটের সমাপ্তি হয় ১৯৫৩ সালে উত্তর কোরিয়ার আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপটে। একদিন সবাই মিলে ছুটলাম নামিয়ারা দ্বীপ দেখতে। পৃথিবীর অন্যসব শহরের মতো সিউলের বেড়ে উঠা হাং নদীকে ঘিরে। এই হাং নদীকে ডান পাশে রেখে ট্রেন এগিয়ে চলল নগর পেরিয়ে গ্রামীণ জনপদে। একটিও গাছ কাটা হলো না। একটিও পাহাড় বা টিলা কাটা হলো না। সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রায় দু’শো কিলোমিটার পথ পেছনে ফেললো মাত্র দু’ঘণ্টায়। পাহাড়গুলো দিব্যি মিতালীতে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলায়। বৃক্ষরাজি ব্যস্ত আছে খোশগল্প আর মৃদু কোলাহলে। গ্রামে মানে ২০-২৫ তলা দালান। সব আধুনিক সুবিধা নিয়ে দালানগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
পাহাড়ের ঢালুতে যৎসামান্য ধান, গম, ভুট্টো আর সবজি ক্ষেত। নিজের ফসলে ৩ মাসের খোরাকও হয় না। বুঝলাম, একসময় কেন কোরিয়ানরা কুকুর, শূকর, সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড় খেতেন। এখনো এসব কোরিয়ানদের জনপ্রিয় খাবার। ধান হয় বলেই পাঞ্জাব আর বাংলার মানুষ ভাত খায়। নইলে আফগানদের মতো আমাদের রুটি খেতে হতো।
প্রযুক্তিতে এরা এখন বিশ^সেরা, অর্ধেক মানুষ খ্রিস্টান হলেও, এক-চতুর্থাংশ বুডিস্ট হলেও, ধর্ম খুব বেশি চর্চিত নয়। এক-চতুর্থাংশ মানুষতো কোন ধর্মই মানে না। বাঙাল কথায় নাস্তিক। অথচ এরা মিথ্যে বলতে জানে না। গত দশকে একমাত্র নারী প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন হাই, বয়ফ্রেন্ড অন্যায়ভাবে সরকারি ফাইল দেখতে দিয়েছিলেন। নৈতিকতার প্রশ্নে তাৎক্ষণিক ভাবে শেষ পর্যন্ত অপসারিত হলে বিশে^র নজরে আসে। অন্যায়ভাবে সামরিক শাসন জারি করায় প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টকে বরখাস্ত করেন। শুধু তাইই নয়। প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল সামরিক আইন জারির জন্য মাফ চেয়েও শাস্তি থেকে রক্ষা পাননি।
বলা হয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতিতে দক্ষিণ কোরিয়া আজকের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক কিছু শেখার আছে। আবার ইনসিওন থেকে টোকিওগামী বিমান আকাশে উড়তেই ভাবলাম মাত্র ৫০ বছরে প্রকৃতিকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না করে, শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ধারণ করে একটি দেশ শহর থেকে গ্রাম অবধি এমন করে সাজাতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ^াস করা কষ্টকর। আনমনে ভাবছিলাম, একটি রাজধানী শহরকেও যে ফুলের বাগানে সজ্জিত করা যায়, বসন্তের সিউল না দেখলে বিশ^াস করা মুশকিল। এ যেন স্বর্গ নেমেছে ধরায়।
[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ ]