alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

অরূপরতন চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। জাতিসংঘের ইউনাইটেড ন্যাশন অফিস অন ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইম (এনওডিসি) এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে - “বর্তমান প্রজন্মকে মাদকমুক্ত রাখতে প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিরোধ কার্যক্রম”। অর্থ্যাৎ, মাদকাসক্তি সমস্যা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে জেঁকে বসছে। সুতরাং প্রতিরোধ কার্যক্রমের প্রতি জোর দেয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’; অর্থাৎ, চিকিৎসার চাইতে প্রতিরোধ ভালো। এটা যদিও স্বাস্থ্যগত অসুখ ও তার চিকিৎসা এবং রোগপ্রতিরোধকে বুঝায় তবুও একই ফরমুলা ব্যবহার করে মাদকাসক্তি সমস্যা মোকাবিলা ও তার সুষ্ঠু সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। সেজন্যই মূলত মাদক প্রতিরোধে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তামাক সেবন মানুষের অকাল মৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশে ৪৯% মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ- ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। বেসরকারি হিসাবমতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, ইয়াবা সেবনকারী শতকরা ৮৫ ভাগই তরুণ যুবসমাজ! ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আসক্তি তাকে মানসিক ও শারীরিক রোগসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন রোগের মতো এইচআইভি এইডসের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদক গ্রহণকালীন সময়ে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও ঝুঁকির্পূণ আচরণ।

মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত, যা গবেষণায় প্রমাণিত। ধূমপানে অভ্যস্ততার মধ্য দিয়ে তরুণরা মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীতে ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেন, আফিস, কোডিন, মরফিন, এলএসডিসহ বিভিন্ন মরণনেশায় আসক্ত হয়। ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তরা কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য তরুণদের ধূমপান, মাদকসহ সব নেশা থেকে দূরে থাকা জরুরি। কিন্তু, মাদকের সঙ্গে জড়িত অসাধু চক্র আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের মাদকের রাজ্যে টানতে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে অসাধু মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিরা। এটিও বড় চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভূত হয়েছে।

মাদক বর্তমানে আমাদের মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে আগ্রাসন চালাচ্ছে। জাতি মেধাশূন্য হওয়ার যে ভয়ানক প্রক্রিয়া চলমান, তা রুখতে হবে ‘মাদক প্রতিরোধ’ কার্যক্রমে জোর দেয়ার মাধ্যমে। তা না হলে ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন। কারণ হলো-কিশোর ও তরুণরা শুধু মাদকদ্রব্যের আসক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। মাদক মূল্যবোধের অবক্ষয় সামাজিক অপরাধের বিস্তার ঘটাচ্ছে। মাদকাসক্তি সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন মাদক-সংক্রান্ত অপরাধে। মাদকজনিত অপরাধের মাঝে বর্তমানে কিশোর গ্যাং অন্যতম সমস্যা। মাদকের খরচ যোগাতে কিশোর ও কিশোরী উভয়ই এই অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনাকারী গ্যাংয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে। মাদক ব্যবসা, হত্যা, খুন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, রাস্তায় পরিকল্পিত সংঘাত তৈরির মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। মাদক নির্মূল কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিত প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন জরুরি। যেখানে মনোসামাজিক, নৈতিক ও সামাজিকরণ শিক্ষা প্রদান এর বিষয়সমূহ সর্বস্তরে পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এজন্যই মাদক প্রতিরোধে বিনিয়োগের যে বিষয়টি ইউএনওডিসি এ বছর সামনে এনেছে, সেটা অত্যন্ত সময়োপোযোগী।

ফ্যাশন হিসেবে অসংখ্য তরুণ আজকাল মাদক সেবনের দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজে ধূমপান ও মাদকদ্রব্য নায়ক ও প্রধান চরিত্র দ্বারা অযাচিতভাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এগুলো মানুষকে ক্ষতিকর নেশা সেবনে উদ্বুদ্ধ করছে, বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের ওপর এসব দৃশ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যে বয়সে তারা শিক্ষা, সৃজনশীল মননে উদ্বুদ্ধ হবে সেই বয়সে তারা ধূমপান, মাদকের ভাগাড়ে ডুবে যাচ্ছে। বিনোদন মাধ্যমে (নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ) প্রচারের ক্ষেত্রে মাদক ও তামাকের ব্যবহার প্রর্দশন বন্ধ করা জরুরি। পাশাপাশি সব গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা, সতর্কীকরণ তথ্যচিত্র প্রচার করা বাধ্যমামূলক করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে মাদক বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কিশোর ও তরুণদের প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর উদ্যোগে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক ও তামাক বিরোধী সেল গঠন ও সচেতনতায় ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যুব ও ক্রীড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু, স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও সম্প্রচার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়গুলো একসঙ্গে প্রতিরোধ কার্যক্রমে একটি রূপরেখা নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে ‘ডোপ টেস্ট’ চালু করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে দেশে ই-সিগারেট, ভেপসহ বিক্রি ও প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।

মোদ্দাকথা, তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার হতে বিরত রাখতে প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করা এখন অপরিহার্য। মাদক শব্দটি শুনলে বেশির ভাগ মানুষই বিচলিত হয় বা ভয় পায়, আর মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ঘৃণা ও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের শাসন, ঘৃণা বা অবহেলা না করে তাকে ¯েœহ ভালোবাসা দিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দেয়া জরুরি। যাতে তারা সমাজের বোঝা না হয়ে সুস্থ হয়ে আবার পরিবারে ফিরে আসতে পারে। তাই পিতা-মাতার প্রতি অনুরোধ আপনার সন্তানকে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে রাখবেন না, ঘৃণা করবেন না বরং তাকে ¯েœহ ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিন। সঠিক চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে একদিন তারাই সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে। একই সঙ্গে মাদকাসক্তি প্রতিরোধে চাহিদা, সরবরাহ কমানোর সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিবে হবে।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)]

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

অরূপরতন চৌধুরী

বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। জাতিসংঘের ইউনাইটেড ন্যাশন অফিস অন ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইম (এনওডিসি) এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে - “বর্তমান প্রজন্মকে মাদকমুক্ত রাখতে প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিরোধ কার্যক্রম”। অর্থ্যাৎ, মাদকাসক্তি সমস্যা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে জেঁকে বসছে। সুতরাং প্রতিরোধ কার্যক্রমের প্রতি জোর দেয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’; অর্থাৎ, চিকিৎসার চাইতে প্রতিরোধ ভালো। এটা যদিও স্বাস্থ্যগত অসুখ ও তার চিকিৎসা এবং রোগপ্রতিরোধকে বুঝায় তবুও একই ফরমুলা ব্যবহার করে মাদকাসক্তি সমস্যা মোকাবিলা ও তার সুষ্ঠু সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। সেজন্যই মূলত মাদক প্রতিরোধে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তামাক সেবন মানুষের অকাল মৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশে ৪৯% মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ- ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। বেসরকারি হিসাবমতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, ইয়াবা সেবনকারী শতকরা ৮৫ ভাগই তরুণ যুবসমাজ! ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আসক্তি তাকে মানসিক ও শারীরিক রোগসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন রোগের মতো এইচআইভি এইডসের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদক গ্রহণকালীন সময়ে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও ঝুঁকির্পূণ আচরণ।

মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত, যা গবেষণায় প্রমাণিত। ধূমপানে অভ্যস্ততার মধ্য দিয়ে তরুণরা মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীতে ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেন, আফিস, কোডিন, মরফিন, এলএসডিসহ বিভিন্ন মরণনেশায় আসক্ত হয়। ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তরা কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য তরুণদের ধূমপান, মাদকসহ সব নেশা থেকে দূরে থাকা জরুরি। কিন্তু, মাদকের সঙ্গে জড়িত অসাধু চক্র আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের মাদকের রাজ্যে টানতে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে অসাধু মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিরা। এটিও বড় চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভূত হয়েছে।

মাদক বর্তমানে আমাদের মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে আগ্রাসন চালাচ্ছে। জাতি মেধাশূন্য হওয়ার যে ভয়ানক প্রক্রিয়া চলমান, তা রুখতে হবে ‘মাদক প্রতিরোধ’ কার্যক্রমে জোর দেয়ার মাধ্যমে। তা না হলে ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন। কারণ হলো-কিশোর ও তরুণরা শুধু মাদকদ্রব্যের আসক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। মাদক মূল্যবোধের অবক্ষয় সামাজিক অপরাধের বিস্তার ঘটাচ্ছে। মাদকাসক্তি সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন মাদক-সংক্রান্ত অপরাধে। মাদকজনিত অপরাধের মাঝে বর্তমানে কিশোর গ্যাং অন্যতম সমস্যা। মাদকের খরচ যোগাতে কিশোর ও কিশোরী উভয়ই এই অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনাকারী গ্যাংয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে। মাদক ব্যবসা, হত্যা, খুন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, রাস্তায় পরিকল্পিত সংঘাত তৈরির মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। মাদক নির্মূল কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিত প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন জরুরি। যেখানে মনোসামাজিক, নৈতিক ও সামাজিকরণ শিক্ষা প্রদান এর বিষয়সমূহ সর্বস্তরে পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এজন্যই মাদক প্রতিরোধে বিনিয়োগের যে বিষয়টি ইউএনওডিসি এ বছর সামনে এনেছে, সেটা অত্যন্ত সময়োপোযোগী।

ফ্যাশন হিসেবে অসংখ্য তরুণ আজকাল মাদক সেবনের দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজে ধূমপান ও মাদকদ্রব্য নায়ক ও প্রধান চরিত্র দ্বারা অযাচিতভাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এগুলো মানুষকে ক্ষতিকর নেশা সেবনে উদ্বুদ্ধ করছে, বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের ওপর এসব দৃশ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যে বয়সে তারা শিক্ষা, সৃজনশীল মননে উদ্বুদ্ধ হবে সেই বয়সে তারা ধূমপান, মাদকের ভাগাড়ে ডুবে যাচ্ছে। বিনোদন মাধ্যমে (নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ) প্রচারের ক্ষেত্রে মাদক ও তামাকের ব্যবহার প্রর্দশন বন্ধ করা জরুরি। পাশাপাশি সব গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা, সতর্কীকরণ তথ্যচিত্র প্রচার করা বাধ্যমামূলক করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে মাদক বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কিশোর ও তরুণদের প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর উদ্যোগে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক ও তামাক বিরোধী সেল গঠন ও সচেতনতায় ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যুব ও ক্রীড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু, স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও সম্প্রচার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়গুলো একসঙ্গে প্রতিরোধ কার্যক্রমে একটি রূপরেখা নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে ‘ডোপ টেস্ট’ চালু করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে দেশে ই-সিগারেট, ভেপসহ বিক্রি ও প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।

মোদ্দাকথা, তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার হতে বিরত রাখতে প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করা এখন অপরিহার্য। মাদক শব্দটি শুনলে বেশির ভাগ মানুষই বিচলিত হয় বা ভয় পায়, আর মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ঘৃণা ও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের শাসন, ঘৃণা বা অবহেলা না করে তাকে ¯েœহ ভালোবাসা দিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দেয়া জরুরি। যাতে তারা সমাজের বোঝা না হয়ে সুস্থ হয়ে আবার পরিবারে ফিরে আসতে পারে। তাই পিতা-মাতার প্রতি অনুরোধ আপনার সন্তানকে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে রাখবেন না, ঘৃণা করবেন না বরং তাকে ¯েœহ ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিন। সঠিক চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে একদিন তারাই সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে। একই সঙ্গে মাদকাসক্তি প্রতিরোধে চাহিদা, সরবরাহ কমানোর সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিবে হবে।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)]

back to top