জিয়াউদ্দীন আহমেদ
১০ মে, ২০২৫। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজ মেয়েকে হত্যা করেছে মা-বাবা। গভীর রাতে ভাইয়ের স্ত্রীর সহযোগিতায় মা-বাবা তাদের মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী জান্নাতি খাতুনকে রড ও দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে ভুট্টা খেতে ফেলে রাখে। ঘটনা ভিন্ন খাতে নেয়ার লক্ষ্যে তারা বাড়ির খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়। ঠিক এক বছর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪-এ পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের রামবল্লভ গ্রামে আট বছর বয়সী শিশু মরিয়মকে হত্যা করে তার নিজ মা ও চাচা; কারণ একই, জমি-সংক্রান্ত বিরোধ। মা রিনা বেগম মেয়ে মরিয়মকে পাশের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নতুন পোশাক পরিয়ে বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত ভিটায় নিয়ে গিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ বেঁধে রাখেন, আর চাচা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন।
গাজীপুরের শ্রীপুরে ২০২৩ সালে মায়ের কোলে দুই বছরের শিশু ফাতেমা চাচার লাঠির উপর্যুপরি আঘাতে মৃত্যবরণ করে। জমি নিয়ে বিরোধ থাকায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ফাতেমার বাবার নির্দেশে চাচা এই হত্যাকা- ঘটান এবং বাবা এই নির্মম হত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবলোকন করেন। মা-বাবার হাতে সন্তানের খুন অহরহ হচ্ছে। কয়েক বছর আগে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাড্ডার সাতারকুলে এমন আরেকটি ঘটনায় পিতা জাহিদের নির্দেশে ভাড়াটে খুনি মজিদ বারো বছরের কিশোর সন্তান আউসারকে তাদের বাড়ির পাশের ধানখেতে ডেকে নিয়ে প্রথমে পানিতে ডুবিয়ে এবং পরে ছুরিকাঘাত করে খুন করে। শিশু ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানির জন্য গলায় ছুরি চালানোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বহু বছর আগে বাংলাদেশেও একজন বাবা তার শিশু সন্তানকে কোরবানি দিয়েছিল।
কী অদ্ভুত পৃথিবী! দুনিয়ার সর্বত্র বিপদের আশঙ্কা থাকলেও সন্তানেরা তাদের মা-বাবার আশ্রয়ে নিশ্চিত নিরাপদ বোধ করে, ক্রন্দনরত শিশু তার কান্না থামায় মায়ের কোল পেলে। মায়ের কোলে এই নিরাপত্তা পশুর বাচ্চারাও অনুভব করে। মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন গৃহকর্মী শিশুরা বিপদ-আপদে শুধু মাকেই স্মরণ করে। একাত্তরে পরিত্যক্ত যে সব শিশুকে বিদেশিরা নিয়ে অঢেল ধন-সম্পদের মধ্যে বড় করেছে তাদেরও অনেকে তাদের মা-বাবার খোঁজে বাংলাদেশে এসেছে, কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি। বিপদে-আপদে মা-বাবার ওপর এমন নির্ভরশীলতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা কেউ প্রত্যাশা করে না। অবশ্য অভাবের তাড়নায় উপায়ন্তর না দেখে অনেক মা-বাবা আত্মহত্যা করার আগে নিজের সন্তানদেরও খুন করে। কারণ তারা জানে এই সমাজ অনাথদের করুণা করলেও বাঁচতে দেয় না।
মা-বাবার ষড়যন্ত্রে খুন হওয়া প্রতিটি সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ মুহূর্তেও মনে করে তার জন্মদাতা মা-বাবা তাদের বাঁচাবে। কিন্তু কী অদ্ভুত সম্পর্ক, যারা সন্তানদের পৃথিবীতে এনেছে তারাই সন্তানের করুণ মৃত্যুর মধ্যে প্রতিপক্ষের আসন্ন বিপদ কল্পনা করে তৃপ্তি পায়। পরকালে প্রাপ্তির ওয়াজ এদের লোভ-লালসা কমাতে পারে না, পরকালের বেহেশতের চেয়ে এদের কাছে এক খ- জমি অনেক বেশি লোভনীয়, এই জমির জন্য সন্তানকেও নিজ হাতে ছুরি দিয়ে জবাই করতে পারে, পারে ভাড়াটে খুনির হাতে সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা দেখতে। অবশ্য সন্তানের হাতেও মা-বাবার লাঞ্ছনা হয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই লাঞ্ছনা হয় অভাবের কারণে।
পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘অনার কিলিং’ হয়, বাংলাদেশেও হয়। তবে মহামারীর মতো এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায় শুধু পাকিস্তানে। বাবার নিষেধ থাকা স্বত্বেও প্রতিপক্ষ পরিবারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার কারণে পাকিস্তানে ছেলের মৃত্যুদ- ঘোষণা করে বাবা খুব শান্তভাবে তার ছেলে গানি রেহমানকে শেষবারের মতো পরিবারের সবার সঙ্গে রাতের খাবার খেতে আহ্বান করেন। মৃত্যুক্ষণ সন্নিকটে জেনে গানি খাওয়ার আহবানে সাড়া না দিয়ে তার কক্ষে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। বাবা খেয়ে এসে ছেলের হাত-পা বেঁধে জবাই করল, মা ও বোনেরা সন্তানের গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তস্রোত দেখল এবং মৃত্যু-কষ্টের গোঙানির শব্দ শুনল। পরিবারের অমতে প্রেম ও কোর্ট ম্যারেজ করার অপরাধে পাকিস্তানের ১৯ বছর বয়সী মেয়ে সাবাকে নদীর কিনারে নিয়ে গুলি করে মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয় তার বাবা। সাবার এই ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত শর্ট ডকুমেন্টারি ২০১৬ সালে জিতে নিয়েছে অস্কার। পরিবারের অমতে বিয়ে করার অপরাধে পাকিস্তানের লাহোরে ফারজানা পারভিন নামের একটি মেয়েকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে, পাথর ছুড়ে হত্যা করে তারই বাবা, ভাই, চাচাতো ভাই মিলে প্রায় ২০ জনের একটি দল। ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী পাকিস্তানের নারী সামিয়া শাহিদ তার প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে ব্রিটেনে আরেকজনকে বিয়ে করায় সামিয়ার বাবা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পাকিস্তান নিয়ে সামিয়াকে হত্যা করে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এসব অনার কিলিংয়ের পর কিলারদের সামাজিক মর্যাদা বহুগুণ বেড়ে যায়।
ভারতের হিন্দু পরিবারেও অনার কিলিং আছে। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হলে অনার কিলিংয়ের উদ্ভব হয়। ২০০৮ সালে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে এক হিন্দু বাবা কুড়াল দিয়ে তার মেয়ের শিরñেদ করে। মুসলমান মেয়ে শাহজাদির সঙ্গে প্রেম করার অপরাধে মেয়ের বাবা ও পরিবারের সদস্যদের হাতে কয়েক বছর আগে দিল্লির রাস্তায় দিনের আলোয় জবাই করা হয় অঙ্কিত সাক্সেনা নামের এক হিন্দু ফটোগ্রাফারকে। অন্যদিকে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার অপরাধে এক গরিব মুসলমান শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা করে শম্ভুলাল নামের এক হিন্দু। সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন ব্যক্তির প্রেম করে বিয়ে করার মধ্যে কোন অপরাধ নেই মর্মে ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে নির্দেশ দিতে হয়েছে এসব অনার কিলিং বন্ধ করতে। বহু যুগ আগে সংঘটিত সতীদাহ প্রথাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনুমোদিত অনার কিলিং হিসেবেও গণ্য করা হয়। খাবার দেয়ার মুরোদ না থাকলেও আমাদের সমাজে রাস্তার যৌনকর্মীদের নির্দয়ভাবে পেটানো হয়, পারলে মেরেও ফেলে। যৌনকর্মীদের প্রতি এই আক্রোশের প্রধান কারণ সমাজ ও সম্প্রদায়ের সম্মান রক্ষা করা।
রক্তপিপাসু তৈমুর লংয়ের পুত্র বাবর, তার পুত্র হুমায়ুন, তার পুত্র আকবর এবং তার পুত্র জাহাঙ্গীর বা সেলিম। জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ব্যর্থ হলে বাবা জাহাঙ্গীর ছেলে খসরুকে অন্ধ করে দেন। উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে সম্রাট শাহজাহান তার বড় ভাই খসরুকে খুন করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রথমে ছোট ভাই মুরাদকে বন্দী করে প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদ- দেন। জ্যেষ্ঠ ভাই দারা শিকোহর শিরñেদের সময় আওরঙ্গজেব সশরিরে উপস্থিত ছিলেন। আওরঙ্গজেবের নির্দেশে দারার বিচ্ছিন্ন মাথা দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়, পরে সোনালি কাপড়ে মুড়িয়ে বাক্সে ভরে পিতা শাহজাহানের কাছে পাঠানো হয়। সম্রাট শাহজাহান নৈশভোজে বসে পাঠানো বাক্স খুলতেই প্রিয় সন্তানের মাথা দেখে অসুস্থ হয়ে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
শুধু কি ক্ষমতার লড়াই! সম্রাট আকবরের হেরেমের সুন্দরী নারী আনারকলির রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত ছিলেন পিতা আকবর ও তার পুত্র জাহাঙ্গীর দুজনই। নর্তকি আনারকলি আবার আকবরের উপপতœীও ছিলেন এবং আনারকলির গর্ভে আকবরের ঔরসে দানিয়েল নামে এক সন্তান ছিলো।পুত্র জাহাঙ্গীরের সাথে আনারকলির প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিতে না পেরে সম্রাট আকবর আনারকলিকে লাহোরে জীবন্ত কবর দিয়ে দেন। তের বছর বয়সী সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরাম খানের সঙ্গে সম্রাটের প্রেয়সী সালমার বিয়ের প্রস্তাবে আকবর সম্মতি দিলেও বিয়ের তিন বছর পর বৈরাম খান আতাতয়ীর হাতে খুন হন। বৈরাম খান নিহত হওয়ার পরপরই সম্রাট তার প্রেয়সীকে স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলেন। অন্যদিকে আকবরের সন্তান জাহাঙ্গীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই তার প্রেমিকা মেহেরুন্নিসার স্বামী শের আফগানকে গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যা করে মেহেরুন্নিসাকে পতœী করে ঘরে তোলেন।
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ পার হয়ে গেছে দেড় হাজার বছর আগে। কিন্তু বর্তমান সভ্য সমাজেও কিশোরী মেয়ে জান্নাতি খাতুনেরা কেন মা-বাবার হতে বলি হচ্ছে তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। নিজেরই গর্ভজাত সন্তানকে হত্যার দায়ে রাশিয়াতে নাকি প্রতি বছর বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন অসংখ্য মা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নাকি প্রতি চারজনের একজন মা নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে চান। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের মনোবৃত্তি থেকেও সন্তান হত্যা হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সন্তান হত্যা করার পর মায়েদের আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়।
ধর্ম এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষগুলো যতই গলা ফাটাক না কেন, সমাজে এখনো মেয়ে সন্তানের গুরুত্ব নেই। গুরুত্ব নেই বলেই প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে হত্যার জন্য বেছে নেয়া হয় মেয়ে সন্তানকে, গুরুত্ব নেই বলেই একাধিক মেয়ে সন্তানের জন্মের পরও শ্বশুর-শাশুড়ির পুত্র সন্তান চাই, গুরুত্ব নেই বলেই চরম বিপদেও গভীর রাতে মেয়ে সন্তান রাস্তায় বের হলে ‘বেশ্যা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, গভীর রাতে মেয়েরা রাস্তায় বের হলে পুলিশও সওয়াল-জবাবে জেরবার করে ফেলে। উপরন্তু সভা-সমাবেশে যখন মেয়েদের ‘বেশ্যা’ নামে অভিহিত করা হয় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মেয়েদের গুরুত্ব প্রদানে আমরা এখনো আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ পার হতে পারিনি।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ২৪ মে ২০২৫
১০ মে, ২০২৫। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজ মেয়েকে হত্যা করেছে মা-বাবা। গভীর রাতে ভাইয়ের স্ত্রীর সহযোগিতায় মা-বাবা তাদের মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী জান্নাতি খাতুনকে রড ও দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে ভুট্টা খেতে ফেলে রাখে। ঘটনা ভিন্ন খাতে নেয়ার লক্ষ্যে তারা বাড়ির খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়। ঠিক এক বছর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪-এ পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের রামবল্লভ গ্রামে আট বছর বয়সী শিশু মরিয়মকে হত্যা করে তার নিজ মা ও চাচা; কারণ একই, জমি-সংক্রান্ত বিরোধ। মা রিনা বেগম মেয়ে মরিয়মকে পাশের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নতুন পোশাক পরিয়ে বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত ভিটায় নিয়ে গিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ বেঁধে রাখেন, আর চাচা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন।
গাজীপুরের শ্রীপুরে ২০২৩ সালে মায়ের কোলে দুই বছরের শিশু ফাতেমা চাচার লাঠির উপর্যুপরি আঘাতে মৃত্যবরণ করে। জমি নিয়ে বিরোধ থাকায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ফাতেমার বাবার নির্দেশে চাচা এই হত্যাকা- ঘটান এবং বাবা এই নির্মম হত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবলোকন করেন। মা-বাবার হাতে সন্তানের খুন অহরহ হচ্ছে। কয়েক বছর আগে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাড্ডার সাতারকুলে এমন আরেকটি ঘটনায় পিতা জাহিদের নির্দেশে ভাড়াটে খুনি মজিদ বারো বছরের কিশোর সন্তান আউসারকে তাদের বাড়ির পাশের ধানখেতে ডেকে নিয়ে প্রথমে পানিতে ডুবিয়ে এবং পরে ছুরিকাঘাত করে খুন করে। শিশু ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানির জন্য গলায় ছুরি চালানোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বহু বছর আগে বাংলাদেশেও একজন বাবা তার শিশু সন্তানকে কোরবানি দিয়েছিল।
কী অদ্ভুত পৃথিবী! দুনিয়ার সর্বত্র বিপদের আশঙ্কা থাকলেও সন্তানেরা তাদের মা-বাবার আশ্রয়ে নিশ্চিত নিরাপদ বোধ করে, ক্রন্দনরত শিশু তার কান্না থামায় মায়ের কোল পেলে। মায়ের কোলে এই নিরাপত্তা পশুর বাচ্চারাও অনুভব করে। মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন গৃহকর্মী শিশুরা বিপদ-আপদে শুধু মাকেই স্মরণ করে। একাত্তরে পরিত্যক্ত যে সব শিশুকে বিদেশিরা নিয়ে অঢেল ধন-সম্পদের মধ্যে বড় করেছে তাদেরও অনেকে তাদের মা-বাবার খোঁজে বাংলাদেশে এসেছে, কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি। বিপদে-আপদে মা-বাবার ওপর এমন নির্ভরশীলতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা কেউ প্রত্যাশা করে না। অবশ্য অভাবের তাড়নায় উপায়ন্তর না দেখে অনেক মা-বাবা আত্মহত্যা করার আগে নিজের সন্তানদেরও খুন করে। কারণ তারা জানে এই সমাজ অনাথদের করুণা করলেও বাঁচতে দেয় না।
মা-বাবার ষড়যন্ত্রে খুন হওয়া প্রতিটি সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ মুহূর্তেও মনে করে তার জন্মদাতা মা-বাবা তাদের বাঁচাবে। কিন্তু কী অদ্ভুত সম্পর্ক, যারা সন্তানদের পৃথিবীতে এনেছে তারাই সন্তানের করুণ মৃত্যুর মধ্যে প্রতিপক্ষের আসন্ন বিপদ কল্পনা করে তৃপ্তি পায়। পরকালে প্রাপ্তির ওয়াজ এদের লোভ-লালসা কমাতে পারে না, পরকালের বেহেশতের চেয়ে এদের কাছে এক খ- জমি অনেক বেশি লোভনীয়, এই জমির জন্য সন্তানকেও নিজ হাতে ছুরি দিয়ে জবাই করতে পারে, পারে ভাড়াটে খুনির হাতে সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা দেখতে। অবশ্য সন্তানের হাতেও মা-বাবার লাঞ্ছনা হয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই লাঞ্ছনা হয় অভাবের কারণে।
পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘অনার কিলিং’ হয়, বাংলাদেশেও হয়। তবে মহামারীর মতো এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায় শুধু পাকিস্তানে। বাবার নিষেধ থাকা স্বত্বেও প্রতিপক্ষ পরিবারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার কারণে পাকিস্তানে ছেলের মৃত্যুদ- ঘোষণা করে বাবা খুব শান্তভাবে তার ছেলে গানি রেহমানকে শেষবারের মতো পরিবারের সবার সঙ্গে রাতের খাবার খেতে আহ্বান করেন। মৃত্যুক্ষণ সন্নিকটে জেনে গানি খাওয়ার আহবানে সাড়া না দিয়ে তার কক্ষে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। বাবা খেয়ে এসে ছেলের হাত-পা বেঁধে জবাই করল, মা ও বোনেরা সন্তানের গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তস্রোত দেখল এবং মৃত্যু-কষ্টের গোঙানির শব্দ শুনল। পরিবারের অমতে প্রেম ও কোর্ট ম্যারেজ করার অপরাধে পাকিস্তানের ১৯ বছর বয়সী মেয়ে সাবাকে নদীর কিনারে নিয়ে গুলি করে মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয় তার বাবা। সাবার এই ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত শর্ট ডকুমেন্টারি ২০১৬ সালে জিতে নিয়েছে অস্কার। পরিবারের অমতে বিয়ে করার অপরাধে পাকিস্তানের লাহোরে ফারজানা পারভিন নামের একটি মেয়েকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে, পাথর ছুড়ে হত্যা করে তারই বাবা, ভাই, চাচাতো ভাই মিলে প্রায় ২০ জনের একটি দল। ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী পাকিস্তানের নারী সামিয়া শাহিদ তার প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে ব্রিটেনে আরেকজনকে বিয়ে করায় সামিয়ার বাবা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পাকিস্তান নিয়ে সামিয়াকে হত্যা করে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এসব অনার কিলিংয়ের পর কিলারদের সামাজিক মর্যাদা বহুগুণ বেড়ে যায়।
ভারতের হিন্দু পরিবারেও অনার কিলিং আছে। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হলে অনার কিলিংয়ের উদ্ভব হয়। ২০০৮ সালে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে এক হিন্দু বাবা কুড়াল দিয়ে তার মেয়ের শিরñেদ করে। মুসলমান মেয়ে শাহজাদির সঙ্গে প্রেম করার অপরাধে মেয়ের বাবা ও পরিবারের সদস্যদের হাতে কয়েক বছর আগে দিল্লির রাস্তায় দিনের আলোয় জবাই করা হয় অঙ্কিত সাক্সেনা নামের এক হিন্দু ফটোগ্রাফারকে। অন্যদিকে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার অপরাধে এক গরিব মুসলমান শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা করে শম্ভুলাল নামের এক হিন্দু। সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন ব্যক্তির প্রেম করে বিয়ে করার মধ্যে কোন অপরাধ নেই মর্মে ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে নির্দেশ দিতে হয়েছে এসব অনার কিলিং বন্ধ করতে। বহু যুগ আগে সংঘটিত সতীদাহ প্রথাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনুমোদিত অনার কিলিং হিসেবেও গণ্য করা হয়। খাবার দেয়ার মুরোদ না থাকলেও আমাদের সমাজে রাস্তার যৌনকর্মীদের নির্দয়ভাবে পেটানো হয়, পারলে মেরেও ফেলে। যৌনকর্মীদের প্রতি এই আক্রোশের প্রধান কারণ সমাজ ও সম্প্রদায়ের সম্মান রক্ষা করা।
রক্তপিপাসু তৈমুর লংয়ের পুত্র বাবর, তার পুত্র হুমায়ুন, তার পুত্র আকবর এবং তার পুত্র জাহাঙ্গীর বা সেলিম। জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ব্যর্থ হলে বাবা জাহাঙ্গীর ছেলে খসরুকে অন্ধ করে দেন। উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে সম্রাট শাহজাহান তার বড় ভাই খসরুকে খুন করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রথমে ছোট ভাই মুরাদকে বন্দী করে প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদ- দেন। জ্যেষ্ঠ ভাই দারা শিকোহর শিরñেদের সময় আওরঙ্গজেব সশরিরে উপস্থিত ছিলেন। আওরঙ্গজেবের নির্দেশে দারার বিচ্ছিন্ন মাথা দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়, পরে সোনালি কাপড়ে মুড়িয়ে বাক্সে ভরে পিতা শাহজাহানের কাছে পাঠানো হয়। সম্রাট শাহজাহান নৈশভোজে বসে পাঠানো বাক্স খুলতেই প্রিয় সন্তানের মাথা দেখে অসুস্থ হয়ে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
শুধু কি ক্ষমতার লড়াই! সম্রাট আকবরের হেরেমের সুন্দরী নারী আনারকলির রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত ছিলেন পিতা আকবর ও তার পুত্র জাহাঙ্গীর দুজনই। নর্তকি আনারকলি আবার আকবরের উপপতœীও ছিলেন এবং আনারকলির গর্ভে আকবরের ঔরসে দানিয়েল নামে এক সন্তান ছিলো।পুত্র জাহাঙ্গীরের সাথে আনারকলির প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিতে না পেরে সম্রাট আকবর আনারকলিকে লাহোরে জীবন্ত কবর দিয়ে দেন। তের বছর বয়সী সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরাম খানের সঙ্গে সম্রাটের প্রেয়সী সালমার বিয়ের প্রস্তাবে আকবর সম্মতি দিলেও বিয়ের তিন বছর পর বৈরাম খান আতাতয়ীর হাতে খুন হন। বৈরাম খান নিহত হওয়ার পরপরই সম্রাট তার প্রেয়সীকে স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলেন। অন্যদিকে আকবরের সন্তান জাহাঙ্গীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই তার প্রেমিকা মেহেরুন্নিসার স্বামী শের আফগানকে গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যা করে মেহেরুন্নিসাকে পতœী করে ঘরে তোলেন।
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ পার হয়ে গেছে দেড় হাজার বছর আগে। কিন্তু বর্তমান সভ্য সমাজেও কিশোরী মেয়ে জান্নাতি খাতুনেরা কেন মা-বাবার হতে বলি হচ্ছে তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। নিজেরই গর্ভজাত সন্তানকে হত্যার দায়ে রাশিয়াতে নাকি প্রতি বছর বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন অসংখ্য মা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নাকি প্রতি চারজনের একজন মা নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে চান। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের মনোবৃত্তি থেকেও সন্তান হত্যা হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সন্তান হত্যা করার পর মায়েদের আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়।
ধর্ম এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষগুলো যতই গলা ফাটাক না কেন, সমাজে এখনো মেয়ে সন্তানের গুরুত্ব নেই। গুরুত্ব নেই বলেই প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে হত্যার জন্য বেছে নেয়া হয় মেয়ে সন্তানকে, গুরুত্ব নেই বলেই একাধিক মেয়ে সন্তানের জন্মের পরও শ্বশুর-শাশুড়ির পুত্র সন্তান চাই, গুরুত্ব নেই বলেই চরম বিপদেও গভীর রাতে মেয়ে সন্তান রাস্তায় বের হলে ‘বেশ্যা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, গভীর রাতে মেয়েরা রাস্তায় বের হলে পুলিশও সওয়াল-জবাবে জেরবার করে ফেলে। উপরন্তু সভা-সমাবেশে যখন মেয়েদের ‘বেশ্যা’ নামে অভিহিত করা হয় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মেয়েদের গুরুত্ব প্রদানে আমরা এখনো আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ পার হতে পারিনি।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]