রায়হান হোসাইন
এক সময় ছিল যখন শিশু-কিশোররা ঘরে থাকার চেয়ে মাঠে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করত। স্কুল বা কলেজ থেকে ফিরে ব্যাগ নামিয়ে রেখে সামান্য কিছু খেয়ে বা না খেয়েই তারা ছুটে যেত খেলতে। এমনকি মা-বাবার বকুনি খেয়েও তারা মাঠে যেত, খেলার জন্য ছিল তাদের এক ধরনের পাগলপারা টান। কিন্তু সময় বদলেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতাও পাল্টে গেছে।
বর্তমানে মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা শিশু-কিশোরদের জীবনযাপন ও চিন্তাধারায় ভয়ানকভাবে প্রভাব ফেলছে। তারা মোবাইল গেমে এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, বাস্তব জীবন ও শারীরিক সক্রিয়তা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পাবজি, ফ্রি-ফায়ারসহ নানা গেমে দলবেঁধে মেতে থাকা কিশোরদের দেখা এখন আর বিরল নয়।
এটি শুধুই একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়; এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে। চোখের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া, ঘুম কম হওয়া, খিটখিটে মেজাজ, দুর্ব্যবহার, এমনকি শুক্রাণু হ্রাসের মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। ফলে একদিকে শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে মানসিকভাবেও হচ্ছে নাজুক। এমন অবস্থা জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর হুমকির ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে, পড়ালেখায় সাফল্য অর্জনের নামে শিশু-কিশোরদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এক ধরনের যান্ত্রিকতা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট টিউশন মিলিয়ে তারা হাঁপিয়ে উঠছে। এ দৌড় থেমে থাকছে নাÑস্কুল শেষে শুরু হয় ভর্তিযুদ্ধ। সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বাবা-মায়েরা নিজেরাই স্থির করে দেন তার ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার লক্ষ্য। কিন্তু সন্তান আদৌ কী হতে চায়, সে বিষয়ে তাদের ইচ্ছা বা মতামতের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না।
ফলে শিক্ষার্থীরা চাপগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কাক্সিক্ষত ফল না পেলে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটছে অনেক ক্ষেত্রে। অথচ তারা হয়তো ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ভালোভাবে রপ্ত করছে; কিন্তু চল্লিশ পার হতেই দেখা দিচ্ছে নানা শারীরিক জটিলতা।
এই বাস্তবতায় আমাদের নতুন করে ভাবতে হবেÑআমাদের কী ধরনের পাঠ্যক্রম প্রয়োজন? একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তি-নির্ভরতা যেমন জরুরি, তেমনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা আরও বেশি প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে পাঠ্যক্রমে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার, যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও সামাজিক সচেতনতার শিক্ষা দেবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর বিষয় হচ্ছে ‘শারীরিক শিক্ষা’।
শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী যেমন বিশ্ব ও সমাজ সম্পর্কে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করে, তেমনি নিজের দেহ ও মন সুস্থ রাখার কৌশলও শেখে। নেতৃত্ব, দলবদ্ধতা ও সহমর্মিতার মতো গুণাবলিও এর মাধ্যমে বিকশিত হয়। সহজ ভাষায় বলা যায়, যে শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশে সহায়তা করে তাকেই শারীরিক শিক্ষা বলা হয়।
আধুনিক শারীরিক শিক্ষার মধ্যে শরীরচর্চা, ক্রীড়া, পুষ্টি, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, বয়ঃসন্ধি, মাদক, অবসাদ ও হতাশা মোকাবিলার কৌশলসহ নানা জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রাচীন শারীরিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল শুধু দেহ গঠন; আধুনিক যুগে তা রূপান্তরিত হয়েছে দেহ-মনের সমন্বিত বিকাশে।
শারীরিক শিক্ষা এখন শুধু শরীরের যতœ নয়, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠার সহায়ক একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয়। এ বিষয়ে বিশ্বের অনেক দেশে অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়েও উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে।
আধুনিক শারীরিক শিক্ষার প্রবর্তক জার্মানির শিক্ষাবিদ ও বিখ্যাত জিমন্যাস্ট জোহান ফ্রেডরিখ লুডউইক। আঠারো শতকে তিনি শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার পক্ষে মত দেন। তার প্রস্তাবেই জার্মান সরকার প্রথমে এবং পরে অন্য দেশগুলো শারীরিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে। আজ পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় এর সুদূরপ্রসারী সুফল আমরা দেখতে পাই।
বাংলাদেশেও শারীরিক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে আরও গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০২৬ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় শারীরিক শিক্ষায় ৫০ নম্বর থাকবেÑ২০ নম্বর তত্ত্বীয় ও ৩০ নম্বর ব্যবহারিক। এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ।
তবে শুধু এসএসসি পর্যায় নয়, বরং প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণীতে নিয়মিতভাবে অন্তত একটি শারীরিক শিক্ষার ক্লাস অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এতে শিক্ষার্থীরা সুস্থ ও কর্মক্ষম হয়ে উঠবে, পাশাপাশি দেশ পাবে একটি সচেতন, সবল ও শক্তিশালী প্রজন্ম।
[লেখক : প্রভাষক, সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ, বরিশাল]
রায়হান হোসাইন
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
এক সময় ছিল যখন শিশু-কিশোররা ঘরে থাকার চেয়ে মাঠে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করত। স্কুল বা কলেজ থেকে ফিরে ব্যাগ নামিয়ে রেখে সামান্য কিছু খেয়ে বা না খেয়েই তারা ছুটে যেত খেলতে। এমনকি মা-বাবার বকুনি খেয়েও তারা মাঠে যেত, খেলার জন্য ছিল তাদের এক ধরনের পাগলপারা টান। কিন্তু সময় বদলেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতাও পাল্টে গেছে।
বর্তমানে মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা শিশু-কিশোরদের জীবনযাপন ও চিন্তাধারায় ভয়ানকভাবে প্রভাব ফেলছে। তারা মোবাইল গেমে এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, বাস্তব জীবন ও শারীরিক সক্রিয়তা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পাবজি, ফ্রি-ফায়ারসহ নানা গেমে দলবেঁধে মেতে থাকা কিশোরদের দেখা এখন আর বিরল নয়।
এটি শুধুই একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়; এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে। চোখের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া, ঘুম কম হওয়া, খিটখিটে মেজাজ, দুর্ব্যবহার, এমনকি শুক্রাণু হ্রাসের মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। ফলে একদিকে শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে মানসিকভাবেও হচ্ছে নাজুক। এমন অবস্থা জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর হুমকির ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে, পড়ালেখায় সাফল্য অর্জনের নামে শিশু-কিশোরদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এক ধরনের যান্ত্রিকতা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট টিউশন মিলিয়ে তারা হাঁপিয়ে উঠছে। এ দৌড় থেমে থাকছে নাÑস্কুল শেষে শুরু হয় ভর্তিযুদ্ধ। সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বাবা-মায়েরা নিজেরাই স্থির করে দেন তার ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার লক্ষ্য। কিন্তু সন্তান আদৌ কী হতে চায়, সে বিষয়ে তাদের ইচ্ছা বা মতামতের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না।
ফলে শিক্ষার্থীরা চাপগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কাক্সিক্ষত ফল না পেলে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটছে অনেক ক্ষেত্রে। অথচ তারা হয়তো ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ভালোভাবে রপ্ত করছে; কিন্তু চল্লিশ পার হতেই দেখা দিচ্ছে নানা শারীরিক জটিলতা।
এই বাস্তবতায় আমাদের নতুন করে ভাবতে হবেÑআমাদের কী ধরনের পাঠ্যক্রম প্রয়োজন? একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তি-নির্ভরতা যেমন জরুরি, তেমনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা আরও বেশি প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে পাঠ্যক্রমে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার, যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও সামাজিক সচেতনতার শিক্ষা দেবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর বিষয় হচ্ছে ‘শারীরিক শিক্ষা’।
শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী যেমন বিশ্ব ও সমাজ সম্পর্কে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করে, তেমনি নিজের দেহ ও মন সুস্থ রাখার কৌশলও শেখে। নেতৃত্ব, দলবদ্ধতা ও সহমর্মিতার মতো গুণাবলিও এর মাধ্যমে বিকশিত হয়। সহজ ভাষায় বলা যায়, যে শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশে সহায়তা করে তাকেই শারীরিক শিক্ষা বলা হয়।
আধুনিক শারীরিক শিক্ষার মধ্যে শরীরচর্চা, ক্রীড়া, পুষ্টি, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, বয়ঃসন্ধি, মাদক, অবসাদ ও হতাশা মোকাবিলার কৌশলসহ নানা জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রাচীন শারীরিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল শুধু দেহ গঠন; আধুনিক যুগে তা রূপান্তরিত হয়েছে দেহ-মনের সমন্বিত বিকাশে।
শারীরিক শিক্ষা এখন শুধু শরীরের যতœ নয়, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠার সহায়ক একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয়। এ বিষয়ে বিশ্বের অনেক দেশে অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়েও উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে।
আধুনিক শারীরিক শিক্ষার প্রবর্তক জার্মানির শিক্ষাবিদ ও বিখ্যাত জিমন্যাস্ট জোহান ফ্রেডরিখ লুডউইক। আঠারো শতকে তিনি শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার পক্ষে মত দেন। তার প্রস্তাবেই জার্মান সরকার প্রথমে এবং পরে অন্য দেশগুলো শারীরিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে। আজ পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় এর সুদূরপ্রসারী সুফল আমরা দেখতে পাই।
বাংলাদেশেও শারীরিক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে আরও গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০২৬ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় শারীরিক শিক্ষায় ৫০ নম্বর থাকবেÑ২০ নম্বর তত্ত্বীয় ও ৩০ নম্বর ব্যবহারিক। এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ।
তবে শুধু এসএসসি পর্যায় নয়, বরং প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণীতে নিয়মিতভাবে অন্তত একটি শারীরিক শিক্ষার ক্লাস অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এতে শিক্ষার্থীরা সুস্থ ও কর্মক্ষম হয়ে উঠবে, পাশাপাশি দেশ পাবে একটি সচেতন, সবল ও শক্তিশালী প্রজন্ম।
[লেখক : প্রভাষক, সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ, বরিশাল]