আনোয়ারুল হক
গত ২২ মে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন বলে গণমাধ্যমে নানা সংবাদ এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। সরকারের কোনো মুখপাত্র বা অতিকথনপ্রিয় ও রাজনৈতিক বিতর্ক উস্কে দেওয়ার জন্য বিশেষ পরিচিত প্রেস সচিব এ সংবাদটি দেননি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান নাহিদ ইসলাম সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যান। সেখান থেকে বেরিয়ে রাতে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন।’ আবার তিনিই পরদিন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন ‘ড. ইউনূসকে জনগণকে দেওয়া সংস্কার, বিচার ও ভোটাধিকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। ওনাকে দায়িত্বে থেকেই রাজনৈতিকভাবে সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করে মনে হলো, দেশে একটি দলীয় সরকার আছে। সরকার প্রধান দলীয় শৃঙ্খলা অনুসরণ করে সরকার থেকে পদত্যাগ করার জন্য দলীয় প্রধানের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন; কিন্তু দলীয় প্রধান তা নাকচ করে দিলেন। অতঃপর দলীয় সিদ্ধান্তের আলোকে ২৪ মে উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত সভায় ঘোষণা করা হয়েছে যে, সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচারপ্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকা- অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো এ সরকারের মধ্যে দলীয় রাজনীতির প্রবেশ। নাহিদ ইসলাম সরকারের উপদেষ্টা পদে আসীন থাকা অবস্থায় জাতীয় নাগরিক পার্টির গঠন প্রক্রিয়ার সাথে নানাভাবে যুক্ত থেকেছেন। দল গঠনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে অবশেষে পদত্যাগ করে দলের প্রধানের দায়িত্ব নিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দল গঠন প্রক্রিয়ার সময় থেকেই এমন সব বক্তব্য দিলেন মনে হলো তিনি ঐ দলেরও ‘প্রধান উপদেষ্টা’। আর তার উপযুক্ত প্রেস সচিব ঐ দলের প্রধানকে ‘ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী’ হিসাবে ঘোষণা করে দিলেন। সরকারে এখনও যে দুইজন ছাত্র উপদেষ্টা আছেন নাগরিক পার্টির গঠন প্রক্রিয়ার সাথে তারাও অপ্রকাশ্যে যুক্ত ছিলেন এবং দলীয় রাজনীতির ধারায় নিয়মিত বক্তব্য, বিবৃতি ও ফেসবুক পোস্ট দিয়েই চলেছেন। পরিস্থিতি এমন জায়গায় যাচ্ছে যে ক’দিন বাদে মানুষ এই সরকারকে আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না বলে এনসিপি’র সরকার বলবে। সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে যে ঘোষণা দিলেন সেই জনগন তো এনসিপির সাথে নেই। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তাদের সভা সমাবেশ থেকেই তা দৃশ্যমান। আর ঢাকার বাইরে তো তারা আরো দুর্বল। তবে সেটা মূল কথা নয়। কথা এটাই সরকার কি পারে জনগণের কথা বলে হুমকি দিতে। যে কোনো ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতিতে সরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে- এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সে কথা না বলে অনেকটা ‘জনতা মব’ সৃষ্টি করে মোকাবিলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এটা কখন বলা হচ্ছে? যখন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন জমায়েত অবস্থান ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করলেন। কিন্তু গত দশমাসে মৌলবাদী শক্তি সমূহ যত মব সৃষ্টি করলো, যত ভাঙচুর করলো তখন তো এ ধরনের হুমকি দেয়া হয় নি। বরং রাজনীতিতে ‘ডাস্টবিন’ সংস্কৃতি, ‘স্যান্ডেল ও বোতল’ সংস্কৃতি তো এই সরকারের আমলেই সৃষ্টি। যমুনার সামনে সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত থাকার পরেও এনসিপি আর জামাত- হেফাজত মিলে যখন সমাবেশ করলো তখন হুমকি না দিয়ে বরং গ্রীষ্মের দাবদাহে শীতল পানি স্প্রে করে স্বাগত জানানো হলো আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর গরম পানি নিক্ষেপ করা হলো। কেনো এই বৈষম্য মূলক আচরণ? এই সরকারের শক্তির দিক ছিলো আপদকালীন পরিস্থিতি থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি মানুষের ভরসা ও আস্থা। কিন্তু ১০ মাসেও গনতান্ত্রিক উত্তরনের লক্ষ্যে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায়, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় এবং ছাত্র সমন্বয়ক বা নতুন দলের নেতৃত্বের কারো কারো ইন্ধনে মব ভায়োলেন্স নামক এক সংস্কৃতি সমাজে শিকড় গেড়ে বসায় সরকারের প্রতি আস্থায় চিড় ধরেছে। এনসিপি এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ায় তাদের মধ্যে নানা আকাক্সক্ষা জন্ম নিয়েছে। আকাক্সক্ষা থাকা দোষের না। তবে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে নিজেদের অবস্থানকে অনেকে বিবেচনায় না নিয়ে রাতারাতি অনেক কিছু হতে চাইছেন। তাইতো নির্বাচনের কথা শুনলেই সরকার আর এনসিপির মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াস খুবই দৃশ্যমান। সমস্যাটি এখানেই।
নির্বাচনের কথা উঠলেই ‘র’-এর ষড়যন্ত্র, ভারতীয় ষড়যন্ত্র, পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র ইত্যাদি আওয়াজ তুলে নির্বাচনকে পাশ কাটানোর প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। আর ভারতীয় কিছু মিডিয়ার বাংলাদেশ ঘিরে নানা অপপ্রচার ও কল্পকাহিনী নির্বাচন বিরোধী ঐ শক্তিকে কার্যত সুবিধা করে দিচ্ছে।
বিএনপি যেহেতু নির্বাচন দাবি করছে বিএনপিকেও ভারতীয় আধিপত্যের কাছে নতজানু শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং নানা কায়দায় বিএনপি নেতৃত্বের একাংশকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে তাদের কাবু করার চেষ্টা হচ্ছে। বামপন্থিদের বিশেষত সিপিবির বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘প্রচার জেহাদ’ পরিচালিত হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে জামায়াত যখন নির্বাচনের পক্ষে ছিলো তখন জামায়াতকেও বলা হলো ‘দিল্লির এক্সটেনশন’। এখন জামায়াত এনসিপির সুরে আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করায় নির্বাচন বিরোধী শক্তির কাছে ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে গেছে। যমুনা মবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এবং নিবন্ধন নিষিদ্ধ করে নির্বাচনী হিসাব নিকাশে জামাত বিপদে পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে থাকতে না দেয়া হলে সাধারণভাবে ভোট একতরফা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিএনপির নিজস্ব ভোট ব্যাংক, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আওয়ামী ভোট (যারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন) জাতীয় পার্টির ভোট, ফ্লোটিং ভোট সব যাবে বিএনপির বাক্সে। বিএনপির প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়, মবতন্ত্রের বিপরীতে দেশে তুলনামূলক একটা স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ভোটের চেহারা এরকম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এনসিপি এবং মৌলবাদী সব শক্তি একত্রিত হলেও ভোটের ময়দানে হারিয়ে যাবে। একতরফা ভোট শক্তিশালী গনতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে দূর্বলতা হিসাবে রয়ে যাবে।আবার আওয়ামী লীগও হয়তোবা এটাই চায়।এক্ষেত্রে তারা দেশে ও বিদেশে প্রচারে সুবিধা নিতে ও ভবিষ্যৎ ইস্যু হিসাবে জিইয়ে রাখতে চায় যে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলো না এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কোন ব্যবস্থাও হলো না। বরং আওয়ামী লীগ ভোটে থাকলে তাদের নিশ্চিত পরাজয় হলেও তাদের ভোট ব্যাংক তাদের দিকেই থাকতো। ফলে বিএনপির পক্ষে সব আসনে একতরফা ভোট পাওয়া সম্ভব হতো না।
মৌলবাদীরা তাদের কিছু পকেট এরিয়া থেকে কিছু আসন আশা করতে পারতো? আর এনসিপির উত্তরাঞ্চলীয় আহ্বায়ক তো কোনো রাখঢাক না করে বলেই দিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে জয়লাভ তো দূরের কথা অধিকাংশ আসনেই এনসিপির জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।
এসব কারণেই নির্বাচন নয়, সংস্কার আর সংস্কার! দেশে এক যুগেরও বেশি সময় যাবত মানুষ ভোট দিতে পারে না, নির্বাচনের নামে হয়েছে প্রহসন- সেখানে একটি ভালো ভোট এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারাটাই তো সবচেয়ে বড় সংস্কার! কিন্তু ওই সংস্কারে তাদের আগ্রহ নেই। নির্ধারিত রাজনৈতিক দলসমূহের নির্ধারিত নেতাদের সাথে বৈঠকের পরে প্রেস সচিবের ব্রিফিং শুনে সন্দেহ জাগে প্রধান উপদেষ্টা তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা হিসাবেই পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন কিনা! প্রেস সচিব প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে বলেন, সবাই একসঙ্গে বসাতে তিনি মনে সাহস পেয়েছেন এবং নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে করা হবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো সন্তোষ প্রকাশ করেছে বলেও জানান প্রেস সচিব। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে এখনও ছোট প্যাকেজ- বড় প্যাকেজ আর ডিসেম্বর-জুনের এক্কাদোক্কা খেলাই অব্যাহত আছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ও পথরেখা নিয়ে এই অনিশ্চয়তায় এনসিপি এবং মৌলবাদী দলসমূহ ছাড়া আর কেউ কি সন্তোষ প্রকাশ করেছে? বিএনপির এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট অবস্থান তারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়।
বাম ও মধ্য বামপন্থি দলসমূহের অবস্থানও কাছাকাছি। প্রেস সচিব কি বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে সরকারের কৌশলকে সর্বোদল সম্মত করার কোশেশ করছেন? কয়েকদিন আগে তথ্য সচিব যেদিন হুংকার দিলেন- সব বিষয়ে আমাদের ম্যান্ডেট আছে, সে দিন থেকে আমার দেখতে খুব সাধ জাগে উনি যেন এবার নির্বাচনে এনসিপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে পার্লামেন্টে আসেন! প্রেস সচিবের মতো কথা বার্তা ওবায়দুল কাদের সহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বলতেন। আর নির্বাচন নিয়ে পর পর তিনবার মস্করা করার কি করুণ পরিণতি হতে পারে তাতো শেখ হাসিনাসহ তারা হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। অভ্যুত্থানের প্রায় দশ মাস পরে ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। তিনি বলেছেন ‘৫ আগস্ট ছিল আকস্মিক ঘটনা। এটা তো ছিলো কোটার আন্দোলন। পরবর্তীতে ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওরের কারনে এক দফা ও সরকার পতন।’
বছরের পর বছর, দশক নয় যুগেরও বেশি সময় মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে, বিরোধী পক্ষ ও গনতন্ত্রের আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করে রাখার সাফল্যে সামান্য কোটার আন্দোলন দেখে আপনাদের মনে হয়েছিলো আকাশে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি হলেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু ঐ মেঘ যে বজ্রমেঘ তা বুঝতে না পারা ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর নয় রাজনৈতিক ফেইলিওর। রাজনীতির বিজ্ঞান ও প্রকৃতিকে না বুঝার ব্যর্থতা। প্রকৃতির নিয়মে দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠা-া বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস তৈরি হয়, আর এর থেকে তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রের তৈরি হয়।
রাজনীতিতেও তাই ঘটেছে। দক্ষিণের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রামকে স্তব্ধ করে রেখে সমাজে যে রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল তা থেকে এবং কোটা আন্দোলনের উপর দমন পীড়ন হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দক্ষিণের বাতাসকে এমন গরম করে ফেলা হয় যে, উত্তরের একটু ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ পেতেই সৃষ্টি হয় বজ্রমেঘ যা থেকে সরাসরি গনভবনের উপর, আওয়ামী লীগের মসনদের উপর বজ্রপাত। আকস্মিক নয় প্রকৃতির নিয়মেই এই বজ্রপাত। কিন্তু আমরা কি এই বজ্রপাত থেকে কোনো শিক্ষা নিলাম? অস্থিতিশীলতাকে আলিঙ্গন করেই তো আমরা অগ্রসর হতে চাইছি। যা কিন্তু দক্ষিণের বাতাসকে উষ্ণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। বাতাস অতি উষ্ণ হলে এবং বাতাসে ঘূর্ণীয়মান গতি সৃষ্টি হলে কিন্তু আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড়। বজ্রপাত অপেক্ষা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয় অনেক বিস্তৃত। এক দফা বজ্রপাতের পর আমাদের কি একটা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করার সামর্থ্য আছে? বিপর্যয় সৃষ্টি হলেও ঘূর্ণিঝড় আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে।
অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীলতার দিকে, নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়ে রাজনীতির তাপের ভারসাম্য রক্ষা করলেই আমরা বজ্রপাত ও ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি। ড. ইউনূস স্বাপ্নিক ও সৃষ্টিশীল মানুষ। তার স্বপ্ন, পরিকল্পনা অনেকেরই পছন্দ হতে পারে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট নিয়ে তো তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেননি। তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স বলে সরকারের দৈনন্দিন নির্বাহী কাজ তথা রুটিন কাজ সম্পাদন করার জন্য। পশ্চিমা দুনিয়ার স্বার্থ রক্ষা আর দেশাভ্যন্তরে এনসিপি আর মৌলবাদীদের খুশী রাখা তার কাজ নয়। তিনি বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ইতোমধ্যে সেখানেও চিড় ধরছে। নিউইর্য়ক টাইমস, ফাইনেন্সিয়াল টাইমস, বিবিসি, আলজাজিরা এসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দুই দিন আগেও ড. ইউনূসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো; কিন্তু এখন তারা বলছে মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এ অনিশ্চয়তা দূর করতে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে অবিলম্বে সুস্পষ্ট রূপরেখা দিতে হবে, এখানে ডিসেম্বর না জুন- এই বিতর্কের সুযোগ নেই। সরকার নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই এই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা অনেকটা কেটে যাবে। এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এই দেশ ও জাতি আরও একটি বজ্রপাত বা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার সামর্থ্য রাখে না।
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]
আনোয়ারুল হক
বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
গত ২২ মে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন বলে গণমাধ্যমে নানা সংবাদ এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। সরকারের কোনো মুখপাত্র বা অতিকথনপ্রিয় ও রাজনৈতিক বিতর্ক উস্কে দেওয়ার জন্য বিশেষ পরিচিত প্রেস সচিব এ সংবাদটি দেননি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান নাহিদ ইসলাম সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যান। সেখান থেকে বেরিয়ে রাতে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন।’ আবার তিনিই পরদিন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন ‘ড. ইউনূসকে জনগণকে দেওয়া সংস্কার, বিচার ও ভোটাধিকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। ওনাকে দায়িত্বে থেকেই রাজনৈতিকভাবে সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করে মনে হলো, দেশে একটি দলীয় সরকার আছে। সরকার প্রধান দলীয় শৃঙ্খলা অনুসরণ করে সরকার থেকে পদত্যাগ করার জন্য দলীয় প্রধানের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন; কিন্তু দলীয় প্রধান তা নাকচ করে দিলেন। অতঃপর দলীয় সিদ্ধান্তের আলোকে ২৪ মে উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত সভায় ঘোষণা করা হয়েছে যে, সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচারপ্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকা- অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো এ সরকারের মধ্যে দলীয় রাজনীতির প্রবেশ। নাহিদ ইসলাম সরকারের উপদেষ্টা পদে আসীন থাকা অবস্থায় জাতীয় নাগরিক পার্টির গঠন প্রক্রিয়ার সাথে নানাভাবে যুক্ত থেকেছেন। দল গঠনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে অবশেষে পদত্যাগ করে দলের প্রধানের দায়িত্ব নিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দল গঠন প্রক্রিয়ার সময় থেকেই এমন সব বক্তব্য দিলেন মনে হলো তিনি ঐ দলেরও ‘প্রধান উপদেষ্টা’। আর তার উপযুক্ত প্রেস সচিব ঐ দলের প্রধানকে ‘ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী’ হিসাবে ঘোষণা করে দিলেন। সরকারে এখনও যে দুইজন ছাত্র উপদেষ্টা আছেন নাগরিক পার্টির গঠন প্রক্রিয়ার সাথে তারাও অপ্রকাশ্যে যুক্ত ছিলেন এবং দলীয় রাজনীতির ধারায় নিয়মিত বক্তব্য, বিবৃতি ও ফেসবুক পোস্ট দিয়েই চলেছেন। পরিস্থিতি এমন জায়গায় যাচ্ছে যে ক’দিন বাদে মানুষ এই সরকারকে আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না বলে এনসিপি’র সরকার বলবে। সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে যে ঘোষণা দিলেন সেই জনগন তো এনসিপির সাথে নেই। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তাদের সভা সমাবেশ থেকেই তা দৃশ্যমান। আর ঢাকার বাইরে তো তারা আরো দুর্বল। তবে সেটা মূল কথা নয়। কথা এটাই সরকার কি পারে জনগণের কথা বলে হুমকি দিতে। যে কোনো ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতিতে সরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে- এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সে কথা না বলে অনেকটা ‘জনতা মব’ সৃষ্টি করে মোকাবিলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এটা কখন বলা হচ্ছে? যখন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন জমায়েত অবস্থান ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করলেন। কিন্তু গত দশমাসে মৌলবাদী শক্তি সমূহ যত মব সৃষ্টি করলো, যত ভাঙচুর করলো তখন তো এ ধরনের হুমকি দেয়া হয় নি। বরং রাজনীতিতে ‘ডাস্টবিন’ সংস্কৃতি, ‘স্যান্ডেল ও বোতল’ সংস্কৃতি তো এই সরকারের আমলেই সৃষ্টি। যমুনার সামনে সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত থাকার পরেও এনসিপি আর জামাত- হেফাজত মিলে যখন সমাবেশ করলো তখন হুমকি না দিয়ে বরং গ্রীষ্মের দাবদাহে শীতল পানি স্প্রে করে স্বাগত জানানো হলো আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর গরম পানি নিক্ষেপ করা হলো। কেনো এই বৈষম্য মূলক আচরণ? এই সরকারের শক্তির দিক ছিলো আপদকালীন পরিস্থিতি থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি মানুষের ভরসা ও আস্থা। কিন্তু ১০ মাসেও গনতান্ত্রিক উত্তরনের লক্ষ্যে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায়, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় এবং ছাত্র সমন্বয়ক বা নতুন দলের নেতৃত্বের কারো কারো ইন্ধনে মব ভায়োলেন্স নামক এক সংস্কৃতি সমাজে শিকড় গেড়ে বসায় সরকারের প্রতি আস্থায় চিড় ধরেছে। এনসিপি এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ায় তাদের মধ্যে নানা আকাক্সক্ষা জন্ম নিয়েছে। আকাক্সক্ষা থাকা দোষের না। তবে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে নিজেদের অবস্থানকে অনেকে বিবেচনায় না নিয়ে রাতারাতি অনেক কিছু হতে চাইছেন। তাইতো নির্বাচনের কথা শুনলেই সরকার আর এনসিপির মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াস খুবই দৃশ্যমান। সমস্যাটি এখানেই।
নির্বাচনের কথা উঠলেই ‘র’-এর ষড়যন্ত্র, ভারতীয় ষড়যন্ত্র, পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র ইত্যাদি আওয়াজ তুলে নির্বাচনকে পাশ কাটানোর প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। আর ভারতীয় কিছু মিডিয়ার বাংলাদেশ ঘিরে নানা অপপ্রচার ও কল্পকাহিনী নির্বাচন বিরোধী ঐ শক্তিকে কার্যত সুবিধা করে দিচ্ছে।
বিএনপি যেহেতু নির্বাচন দাবি করছে বিএনপিকেও ভারতীয় আধিপত্যের কাছে নতজানু শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং নানা কায়দায় বিএনপি নেতৃত্বের একাংশকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে তাদের কাবু করার চেষ্টা হচ্ছে। বামপন্থিদের বিশেষত সিপিবির বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘প্রচার জেহাদ’ পরিচালিত হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে জামায়াত যখন নির্বাচনের পক্ষে ছিলো তখন জামায়াতকেও বলা হলো ‘দিল্লির এক্সটেনশন’। এখন জামায়াত এনসিপির সুরে আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করায় নির্বাচন বিরোধী শক্তির কাছে ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে গেছে। যমুনা মবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এবং নিবন্ধন নিষিদ্ধ করে নির্বাচনী হিসাব নিকাশে জামাত বিপদে পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে থাকতে না দেয়া হলে সাধারণভাবে ভোট একতরফা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিএনপির নিজস্ব ভোট ব্যাংক, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আওয়ামী ভোট (যারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন) জাতীয় পার্টির ভোট, ফ্লোটিং ভোট সব যাবে বিএনপির বাক্সে। বিএনপির প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়, মবতন্ত্রের বিপরীতে দেশে তুলনামূলক একটা স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ভোটের চেহারা এরকম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এনসিপি এবং মৌলবাদী সব শক্তি একত্রিত হলেও ভোটের ময়দানে হারিয়ে যাবে। একতরফা ভোট শক্তিশালী গনতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে দূর্বলতা হিসাবে রয়ে যাবে।আবার আওয়ামী লীগও হয়তোবা এটাই চায়।এক্ষেত্রে তারা দেশে ও বিদেশে প্রচারে সুবিধা নিতে ও ভবিষ্যৎ ইস্যু হিসাবে জিইয়ে রাখতে চায় যে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলো না এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কোন ব্যবস্থাও হলো না। বরং আওয়ামী লীগ ভোটে থাকলে তাদের নিশ্চিত পরাজয় হলেও তাদের ভোট ব্যাংক তাদের দিকেই থাকতো। ফলে বিএনপির পক্ষে সব আসনে একতরফা ভোট পাওয়া সম্ভব হতো না।
মৌলবাদীরা তাদের কিছু পকেট এরিয়া থেকে কিছু আসন আশা করতে পারতো? আর এনসিপির উত্তরাঞ্চলীয় আহ্বায়ক তো কোনো রাখঢাক না করে বলেই দিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে জয়লাভ তো দূরের কথা অধিকাংশ আসনেই এনসিপির জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।
এসব কারণেই নির্বাচন নয়, সংস্কার আর সংস্কার! দেশে এক যুগেরও বেশি সময় যাবত মানুষ ভোট দিতে পারে না, নির্বাচনের নামে হয়েছে প্রহসন- সেখানে একটি ভালো ভোট এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারাটাই তো সবচেয়ে বড় সংস্কার! কিন্তু ওই সংস্কারে তাদের আগ্রহ নেই। নির্ধারিত রাজনৈতিক দলসমূহের নির্ধারিত নেতাদের সাথে বৈঠকের পরে প্রেস সচিবের ব্রিফিং শুনে সন্দেহ জাগে প্রধান উপদেষ্টা তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা হিসাবেই পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন কিনা! প্রেস সচিব প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে বলেন, সবাই একসঙ্গে বসাতে তিনি মনে সাহস পেয়েছেন এবং নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে করা হবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো সন্তোষ প্রকাশ করেছে বলেও জানান প্রেস সচিব। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে এখনও ছোট প্যাকেজ- বড় প্যাকেজ আর ডিসেম্বর-জুনের এক্কাদোক্কা খেলাই অব্যাহত আছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ও পথরেখা নিয়ে এই অনিশ্চয়তায় এনসিপি এবং মৌলবাদী দলসমূহ ছাড়া আর কেউ কি সন্তোষ প্রকাশ করেছে? বিএনপির এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট অবস্থান তারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়।
বাম ও মধ্য বামপন্থি দলসমূহের অবস্থানও কাছাকাছি। প্রেস সচিব কি বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে সরকারের কৌশলকে সর্বোদল সম্মত করার কোশেশ করছেন? কয়েকদিন আগে তথ্য সচিব যেদিন হুংকার দিলেন- সব বিষয়ে আমাদের ম্যান্ডেট আছে, সে দিন থেকে আমার দেখতে খুব সাধ জাগে উনি যেন এবার নির্বাচনে এনসিপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে পার্লামেন্টে আসেন! প্রেস সচিবের মতো কথা বার্তা ওবায়দুল কাদের সহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বলতেন। আর নির্বাচন নিয়ে পর পর তিনবার মস্করা করার কি করুণ পরিণতি হতে পারে তাতো শেখ হাসিনাসহ তারা হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। অভ্যুত্থানের প্রায় দশ মাস পরে ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। তিনি বলেছেন ‘৫ আগস্ট ছিল আকস্মিক ঘটনা। এটা তো ছিলো কোটার আন্দোলন। পরবর্তীতে ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওরের কারনে এক দফা ও সরকার পতন।’
বছরের পর বছর, দশক নয় যুগেরও বেশি সময় মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে, বিরোধী পক্ষ ও গনতন্ত্রের আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করে রাখার সাফল্যে সামান্য কোটার আন্দোলন দেখে আপনাদের মনে হয়েছিলো আকাশে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি হলেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু ঐ মেঘ যে বজ্রমেঘ তা বুঝতে না পারা ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর নয় রাজনৈতিক ফেইলিওর। রাজনীতির বিজ্ঞান ও প্রকৃতিকে না বুঝার ব্যর্থতা। প্রকৃতির নিয়মে দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠা-া বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস তৈরি হয়, আর এর থেকে তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রের তৈরি হয়।
রাজনীতিতেও তাই ঘটেছে। দক্ষিণের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রামকে স্তব্ধ করে রেখে সমাজে যে রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল তা থেকে এবং কোটা আন্দোলনের উপর দমন পীড়ন হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দক্ষিণের বাতাসকে এমন গরম করে ফেলা হয় যে, উত্তরের একটু ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ পেতেই সৃষ্টি হয় বজ্রমেঘ যা থেকে সরাসরি গনভবনের উপর, আওয়ামী লীগের মসনদের উপর বজ্রপাত। আকস্মিক নয় প্রকৃতির নিয়মেই এই বজ্রপাত। কিন্তু আমরা কি এই বজ্রপাত থেকে কোনো শিক্ষা নিলাম? অস্থিতিশীলতাকে আলিঙ্গন করেই তো আমরা অগ্রসর হতে চাইছি। যা কিন্তু দক্ষিণের বাতাসকে উষ্ণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। বাতাস অতি উষ্ণ হলে এবং বাতাসে ঘূর্ণীয়মান গতি সৃষ্টি হলে কিন্তু আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড়। বজ্রপাত অপেক্ষা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয় অনেক বিস্তৃত। এক দফা বজ্রপাতের পর আমাদের কি একটা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করার সামর্থ্য আছে? বিপর্যয় সৃষ্টি হলেও ঘূর্ণিঝড় আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে।
অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীলতার দিকে, নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়ে রাজনীতির তাপের ভারসাম্য রক্ষা করলেই আমরা বজ্রপাত ও ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি। ড. ইউনূস স্বাপ্নিক ও সৃষ্টিশীল মানুষ। তার স্বপ্ন, পরিকল্পনা অনেকেরই পছন্দ হতে পারে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট নিয়ে তো তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেননি। তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স বলে সরকারের দৈনন্দিন নির্বাহী কাজ তথা রুটিন কাজ সম্পাদন করার জন্য। পশ্চিমা দুনিয়ার স্বার্থ রক্ষা আর দেশাভ্যন্তরে এনসিপি আর মৌলবাদীদের খুশী রাখা তার কাজ নয়। তিনি বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ইতোমধ্যে সেখানেও চিড় ধরছে। নিউইর্য়ক টাইমস, ফাইনেন্সিয়াল টাইমস, বিবিসি, আলজাজিরা এসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দুই দিন আগেও ড. ইউনূসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো; কিন্তু এখন তারা বলছে মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এ অনিশ্চয়তা দূর করতে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে অবিলম্বে সুস্পষ্ট রূপরেখা দিতে হবে, এখানে ডিসেম্বর না জুন- এই বিতর্কের সুযোগ নেই। সরকার নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই এই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা অনেকটা কেটে যাবে। এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এই দেশ ও জাতি আরও একটি বজ্রপাত বা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার সামর্থ্য রাখে না।
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]