alt

উপ-সম্পাদকীয়

পিতৃতন্ত্রের মনস্তত্ত্ব ও নারীর গ-িবদ্ধতা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

পৃথিবীতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি কখন শুরু হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা না গেলেও বলা যায়, আদি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর, যখন মানুষ ব্যক্তিগত মালিকানায় সম্পদ ভোগ করতে শুরু করে, তখনই এই কাঠামোর সূচনা হয়। পুরাতত্ত্ববিদ মারিজা গিমবুটাসের মতে, প্রাচীন ইউরোপের এজিয়ান অঞ্চলের প্রাথমিক কৃষিভিত্তিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে ইউক্রেনিয়ান স্পেস থেকে আগত কুরগান আক্রমণকারীরা দফায় দফায় আক্রমণ করলে বলকান ও দক্ষিণ ইতালিতে পুরুষ প্রাধান্যপূর্ণ শ্রেণি গড়ে ওঠে, যা পশ্চিমা সমাজে পিতৃতন্ত্রের ভিত্তি রচনা করে।

নৃতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, প্রাগৈতিহাসিক শিকারি-সংগ্রাহক সমাজগুলোতে তুলনামূলকভাবে লিঙ্গসমতা বিরাজমান ছিল এবং প্লেইস্টোসিন যুগের পর কৃষি ও পশু গৃহপালনের প্রযুক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের সময় পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর বিকাশ ঘটে। ইতিহাসবিদ রবার্ট এম স্ট্রোজিয়ারের মতে, পিতৃতন্ত্রের নির্দিষ্ট সূচনার ঘটনা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কেউ কেউ খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর সময়কে পিতৃতন্ত্রের সূচনাকাল বলে মনে করেন, যখন পিতার ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়।

মার্ক্সবাদী তত্ত্বে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মার্কস পিতৃতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছেন শ্রম বিভাজনের দৃষ্টিকোণ থেকে। নারীরা গৃহকর্ম ও কৃষিভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনের তত্ত্বাবধানে থাকায় সমাজে তাদের ভূমিকা গৃহকেন্দ্রিক হয়। পুঁজিবাদ বিকাশের পর মুদ্রায়িত অর্থনীতির জগতে নারীর শ্রমের গৃহস্থালী অংশ মুদ্রায়িত না হওয়ায় তা অবমূল্যায়িত হয় এবং পুরুষের প্রাধান্য সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়।

পিতৃতন্ত্র এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে কর্তৃত্বের কেন্দ্র পুরুষ। নৃবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি এমন একটি পরিবারের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে পিতা বা পুরুষ সদস্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। পিতৃতন্ত্রের বিকাশে শ্রমের যৌন বিভাজন ও পিতৃত্বের ধারণার বিস্তার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। গবেষকরা বলছেন, প্রায় বিশ লক্ষ বছর আগে থেকেই এই বিভাজনের সূচনা ঘটে, যা সম্পদের ঘাটতির প্রেক্ষাপটে আফ্রিকায় একটি বিবর্তনীয় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।

এই সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব কেবল কাঠামোগত নয়, এটি ব্যক্তি মানসেও গভীরভাবে প্রোথিত। ধর্মীয় অনুশাসনের আবির্ভাবে পিতৃতন্ত্র একধরনের পবিত্রতার রূপ পায়। ধর্মগ্রন্থগুলোতে পুরুষ প্রাধান্যকে ঈশ্বরীয় আদেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং নারী হয় অধীনস্থ এক সত্তা। যৌন শ্রম বিভাজনের ফলে নারীর ওপর নির্দিষ্ট গৃহস্থালি কাজের দায়ভার চাপানো হয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই মানসিকতা নারীর মনোজগতে প্রোথিত হয়। নারীরা নিজেরাই প্রথাগত দায়িত্বকে পবিত্র কর্তব্য মনে করেন।

এই প্রথার শিকড় কতটা গভীর, তা কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট। এক ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন ক্লিনার যথাযথভাবে মেঝে পরিষ্কার না করায় আমি বলেছিলাম, আমি নিজেই ঘর মুছতে পারি। নার্সের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা গেল, তার কাছে এটি এক প্রকার নারী কর্তৃক স্বামীকে ‘দাস’ বানানোর মতো বিষয়। তার ধারণা, গৃহস্থালি কাজ কেবল নারীর, পুরুষ করলে সেটি লজ্জার। একইভাবে এক তরুণ রক্ত সংগ্রহের সময় আমার জামায় রক্ত লাগিয়ে পরামর্শ দেয়, আমি যেন বাসায় গিয়ে “আন্টিকে” বলি ধুয়ে দিতে। সে ধরে নিয়েছে, কাপড় ধোয়া নারীর কাজ।

এ মানসিকতা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। নারীকে গৃহস্থালি কাজের জন্য জন্মানো মনে করা হয় এবং বাইরের জগৎ থেকে তাকে বিরত রাখা হয়। নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য পুরুষের যৌন চেতনা জাগিয়ে তোলেÑএমন চিন্তা থেকে পর্দা প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ নারীর আকর্ষণে পুরুষ যদি দুর্বল হয়, তার দায় নারীর ওপর চাপানো হয়। কিন্তু নারীর আকর্ষণে নারীর মন দুর্বল হলে সেটি পাপ। এ এক দ্বিমুখী নৈতিকতা। একদিকে পুরুষ তার নিজের স্ত্রী-কন্যাকে হিজাবে ঢেকে রাখে, অন্যদিকে অন্যের স্ত্রী-কন্যার দিকে লোলুপদৃষ্টিতে তাকায়।

পিতৃতন্ত্র কেবল ব্যক্তি মনোভাব নয়, এটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থারও অংশ। পুরুষদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সহজলভ্য হলেও নারীরা গৃহপালিত রূপে বিবেচিত হয়ে নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হন। পিতৃতন্ত্র পুরুষদের হাতে কর্তৃত্ব কেন্দ্রিকতা দান করে নারীর সম্ভাবনাকে গ-িবদ্ধ করে রাখে। ঐতিহাসিকভাবে নারীকে ক্ষমতার বাইরে রেখে পুরুষদের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।

যুদ্ধেও নারীকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেমন- উনিশ ও বিশ শতকে ক্রোয়েশিয়া, কসোভো ও বসনিয়ায় সার্ব বাহিনী ধর্ষণকে যুদ্ধ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। নারীর মর্যাদা সেখানে কোনো বিষয়ই ছিল না। অথচ ইতিহাসে দেখা যায়, আদি সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। নারীর নৈতিক কর্তৃত্ব, সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ এবং সমাজের নেতৃত্ব ছিল স্বাভাবিক বিষয়।

এ দুটি ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে এমন আইন ও বিধান তৈরি করতে হবে, যা নারী ও পুরুষের সমতা নিশ্চিত করে। কেবল আইন নয়, চর্চাও জরুরি এবং সেই চর্চার শুরু হওয়া উচিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমেÑ নারীকে গৃহকোণে আবদ্ধ রাখার মানসিকতা ভেঙে তাকে স্বাধীন মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

চিরতন ও কালীচরণ : শতবর্ষ আগে যারা আইনের মঞ্চে উঠেছিলেন

রম্যগদ্য : প্লিজ স্যার... প্লিজ, ইকটু রেহাই দ্যান...

জমি, সম্মান ও প্রতিহিংসার নির্মম রাজনীতি

জানি তিনি মোড়ল বটে, আমাদের কেন তা হতে হবে

ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী আমূল সংস্কার জরুরি

বরেন্দ্রর মাটিতে আমের বিপ্লব : সম্ভাবনা ও সতর্কবার্তা

অবশেষে ‘হাসিনা’ গ্রেফতার

স্ক্যাবিস সংক্রমণের কারণ ও প্রতিরোধে করণীয়

বাস্তবমুখী বাজেটের প্রত্যাশা : বৈষম্যহীন অর্থনীতির পথে কতটা অগ্রগতি?

কৌশল নয়, এবার প্রযুক্তিতে সৌদি-মার্কিন জোট

সিউল : স্বর্গ নেমেছে ধরায়

নাচোল বিদ্রোহ ও ইলা মিত্র সংগ্রহশালা : সাঁওতাল স্মৃতি কেন উপেক্ষিত?

ছবি

অন্ধকার সত্য, শেষ সত্য নয়!

বিয়েতে মিতব্যয়িতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাহবা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের ভয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পিতৃতন্ত্রের মনস্তত্ত্ব ও নারীর গ-িবদ্ধতা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

পৃথিবীতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি কখন শুরু হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা না গেলেও বলা যায়, আদি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর, যখন মানুষ ব্যক্তিগত মালিকানায় সম্পদ ভোগ করতে শুরু করে, তখনই এই কাঠামোর সূচনা হয়। পুরাতত্ত্ববিদ মারিজা গিমবুটাসের মতে, প্রাচীন ইউরোপের এজিয়ান অঞ্চলের প্রাথমিক কৃষিভিত্তিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে ইউক্রেনিয়ান স্পেস থেকে আগত কুরগান আক্রমণকারীরা দফায় দফায় আক্রমণ করলে বলকান ও দক্ষিণ ইতালিতে পুরুষ প্রাধান্যপূর্ণ শ্রেণি গড়ে ওঠে, যা পশ্চিমা সমাজে পিতৃতন্ত্রের ভিত্তি রচনা করে।

নৃতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, প্রাগৈতিহাসিক শিকারি-সংগ্রাহক সমাজগুলোতে তুলনামূলকভাবে লিঙ্গসমতা বিরাজমান ছিল এবং প্লেইস্টোসিন যুগের পর কৃষি ও পশু গৃহপালনের প্রযুক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের সময় পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর বিকাশ ঘটে। ইতিহাসবিদ রবার্ট এম স্ট্রোজিয়ারের মতে, পিতৃতন্ত্রের নির্দিষ্ট সূচনার ঘটনা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কেউ কেউ খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর সময়কে পিতৃতন্ত্রের সূচনাকাল বলে মনে করেন, যখন পিতার ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়।

মার্ক্সবাদী তত্ত্বে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মার্কস পিতৃতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছেন শ্রম বিভাজনের দৃষ্টিকোণ থেকে। নারীরা গৃহকর্ম ও কৃষিভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনের তত্ত্বাবধানে থাকায় সমাজে তাদের ভূমিকা গৃহকেন্দ্রিক হয়। পুঁজিবাদ বিকাশের পর মুদ্রায়িত অর্থনীতির জগতে নারীর শ্রমের গৃহস্থালী অংশ মুদ্রায়িত না হওয়ায় তা অবমূল্যায়িত হয় এবং পুরুষের প্রাধান্য সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়।

পিতৃতন্ত্র এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে কর্তৃত্বের কেন্দ্র পুরুষ। নৃবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি এমন একটি পরিবারের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে পিতা বা পুরুষ সদস্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। পিতৃতন্ত্রের বিকাশে শ্রমের যৌন বিভাজন ও পিতৃত্বের ধারণার বিস্তার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। গবেষকরা বলছেন, প্রায় বিশ লক্ষ বছর আগে থেকেই এই বিভাজনের সূচনা ঘটে, যা সম্পদের ঘাটতির প্রেক্ষাপটে আফ্রিকায় একটি বিবর্তনীয় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।

এই সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব কেবল কাঠামোগত নয়, এটি ব্যক্তি মানসেও গভীরভাবে প্রোথিত। ধর্মীয় অনুশাসনের আবির্ভাবে পিতৃতন্ত্র একধরনের পবিত্রতার রূপ পায়। ধর্মগ্রন্থগুলোতে পুরুষ প্রাধান্যকে ঈশ্বরীয় আদেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং নারী হয় অধীনস্থ এক সত্তা। যৌন শ্রম বিভাজনের ফলে নারীর ওপর নির্দিষ্ট গৃহস্থালি কাজের দায়ভার চাপানো হয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই মানসিকতা নারীর মনোজগতে প্রোথিত হয়। নারীরা নিজেরাই প্রথাগত দায়িত্বকে পবিত্র কর্তব্য মনে করেন।

এই প্রথার শিকড় কতটা গভীর, তা কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট। এক ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন ক্লিনার যথাযথভাবে মেঝে পরিষ্কার না করায় আমি বলেছিলাম, আমি নিজেই ঘর মুছতে পারি। নার্সের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা গেল, তার কাছে এটি এক প্রকার নারী কর্তৃক স্বামীকে ‘দাস’ বানানোর মতো বিষয়। তার ধারণা, গৃহস্থালি কাজ কেবল নারীর, পুরুষ করলে সেটি লজ্জার। একইভাবে এক তরুণ রক্ত সংগ্রহের সময় আমার জামায় রক্ত লাগিয়ে পরামর্শ দেয়, আমি যেন বাসায় গিয়ে “আন্টিকে” বলি ধুয়ে দিতে। সে ধরে নিয়েছে, কাপড় ধোয়া নারীর কাজ।

এ মানসিকতা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। নারীকে গৃহস্থালি কাজের জন্য জন্মানো মনে করা হয় এবং বাইরের জগৎ থেকে তাকে বিরত রাখা হয়। নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য পুরুষের যৌন চেতনা জাগিয়ে তোলেÑএমন চিন্তা থেকে পর্দা প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ নারীর আকর্ষণে পুরুষ যদি দুর্বল হয়, তার দায় নারীর ওপর চাপানো হয়। কিন্তু নারীর আকর্ষণে নারীর মন দুর্বল হলে সেটি পাপ। এ এক দ্বিমুখী নৈতিকতা। একদিকে পুরুষ তার নিজের স্ত্রী-কন্যাকে হিজাবে ঢেকে রাখে, অন্যদিকে অন্যের স্ত্রী-কন্যার দিকে লোলুপদৃষ্টিতে তাকায়।

পিতৃতন্ত্র কেবল ব্যক্তি মনোভাব নয়, এটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থারও অংশ। পুরুষদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সহজলভ্য হলেও নারীরা গৃহপালিত রূপে বিবেচিত হয়ে নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হন। পিতৃতন্ত্র পুরুষদের হাতে কর্তৃত্ব কেন্দ্রিকতা দান করে নারীর সম্ভাবনাকে গ-িবদ্ধ করে রাখে। ঐতিহাসিকভাবে নারীকে ক্ষমতার বাইরে রেখে পুরুষদের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।

যুদ্ধেও নারীকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেমন- উনিশ ও বিশ শতকে ক্রোয়েশিয়া, কসোভো ও বসনিয়ায় সার্ব বাহিনী ধর্ষণকে যুদ্ধ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। নারীর মর্যাদা সেখানে কোনো বিষয়ই ছিল না। অথচ ইতিহাসে দেখা যায়, আদি সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। নারীর নৈতিক কর্তৃত্ব, সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ এবং সমাজের নেতৃত্ব ছিল স্বাভাবিক বিষয়।

এ দুটি ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে এমন আইন ও বিধান তৈরি করতে হবে, যা নারী ও পুরুষের সমতা নিশ্চিত করে। কেবল আইন নয়, চর্চাও জরুরি এবং সেই চর্চার শুরু হওয়া উচিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমেÑ নারীকে গৃহকোণে আবদ্ধ রাখার মানসিকতা ভেঙে তাকে স্বাধীন মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top