আনোয়ারুল হক
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পটভূমিতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নাটকীয় মোড় সৃষ্টি হয়। ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের অতিরঞ্জিত প্রচার হয়েছে। ভারত সরকারের কিছু কর্তাব্যক্তি ও রাজনীতিকেরও তা নিয়ে সমালোচনা ও বাড়তি মন্তব্য করতে দেখা গেছে। ভারতের মাটিতে বসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আগ্রাসী বক্তব্য দিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকেও কোনো কোনো মহলের নিয়মিত ভারতবিদ্বেষ উগরে দেয়ার মনোভাব, সরকারের একজন উপদেষ্টার বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে বিতর্কিত এবং কিছুটা উসকানিমূলক পোস্ট প্রদান ও প্রত্যাহারের ঘটনা পরিস্থিতিকে বেশ উত্তপ্ত করে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ঝানু কূটনীতিকের মতো ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার বক্তব্যের ২/১টি উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। খোলাখুলি বললে, শুরুটা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। হয়তো নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ভারতের কিছুটা সময় লাগছে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত যে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘গত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশটির সম্পর্কের বিষয়ে দূরত্ব রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই দূরত্ব ঘোচাতে কাজ করবে। মানুষ যেন ভাবে ভারত ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’ আবার বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান হলো আশপাশ থেকে দু-চারজন কী বলল, তাতে মনোযোগ না দিয়ে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করে যেতে হবে।’
উপদেষ্টা মহোদয়ের মন্তব্যগুলো পড়লে এটা স্পষ্ট যে, তার প্রতিপক্ষ বক্তব্য বিবৃতিতে মোড়লিপনাভাব অব্যাহত রাখলেও তিনি অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে দেশের অবস্থান ও মর্যাদাকে অক্ষুণœ রেখে কূটনৈতিক কুশলতার ক্ষেত্রে পারঙ্গমতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন।
তবে চট্টগ্রাম বন্দর ও রাখাইনে মানবিক করিডোর ইস্যু সামনে চলে আসার পর সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এ দুই ইস্যুতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা খুব একটা কথা বলছেন না। প্রাথমিকভাবে করিডোর ইস্যু নিয়ে ‘নীতিগত সিদ্ধান্তের’ বিষয়ে দু’এক কথা বললেও এখন আর বলছেন না। যা বলার বলছেন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রেস সচিব। আর বন্দর ইস্যু নিয়ে বলছেন সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা নিজেই। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ মানবিক করিডোর ইস্যু নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এবং পররাষ্ট্র সচিব ইতোমধ্যেই ‘শহীদ’ হয়ে ছুটিতে গিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক বিষয়ে খলিলুর রহমানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে আলোচনা করে থাকেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রায়ই বলেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে; কিন্তু মানবিক করিডর ইস্যু এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে কারো সাথে আলোচনা করা তো দূরের কথা বরং প্রথম দিকে কেমন একটা লুকোছাপা ভাব এবং অস্বচ্ছতা ছিল। তারপরে আবার একটা স্পর্ধিতভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। অথচ করিডোর ইস্যুর সাথে জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত হলেও এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর সম্মতিও নেয়া হয়নি।
ড. ইউনূস চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, বন্দর ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর সেরা যারা তাদের হাতে বন্দর দিয়ে দিতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ যদি রাজি না থাকে তাদের রাজি করাতে হবে। অর্থাৎ তিনি তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চান। মানবিক করিডোর ও বন্দর ব্যবস্থাপনা ইস্যু নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী এক বিপজ্জনক খেলায় জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে হয়। রোহিঙ্গাদের জন্য পুরো বাংলাদেশটাই তো দীর্ঘদিন থেকে মানবিক করিডোর হয়ে আছে। বিশ্বের মোড়ল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের সাথে কি দানবিক আচরণ করেছে তাতো কারো অজানা নয়। আজ তাদের কাছে প্রফেসর ইউনূস খুবই পছন্দের। ভালো কথা। আমরাও খুশি। কিন্তু ওই ‘দানবিক’ শক্তির কথায় আমরা ‘মানবিক’ হয়ে প্রতিবেশী মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের সাথে প্রক্সি ওয়ারে কেন জড়াব? অবশ্য মানবিক করিডোর ইস্যু নিয়ে খলিলুর রহমান কিছুটা কথার মারপ্যাঁচ সৃষ্টি করছেন। তিনি এখন বলছেন করিডোর নিয়ে কখনো কোনো আলোচনাই হয় নাই। আলোচনা হয়েছে ত্রাণ নিয়ে। ভারতীয় গণমাধ্যম এটাকে করিডোর বানিয়েছে।
এত বড় অসত্য কথন কি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মুখে শোভা পায়? সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখ দিয়েই তো বলানো হলোÑ‘সরকার মানবিক করিডোর প্রদানের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে’। গোটা দেশ যখন এর বিরোধিতা করছে তখন ভারতীয় মিডিয়ার ওপর দায় চাপিয়ে পশ্চাৎপসারণ করছেন। আসলে কিন্তু পিছু হটছেন না। এখন করিডোর শব্দের বদলে ত্রাণ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। শব্দ যেটাই ব্যবহার করা হোক না কেন কোনো একটি পরাশক্তির কূটকৌশলের কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করে বসে আছি এবং দেশকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলছি।
আমরাই বলছি চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের অর্থনীতির হার্ট। আমাদের হার্টতো লাভজনকভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। হার্টে যদি কোন ব্লকেজ হয়ে থাকে এবং ‘বাইপাস’ বা ‘স্টেন’ করাতে নিজেরা সক্ষম না হই অর্থাৎ সক্ষমতা বাড়াতে, ব্যবস্থাপনা আরো আধুনিক করতে আমাদের ‘দানবিক বন্ধুদের’ কাছ থেকে কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ সহায়তাও নেয়া যেতে পারে। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আলাদা পোর্ট রোড, মাল্টি মডেল কমিউনিকেশন বা আরো অনেক কিছুই করা যেতে পারে; কিন্তু আমাদের হার্ট আমরা ইজারা বা বিক্রি করে দেবো কেনো? চট্টগ্রাম বন্দর যদি আমাদের হৃৎপি- হয়ে থাকে তবে হৃৎপিন্ডের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আমাদের বাঁচা-মরা তার ইচ্ছামাফিক কেন করতে দেব?
একটি দেশের বন্দর শুধু অর্থনীতির হৃৎপি- নয়, কৌশলগত সম্পদও বটে এবং জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত। ইচ্ছে হলেই তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। তেমনি ইচ্ছে হলেই মানবিক শব্দটি আগে জুড়ে দিয়ে কাউকে করিডোর দেওয়া যায় না। আর এ সব বিষয়ের সাথে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও যুক্ত এবং সেক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি করার তো প্রয়োজন নেই।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গত মার্চ মাসে চীন সফরে গিয়ে বললেন, ‘উত্তর-পূর্ব ভারত স্থলবেষ্টিত এবং ঢাকা এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক।’ চীন সফরে যেয়ে উত্তর পূর্ব ভারতের সামুদ্রিক যোগাযোগের অভিভাবকত্বের আকাক্সক্ষা পোষণ করাটা কি খুব জরুরি ছিল? উত্তর পূর্ব ভারত কি ভাবে যোগাযোগ করবে তা ভারতবর্ষই ভাবুক। এ ইস্যুতে চীনের সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্কের শীতলতা নিয়ে তো আমরা অবহিত। আমাদের কি প্রয়োজন এ নাজুক বিষয় নিয়ে মোড়লিপনা করা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র সচিবের যে বক্তব্যÑ ‘সম্পর্ক দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধার ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত’- সেটা অনুসরণ করাই শ্রেয়।
এটা নিয়ে তো কোনো বিতর্ক নেই যে, বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমাদের সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বলে কিছু নেই। সর্বোচ্চ আদালতের রেফারেন্স নিয়ে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এ সরকার নির্বাহী কাজ অর্থাৎ রুটিন কাজ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য ক্ষমতায় আছে। সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে সম্ভবত দ্রুত সময়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য নিরপেক্ষতার সাথে অংশগ্রহণমূলক একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা। সেক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত নির্বাচনের সুস্পষ্ট পথরেখা ঘোষণা না করে, করিডোর, বন্দর ইত্যাদি বিতর্কিত ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি বিষয় নিয়ে সরকার নিজেকে ব্যস্ত রাখছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলছেন- তাদের যা খুশি তা করার ম্যান্ডেট নাকি রয়েছে। সরকারের মধ্যেই এ ধরনের চিন্তা ভাবনা বর্তমান অস্থির ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করছে। সেই সাথে সদ্য গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল যাদের এখন পর্যন্ত শক্তিশালী কোনো সংগঠন ও জনভিত্তি গড়ে ওঠেনি তাদের সব বিষয়ে দাদাগিরির ফলে উপদেষ্টা পরিষদ, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। শুরু থেকে লাগাম হাতছাড়া করে এবং ‘কচিকাঁচার আসরের’ ওপর নির্ভর করে দিশাহীন অধ্যাপক ইউনূসকে এখন নাকি পদত্যাগের কথা ভাবতে হচ্ছে। অথচ প্রথম থেকেই নির্বাচনের দিশা নিয়ে অগ্রসর হলে এই দশ মাসেই নির্বাচনী হাওয়া উঠতো। আর নির্বাচনী উৎসবই পরাস্ত করতো অস্থিতিশীলতার শক্তিকে।
এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে এবং সেই অনুযায়ী সরকারের সব কার্যক্রম ও তৎপরতা দৃশ্যমান হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিকতার পথে অগ্রসর হবে। আপাতত করিডোর, বন্দর বা অন্য যে কোনো ইস্যুতেই ভারত বা মার্কিন কারো মোড়লগিরি যেমন চাই না, আমাদেরও ছোটখাটো মোড়ল হওয়ার দরকার নাই।
[ লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ]
আনোয়ারুল হক
শনিবার, ২৪ মে ২০২৫
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পটভূমিতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নাটকীয় মোড় সৃষ্টি হয়। ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের অতিরঞ্জিত প্রচার হয়েছে। ভারত সরকারের কিছু কর্তাব্যক্তি ও রাজনীতিকেরও তা নিয়ে সমালোচনা ও বাড়তি মন্তব্য করতে দেখা গেছে। ভারতের মাটিতে বসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আগ্রাসী বক্তব্য দিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকেও কোনো কোনো মহলের নিয়মিত ভারতবিদ্বেষ উগরে দেয়ার মনোভাব, সরকারের একজন উপদেষ্টার বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে বিতর্কিত এবং কিছুটা উসকানিমূলক পোস্ট প্রদান ও প্রত্যাহারের ঘটনা পরিস্থিতিকে বেশ উত্তপ্ত করে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ঝানু কূটনীতিকের মতো ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার বক্তব্যের ২/১টি উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। খোলাখুলি বললে, শুরুটা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। হয়তো নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ভারতের কিছুটা সময় লাগছে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত যে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘গত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশটির সম্পর্কের বিষয়ে দূরত্ব রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই দূরত্ব ঘোচাতে কাজ করবে। মানুষ যেন ভাবে ভারত ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’ আবার বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান হলো আশপাশ থেকে দু-চারজন কী বলল, তাতে মনোযোগ না দিয়ে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করে যেতে হবে।’
উপদেষ্টা মহোদয়ের মন্তব্যগুলো পড়লে এটা স্পষ্ট যে, তার প্রতিপক্ষ বক্তব্য বিবৃতিতে মোড়লিপনাভাব অব্যাহত রাখলেও তিনি অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে দেশের অবস্থান ও মর্যাদাকে অক্ষুণœ রেখে কূটনৈতিক কুশলতার ক্ষেত্রে পারঙ্গমতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন।
তবে চট্টগ্রাম বন্দর ও রাখাইনে মানবিক করিডোর ইস্যু সামনে চলে আসার পর সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এ দুই ইস্যুতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা খুব একটা কথা বলছেন না। প্রাথমিকভাবে করিডোর ইস্যু নিয়ে ‘নীতিগত সিদ্ধান্তের’ বিষয়ে দু’এক কথা বললেও এখন আর বলছেন না। যা বলার বলছেন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রেস সচিব। আর বন্দর ইস্যু নিয়ে বলছেন সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা নিজেই। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ মানবিক করিডোর ইস্যু নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এবং পররাষ্ট্র সচিব ইতোমধ্যেই ‘শহীদ’ হয়ে ছুটিতে গিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক বিষয়ে খলিলুর রহমানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে আলোচনা করে থাকেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রায়ই বলেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে; কিন্তু মানবিক করিডর ইস্যু এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে কারো সাথে আলোচনা করা তো দূরের কথা বরং প্রথম দিকে কেমন একটা লুকোছাপা ভাব এবং অস্বচ্ছতা ছিল। তারপরে আবার একটা স্পর্ধিতভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। অথচ করিডোর ইস্যুর সাথে জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত হলেও এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর সম্মতিও নেয়া হয়নি।
ড. ইউনূস চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, বন্দর ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর সেরা যারা তাদের হাতে বন্দর দিয়ে দিতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ যদি রাজি না থাকে তাদের রাজি করাতে হবে। অর্থাৎ তিনি তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চান। মানবিক করিডোর ও বন্দর ব্যবস্থাপনা ইস্যু নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী এক বিপজ্জনক খেলায় জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে হয়। রোহিঙ্গাদের জন্য পুরো বাংলাদেশটাই তো দীর্ঘদিন থেকে মানবিক করিডোর হয়ে আছে। বিশ্বের মোড়ল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের সাথে কি দানবিক আচরণ করেছে তাতো কারো অজানা নয়। আজ তাদের কাছে প্রফেসর ইউনূস খুবই পছন্দের। ভালো কথা। আমরাও খুশি। কিন্তু ওই ‘দানবিক’ শক্তির কথায় আমরা ‘মানবিক’ হয়ে প্রতিবেশী মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের সাথে প্রক্সি ওয়ারে কেন জড়াব? অবশ্য মানবিক করিডোর ইস্যু নিয়ে খলিলুর রহমান কিছুটা কথার মারপ্যাঁচ সৃষ্টি করছেন। তিনি এখন বলছেন করিডোর নিয়ে কখনো কোনো আলোচনাই হয় নাই। আলোচনা হয়েছে ত্রাণ নিয়ে। ভারতীয় গণমাধ্যম এটাকে করিডোর বানিয়েছে।
এত বড় অসত্য কথন কি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মুখে শোভা পায়? সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখ দিয়েই তো বলানো হলোÑ‘সরকার মানবিক করিডোর প্রদানের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে’। গোটা দেশ যখন এর বিরোধিতা করছে তখন ভারতীয় মিডিয়ার ওপর দায় চাপিয়ে পশ্চাৎপসারণ করছেন। আসলে কিন্তু পিছু হটছেন না। এখন করিডোর শব্দের বদলে ত্রাণ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। শব্দ যেটাই ব্যবহার করা হোক না কেন কোনো একটি পরাশক্তির কূটকৌশলের কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করে বসে আছি এবং দেশকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলছি।
আমরাই বলছি চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের অর্থনীতির হার্ট। আমাদের হার্টতো লাভজনকভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। হার্টে যদি কোন ব্লকেজ হয়ে থাকে এবং ‘বাইপাস’ বা ‘স্টেন’ করাতে নিজেরা সক্ষম না হই অর্থাৎ সক্ষমতা বাড়াতে, ব্যবস্থাপনা আরো আধুনিক করতে আমাদের ‘দানবিক বন্ধুদের’ কাছ থেকে কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ সহায়তাও নেয়া যেতে পারে। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আলাদা পোর্ট রোড, মাল্টি মডেল কমিউনিকেশন বা আরো অনেক কিছুই করা যেতে পারে; কিন্তু আমাদের হার্ট আমরা ইজারা বা বিক্রি করে দেবো কেনো? চট্টগ্রাম বন্দর যদি আমাদের হৃৎপি- হয়ে থাকে তবে হৃৎপিন্ডের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আমাদের বাঁচা-মরা তার ইচ্ছামাফিক কেন করতে দেব?
একটি দেশের বন্দর শুধু অর্থনীতির হৃৎপি- নয়, কৌশলগত সম্পদও বটে এবং জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত। ইচ্ছে হলেই তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। তেমনি ইচ্ছে হলেই মানবিক শব্দটি আগে জুড়ে দিয়ে কাউকে করিডোর দেওয়া যায় না। আর এ সব বিষয়ের সাথে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও যুক্ত এবং সেক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি করার তো প্রয়োজন নেই।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গত মার্চ মাসে চীন সফরে গিয়ে বললেন, ‘উত্তর-পূর্ব ভারত স্থলবেষ্টিত এবং ঢাকা এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক।’ চীন সফরে যেয়ে উত্তর পূর্ব ভারতের সামুদ্রিক যোগাযোগের অভিভাবকত্বের আকাক্সক্ষা পোষণ করাটা কি খুব জরুরি ছিল? উত্তর পূর্ব ভারত কি ভাবে যোগাযোগ করবে তা ভারতবর্ষই ভাবুক। এ ইস্যুতে চীনের সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্কের শীতলতা নিয়ে তো আমরা অবহিত। আমাদের কি প্রয়োজন এ নাজুক বিষয় নিয়ে মোড়লিপনা করা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র সচিবের যে বক্তব্যÑ ‘সম্পর্ক দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধার ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত’- সেটা অনুসরণ করাই শ্রেয়।
এটা নিয়ে তো কোনো বিতর্ক নেই যে, বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমাদের সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বলে কিছু নেই। সর্বোচ্চ আদালতের রেফারেন্স নিয়ে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এ সরকার নির্বাহী কাজ অর্থাৎ রুটিন কাজ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য ক্ষমতায় আছে। সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে সম্ভবত দ্রুত সময়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য নিরপেক্ষতার সাথে অংশগ্রহণমূলক একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা। সেক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত নির্বাচনের সুস্পষ্ট পথরেখা ঘোষণা না করে, করিডোর, বন্দর ইত্যাদি বিতর্কিত ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি বিষয় নিয়ে সরকার নিজেকে ব্যস্ত রাখছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলছেন- তাদের যা খুশি তা করার ম্যান্ডেট নাকি রয়েছে। সরকারের মধ্যেই এ ধরনের চিন্তা ভাবনা বর্তমান অস্থির ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করছে। সেই সাথে সদ্য গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল যাদের এখন পর্যন্ত শক্তিশালী কোনো সংগঠন ও জনভিত্তি গড়ে ওঠেনি তাদের সব বিষয়ে দাদাগিরির ফলে উপদেষ্টা পরিষদ, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। শুরু থেকে লাগাম হাতছাড়া করে এবং ‘কচিকাঁচার আসরের’ ওপর নির্ভর করে দিশাহীন অধ্যাপক ইউনূসকে এখন নাকি পদত্যাগের কথা ভাবতে হচ্ছে। অথচ প্রথম থেকেই নির্বাচনের দিশা নিয়ে অগ্রসর হলে এই দশ মাসেই নির্বাচনী হাওয়া উঠতো। আর নির্বাচনী উৎসবই পরাস্ত করতো অস্থিতিশীলতার শক্তিকে।
এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে এবং সেই অনুযায়ী সরকারের সব কার্যক্রম ও তৎপরতা দৃশ্যমান হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিকতার পথে অগ্রসর হবে। আপাতত করিডোর, বন্দর বা অন্য যে কোনো ইস্যুতেই ভারত বা মার্কিন কারো মোড়লগিরি যেমন চাই না, আমাদেরও ছোটখাটো মোড়ল হওয়ার দরকার নাই।
[ লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ]