সংগ্রাম দত্ত
সিলেট জেলার মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হরিজন সম্প্রদায় থেকে চিরতন হরিজন ও কালীচরণ হরিজন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ১৯২০ ও ১৯৩০ সালে পরপর দুইবার এমএলসি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘ শত বছর পর তাদের সম্পর্কে তথ্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখনো অজানা। আবার কারো কারো কাছে গল্পের মতো মনে হয়।
১৯১৯ সালে যখন সমগ্র ভারতজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে চরম পর্যায়ে, তখন এই আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য চতুর ইংরেজরা ১৯১৯ সালে একটি আইন করে ‘আসাম প্রদেশিক আইন সভার সদস্য’ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। তখন ব্রিটিশরা সমর্থন দিয়ে এক গোষ্ঠী ‘ন্যাশনাল লিবারাল ফ্রন্ট’ গঠন করে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘোষণা দেয়। তখন ওই ফ্রন্টের পক্ষ থেকে দক্ষিণ শ্রীহট্ট পৌরসভার তৎকালিন চেয়ারম্যান ইরেশ লাল সোম প্রার্থী হন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন বর্জন করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনকে বিদ্রƒপ ও হাস্যকর করার লক্ষে নিম্নশ্রেণির মুচি, ধোপা, নাপিত, মৎস্যজীবী, মাঝি ইত্যাদি নিরক্ষর লোক দিয়ে নির্বাচন করানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
ব্রিটিশ ভারতে ১৯২০ সালে দক্ষিণ শ্রীহট্ট সাবডিভিশন তথা বর্তমান মৌলভীবাজার থেকে আসাম মেম্বার অব লেজিসলেটিভ কাউন্সিল (এমএলসি) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন স্থানীয় হরিজন সম্প্রদায়ের চিরতন হরিজন ও সুনামগঞ্জ মহকুমার তাহিরপুর থানা থেকে কালীচরণ হরিজন।
স্থানীয়ভাবে উভয়ে সবার কাছে চিরতন মুচি ও কালীচরণ মুচি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঐ নির্বাচনে সারা দেশজুড়ে চিরতন মুচির মতো কর্মকার, নাপিত, ধোপা, মৎসজীবী, বারুজীবী, মাঝি, ভাটিয়াল ইত্যাদি তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ নির্বাচনে অংশ নিয়ে অনেকেই প্রার্থী করিয়ে নির্বাচিত করা হয়।
১৯২০ সালের ১ আগস্ট বাল গঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুর পর গুজরাটে সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবারে জন্ম নেয়া মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ভারতের মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতের জাতির পিতার মর্যাদা লাভ করেছিলেন।
১৯২১ সালের নির্বাচনে দক্ষিণ শ্রীহট্ট থেকে চিরতন হরিজন ও সুনামগঞ্জ থেকে কালীচরণ হরিজন নির্বাচিত হবার ঐতিহাসিক ঘটনাটিও বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখনো অজানা।
নির্বাচনের পটভূমি ছিল এই যে, ১৯২০ সালে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে সারা ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ওই বছরের ৯ মার্চ মহাত্মা গান্ধি তার প্রথম অসহযোগ ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন। এতে বলা হয় ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাবলীর সুবিচার না হলে অচিরেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু করা হবে।
১৯২০ সালের ৪-৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার ওয়ালিংটন স্কোয়ারে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব পেশ করা হয়। সভায় মহাত্মা গান্ধী বলেন, ‘আমরা যদি স্বরাজ চাই এবং সন্তোষজনকভাবে খেলাফত সমস্যার সমাধান করতে চাই, তাহলে, অসহযোগ কর্মসূচি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।’ লালা লাজপত রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিন চন্দ্র পাল ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমুখ নেতা এ প্রস্তাবের ঘোর-বিরোধিতা করলেও বিরাট সংখ্যাধিক্যের সমর্থনের ভিত্তিতে অসহযোগ কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং বৈধ ও শান্তিপূর্ণভাবে স্বরাজ অর্জন কংগ্রেসের লক্ষ্য বলে স্বীকার করে নেয়া হয়।
সভায় আন্দোলনের ৪টি ক্ষেত্র সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়। যথাÑ ক) সরকারের দেয়া উপাধি পরিত্যাগ, খ) সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল-কলেজ বর্জন করে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, গ) কোর্ট-কাউন্সিল বর্জন এবং ঘ) বিদেশি পণ্য বর্জন।
এ অসহযোগ আন্দোলনের ৪টি ক্ষেত্র সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হলেও পাশাপাশি মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন-সংস্কার অনুযায়ি যে-আইন সভা গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেই নির্বাচন বয়কট করার আন্দোলন দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছিল।
১৯১৯ সালের গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুসারে কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য একটি ব্যবস্থা পরিষদ একটি রাষ্ট্র পরিষদ এবং প্রতি প্রদেশের জন্য একটি আইন সভার বিধান রাখা হয়।
আসাম প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে তখন ৫৩ জনে উন্নীত করা হয়েছিল। এতে ৪১ জন নির্বাচিত এবং ১২ জন অনুমোদিত সদস্য রাখার বিধান ছিল; কিন্তু নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার সবার ছিল না। যারা জমির খাজনা, চৌকিদারি ট্যাক্স দিতে পারতেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে মাইনর পাশ ছিলেন, কেবলমাত্র তারাই নির্বাচিত হবার যোগ্য ছিলেন।
এই অ্যাক্ট নিয়ে ১৯১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারত-শাসন বিষয়ক নতুন বিধান সম্পর্কে অমৃতশহরে কংগ্রেসের অধিবেশনে তুমুল বাক বিতন্ড হয়। কংগ্রেসের বিতর্কের প্রধান বিষয় ছিল, ‘নতুন শাসনসংস্কার মেনে নেয়া ও সংস্কারের জন্য মন্টেগুকে ধন্যবাদ দেয়া হবে কি না।’ চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন এ নতুন সংস্কার একেবারেই বর্জন করার পক্ষে। শেষপর্যন্ত চিত্তরঞ্জন দাশ যে প্রস্তাব করেছিলেন তার সাথে যোগ করা হয়, ‘যতদিন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন কংগ্রেসের মতে এই সংস্কার স্বীকার এবং সে অনুসারে কাজ করে যাতে যথা শীঘ্র সম্ভব পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন লাভ করা যায় তার চেষ্টা করা হোক এবং কংগ্রেস এ সংস্কারের জন্য মন্টেগুকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।’
এই ভারত-শাসন বিষয়ক নতুন বিধান অনুসারে দপ্রাদেশিক পরিষদদ নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯২১ সালের ১ এপ্রিল কার্যভার গ্রহণের কথা। সে অনুসারে ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে পরে কংগ্রেস কলকাতা ও নাগপুর অধিবেশনে নতুন সংবিধান অনুসারে প্রথম ব্যবস্থাপক সভার (১৯২১-২৩) নির্বাচন বয়কট ঘোষণা করে এ নির্বাচনকে হাস্যকর করে তোলার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তখন নোয়াখালী থেকে একজন মুচি ও একজন নাপিতকে প্রার্থী করে মনোনয়নপত্র পেশ করা হয়। কুমিল্লা অঞ্চল থেকে রাস্তার ধারে খাবারের দোকানদার মোকরম আলী ও সুনামগঞ্জ থেকে কালীচরণ মুচিকে প্রার্থী করিয়ে নির্বাচনে জিতিয়ে আসাম আইন সভায় পাঠিয়ে হাস্যরসে পরিণত করা হয়।
সুনামগঞ্জবাসী কালীচরণ মুচিকে প্রার্থী হিসেবে এবং নোয়াখালীর মানুষ একজন মুচি, আরেকজন ধোপা এবং মোকরম আলী ভাটিয়ালকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলেও এ নিয়ে কোন শোরগুল শোনা যায়নি; কিন্তু চিরতন হরিজনকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় দক্ষিণ শ্রীহট্টবাসীকে, সুনামগঞ্জসহ গোটা শ্রীহট্টের মানুষ শতাধিক শত বছর পরও দফগাদ বা বোকা বলে হাসি-ঠাট্টা করতে দেখা যায়।
তৎকালীন দক্ষিণ শ্রীহট্ট বা বর্তমান মৌলভীবাজার হচ্ছে মনু নদীর তীর ঘেষে গড়া উঠা মৌলভী কুদরত উল্লার প্রতিষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। কালের পরিক্রমায় এখন এটি একটি জেলা শহর। এ বাজারের পশ্চিম বাজারে ছিল মুচি বা হরিজন সম্প্রদায়ের বসবাস। সেখানে চিরতন মুচির বাস করতেন। ছোট্ট একটি ঝুপড়ির মতো ঘরে বসে তৎকালীন ভদ্রলোকদের জুতা সেলাই কিংবা পালিশ করে দেয়াই ছিল তার জীবিকা নির্বাহের মূল অবলম্বন।
রাজনীতির কূটচাল, আন্দোলন, সংগ্রাম এ জাতীয় শব্দগুলো তার কানে পৌঁছালেও শব্দগুলোর সঠিক অর্থ কী তা চিরতন মুচি জানতেন না। এমন কী ১৯২০ সালের নির্বাচনে চিরতন মুচি কিংবা এ ধরনের আরও যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদের শুধু সম্মতিদান ছাড়া আর কোনও কিছু বুঝারও উপায় ছিল না। বোঝাপড়ার দায়-দায়িত্ব ছিল কংগ্রেসের নেতাদের ওপর।
কংগ্রেস নেতা সারদা চরণ শ্যামের নেতৃত্বে সবাই দল বেঁধে হাজির হন চিরতন মুচির ঝুপড়ি ঘরে। নিজের ঘরের সামনে এতো লোকের সমাগম দেখে চিরতনের হৃৎপি- যতটুকু কেঁপে উঠেছিল তার চাইতেও বেশি তিনি বিষ্ময়ে হতবাক হয়েছিল যখন তাকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তাব দেয়া হয় তা শুনে।
কথিত আছে যে, তখন চিরতনের জবাব ছিল, ‘রাম রাম এ কিয়া বলো বাবু! হামি আপনার সাথে কোন দুছ করছি যে, হামার লগে আপনারা তামছা (তামাশা) করতে আইছন (এসেছেন)।’
প্রস্তাবটি সে প্রথমে আমলেই নিতে চায়নি। এতে প্রস্তাবকদের গলার স্বর চরমে উঠে। হুমকি দেয়া হয় রাজি না হলে বাড়িঘর ভেঙ্গে দিয়ে ভিটে ছাড়া করা হবে! তাই বাধ্য হয়েই সেদিন চিরতনকে প্রস্তাবটি মেনে নিতে হয়েছিল। সম্মতি আদায়ের সাথে সাথে তার খাজনা ও ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়।
কংগ্রেস ভলন্টিয়ারগণ সিলেটি নাগরি হরফে চিরতনকে দস্তখত দেয়া শেখান। একই সাথে পশ্চিম বাজারের মাড়োয়ারি দোকানে চলতে থাকে তার জন্য পাঞ্জাবি, পায়জামা ও মাথার ধাশা তৈরির কাজ।
জানা যায়, যে দিন দক্ষিণ শ্রীহট্টের এসডিও কোর্টে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয় তখন প্রায় ছয় ফুট লম্বা পঞ্চাশোর্ধ চিরতনের বাবুয়ানা চেহারা ও বেশভুষা দেখে সবাই অবাক। কৌতুহলী অনেকেই তখন হাসি-ঠাট্টার ছলে নানা প্রশ্ন ধরণের করছিলেন। কেউ কেউ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিলেন চিরতন, তুমি নির্বাচিত হলে হলে কি করবে?
চিরতনের উত্তর ছিল বড় বড় পোটকো ছোট কর দেয়েঙ্গা। একজন ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে আরেকজন মুচির এ ধরনের নির্বাচনী লড়াই এবং নির্বাচনে মুচির ঘর মার্কা প্রতীকের পেছনে শত শত সম্ভ্রান্ত হিন্দু-মুসলিম উভয়-সম্প্রদায়ের জমিদার, তালুকদার, মিরাশদারের সকাল-সন্ধ্যা আধাজল খেয়ে মাঠে নামাকে নিয়ে সারা শ্রীহট্টের দৃষ্টি ছিল দক্ষিণ শ্রীহট্টের দিকে। নির্বাচনী প্রচারণায় চিরতনের বক্তব্য ছিল অনেকটা এভাবেÑ ‘বাবুরা, হামি খানবাহাদুর, রায়বাহাদুর নেহি, হামি মুচি বেটা আছি, আপনাগো খাদেম আছি, খাদেম রহেগা’। নির্বাচনে চিরতন মুচি ইরেশলাল সোমকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে এমএলসি নির্বাচিত হন।
দেশের অন্যান্য এলাকার চাইতে দক্ষিণ শ্রীহট্টের সেই নির্বাচনের বিশেষত্ব ছিল যা অন্য কোনও জায়গায় হিন্দু-মুসলমান ভদ্রলোকেরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আসাম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলকে হাস্যকর এবং অকার্যকর করে তুলতে যা যা করার তাই করেছিলেন।
ওই নির্বাচনে আসামের প্রায় দশ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ব্যবস্থাপক সভার পুরাতন মডারেট পরবর্তীকালের লিবারাল দলের সদস্য এবং তাদের সমর্থকগণ এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন নাপিত, চর্মকার, মেথর, ঢুলি জাতীয় প্রার্থীদের পক্ষে ভোট পড়েছিল মাত্র ১৮২০০০টি।
নির্বাচনে কুমিল্লায় মকরম আলী ভাটিয়াল, দক্ষিণ শ্রীহট্টের চিরতন মুচিসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সমাজের তফসিলি সম্প্রদায়ের (নিম্ন শ্রেণী) কিছু লোক এমএলসি নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন।
ওই নির্বাচনে ভারতীয় উচ্চপরিষদে শ্রীহট্ট তথা সিলেট থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন- গিরিশচন্দ্র নাগ (সুরমা ভেলি সেন্ট্রাল) ও মৌলভী আমজাদ আলী (মুসলিম) এবং প্রাদেশিক পরিষদে : সিলেট সদর মহকুমা থেকে সৈয়দ আব্দুল মজিদ (পরে তিনি আসামের শিক্ষামন্ত্রী এবং সিআইই) ও দেওয়ান আব্দুর রহিম। সুনামগঞ্জ মহকুমা থেকে মনওয়ার আলী ও বাবু কালীচরণ মুচি। দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা থেকে আলাউদ্দিন চৌধুরী ও বাবু চিরতন মুচি এবং হবিগঞ্জ মহকুমা থেকে মোহাম্মদ বক্ত মজুমদার ও সৈয়দ নুরুর রহমান মোক্তার।
নির্বাচিত সদস্যরা ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩০ সালের ২ জানুয়ারি কংগ্রেসের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি নির্দেশ দেয় যে, ব্যবস্থাপনা সভার (কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক) সদস্যগণকে পদত্যাগ করতে হবে এবং এদের স্থলে যে নতুন নির্বাচন হবে এতে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। নির্দেশ অনুসারে ফেব্রুয়ারি মাসে কংগ্রেস সদস্যগণ একযোগে পদত্যাগ করলে সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে কংগ্রেস সদস্যদের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে। তখন পুনরায় চিরতন মুচি এবং কালীচরণ মুচি আসাম প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এ সম্পর্কে ‘প্রফল্ল কুমার মোহান্ত : চিফ মিনিস্টার অব আসাম’ গ্রন্থের ভাষ্য হচ্ছে এরূপÑ ১৯৩০ সালে কংগ্রেস হাই কমান্ডের নির্দেশে কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা যখন পদত্যাগ করেন তখন তাদের শূন্য আসনে আবারো বাবু চিরতন মুচি ও বাবু কালিচরণ মুচি এলএসসি নির্বচিত হন। তখন মডারেইট এবং টাইটেল হোল্ডারদের মধ্যে ছিলেন যথাক্রমে রাইট অনারেবল মৌলভী আব্দুল হামিদ, মৌলভী আব্দুর রশিদ চৌধুরী, মৌলভী মনোওর আলী, মৌলভী আব্দুর রহিম চৌধুরী, মৌলভী আব্দুল খালিক চৌধুরী, খান বাহদুর মৌলভী মাহমুদ আলী, খান বাহাদুর মৌলভী নুরুদ্দিন আহমদ।
১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের আইন সভায় দক্ষিণ শ্রীহট্টের মাজডিহি চা বাগানের লেবার সরদার ও শ্রীমঙ্গল থানা শহরের পূর্বাশা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জীবন সাঁওতাল এমএনএ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে পুনরায় সংরক্ষিত আসনে এমএনএ নির্বাচিত হন।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে দুই ভাগ করে ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, রাজশাহী বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা এবং আসাম নিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হলে সিলেট ছিল এই প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল আসাম প্রদেশ পৃথক হলে পরে সিলেটকে আবারও আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের জন্ম হলে রেফারেন্ডামে সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়; যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল। দীর্ঘ ২৪ বছর পর ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়।
সংগ্রাম দত্ত
শনিবার, ২৪ মে ২০২৫
সিলেট জেলার মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হরিজন সম্প্রদায় থেকে চিরতন হরিজন ও কালীচরণ হরিজন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ১৯২০ ও ১৯৩০ সালে পরপর দুইবার এমএলসি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘ শত বছর পর তাদের সম্পর্কে তথ্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখনো অজানা। আবার কারো কারো কাছে গল্পের মতো মনে হয়।
১৯১৯ সালে যখন সমগ্র ভারতজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে চরম পর্যায়ে, তখন এই আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য চতুর ইংরেজরা ১৯১৯ সালে একটি আইন করে ‘আসাম প্রদেশিক আইন সভার সদস্য’ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। তখন ব্রিটিশরা সমর্থন দিয়ে এক গোষ্ঠী ‘ন্যাশনাল লিবারাল ফ্রন্ট’ গঠন করে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘোষণা দেয়। তখন ওই ফ্রন্টের পক্ষ থেকে দক্ষিণ শ্রীহট্ট পৌরসভার তৎকালিন চেয়ারম্যান ইরেশ লাল সোম প্রার্থী হন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন বর্জন করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনকে বিদ্রƒপ ও হাস্যকর করার লক্ষে নিম্নশ্রেণির মুচি, ধোপা, নাপিত, মৎস্যজীবী, মাঝি ইত্যাদি নিরক্ষর লোক দিয়ে নির্বাচন করানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
ব্রিটিশ ভারতে ১৯২০ সালে দক্ষিণ শ্রীহট্ট সাবডিভিশন তথা বর্তমান মৌলভীবাজার থেকে আসাম মেম্বার অব লেজিসলেটিভ কাউন্সিল (এমএলসি) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন স্থানীয় হরিজন সম্প্রদায়ের চিরতন হরিজন ও সুনামগঞ্জ মহকুমার তাহিরপুর থানা থেকে কালীচরণ হরিজন।
স্থানীয়ভাবে উভয়ে সবার কাছে চিরতন মুচি ও কালীচরণ মুচি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঐ নির্বাচনে সারা দেশজুড়ে চিরতন মুচির মতো কর্মকার, নাপিত, ধোপা, মৎসজীবী, বারুজীবী, মাঝি, ভাটিয়াল ইত্যাদি তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ নির্বাচনে অংশ নিয়ে অনেকেই প্রার্থী করিয়ে নির্বাচিত করা হয়।
১৯২০ সালের ১ আগস্ট বাল গঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুর পর গুজরাটে সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবারে জন্ম নেয়া মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ভারতের মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতের জাতির পিতার মর্যাদা লাভ করেছিলেন।
১৯২১ সালের নির্বাচনে দক্ষিণ শ্রীহট্ট থেকে চিরতন হরিজন ও সুনামগঞ্জ থেকে কালীচরণ হরিজন নির্বাচিত হবার ঐতিহাসিক ঘটনাটিও বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখনো অজানা।
নির্বাচনের পটভূমি ছিল এই যে, ১৯২০ সালে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে সারা ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ওই বছরের ৯ মার্চ মহাত্মা গান্ধি তার প্রথম অসহযোগ ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন। এতে বলা হয় ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাবলীর সুবিচার না হলে অচিরেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু করা হবে।
১৯২০ সালের ৪-৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার ওয়ালিংটন স্কোয়ারে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব পেশ করা হয়। সভায় মহাত্মা গান্ধী বলেন, ‘আমরা যদি স্বরাজ চাই এবং সন্তোষজনকভাবে খেলাফত সমস্যার সমাধান করতে চাই, তাহলে, অসহযোগ কর্মসূচি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।’ লালা লাজপত রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিন চন্দ্র পাল ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমুখ নেতা এ প্রস্তাবের ঘোর-বিরোধিতা করলেও বিরাট সংখ্যাধিক্যের সমর্থনের ভিত্তিতে অসহযোগ কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং বৈধ ও শান্তিপূর্ণভাবে স্বরাজ অর্জন কংগ্রেসের লক্ষ্য বলে স্বীকার করে নেয়া হয়।
সভায় আন্দোলনের ৪টি ক্ষেত্র সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়। যথাÑ ক) সরকারের দেয়া উপাধি পরিত্যাগ, খ) সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল-কলেজ বর্জন করে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, গ) কোর্ট-কাউন্সিল বর্জন এবং ঘ) বিদেশি পণ্য বর্জন।
এ অসহযোগ আন্দোলনের ৪টি ক্ষেত্র সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হলেও পাশাপাশি মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন-সংস্কার অনুযায়ি যে-আইন সভা গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেই নির্বাচন বয়কট করার আন্দোলন দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছিল।
১৯১৯ সালের গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুসারে কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য একটি ব্যবস্থা পরিষদ একটি রাষ্ট্র পরিষদ এবং প্রতি প্রদেশের জন্য একটি আইন সভার বিধান রাখা হয়।
আসাম প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে তখন ৫৩ জনে উন্নীত করা হয়েছিল। এতে ৪১ জন নির্বাচিত এবং ১২ জন অনুমোদিত সদস্য রাখার বিধান ছিল; কিন্তু নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার সবার ছিল না। যারা জমির খাজনা, চৌকিদারি ট্যাক্স দিতে পারতেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে মাইনর পাশ ছিলেন, কেবলমাত্র তারাই নির্বাচিত হবার যোগ্য ছিলেন।
এই অ্যাক্ট নিয়ে ১৯১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারত-শাসন বিষয়ক নতুন বিধান সম্পর্কে অমৃতশহরে কংগ্রেসের অধিবেশনে তুমুল বাক বিতন্ড হয়। কংগ্রেসের বিতর্কের প্রধান বিষয় ছিল, ‘নতুন শাসনসংস্কার মেনে নেয়া ও সংস্কারের জন্য মন্টেগুকে ধন্যবাদ দেয়া হবে কি না।’ চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন এ নতুন সংস্কার একেবারেই বর্জন করার পক্ষে। শেষপর্যন্ত চিত্তরঞ্জন দাশ যে প্রস্তাব করেছিলেন তার সাথে যোগ করা হয়, ‘যতদিন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন কংগ্রেসের মতে এই সংস্কার স্বীকার এবং সে অনুসারে কাজ করে যাতে যথা শীঘ্র সম্ভব পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন লাভ করা যায় তার চেষ্টা করা হোক এবং কংগ্রেস এ সংস্কারের জন্য মন্টেগুকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।’
এই ভারত-শাসন বিষয়ক নতুন বিধান অনুসারে দপ্রাদেশিক পরিষদদ নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯২১ সালের ১ এপ্রিল কার্যভার গ্রহণের কথা। সে অনুসারে ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে পরে কংগ্রেস কলকাতা ও নাগপুর অধিবেশনে নতুন সংবিধান অনুসারে প্রথম ব্যবস্থাপক সভার (১৯২১-২৩) নির্বাচন বয়কট ঘোষণা করে এ নির্বাচনকে হাস্যকর করে তোলার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তখন নোয়াখালী থেকে একজন মুচি ও একজন নাপিতকে প্রার্থী করে মনোনয়নপত্র পেশ করা হয়। কুমিল্লা অঞ্চল থেকে রাস্তার ধারে খাবারের দোকানদার মোকরম আলী ও সুনামগঞ্জ থেকে কালীচরণ মুচিকে প্রার্থী করিয়ে নির্বাচনে জিতিয়ে আসাম আইন সভায় পাঠিয়ে হাস্যরসে পরিণত করা হয়।
সুনামগঞ্জবাসী কালীচরণ মুচিকে প্রার্থী হিসেবে এবং নোয়াখালীর মানুষ একজন মুচি, আরেকজন ধোপা এবং মোকরম আলী ভাটিয়ালকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলেও এ নিয়ে কোন শোরগুল শোনা যায়নি; কিন্তু চিরতন হরিজনকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় দক্ষিণ শ্রীহট্টবাসীকে, সুনামগঞ্জসহ গোটা শ্রীহট্টের মানুষ শতাধিক শত বছর পরও দফগাদ বা বোকা বলে হাসি-ঠাট্টা করতে দেখা যায়।
তৎকালীন দক্ষিণ শ্রীহট্ট বা বর্তমান মৌলভীবাজার হচ্ছে মনু নদীর তীর ঘেষে গড়া উঠা মৌলভী কুদরত উল্লার প্রতিষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। কালের পরিক্রমায় এখন এটি একটি জেলা শহর। এ বাজারের পশ্চিম বাজারে ছিল মুচি বা হরিজন সম্প্রদায়ের বসবাস। সেখানে চিরতন মুচির বাস করতেন। ছোট্ট একটি ঝুপড়ির মতো ঘরে বসে তৎকালীন ভদ্রলোকদের জুতা সেলাই কিংবা পালিশ করে দেয়াই ছিল তার জীবিকা নির্বাহের মূল অবলম্বন।
রাজনীতির কূটচাল, আন্দোলন, সংগ্রাম এ জাতীয় শব্দগুলো তার কানে পৌঁছালেও শব্দগুলোর সঠিক অর্থ কী তা চিরতন মুচি জানতেন না। এমন কী ১৯২০ সালের নির্বাচনে চিরতন মুচি কিংবা এ ধরনের আরও যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদের শুধু সম্মতিদান ছাড়া আর কোনও কিছু বুঝারও উপায় ছিল না। বোঝাপড়ার দায়-দায়িত্ব ছিল কংগ্রেসের নেতাদের ওপর।
কংগ্রেস নেতা সারদা চরণ শ্যামের নেতৃত্বে সবাই দল বেঁধে হাজির হন চিরতন মুচির ঝুপড়ি ঘরে। নিজের ঘরের সামনে এতো লোকের সমাগম দেখে চিরতনের হৃৎপি- যতটুকু কেঁপে উঠেছিল তার চাইতেও বেশি তিনি বিষ্ময়ে হতবাক হয়েছিল যখন তাকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তাব দেয়া হয় তা শুনে।
কথিত আছে যে, তখন চিরতনের জবাব ছিল, ‘রাম রাম এ কিয়া বলো বাবু! হামি আপনার সাথে কোন দুছ করছি যে, হামার লগে আপনারা তামছা (তামাশা) করতে আইছন (এসেছেন)।’
প্রস্তাবটি সে প্রথমে আমলেই নিতে চায়নি। এতে প্রস্তাবকদের গলার স্বর চরমে উঠে। হুমকি দেয়া হয় রাজি না হলে বাড়িঘর ভেঙ্গে দিয়ে ভিটে ছাড়া করা হবে! তাই বাধ্য হয়েই সেদিন চিরতনকে প্রস্তাবটি মেনে নিতে হয়েছিল। সম্মতি আদায়ের সাথে সাথে তার খাজনা ও ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়।
কংগ্রেস ভলন্টিয়ারগণ সিলেটি নাগরি হরফে চিরতনকে দস্তখত দেয়া শেখান। একই সাথে পশ্চিম বাজারের মাড়োয়ারি দোকানে চলতে থাকে তার জন্য পাঞ্জাবি, পায়জামা ও মাথার ধাশা তৈরির কাজ।
জানা যায়, যে দিন দক্ষিণ শ্রীহট্টের এসডিও কোর্টে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয় তখন প্রায় ছয় ফুট লম্বা পঞ্চাশোর্ধ চিরতনের বাবুয়ানা চেহারা ও বেশভুষা দেখে সবাই অবাক। কৌতুহলী অনেকেই তখন হাসি-ঠাট্টার ছলে নানা প্রশ্ন ধরণের করছিলেন। কেউ কেউ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিলেন চিরতন, তুমি নির্বাচিত হলে হলে কি করবে?
চিরতনের উত্তর ছিল বড় বড় পোটকো ছোট কর দেয়েঙ্গা। একজন ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে আরেকজন মুচির এ ধরনের নির্বাচনী লড়াই এবং নির্বাচনে মুচির ঘর মার্কা প্রতীকের পেছনে শত শত সম্ভ্রান্ত হিন্দু-মুসলিম উভয়-সম্প্রদায়ের জমিদার, তালুকদার, মিরাশদারের সকাল-সন্ধ্যা আধাজল খেয়ে মাঠে নামাকে নিয়ে সারা শ্রীহট্টের দৃষ্টি ছিল দক্ষিণ শ্রীহট্টের দিকে। নির্বাচনী প্রচারণায় চিরতনের বক্তব্য ছিল অনেকটা এভাবেÑ ‘বাবুরা, হামি খানবাহাদুর, রায়বাহাদুর নেহি, হামি মুচি বেটা আছি, আপনাগো খাদেম আছি, খাদেম রহেগা’। নির্বাচনে চিরতন মুচি ইরেশলাল সোমকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে এমএলসি নির্বাচিত হন।
দেশের অন্যান্য এলাকার চাইতে দক্ষিণ শ্রীহট্টের সেই নির্বাচনের বিশেষত্ব ছিল যা অন্য কোনও জায়গায় হিন্দু-মুসলমান ভদ্রলোকেরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আসাম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলকে হাস্যকর এবং অকার্যকর করে তুলতে যা যা করার তাই করেছিলেন।
ওই নির্বাচনে আসামের প্রায় দশ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ব্যবস্থাপক সভার পুরাতন মডারেট পরবর্তীকালের লিবারাল দলের সদস্য এবং তাদের সমর্থকগণ এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন নাপিত, চর্মকার, মেথর, ঢুলি জাতীয় প্রার্থীদের পক্ষে ভোট পড়েছিল মাত্র ১৮২০০০টি।
নির্বাচনে কুমিল্লায় মকরম আলী ভাটিয়াল, দক্ষিণ শ্রীহট্টের চিরতন মুচিসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সমাজের তফসিলি সম্প্রদায়ের (নিম্ন শ্রেণী) কিছু লোক এমএলসি নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন।
ওই নির্বাচনে ভারতীয় উচ্চপরিষদে শ্রীহট্ট তথা সিলেট থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন- গিরিশচন্দ্র নাগ (সুরমা ভেলি সেন্ট্রাল) ও মৌলভী আমজাদ আলী (মুসলিম) এবং প্রাদেশিক পরিষদে : সিলেট সদর মহকুমা থেকে সৈয়দ আব্দুল মজিদ (পরে তিনি আসামের শিক্ষামন্ত্রী এবং সিআইই) ও দেওয়ান আব্দুর রহিম। সুনামগঞ্জ মহকুমা থেকে মনওয়ার আলী ও বাবু কালীচরণ মুচি। দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা থেকে আলাউদ্দিন চৌধুরী ও বাবু চিরতন মুচি এবং হবিগঞ্জ মহকুমা থেকে মোহাম্মদ বক্ত মজুমদার ও সৈয়দ নুরুর রহমান মোক্তার।
নির্বাচিত সদস্যরা ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩০ সালের ২ জানুয়ারি কংগ্রেসের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি নির্দেশ দেয় যে, ব্যবস্থাপনা সভার (কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক) সদস্যগণকে পদত্যাগ করতে হবে এবং এদের স্থলে যে নতুন নির্বাচন হবে এতে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। নির্দেশ অনুসারে ফেব্রুয়ারি মাসে কংগ্রেস সদস্যগণ একযোগে পদত্যাগ করলে সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে কংগ্রেস সদস্যদের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে। তখন পুনরায় চিরতন মুচি এবং কালীচরণ মুচি আসাম প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এ সম্পর্কে ‘প্রফল্ল কুমার মোহান্ত : চিফ মিনিস্টার অব আসাম’ গ্রন্থের ভাষ্য হচ্ছে এরূপÑ ১৯৩০ সালে কংগ্রেস হাই কমান্ডের নির্দেশে কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা যখন পদত্যাগ করেন তখন তাদের শূন্য আসনে আবারো বাবু চিরতন মুচি ও বাবু কালিচরণ মুচি এলএসসি নির্বচিত হন। তখন মডারেইট এবং টাইটেল হোল্ডারদের মধ্যে ছিলেন যথাক্রমে রাইট অনারেবল মৌলভী আব্দুল হামিদ, মৌলভী আব্দুর রশিদ চৌধুরী, মৌলভী মনোওর আলী, মৌলভী আব্দুর রহিম চৌধুরী, মৌলভী আব্দুল খালিক চৌধুরী, খান বাহদুর মৌলভী মাহমুদ আলী, খান বাহাদুর মৌলভী নুরুদ্দিন আহমদ।
১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের আইন সভায় দক্ষিণ শ্রীহট্টের মাজডিহি চা বাগানের লেবার সরদার ও শ্রীমঙ্গল থানা শহরের পূর্বাশা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জীবন সাঁওতাল এমএনএ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে পুনরায় সংরক্ষিত আসনে এমএনএ নির্বাচিত হন।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে দুই ভাগ করে ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, রাজশাহী বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা এবং আসাম নিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হলে সিলেট ছিল এই প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল আসাম প্রদেশ পৃথক হলে পরে সিলেটকে আবারও আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের জন্ম হলে রেফারেন্ডামে সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়; যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল। দীর্ঘ ২৪ বছর পর ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়।