alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

আনোয়ারুল হক

: বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
image

সুনামগঞ্জের সন্নিকটে একই কবরে শায়িত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের তিন মুক্তিযোদ্ধা। মুসলিম সম্প্রদায়ের শহীদ তালেবউদ্দীন, হিন্দু সম্প্রদায়ের শহীদ কৃপেন্দ্র দাস এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের চম্পক বাড়ৈ। হ্যাঁ এটাই মুক্তিযুদ্ধ, এটাই বাংলাদেশ!

বাংলাদেশের জন্য একটা সুযোগ কিন্তু বাস্তবে এসেছিল। দেড় দশক যাবত জবরদস্তিমূলকভাবে অনেকটা একদলীয় শাসনের মতো দেশ চালিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সেই স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কিন্তু একটা বড় ঘটনা। তবে এর পরেও আশা ও হতাশা-দুটোই আছে। পাঁচ আগস্ট সরকারের পতনের পর শহুরে মানুষের মাঝে গণতান্ত্রিক পূনর্গঠনের এক জনাকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়। সরকার পতনের পর সাড়ে দশ মাস অতিবাহিত। এ সময়টা কিন্তু একেবারে কম সময় নয়। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথযাত্রায় এর মধ্যেই কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। কেন হলো না?

একটা কারণ শেখ হাসিনার শাসন অবসানের পরে যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শূন্যতার সৃষ্টি হয় তার সুযোগে এক উগ্রপন্থার উদ্ভব ঘটে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়। পুলিশি হামলা ও গুলিতে অসংখ্য ছাত্র তরুণ শ্রমজীবী মানুষ নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরিকল্পিত বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারাদেশে অসংখ্য থানার অস্ত্র লুট এবং অসংখ্য পুলিশ হত্যার ফলে থানাগুলো পুলিশশূন্য হয়ে যায়। ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশের উসকানিতে দেশে কায়েম হয় মব সংস্কৃতি। উচ্ছৃঙ্খলতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের অক্ষমতা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোকে আরও শক্তিশালী করে। সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহ। তাদের ক্রোধ, প্রতিহিংসা, উগ্রতা দেখে সাধারণ ছাত্র তরুণ এবং জনসাধারণের উৎসাহে ভাটা পড়ে। সরকারকেও একটা স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছাতে অনেকটা সময় লাগে।

দেশে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে না পারায় মানুষ সংস্কার-নির্বাচন কিছুতেই আস্থা ভরসা পাচ্ছেন না। শেখ হাসিনার আমলে আইনের শাসনে ব্যত্যয় হয়েছিল। গুম-খুনের বিচার ছিল না। এখনও মব হামলার বিচার নাই। তখনও বিনাবিচারে নানা কায়দায় বিরোধীদের আটক রাখা হতো। এখনও কোনো প্রমাণ ও তদন্ত ছাড়াই খুনের মামলায় অনেককে আটক রাখা হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এ কারণে কথিত খুনের মামলায় নাম ঢুকিয়ে মাসের পর মাস কাউকে আটক রাখা রীতিমতো অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে যদি অন্য কোনও ফৌজদারি অপরাধ থেকে থাকে সেটা নিয়ে মামলা হোক, তদন্ত হোক, বিচার হোক। প্রবীণ রাজনীতিক ৮২ বছরের রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে মনে হয় ‘৮২টি’ খুনের মামলা দেয়া হয়েছে। রিমান্ডেও মনে হয় ৮২ দিন কেটেছে। ’৭১-এর রণাঙ্গনের যোদ্ধা হাসানুল হক ইনুরও একই দশা। আদালতকে প্রভাবিত করে এভাবে আটকে রেখে বিচার বিভাগকে কলুষিত করে রাখা হচ্ছে। বলা হয়েছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ দেখছে মবের শাসন আর বিচারহীনতার একই সংস্কৃতি। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে, পাঁচশ টাকা থেকে হাজার টাকার বিনিময়ে বাদী ক্রয় করা যাচ্ছে বা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কারো সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ব্যক্তিগত বিরোধ, পেশাগত বিরোধ বা ঈর্ষা এসব নানা কারণেও বাদী সংগ্রহ করে খুনের মামলা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে মব সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের দায়সারা বিবৃতি ও নিস্ক্রিয়তা সহিংস গোষ্ঠীকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে। যার নিকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখলাম সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লাঞ্ছিত ও হেনস্তা করার মধ্য দিয়ে। প্রতিহিংসার আগুন জ্বালালে, সে আগুনে যে একদিন নিজেকেও জ্বলতে হতে পারে- সে বিবেচনা কেউ করছে না। সুশাসন আর ন্যায় বিচারের বাইরে যে ক্রোধ ও প্রতিহিংসার রাজত্ব চলছে তাতে করে যথাযথ সংস্কারের ভরসা মানুষ পাচ্ছেন না।

সংস্কারে অগ্রগতি না হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ বিদেশি বা দ্বৈত নাগরিক সুবাদে কিছু বিশেষজ্ঞ যাদের দীর্ঘকাল যাবত দেশের সঙ্গে, দেশের জনগণের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক নাই, তাদের আনা হয়েছে সংস্কার প্রস্তাব রচনার জন্য। ছাত্র নেতৃত্বাধীন এনসিপির অনেক সদস্য ‘ছাত্র প্রতিনিধি’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশনগুলোতে যোগদান করেন এবং সংস্কার প্রস্তাবগুলোর খসড়া করার ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করেন। বিপরীতে অন্য প্রধান দলগুলো শুধু তাদের ধারণা জানানোর সুযোগ পেয়েছে এবং তাদেরকে কিছু প্রস্তাব দিয়ে শুধু হ্যাঁ/না ভোট নেয়া হয়েছে। ফলে শুরুতেই বিষয়টি হয়ে গেছে একতরফা। কিন্তু বিষয়গুলোতে শুধু হ্যাঁ বা না বলার বিষয় না। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, বিষয়বস্তু নির্ধারণ থেকে শুরু করে খসড়া রচনায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় খসড়ার বিষয়বস্তু ও বাক্যগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় নিষ্পত্তি করতে কালক্ষেপণ হবে।

অথচ শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনের পরিবর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে নির্বাচনী ব্যবস্থায় এবং এক ব্যক্তির হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা অবসানের দলীয় কাঠামো বিনির্মাণে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘ সময় যাবত সমাজে অনুভূত হচ্ছিল। এটা নতুন কোনো আবিষ্কার নয়। দীর্ঘ ১৫ বছরের একটানা শাসনে পরিবারকেন্দ্রিক আধিপত্য দৃষ্টিকটু ভাবেই দৃশ্যমান ছিল। সারাদেশে একই অবস্থা ছিল। বাবা মন্ত্রী-এমপি, ছেলে উপজেলার চেয়ারম্যান কিংবা পৌর মেয়র। স্বামী এমপি আবার স্ত্রী মেয়র কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান অথবা সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। কখনো কখনো এসব দায়িত্বে বসানো হয়েছে এমপি-মন্ত্রীর নিকট আত্মীয়কে। এ কারণে টানা সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগে কিছু সুবিধাভোগী তৈরি হয়েছে। নতুন নেতা কিংবা ত্যাগী কর্মী তৈরি হয়নি। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি আমলেও সুখকর কিছু দৃশ্যমান হয়নি। নতুন করে যে তোড়জোড় চলছে সেখানেও পরিবারতন্ত্র প্রাধান্য পাচ্ছে। এবং পরিবারতন্ত্রের এই আধিপত্য দীর্ঘকাল থেকেই চলে আসছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশজুড়েই এর শিকড় অনেক গভীরে। ঐক্যমত কমিশনের যুক্তিসঙ্গত একটি সমাধানে আসতে পারলে সেটা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাহাত্তরের সংবিধান ইচ্ছামতো কাটাকুটির কারণে একটি শ্রীহীন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ’৯১ সালে এরশাদ পতনের পর যখন প্রেসিডেনশিয়াল সরকার থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা এলো তখন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের জায়গায় কেবল প্রধানমন্ত্রীর নাম বসিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার নামে একটি স্বৈরতান্ত্রিক সংসদীয় সরকারব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। আরো আরও অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি বর্তমান সংবিধানে রয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদের কথা সবাই জানে। যা প্রয়োজন তা হল, ভারসাম্যপূর্ণভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে সংসদীয় ব্যবস্থার নবায়ন। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে সংসদীয় ব্যবস্থার হাত-পা যাতে বাঁধা না পড়ে। এ জায়গায় ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে নতুন করে আর এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে দেশে পাহাড় ও সমতলে যে যে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রয়েছে, তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে, সব ধর্মের মানুষের সম-অধিকারের নিমিত্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করা। এসব কাজ রাজনীতিকদের। এর জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ভাড়া করার প্রয়োজন হয় না।

আইনের শাসন নিশ্চিত কল্পে বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতা ও দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিম্ন আদালতসহ যে কোনো আদালতে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধের ব্যবস্থা, দুদককে বিরোধী বা প্রতিপক্ষের প্রতি ব্যবস্থা নেয়ার বিপরীতে সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত স্বাধীন কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর পদ্ধতি উদ্ভাবন, নির্বাচন কমিশনে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধের পদ্ধতি উদ্ভাবন, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিচালক পদে সরকার দলীয় লোকজনকে পরিচালক পদে মনোনয়ন দেয়ার ব্যবস্থা বন্ধ করা, সাংবিধানিক সংস্থাসমূহের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতি আনুগত্যের বিপরীতে যোগ্যতা ও দক্ষতার মাপকাঠিতে করার নীতিমালা প্রণয়নÑ এসব বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ রেখে যাতে পারে এবং অন্তর্বর্তী সরকারও কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে।

তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যারা জন্ম বিরোধী, সংস্কার নিয়ে তাদের তোড়জোড় দেখে স্পষ্টত চারদিকে চাপা নিঃশ্বাসের অনুভব হচ্ছে। এরা আবার অভিমানও করে! প্রধান উপদেষ্টাকে তাদের টেলিফোন করে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে হয়। কিন্তু তাদের কথা তো সুস্পষ্ট। তারা ‘পরিবর্তিত হতে জানে না’। তারা তো এখনো তাদের পত্রিকায় লিখছেন ‘সে সময়ের সব ইসলামী রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ইসলামের সঙ্গে। সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।’ ১৯৭১ সালেও জামায়াত আমির গোলাম আজম বলেছিলেন, কোন ভালো মুসলমান বাংলাদেশের সমর্থক হতে পারে না।’ তাহলে বাংলাদেশে সংস্কারের ছবক তাদের কাছ থেকে নিতে হবে কেন?

অনেকেই আশা করেছিলেন ওরা ’৭১-এর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে এবং তাদের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন এক উদারনৈতিক রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে শামিল হবেন। কিন্তু না, কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা তাদের পুরনো অবস্থানের পক্ষেই সাফাই গাইতে শুরু করে। তারা বলতে শুরু করেন আজকের পরিস্থিতি প্রমাণ করছে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষায় জামায়াতে ইসলামের ভূমিকা সঠিক ছিল।

সুনামগঞ্জের সন্নিকটে জয়কলস বাজারে একই কবরে শুয়ে আছেন তিন মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ তালেবউদ্দীন মুসলিম, শহীদ কৃপেন্দ্র দাস হিন্দু এবং চম্পক বাড়ৈক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। হ্যাঁ এটাই মুক্তিযুদ্ধ; এটাই বাংলাদেশ! মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চাইলে তাদের পরিবর্তিত হতে হবে এবং এই বাংলাদেশকে মেনে নিতে হবে। শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ও জাতীয় স্মৃতিসৌধের সম্মুখপানে তাকিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। এই সংস্কার যদি করা না যায় বিভাজনের রাজনীতি চলতেই থাকবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হয়ে থাকবে সোনার হরিণ। ছাত্র তরুণ শ্রমজীবী মানুষের এক অভূতপূর্ব নির্মাণ ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান তার স্বমহিমা নিয়ে থাকবে। কিন্তু সংস্কার বা সনদের নামে ’২৪-কে দিয়ে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ ’৭১-কে আড়াল করে বা ’৭১ ও ’২৪-কে একইভাবে সঙ্গায়িত করেÑ সামনে মিঠাপানির নহর বইয়ে দিলেও মানুষ সেটা মেনে নেবে না।

নির্বাচন পরিস্থিতি সামনে রেখে এক ধরনের সংস্কার হয়তো অনেকেই মেনে নেবেন। আবার সরকার গঠন করে তাদের মতো করে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন। অনেক কিছুই পাল্টে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক সংস্কারকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যতে সংস্কারের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে মব-উল্লম্ফন মুক্ত একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কথিত খুনের মামলা দিয়ে আটক বা দৌড়ের ওপর রাখলে নির্বাচন, সংস্কার কোনটাই টেকসই হবে না। আওয়ামী লীগবিহীন ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করে নির্বাচন সম্পন্ন করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে যদিও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘নির্বাচনে তারা থাকবে কিনা, সেটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে’। ভিন্ন একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের আগের বয়ানের মতো বলছেন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক মানে কোনো নির্দিষ্ট দল নয়, সব মানুষের অংশগ্রহণ। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ভোট দিতে পারছে, ততক্ষণ এটা অন্তর্ভুক্তিমূলক।’ এক্ষেত্রে ইউনূস সরকার কি তাহলে ‘আওয়ামী পদ্ধতির’ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন? লন্ডন বৈঠকে কি সাব্যস্ত হলো, জানা নেই।

মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা অবচেতন অভ্যাস ও মানসিকতায় পরিবর্তন ও সংস্কার সহজ কাজ নয়। এত বড় জনজাগরণ বা অভ্যুত্থানের সামনে থাকা তরুণরাই পরিবর্তিত হতে পারলেন না! এই বয়সেই তাদের একটা বড় অংশ অর্থবিত্ত গাড়িবাড়ি আর ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন। তবে এখনো তরুণদের দলের নেতৃত্বে বেশ কিছু প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী আছেন যাদের মধ্যে সততা, সাহস আর রাজনৈতিক কুশলতা রয়েছে। অসৎ আর ‘মবিষ্টদের’ দাপটে তারা কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবেন সেটা সামনের দিনগুলোতে দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে যাদের একচেটিয়া কতৃত্ব সেই বিএনপি ৫ আগস্ট বিকেল থেকেই যে চেহারা দেখিয়েছে এবং এখনও দেখিয়ে যাচ্ছে তাও তো রীতিমতো ভীতিপ্রদ। নেতৃত্বের দিক থেকে যত ভালো ভালো কথা বলা হোক না কেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন কেন্দ্রীয় নেতাদের এটা বলতে হয়। নেতারা নেতাদের কাজ করুক, আমরা আমাদের কাজ করে যাই। মুখে যা-ই বলুক নেতারাও হয়তো মনে করেন এলাকায় একচেটিয়া আধিপত্যের প্রয়োজনে দখলদারিত্বের দরকার আছে। মানুষের মাঝে একটা ভীতি, এখনই এ অবস্থা ক্ষমতায় আসলে আরো কী দেখতে হয়!

হতাশার মাঝেও মানুষ ভরসাকে অবলম্বন করে বাঁচে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে কৃষকের সবকিছু ভেসে যাবার পরেও সে আবার নতুন আশায় ঘর বাঁধে, আবার বীজতলা তৈরি করে, ফসল ফলায়। ভরসাকে সম্বল করেই ধ্বংসস্তূপের মাঝ থেকে আবার উঠে দাঁড়ায়। কৃষকের দেশের মানুষ আমরা। কৃষকের মতোই আশায় বুক বাঁধি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘বিপদ থাকে তো থাকে, তাই বলিয়া বিকাশের পথকে একেবারে পরিত্যাগ করিয়া চলিলে মঙ্গল নাই’। সেই ভরসায় আছি। ভরসার নামই তো জীবন!

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

আনোয়ারুল হক

image

সুনামগঞ্জের সন্নিকটে একই কবরে শায়িত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের তিন মুক্তিযোদ্ধা। মুসলিম সম্প্রদায়ের শহীদ তালেবউদ্দীন, হিন্দু সম্প্রদায়ের শহীদ কৃপেন্দ্র দাস এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের চম্পক বাড়ৈ। হ্যাঁ এটাই মুক্তিযুদ্ধ, এটাই বাংলাদেশ!

বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের জন্য একটা সুযোগ কিন্তু বাস্তবে এসেছিল। দেড় দশক যাবত জবরদস্তিমূলকভাবে অনেকটা একদলীয় শাসনের মতো দেশ চালিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সেই স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কিন্তু একটা বড় ঘটনা। তবে এর পরেও আশা ও হতাশা-দুটোই আছে। পাঁচ আগস্ট সরকারের পতনের পর শহুরে মানুষের মাঝে গণতান্ত্রিক পূনর্গঠনের এক জনাকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়। সরকার পতনের পর সাড়ে দশ মাস অতিবাহিত। এ সময়টা কিন্তু একেবারে কম সময় নয়। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথযাত্রায় এর মধ্যেই কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। কেন হলো না?

একটা কারণ শেখ হাসিনার শাসন অবসানের পরে যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শূন্যতার সৃষ্টি হয় তার সুযোগে এক উগ্রপন্থার উদ্ভব ঘটে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়। পুলিশি হামলা ও গুলিতে অসংখ্য ছাত্র তরুণ শ্রমজীবী মানুষ নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরিকল্পিত বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারাদেশে অসংখ্য থানার অস্ত্র লুট এবং অসংখ্য পুলিশ হত্যার ফলে থানাগুলো পুলিশশূন্য হয়ে যায়। ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশের উসকানিতে দেশে কায়েম হয় মব সংস্কৃতি। উচ্ছৃঙ্খলতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের অক্ষমতা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোকে আরও শক্তিশালী করে। সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহ। তাদের ক্রোধ, প্রতিহিংসা, উগ্রতা দেখে সাধারণ ছাত্র তরুণ এবং জনসাধারণের উৎসাহে ভাটা পড়ে। সরকারকেও একটা স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছাতে অনেকটা সময় লাগে।

দেশে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে না পারায় মানুষ সংস্কার-নির্বাচন কিছুতেই আস্থা ভরসা পাচ্ছেন না। শেখ হাসিনার আমলে আইনের শাসনে ব্যত্যয় হয়েছিল। গুম-খুনের বিচার ছিল না। এখনও মব হামলার বিচার নাই। তখনও বিনাবিচারে নানা কায়দায় বিরোধীদের আটক রাখা হতো। এখনও কোনো প্রমাণ ও তদন্ত ছাড়াই খুনের মামলায় অনেককে আটক রাখা হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এ কারণে কথিত খুনের মামলায় নাম ঢুকিয়ে মাসের পর মাস কাউকে আটক রাখা রীতিমতো অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে যদি অন্য কোনও ফৌজদারি অপরাধ থেকে থাকে সেটা নিয়ে মামলা হোক, তদন্ত হোক, বিচার হোক। প্রবীণ রাজনীতিক ৮২ বছরের রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে মনে হয় ‘৮২টি’ খুনের মামলা দেয়া হয়েছে। রিমান্ডেও মনে হয় ৮২ দিন কেটেছে। ’৭১-এর রণাঙ্গনের যোদ্ধা হাসানুল হক ইনুরও একই দশা। আদালতকে প্রভাবিত করে এভাবে আটকে রেখে বিচার বিভাগকে কলুষিত করে রাখা হচ্ছে। বলা হয়েছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ দেখছে মবের শাসন আর বিচারহীনতার একই সংস্কৃতি। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে, পাঁচশ টাকা থেকে হাজার টাকার বিনিময়ে বাদী ক্রয় করা যাচ্ছে বা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কারো সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ব্যক্তিগত বিরোধ, পেশাগত বিরোধ বা ঈর্ষা এসব নানা কারণেও বাদী সংগ্রহ করে খুনের মামলা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে মব সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের দায়সারা বিবৃতি ও নিস্ক্রিয়তা সহিংস গোষ্ঠীকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে। যার নিকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখলাম সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লাঞ্ছিত ও হেনস্তা করার মধ্য দিয়ে। প্রতিহিংসার আগুন জ্বালালে, সে আগুনে যে একদিন নিজেকেও জ্বলতে হতে পারে- সে বিবেচনা কেউ করছে না। সুশাসন আর ন্যায় বিচারের বাইরে যে ক্রোধ ও প্রতিহিংসার রাজত্ব চলছে তাতে করে যথাযথ সংস্কারের ভরসা মানুষ পাচ্ছেন না।

সংস্কারে অগ্রগতি না হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ বিদেশি বা দ্বৈত নাগরিক সুবাদে কিছু বিশেষজ্ঞ যাদের দীর্ঘকাল যাবত দেশের সঙ্গে, দেশের জনগণের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক নাই, তাদের আনা হয়েছে সংস্কার প্রস্তাব রচনার জন্য। ছাত্র নেতৃত্বাধীন এনসিপির অনেক সদস্য ‘ছাত্র প্রতিনিধি’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশনগুলোতে যোগদান করেন এবং সংস্কার প্রস্তাবগুলোর খসড়া করার ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করেন। বিপরীতে অন্য প্রধান দলগুলো শুধু তাদের ধারণা জানানোর সুযোগ পেয়েছে এবং তাদেরকে কিছু প্রস্তাব দিয়ে শুধু হ্যাঁ/না ভোট নেয়া হয়েছে। ফলে শুরুতেই বিষয়টি হয়ে গেছে একতরফা। কিন্তু বিষয়গুলোতে শুধু হ্যাঁ বা না বলার বিষয় না। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, বিষয়বস্তু নির্ধারণ থেকে শুরু করে খসড়া রচনায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় খসড়ার বিষয়বস্তু ও বাক্যগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় নিষ্পত্তি করতে কালক্ষেপণ হবে।

অথচ শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনের পরিবর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে নির্বাচনী ব্যবস্থায় এবং এক ব্যক্তির হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা অবসানের দলীয় কাঠামো বিনির্মাণে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘ সময় যাবত সমাজে অনুভূত হচ্ছিল। এটা নতুন কোনো আবিষ্কার নয়। দীর্ঘ ১৫ বছরের একটানা শাসনে পরিবারকেন্দ্রিক আধিপত্য দৃষ্টিকটু ভাবেই দৃশ্যমান ছিল। সারাদেশে একই অবস্থা ছিল। বাবা মন্ত্রী-এমপি, ছেলে উপজেলার চেয়ারম্যান কিংবা পৌর মেয়র। স্বামী এমপি আবার স্ত্রী মেয়র কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান অথবা সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। কখনো কখনো এসব দায়িত্বে বসানো হয়েছে এমপি-মন্ত্রীর নিকট আত্মীয়কে। এ কারণে টানা সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগে কিছু সুবিধাভোগী তৈরি হয়েছে। নতুন নেতা কিংবা ত্যাগী কর্মী তৈরি হয়নি। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি আমলেও সুখকর কিছু দৃশ্যমান হয়নি। নতুন করে যে তোড়জোড় চলছে সেখানেও পরিবারতন্ত্র প্রাধান্য পাচ্ছে। এবং পরিবারতন্ত্রের এই আধিপত্য দীর্ঘকাল থেকেই চলে আসছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশজুড়েই এর শিকড় অনেক গভীরে। ঐক্যমত কমিশনের যুক্তিসঙ্গত একটি সমাধানে আসতে পারলে সেটা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাহাত্তরের সংবিধান ইচ্ছামতো কাটাকুটির কারণে একটি শ্রীহীন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ’৯১ সালে এরশাদ পতনের পর যখন প্রেসিডেনশিয়াল সরকার থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা এলো তখন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের জায়গায় কেবল প্রধানমন্ত্রীর নাম বসিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার নামে একটি স্বৈরতান্ত্রিক সংসদীয় সরকারব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। আরো আরও অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি বর্তমান সংবিধানে রয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদের কথা সবাই জানে। যা প্রয়োজন তা হল, ভারসাম্যপূর্ণভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে সংসদীয় ব্যবস্থার নবায়ন। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে সংসদীয় ব্যবস্থার হাত-পা যাতে বাঁধা না পড়ে। এ জায়গায় ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে নতুন করে আর এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে দেশে পাহাড় ও সমতলে যে যে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রয়েছে, তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে, সব ধর্মের মানুষের সম-অধিকারের নিমিত্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করা। এসব কাজ রাজনীতিকদের। এর জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ভাড়া করার প্রয়োজন হয় না।

আইনের শাসন নিশ্চিত কল্পে বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতা ও দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিম্ন আদালতসহ যে কোনো আদালতে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধের ব্যবস্থা, দুদককে বিরোধী বা প্রতিপক্ষের প্রতি ব্যবস্থা নেয়ার বিপরীতে সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত স্বাধীন কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর পদ্ধতি উদ্ভাবন, নির্বাচন কমিশনে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধের পদ্ধতি উদ্ভাবন, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিচালক পদে সরকার দলীয় লোকজনকে পরিচালক পদে মনোনয়ন দেয়ার ব্যবস্থা বন্ধ করা, সাংবিধানিক সংস্থাসমূহের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতি আনুগত্যের বিপরীতে যোগ্যতা ও দক্ষতার মাপকাঠিতে করার নীতিমালা প্রণয়নÑ এসব বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ রেখে যাতে পারে এবং অন্তর্বর্তী সরকারও কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে।

তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যারা জন্ম বিরোধী, সংস্কার নিয়ে তাদের তোড়জোড় দেখে স্পষ্টত চারদিকে চাপা নিঃশ্বাসের অনুভব হচ্ছে। এরা আবার অভিমানও করে! প্রধান উপদেষ্টাকে তাদের টেলিফোন করে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে হয়। কিন্তু তাদের কথা তো সুস্পষ্ট। তারা ‘পরিবর্তিত হতে জানে না’। তারা তো এখনো তাদের পত্রিকায় লিখছেন ‘সে সময়ের সব ইসলামী রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ইসলামের সঙ্গে। সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।’ ১৯৭১ সালেও জামায়াত আমির গোলাম আজম বলেছিলেন, কোন ভালো মুসলমান বাংলাদেশের সমর্থক হতে পারে না।’ তাহলে বাংলাদেশে সংস্কারের ছবক তাদের কাছ থেকে নিতে হবে কেন?

অনেকেই আশা করেছিলেন ওরা ’৭১-এর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে এবং তাদের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন এক উদারনৈতিক রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে শামিল হবেন। কিন্তু না, কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা তাদের পুরনো অবস্থানের পক্ষেই সাফাই গাইতে শুরু করে। তারা বলতে শুরু করেন আজকের পরিস্থিতি প্রমাণ করছে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষায় জামায়াতে ইসলামের ভূমিকা সঠিক ছিল।

সুনামগঞ্জের সন্নিকটে জয়কলস বাজারে একই কবরে শুয়ে আছেন তিন মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ তালেবউদ্দীন মুসলিম, শহীদ কৃপেন্দ্র দাস হিন্দু এবং চম্পক বাড়ৈক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। হ্যাঁ এটাই মুক্তিযুদ্ধ; এটাই বাংলাদেশ! মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চাইলে তাদের পরিবর্তিত হতে হবে এবং এই বাংলাদেশকে মেনে নিতে হবে। শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ও জাতীয় স্মৃতিসৌধের সম্মুখপানে তাকিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। এই সংস্কার যদি করা না যায় বিভাজনের রাজনীতি চলতেই থাকবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হয়ে থাকবে সোনার হরিণ। ছাত্র তরুণ শ্রমজীবী মানুষের এক অভূতপূর্ব নির্মাণ ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান তার স্বমহিমা নিয়ে থাকবে। কিন্তু সংস্কার বা সনদের নামে ’২৪-কে দিয়ে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ ’৭১-কে আড়াল করে বা ’৭১ ও ’২৪-কে একইভাবে সঙ্গায়িত করেÑ সামনে মিঠাপানির নহর বইয়ে দিলেও মানুষ সেটা মেনে নেবে না।

নির্বাচন পরিস্থিতি সামনে রেখে এক ধরনের সংস্কার হয়তো অনেকেই মেনে নেবেন। আবার সরকার গঠন করে তাদের মতো করে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন। অনেক কিছুই পাল্টে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক সংস্কারকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যতে সংস্কারের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে মব-উল্লম্ফন মুক্ত একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কথিত খুনের মামলা দিয়ে আটক বা দৌড়ের ওপর রাখলে নির্বাচন, সংস্কার কোনটাই টেকসই হবে না। আওয়ামী লীগবিহীন ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করে নির্বাচন সম্পন্ন করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে যদিও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘নির্বাচনে তারা থাকবে কিনা, সেটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে’। ভিন্ন একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের আগের বয়ানের মতো বলছেন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক মানে কোনো নির্দিষ্ট দল নয়, সব মানুষের অংশগ্রহণ। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ভোট দিতে পারছে, ততক্ষণ এটা অন্তর্ভুক্তিমূলক।’ এক্ষেত্রে ইউনূস সরকার কি তাহলে ‘আওয়ামী পদ্ধতির’ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন? লন্ডন বৈঠকে কি সাব্যস্ত হলো, জানা নেই।

মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা অবচেতন অভ্যাস ও মানসিকতায় পরিবর্তন ও সংস্কার সহজ কাজ নয়। এত বড় জনজাগরণ বা অভ্যুত্থানের সামনে থাকা তরুণরাই পরিবর্তিত হতে পারলেন না! এই বয়সেই তাদের একটা বড় অংশ অর্থবিত্ত গাড়িবাড়ি আর ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন। তবে এখনো তরুণদের দলের নেতৃত্বে বেশ কিছু প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী আছেন যাদের মধ্যে সততা, সাহস আর রাজনৈতিক কুশলতা রয়েছে। অসৎ আর ‘মবিষ্টদের’ দাপটে তারা কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবেন সেটা সামনের দিনগুলোতে দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে যাদের একচেটিয়া কতৃত্ব সেই বিএনপি ৫ আগস্ট বিকেল থেকেই যে চেহারা দেখিয়েছে এবং এখনও দেখিয়ে যাচ্ছে তাও তো রীতিমতো ভীতিপ্রদ। নেতৃত্বের দিক থেকে যত ভালো ভালো কথা বলা হোক না কেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন কেন্দ্রীয় নেতাদের এটা বলতে হয়। নেতারা নেতাদের কাজ করুক, আমরা আমাদের কাজ করে যাই। মুখে যা-ই বলুক নেতারাও হয়তো মনে করেন এলাকায় একচেটিয়া আধিপত্যের প্রয়োজনে দখলদারিত্বের দরকার আছে। মানুষের মাঝে একটা ভীতি, এখনই এ অবস্থা ক্ষমতায় আসলে আরো কী দেখতে হয়!

হতাশার মাঝেও মানুষ ভরসাকে অবলম্বন করে বাঁচে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে কৃষকের সবকিছু ভেসে যাবার পরেও সে আবার নতুন আশায় ঘর বাঁধে, আবার বীজতলা তৈরি করে, ফসল ফলায়। ভরসাকে সম্বল করেই ধ্বংসস্তূপের মাঝ থেকে আবার উঠে দাঁড়ায়। কৃষকের দেশের মানুষ আমরা। কৃষকের মতোই আশায় বুক বাঁধি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘বিপদ থাকে তো থাকে, তাই বলিয়া বিকাশের পথকে একেবারে পরিত্যাগ করিয়া চলিলে মঙ্গল নাই’। সেই ভরসায় আছি। ভরসার নামই তো জীবন!

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

back to top